ভুত ও ভিকটিম



আনন্দবাজারের কোণায় একটা দেড় ইঞ্চি বাই দেড় ইঞ্চি বিজ্ঞাপন। বেলেঘাটা অঞ্চলে বড়রাস্তার পঞ্চাশ পা ভেতরে একটি পুরোনো বাড়ি ভাঙা হয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হবে। আগ্রহী খরিদ্দারেরা যোগাযোগ করুন।

মা খুব খরিদ্দার ছিলেন বলে মনে হয়নি কখনও। সংসারের হাঁ মেটাতে যা লাগে কিনতেন। চাল ডাল নুন তেল হারপিক লাইজল। সমাজের প্রয়োজনেও কিনতেন। এর বিয়ের বেডকভার, তার পুজোর শার্টপ্যান্ট , আমার ফ্রকের রং মিলিয়ে নিউ মার্কেটে ঘুরে ঘুরে সিল্কের রিবন। নিজের জন্যও কিনতেন, তবে সে সব কেনায় অন্যদের জন্য কেনার তুলনায় পঁচাত্তর গুণ বেশি  প্রয়োজন-শখের তুল্যমূল্য দড়িটানাটানি লেগে থাকত।

মা ডেফিনিটলি আগ্রহী ছিলেন। ভাড়াবাড়ির বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মণি ভাবত, বড় হয়ে একটা নিজস্ব, বিরাট, ছাদওয়ালা বাড়ি হবে ওর। মণিমঞ্জিল। মণির সে মঞ্জিলের সঙ্গে বেলেঘাটার ফ্ল্যাটের (যদি আদৌ হয় কোনওদিন) আকৃতিপ্রকৃতিতে কোনও মিল থাকবে না জেনেও মা গিয়েছিলেন। একাই।

সে বাড়ি তখন সদ্য ভাঙা হচ্ছে। বাড়ি ভাঙা হল। ফ্ল্যাট শুরু হল। মা অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝেসাঝে দেখে আসতেন। প্রোমোটার বদলাল। নতুন প্রোমোটার এল। ফ্ল্যাট ফিনিশ হল। কাগজপত্র হল। ভাঙাপড়া বাড়ির মালিকের মামা কলকাতার আইনজগতে চেনা মুখ এবং ও পক্ষের মুখ্য আইনি উপদেষ্টা। তাঁর সঙ্গে নতুন মালিকদের ঝগড়া হল। সেই উকিলের স্টাডিতে, সহ-ফ্ল্যাটমালিকদের সঙ্গে বসে, সবার হয়ে ঝগড়াটা করলেন মা। আমি যে কেন ওখানে উপস্থিত ছিলাম জানি না। কনফ্লিক্ট বাধলে কোণে বসে কাঁপা আমার পেটেন্ট রিঅ্যাকশন সবাই জানে। মায়ের উকিলেরও যে এক্স্যাক্টলি সেটাই রিঅ্যাকশন সেটা আশ্চর্যের। উকিল ভদ্রমহিলাকে আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। বিনুনি, ফুলহাতা সাদা ব্লাউজ, সম্ভবতঃ ইউনিফর্মের। ঘরশুদ্ধু লোক চুপ। একটা প্রকাণ্ড টেবিলের ওপার থেকে প্রাজ্ঞ উকিল উপদেষ্টা আর এদিক থেকে মা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করছেন। মায়ের উকিল আমার কানে ফিসফিসাচ্ছেন, তোমার মা ঠিকই বলেছেন। আমি মনে মনে বলছি, মা ঠিকই বলে কিন্তু আমি চাই মা ঠিক ভুল কিছুই না বলুক। যা হচ্ছে হোক বলে গা বাঁচিয়ে সরে আসুক। বাক্যবিনিময় থামল। সবাই হাঁফ ছেড়ে উঠে পড়ল। মায়ের উকিল মাথা নেড়ে বলে গেলেন, মায়ের সাহস পাওনি।

