জয়পুর ২ঃ গুলাব জামুন, গাট্টা কারি ও হাওয়ামহল



ট্রেনে উঠতে ভুল। নামতেও ভুল। জয়পুর জংশনে নামার কথা আমাদের। কামরার সবাই নামছে দেখে আমরাও নেমে পড়লাম। ওটা গান্ধীনগর। জয়পুর জংশনের আগের স্টেশন। আমাদের হোটেল আবার  জয়পুর জংশনের নাকের ডগায়। কোই বাত নেহি, উবার ডেকে চলে যাওয়া যাবে।


ডাকলাম। ভাইসাব বললেন, আপ কাহাঁ হো? আমরা বলছি, যাহাঁ বহোৎ সারে অটো কা ভিড় উধার। ভাইসাব বললেন, ম্যাডাম, পুরা জয়পুরমে বহোৎ সারে অটো কা ভিড় হ্যায়। তখন ফোন নামিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করতে হল, আমরা কোথায়। গেট নাম্বার টু-তে। তথ্য সরবরাহ করে দিলাম, ভাইসাব একনম্বর গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ব্যাজার গলায় বললেন, আ রহা হুঁ। এলেন। শহরের পথে ভেসে পড়লাম। অর্চিষ্মান অটোর ওই ফোঁকর দিয়ে, আমি অটোর এই ফোঁকর দিয়ে বডি অর্ধেক বার করে  জয়পুর গিলতে গিলতে চললাম। দিল্লিতে পাঁচ কিলোমিটার পরপর ভাঙা বাড়ির খণ্ডাংশ দেখা যায়, এখানে মোড়ে মোড়ে একটা লাল পাথরের হয় সিংদরজা নয় উঁচু মিনার টাইপের জিনিস। সেগুলো অরিজিন্যাল নাকি পরবর্তীতে শহরের চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বানানো জানি না। সিংদরজাগুলো অবশ্যই আগেকার। অর্চিষ্মান ভুলধরা জেঠুদের মতো বলল, পাথরগুলো তো লাল, গোলাপি তো না? আমি বললাম, একই হল।



আমাদের হোটেল আর টি ডি সি-র গনগৌর। যাদের সরকারি অ্যাকোমোডেশনে অ্যালার্জি, আমার ধারণা তাঁরা জীবনের শুরুতে এবং একাধিকবার গনগৌর টাইপের হোটেলের খপ্পরে পড়েছেন। স্মরণে এত খারাপ সার্ভিস আমি আগে কোনও সরকারি আবাসে পাইনি। আশ্চর্যজনকভাবে সকালে সব ঠিকঠাক থাকে। রুমসার্ভিসের ভদ্রলোকেরা ফোন তুলে গুড মর্নিং বলেন, চা পাঠান। বিকেলে গুড আফটারনুন তো দূর, চা পাঠাচ্ছি বলেও পাঠান না। এই প্রথম বেড়াতে গিয়ে সি আই ডি দেখা হল না আমার। নাকি টিভি চলছে না, কারণ কনস্ট্রাকশন চলছে।

চা আনালাম। চা-টা ভালো। কড়া। আদাএলাচ দেওয়া তবে মাপা হাতে। লোকে ভালো চা করতে বললে এমন এলাচ ঢালে যেন বিরিয়ানি। বিতিকিচ্ছিরি। নিজেদের এলিয়ে পড়তে অ্যালাউ করলাম না। উবার ডেকে বেরিয়ে পড়লাম। জয়পুরের আড়াইদিন উবার করেই ঘুরেছি যেটুকু ঘোরার। উবার আর ওলা।  রানিং ই-রিকশা বা অটো প্রায় নিইনি বললেই চলে। ভাড়া বলার মতো কম। এই যে গান্ধীনগর স্টেশন থেকে জয়পুর জংশন গেলাম ভাড়া নিল মাত্র ছিয়ানব্বই টাকা। ওই পরিমাণ রাস্তা দিল্লিতে যেতে মিনিমাম দেড়শো নিয়ে নিত। দুশোও হতে পারে। অর্চিষ্মান শুধরে দিল। জয়পুরের উবার শস্তা না, দিল্লির উবার ডাকাত। তা ঠিক।