উনি আমাকে ঠিক চিনেছিলেন। অনেকেই ভুল চেনেন। এই যেমন পুতুলপিসি। সকাল সাড়ে ছ'টা নাগাদ ছাদে হাঁটছি, নচিকেতা কানের ভেতর চোর চোর চেল্লাচ্ছেন, এমন সময় সে ছাপিয়ে বাবার গলা। আগের পোস্টে লোকজনকে ডাকাডাকি নিয়ে অত কাব্য করলাম, কিন্তু সর্বদা যে ব্যাপারটার প্রতি উদবাহু থাকি তাও না। একটাই কারণ, স্বায়ত্ত্ব। আমি নিজে ডেকে কথা বলছি একরকম। বাবা ডেকে ডেকে লৌকিকতা আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছেন সে বড় বুককাঁপুনির। আমগাছের ঘন ডালটার আড়াল থেকে উঁকি মারলাম।

যাক। অনেক সময় গুরুজনরা ডেকে “প্রণাম কর” বললে প্রণম্য ব্যক্তির প্রতি উদাসীনতা অ্যাকটিভ অপছন্দে বদলে যায়। পুতুলপিসির সঙ্গে সে রকম হওয়ার চান্স নেই। পুতুলপিসি আমার পাশের পাড়াতুতো পিসি শুধু না আমার ঠাকুরদার খুড়তুতো ভাইয়ের মেয়ে। পিসি যাচ্ছিল একটা বাজারের ব্যাগ মতো হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে। বাবার হাঁকডাকে হাসিহাসি মুখে গেট খুলে ঢুকছে। বাবা আবার রহস্য করছে। পুতুল, দেখে যা কে এসেছে। সকাল সাড়ে ছ’টায় কেই বা বাবার বাড়িতে আসবে?

তবু পুতুলপিসি ঢোকেন। আমি নেমে আসি। আমগাছের ছায়ায় সামনের ঘরটা সারাদিন অন্ধকার। সন্ধেবেলা দুই মোড়ের দুটো চল্লিশ ওয়াটের (এখন অন্য ওয়াটের হিসেবওয়ালা বাল্ব লাগানো হয় নিশ্চয়, তবে ইম্প্যাক্ট ইকুইভ্যালেন্ট) বাল্বের আলো সে ছায়া ফুঁড়ে ঢুকতে ব্যর্থ হয়। এখন জানি না, একসময় কোচিং থেকে ফেরা ছেলেমেয়েদের সাইকেল রেগুলারলি সে ছায়ায় হল্ট দিত। সেটা আবার ঠাকুমার কোপের কারণ ছিল, সে গল্প আগেও হয়েছে, পরেও হবে।

যাই হোক, পুতুলপিসি বাগানের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে, আমি সামনের ঘরের অন্ধকার থেকে বেরোচ্ছি। পিসি বুকে হাত দিয়ে হাঁ করল। ও মা গো, আমি ভেবেছি বউদি।

সবাই বলে, নাকতলার মা পর্যন্ত। ডাইনিং টেবিলে ওপিনিয়নের তুফান তুলেছি, মা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, কুন্তলা, তুমি না একেবারে তোমার মা। মাছি বসা দানাদারকে সদ্য বানানো ফুটফুটে কাঁচাগোল্লার সঙ্গে তুলনা করলে কোনও সুস্থমস্তিষ্কের দানাদারই তার প্রতিবাদ করে না, আমিও চুপচাপ থাকি। চিরকালই থাকতাম। গল্পটা অবান্তরে আগেও অনেকবার বলেছি, কিন্তু যেহেতু আমার প্রিয় গল্প আর বুড়ো হলে লোকে একই গল্প একশোবার করে, তাই আবার শুনুন। কলেজ থেকে ফিরছিলাম। এখন দু'নম্বর থেকে ফুচকা খেয়ে ফিরে আধঘণ্টা আলো নিভিয়ে শুয়ে ডিপ ব্রিদিং প্র্যাকটিস করতে হয়, তখন অফিসটাইমের বারো কামরার ব্যান্ডেল লোকালে এক কামরা (মায়েরা নাকি হাফকামরাতেও চড়েছেন) 'লেডিস'-এ ঠেসাঠেসি (এর মানে কিন্তু এই নয় যে জেনারেল কামরায় ভিড় হয় না, আমাদের দেশে ভিড় না হওয়া জায়গা পাওয়া মুশকিল) রিষড়া থেকে হাওড়া গিয়ে দু’শো উনিশে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হেদুয়া পৌঁছে, সারাদিন ক্লাসের নামে ফাঁকি মেরে, মাঝখানে বেরিয়ে এক ট্যাক্সিতে ন’জন চেপে সিনেমা গিয়ে, ফিরে, ফুচকা খেয়ে, এগরোল খেতে খেতে ফিরতি দু’শো উনিশে চড়ে রাস্তায় তিনটে মিছিল, চারটে প্রসেশন পেরিয়ে, কিছু না থাকলে প্রতি সিগন্যালের তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকাকুর কান চুলকোনো আর কন্ডাকটরকাকুর হাই তোলা - যতক্ষণ সিগন্যাল সবুজ থেকে লাল থেকে সবুজ থেকে লাল হচ্ছে - পেরিয়ে, হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে, বৈদ্যবাটিতে দুপুরবেলা তার ছিঁড়ে গেছে বলে গত তিনঘণ্টা ট্রেনচলাচল বন্ধ ছিল, এই সবে ছাড়ছে খবর পেয়ে সেই ট্রেনে দৌড়ে উঠে গোটা রাস্তা ননস্টপ গলা ফাটিয়ে গল্প করতে করতে ফিরতাম।

সেই রকম একটা গল্প করার দিনে এক ভদ্রমহিলা কাঁধে টোকা মেরেছিলেন। অনেকটা মায়ের মতোই দেখতে। শাড়ি পরেন, লোক্যাল ট্রেনে চড়ে রোজ অফিসে যান আসেন, এসে সংসার ঠেলেন। এত কিছু কমন পড়লে চেহারাও একরকম না হলেই অদ্ভুত। টোকা খেয়ে ঘাড়  ঘোরাতে মহিলা বলেছিলেন, তুমি অর্চনার মেয়ে? মা কেমন আছে? অনেকদিন দেখা হয় না। ভদ্রমহিলা আমার মুখটাও দেখেননি, আমার কথাবার্তার ধরণধারণ শুনেই নিশ্চিত হয়ে গেছেন আমি আমার মায়ের মেয়ে।

জীবনে যে ক’টা কাজ মা একা, আই মিন সম্পূর্ণ একা করেছেন, তার মধ্যে হারমোনিয়াম কেনা একটা আর এই বেলেঘাটার ফ্ল্যাট কেনাটা আরেকটা। আমাকে স্কুলে ভর্তি করাটা আরেকটা, সে গল্পটা আরেকদিন। অফিস, সংসার, সন্তান সামলে, ফ্ল্যাট কিনেটিনে, সাজিয়েগুছিয়ে মা পগারপার হয়েছেন, ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার হাতে।

অর্থাৎ বাবার হাতে। বাবা বাড়ির ট্যাক্স দেন। গ্যারেজ ভাড়া দেন। মেন্টেন্যান্স ফি দেন। মনুপিসি সুবল পিসেমশাইকে ফোন করে খবর নেন সব ঠিক আছে কি না, কী খারাপ হয়েছে, কী খারাপ হবে হবে করছে। এত লোকের সঙ্গে কথা বলতে হলে আমি বাঁচতাম না। এবার বাবা একটু রাগই করেছিলেন ফোনে। তাই কসম খেয়েছিলাম, বাড়ি গিয়ে খাই না খাই, বাঁচি না বাঁচি বেলেঘাটায় গিয়ে থাকব একদিন। তাছাড়া কয়েকটা জিনিস সারাতেও হত, পিসি পিসেমশাই দায়িত্ব নিয়ে সবই করে, এ জিনিসও পারত, তবে আমি থাকলে বেটার।

গেলাম। একফেরতা সিঁড়ি উঠে ফ্ল্যাট। কোলাপসিবল গেটের ওপারে দরজার গায়ে কার্সিভ অক্ষর বানান করে পড়লে 'বন্দ্যোপাধ্যায়', যদিও আমি প্রত্যেকবার ওটা 'মণিমঞ্জিল' পড়ি। ফাঁকা ফ্ল্যাটে তালার ঘটা দেখার মতো। কোলাপসিবল গেটে একটা, সেটা খোল, বন্ধ তালাটা আবার ওটার গায়েই ঝুলিয়ে রাখ। তারপর মেন দরজা। খোল, বন্ধ কর। তালাচাবিসংক্রান্ত প্রচুর ট্রমা জীবনে, এই অংশটা করতে আমার কান্না পায়। তারপর ঘরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকি। রিষড়ার বাড়িতে আরও অনেকের হাঁটাচলা, কথাবার্তা। বেলেঘাটার ফ্ল্যাটের দরজায়, মেঝেতে, জানালার পর্দায়, দেওয়ালের ছবিতে কেবল মা। খাটবিছানা চেয়ার ডাইনিং টেবিল, রান্নাঘরের প্রতিটি চামচপ্লেটে মা। মায়ের সঙ্গে অল্প অল্প আমি। বেলেঘাটায় থাকাটা আমাদের  ছিল পিকনিকের মতো। এক, বড়জোর দু'রাতের থাকা। ঢোকার আগে পাড়ার দোকান থেকে পাউচের চা পাতা, পাউচের গুঁড়ো দুধ কেনা। ঠোঙায় করে চাল আর মুসুরডাল। রাত হলে মা বলছেন, ভাত বসাই? আমি বলছি, ধুর ম্যাগি খেয়ে শুয়ে পড়ি চল। মা ঘাড় পাতছেন। ম্যাগি খাওয়া শেষ হলে, কে জানে হয়তো আমার মন রাখতেই, চকচকে মুখে বলছেন, বাহ্‌, কী কম খাটনিতে সব শেষ রে সোনা।

একা ঘরে বসে বসে সে সব ছবি মাথার ভেতর পাক খাওয়াতে লাগলাম। বেশিক্ষণ না। ঘুমের সময় হয়ে গিয়েছিল। দরজা দিয়েটিয়ে, বসার ঘরের আলো জ্বালিয়ে রেখে, শোবার ঘরের দরজাটায় ছিটকিনি তুলে, ছোট আলো জ্বালিয়ে চোখ বুজলাম। নিচের মেন গেট ঢংঢং করে খুলছে। গাড়ি থামছে। বুট উঠছে সিঁড়ি বেয়ে। বন্দ্যোপাধ্যায় লেখা দরজা পার করে যাচ্ছে। ঘুঙুর বাজছে। এত রাতে কে নাচ প্র্যাকটিস করছে? শব্দটা কত দূরে? দরকারের থেকে বেশি কাছে মনে হচ্ছে না? মাইন্ড ওভার ম্যাটার করলাম। এখানে পার্মানেন্টলি থাকতে শুরু করলে কেমন লাগবে? রিষড়ার বাড়িতে জন্মেছি (অ্যাকচুয়ালি বালি নার্সিংহোমে, কিন্তু সেটা অধর্তব্য)। রিষড়ার বাড়িতেই মরলে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ওই বাড়িটাতে জন্মের দু’দিন পর থেকে থাকলেও আমার তো না-ই, বাড়িটা আমার বাবারও না। মরতে হলে ও বাড়িতেই মরব, বুক ঠুকে সে দাবি করার অধিকার আমার নেই। বেলেঘাটার ফ্ল্যাটে সম্ভবতঃ আছে। শেষনিঃশ্বাস ফেলার ভেনু হিসেবে এটাকে বুক করা বেটার। বিশেষ করে চারদিকে জানালা আর জানালা ঘেঁষা বাতাবিলেবুর গাছওয়ালা এই ঘরটা।  এমনিও আর দিল্লি ভালো লাগে না। চলে আসব। একেবারে লুব্জুগুব্জু হয়ে আসার মানে হয় না। বেড়াবখেলাব, রেস্টোর‍্যান্টে খাব, সিনেমা দেখব, নন্দনে গিয়ে সেলিব্রিটি দেখব। দশ বছর বাদে আমার সাড়ে বাহান্ন, তখনও উপরোক্ত সমস্ত কাজ করার এনার্জি থাকবে বলেই মনে হয়। একা আসলে হবে না। অর্চিষ্মানকে জপাতে হবে। ফ্ল্যাট মেন্টেন করতে বাবা যে জনসংযোগগুলো করছেন সেগুলো অর্চিষ্মানকে দিয়ে করাব।

ফোন কেঁপে উঠল। আমিও অল্প। স্বয়ং শয়তান উপস্থিত। ভয় লাগছে না? দন্তবিকশিত স্বর্ণালী গোল মুখ। তিন সেকেন্ড ভেবে টাইপ করলাম, করছে অ্যাকচুয়ালি। নানারকম অচেনা আওয়াজ হচ্ছে। ছোট ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়েছি। বসার ঘরে কী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি না। বুঝতে পারছ তো? প্ল্যানটা তো দিল্লির বাড়ির মতোই। তুমিও যদি এসি চালিয়ে দরজা বন্ধ করে শোও, বাইরের ঘরে কী হচ্ছে দেখতে পাবে না। একটা ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে, ঘুঙুর পরে যেন হাঁটছে কেউ। কোথায় বুঝতে পারছি না। হোপফুলি, বাইরের ঘরে না।

ওরে বাবা কুন্তলা, অত ডিটেলে যেতে হবে না। তোমার সমস্যা কী বলো তো, কম কথায় কিছু সারতে পার না। অর্চিষ্মানের সবুজ বাতি নিভল।

সকালে উঠে চাঙ্গা লাগল। রিষড়া থেকে বেরোনোর লাস্ট মোমেন্টে দৌড়ে গিয়ে বাথরুম থেকে ব্রাশটা ব্যাগে ঢুকিয়েছিলাম, বার করে মাজলাম। অনভ্যস্ত বাথরুমের অনভ্যস্ত আয়নায় নিজেকে নতুন লাগল। বিকেলে বেড়াতে যাওয়ার কথা, তার আগে সারাদিন ধরে শুয়েবসে বিছানার চাদরে বাতাবি লেবু পাতার নাচ দেখা যায়। কিন্তু একটা বেটার আইডিয়া এল।

দিনদুয়েক আগে নাকতলা থেকে অর্চিষ্মান ঢাকা গেল, সকালসকাল মা বাবা আমি ছাড়তে গেলাম। জানালা দিয়ে বৃষ্টির আকাশ দেখতে দেখতে ছবি এল মাথায়। সিকিউরিটিমিকিউরিটি হয়ে যাওয়ার পর অর্চিষ্মান এককাপ ক্যাপুচিনো নিয়ে বসে টুইটার চষছে। আড়চোখে লোক দেখছে আর আড়ি পাতছে। এই মুহূর্তে বোরিং লাগলেও ওই মুহূর্তে ছবিটা আমার মধ্যে একটা হিংসের সুইচ অন করেছিল। সে সব প্রকাশ না করে জাস্ট জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তুমি কফি খাবে নিশ্চয় ভেতরে? করে আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়েছিলাম। গাড়ি এয়ারপোর্টে পৌঁছল। অর্চিষ্মান নেমে প্রণামটনাম সেরে, টাটা বাইবাই করেটরে আমার দিকে আঙুল তুলে, বাবা ও বলছিল কফি খেতে ইচ্ছে করছে, বলে দাঁত বার করে হাওয়া। আমাকে প্রতিবাদের কোনও সুযোগ না দিয়েই।

ফেরার পথে বাবা বললেন, চল কুন্তলা তোমাকে একটা ভালো রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাই।  যুবভারতীর পাশ দিয়ে সল্টলেকের রাস্তায় ঢুকে গাড়ি একের পর এক গোলচক্কর পেরোতে লাগল। মেঘ করেছিল, হাওয়া দিচ্ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে গাছগুলো সতেজ হয়ে উঠেছিল। আমি জানালা দিয়ে মনটাকে আকাশে ঘুড়ির মতো ওড়াচ্ছিলাম। শেষ গোলচক্কর ছুঁয়ে বাবা বললেন, ওক্কে, সরোজ এবার ফিরতি পথ। ফিরছি, হাওয়া দিচ্ছে, মন উড়ছে, এমন সময় বাবা বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা দেখলাম যেন মনে হল।

দেখেছি আমিও। কিন্তু বাবা যে ও জিনিস খুঁজছিলেন বুঝিনি। একটা কফির দোকান। চারপাশে গাছ নিয়ে, মেঘলা শহরে মারাত্মক ইনভাইটিং লুক নিয়ে দাঁড়িয়ে। সে দোকানে আমরা নেমেছিলাম, খেয়েওছিলাম। ফুরফুরে মন আরও ফুরফুরে হয়েছিল।

দোকানটা বেশিদূর হবে না। উবার ডাকলাম। কলকাতা কয়েকটা পয়েন্ট ছাড়া চিনি না। উবার গলির মধ্যে ঢুকল। গাছপালা, বাড়িগুলোর চেহারা পুরোনো, এপারে ওপারে পুকুর। ছেলেটা বলল, এখানে ধোপাদের আড্ডা তো দিদি। ঠিকই। মোড় ঘুরতেই বাঁশের এক্স-এ খাটানো দড়ি থেকে সারিসারি জামাকাপড় বেডকাভার পর্দা।

কফির দোকানে বসে কাজ করলাম, তার থেকে বেশি লোক দেখলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে। ধোপাদের কাজ কত বেড়েছে, ভাবলাম। সময় হল। ব্যাগ গুছিয়ে গেলাম অ্যাকাডেমি। বাবামা টিকিটসহযোগে এলেন।

ওই জায়গাটায় পৌঁছলেই আমার সেলেব্রিটি অ্যান্টেনা থরথর করে কাঁপতে থাকে। কফিতে চুমুক দেওয়ার আগে নিচু গলায় বাবার কাছে জানতে চাই, আচ্ছা ইনি কি উনি? গলা যথেষ্ট নিচু হয়নি এভিডেন্টলি, কফিদাদা মুচকি হেসে বলেন, ইনিই উনি। চতুর্দিকে নাটকের উনি, সিরিয়ালের উনি, সিনেমার উনি, লিটল ম্যাগের উনি। বেল বাজল। কাপ দুমড়ে বিনে ফেলে হলে ঢুকলাম।

টিকিট দ্বিতীয় সারির। স্টেজের এত কাছে বসলে আমার মধ্যে পূর্বপুরুষের (বেসিক্যালি, নারীর) একটা স্মৃতি আনলকড হয়। অনেকদিন আগের ঘটনা। ঘটেছিল বরিশালের গ্রামের মাঠে। যাত্রা হচ্ছে। যাত্রার নাম সিরাজদ্দৌলাও হতে পারে, ঔরংজেবও হতে পারে। দর্শকের মধ্যে ছিলেন চপলা দেবী, আমার ঠাকুরদার মা। সে সময় তাঁর বয়স জানি না। ছবিতে দেখে যা বুঝেছি বয়স নির্বিশেষে চপলা দেবীর আয়তন ছিল বালিকার মতো। বালিকাসম চপলা উৎসাহের চোটে ত্রিপল পার করে মঞ্চের একহাতের মধ্যে বসেছেন। সমস্ত রক্তবিন্দুর মনোযোগ সংহত করে, গলা প্রায় সমকোণে উঁচিয়ে যাত্রা দেখছেন। যুদ্ধ বাধল। ঢালতলোয়ার ঝমঝমিয়ে সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। দর্শকরাও চিয়ারটিয়ার করছিলেন হয়তো, সব মিলিয়ে অভিনেতাদের রক্ত গরম হয়ে গিয়ে থাকবে, মারামারি করতে করতে তাদের একজন ফোর্থ ওয়াল ভেঙে দুমড়ে মঞ্চ উপচে অস্ত্রশস্ত্র সহযোগে চপলা দেবীর ঘাড়ে পড়েছিলেন। সে ট্রমা চপলা দেবীর ভেতর আমরণ প্রবাহিত হয়েছিল। আর কোনওদিন কেউ চপলা দেবীকে মঞ্চের কাছাকাছি বসাতে পারেনি। তিনি হাওয়া হওয়ার পরেও প্রজন্ম পেরিয়ে আমার মধ্যেও এসেছে, মঞ্চের কাছাকাছি বসতে আমার এখনও বুকধুকপুক করে।

সেদিন কেউ কারও ঘাড়ে পড়ল না। নাটক ভাঙল। ততক্ষণে বেশ রাত। বেলেঘাটা ফিরব। নাকতলাতেও চলে যেতে পারতাম, কিন্তু একরাত থেকেই বেলেঘাটার প্রতি টান উথলে উঠেছে। খেতে যেতে যেতে মনে পড়ল। বেলেঘাটার মেন গেট বন্ধ হয়ে যায় কি না আমার জানা নেই।বন্ধ হলেও অসুবিধে নেই, বাবামা-ই আমাকে ছেড়ে দিয়ে আসবেন, গেটে তালা দেখলে গটগটিয়ে পেছন ফিরে গাড়িতে উঠে নাকতলায় চলে আসা যাবে। কিন্তু হাতের কাছে এমন সুন্দর প্যানিক, ছাড়া যায়? রিষড়ার বাবাকে ফোন করলাম। ওপরের তলার ফ্ল্যাটে আগরওয়ালের ফোন নম্বর নেওয়া হল। ইনিই ফ্ল্যাটের সমস্ত কমন ব্যাপার দেখাশোনা করেন। যতখানি সম্ভব শুদ্ধ হিন্দিতে নিজের ইন্ট্রোডাকশন দেওয়ায় শুদ্ধতর বাংলায় বললেন, চিনতে পেরেছি। বাংলায় শিফট করে সমস্যার কথা বললাম। ভদ্রলোক বললেন, উনি তালায় চাবি ঝুলিয়ে রেখে আসবেন, আমি যেন ফিরে ওঁকে চাবি দিয়ে যাবেন।

ফাইন্যালি যাওয়া হল আমার অনেকদিন ধরে যেতে চাওয়া একটা দোকানে। সে দোকানে আমি ছাড়া আমার চেনা সকলেই খেয়ে ফেলেছে। আমিও খেয়েছি। তখন ওটা ছিল একটা সাদামাটা ক্যান্টিন। দোসা, ইডলি পাওয়া যেত। সেই সাদামাটা ক্যান্টিন ভেঙে কায়দার ক্যাফে হয়েছে, রোস্টারি। ছককাটা বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে এসিতে গিয়ে বসা হল কারণ ঘামতে ঘামতে খেতে ভালো লাগে না। আম পান্না মোহিতো, চকোলেট শেক, মাশরুম স্যান্ডউইচ, কিমা স্যান্ডউইচ।যত দেরি হবে ভেবেছিলাম হল না। ফাঁকা বাইপাস দিয়ে হু হু করে বেলেঘাটায় পৌঁছে গেলাম। বাবামা সরোজবাবুকে টাটা করে ফ্ল্যাটের মেন লোহার গেট ঝমঝম করে খুলে ঢুকলাম।

তালায় চাবি ঝুলছিল। ঘুরিয়ে, তালাটা টেনেটুনে দেখে, সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। অন্ধকার সিঁড়ি।  বন্দ্যোপাধ্যায় লেখা দরজা পেরোলাম। আগরওয়ালদের ফ্ল্যাটে আগে একবারই এসেছি। সত্তর পার সেন্ট শিওর কোনটা। ভেতরে টিভি চলছে। বাইরে কোনও আলো জ্বলছে না। বেল বাজালাম। চেয়ার ঠেলে উঠল কেউ। দরজা খুলল। আগরওয়ালের কন্যা। স্কুলের শেষ, কলেজও হতে পারে।

আমাকে ঠাহর করতে দু'সেকেন্ড নিল, তারপর চিৎকার করল। শরীরের সমস্ত কোষ থেকে আতংক উঠে আসা চিৎকার। এবং করেই যেতে লাগল, করেই যেতে লাগল। চিৎকার করতে করতে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।

আগরওয়ালজী সংকুচিত হলেন। কন্যার মা কেয়া হুয়া কেয়া হুয়া বলে বেলুন হাতে ছুটে এলেন, আমাকে দেখে বললেন, আরে ও বুঝতে পারেনি। কথা বাড়ালাম না। এই যে চাবি, থ্যাংক ইউ সো মাচ, বলে নিচে চলে এলাম।

নামতে নামতে, তালা খুলতে খুলতে, জুতো ছাড়তে ছাড়তে ভাবলাম এত ভয় পেল কেন মেয়েটা। মেয়েটার চোখ দিয়ে নিজেকে দেখার চেষ্টা করলাম। অন্ধকারের মধ্যে একদলা ঘন অন্ধকার, ঘরের ভেতরের টিউবলাইট পড়ে সেটা মানুষের অবয়ব নিয়েছে, অবয়বের ওপর আবছা ফুটে উঠেছে লাল টিপ, গোল মুণ্ডু ঘিরে উড়ন্ত সাদা চুল।

শুয়ে পড়লাম। অর্চিষ্মান পিং করলে বলব একটুও ভয় লাগছে না। অচেনা আওয়াজে কান, অচেনা বিছানায় শরীর অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে বোধহয়। নাকি অন্যরা আমাকে ভয় পেতে শুরু করেছে বলে আমার আর কাউকে ভয় লাগছে না? টপ করে ঘুম এসে গেল।

Comments

  1. khub bhalo laglo.. bhalo thakben

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনিও, ইন্দ্রাণী।

      Delete
  2. এই যে লোকের সাথে কথা বলায় দ্বিধা এ আমারও খুব। কাউকে ফোন করতে হবে বা কথা বলতে হবে ভাবলেই জ্বর আসে যেন। তাই রিষড়ায় সব সময় অত লোকের ভীড় লম্বা সময়ের জন্যে সইবে না মনে হয়। কিছু জিনিস দূর থেকে ভালো লাগে বেশী হয়তো।
    তোমার সাথে কাকীমার মিলের গল্প আগে শুনেছি বটে, কিন্তু দুবার করে শুনতে অসুবিধে কিচ্ছু হল না, ভালোই লাগলো। গল্প করতে বসে সব সময় এটা বলেছি কিনা ভাব অসুবিধের।

    তবে এসবই বাহ্য, আসলে তোমার লেখাটা পড়ে মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে কাল থেকে। ভালো, খারাপে ফেলা যবে না। ভালো থেকো। আর দিল্লী সত্যিই মনে হয়না ছাড়তে চাও, চাইলে লাদাখ ঘুরে তারপর ছাড়লে সুবিধে হবে খুব।
    ভালো থেকো।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. দিল্লি ছাড়তে চাওয়ার থেকেও নিজের জায়গার কাছাকাছি যেতে চাওয়ার ইচ্ছে বেশি, প্রদীপ্ত। যে জায়গাটা আমার মত সেই জায়গাটায় গিয়ে থাকার ইচ্ছে। নিজেকে আরও কম বদলাতে চাওয়ার ইচ্ছে। লাদাখটা ঘুরে নিতে হবে, ঠিকই বলেছ।

      Delete
  3. অন্যদেরকে ভয় পাওয়ানোর স্কিলসেট আর কিন্তু ডিনাই করা যাবে না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওই স্কিলটা অ্যাকোয়ার করার চেষ্টায় আছি। সবাইকে ভয় পেয়ে চলার থেকে সবাইকে ভয় পাইয়ে চলা অনেক বেটার।

      Delete
  4. এবাড়ি ওবাড়ি সেবাড়ি আরও এক বাড়ি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. কোনওটাই আমার না, অমিতা। সবই পরের ধন।

      Delete

Post a Comment