আমাদের এবারের বেড়ানোটা হাইব্রিড। থোড়া কাজ, থোড়া বেড়ানো। অর্চিষ্মান একদিন বলল, একটু লজ্জা লজ্জা মুখেই, একটা স্টেকেশন করবে গো? আমি বললাম, তুমি যেটা করতে চাইছ সেটাকে স্টেকেশন বলে না। অন্তত ইন্টারনেটের সংজ্ঞায়। ইন্টারনেটে স্টেকেশন বলতে লোকে বোঝে একটা অসভ্যের মতো দামি হোটেলে উঠে, প্রধানতঃ নিজের শহরেরই বা অন্য শহরেরও হতে পারে, সকাল থেকে রুম সার্ভিস আনিয়ে হোটেলের ধপধপে বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়া। তুমি চাইছ কাছাকাছির মধ্যে বেড়াতে গিয়ে অল্প ঘুরে, অল্প কাজ করে আবার বাড়ি ফিরে আসতে, তাই তো? 

এবারেরটা  সেই রকমই বেড়ানো। হোয়াট টু ডু, হোয়াট টু ইট-এর সঙ্গে ক্যাফে উইথ ওয়াই ফাই-ও সার্চ করেছি। তাতে অনেক ক্যাফের সঙ্গে কিউরিয়াস লাইফ-এর নামও বেরিয়েছে। আমাদের হোটেলের কাছের শাখাটা কিউরিয়াস লাইফ-এর রেড ভার্শান। ব্লু ভার্শান অন্য কোথাও।


অটোর রুট জয়পুরের সচ্ছল পাড়াদের মধ্য দিয়ে। ফ্ল্যাট নয়, স্ট্যান্ড অ্যালোন একতলা, দোতলা বাড়ি। এরা খুব বারান্দা আর চাতাল ভালোবাসে। বাড়ির দোতলায় ছড়ানো বারান্দা, সামনে প্রশস্ত চাতাল। গেটের ধার ঘেঁষে কাঁঠালচাঁপা। অনেক বাড়ির সামনের দেওয়ালটা গোল হয়ে বেরিয়ে এসেছে। বাড়ির কপালে চন্দনের রেখার মতো ডিজাইন। অবিকল এই ডিজাইন আমাদের পাড়ার, পাশের পাড়ার বাড়িতে দেখেছি। ওঁরা টুকেছেন না আমরা টুকেছি?

দিল্লির সম্পর্কে অর্চিষ্মানের তিনটে মেন আপত্তির একটা হচ্ছে কুৎসিতদর্শন বাড়িঘরদোর। গরিব বস্তির কথা ছেড়ে দিন, যাদের বিপুল পয়সা আছে তাদেরও সৌন্দর্যের থেকে সাইজের প্রতি মোহ বেশি। অর্চিষ্মান পাঞ্জাবে ফিল্ড করে এসে বলেছে এটা ডিস্টিংক্টলি পাঞ্জাবী ট্রেট। মানে পয়সা থাকলে শুধু হবে না, আছে যে সেটা ঢাক পিটিয়ে না জাহির করা পর্যন্ত চোঁয়াঢেঁকুর। এই যে এ সব পাড়ার লোকেরা এদের কি পয়সা নেই? আমি শিওর এদের পয়সা আমার কল্পনার বাইরে। অথচ বাড়িগুলো শান্তশিষ্ট, ভদ্রসভ্য। দিল্লির লোক হলে রাস্তার ওপর থেকে দেওয়াল তুলত, বাড়ির ভেতর ফুটবল মাঠের মতো হলঘর ঘিরে বিরাট বিরাট আর্চ বসিয়ে, বাইরের প্লাস্টারে খাঁজ কেটে, গোলাপফুল এঁকে একটা মারাত্মক কাণ্ড ঘটাত। যাতে কোনও সন্দেহ না থাকে যে বাড়ি বানাতে রুচির থেকে পয়সা বেশি খরচ হয়েছে।


কফিশপটা দেখেই পছন্দ হল। আপনারা গেলে যেতে পারেন। এই শাখাটা সরোজিনী মার্গে। অ্যামবিয়েন্স চমৎকার। প্রচুর লোক কাজ করছেন। যে দোকানে আরও লোক কাজ করেন, সেই দোকানে কাজ করতে সুবিধে হয়। দৌড়ে গিয়ে প্লাগ পয়েন্টে চার্জার গুঁজে বসে পড়লাম। স্যাডলি ওয়াইফাই নেই। ফোন থেকে অ্যাটাচ করতে হল। এই গরমে গরম কফি নেওয়ার প্রশ্ন নেই। আমি নিলাম আমার যা স্ট্যান্ডার্ড, ক্ল্যাসিক কোল্ড ব্রু। অর্চিষ্মান আইসড ভিয়েতনামিজ। টফি কিছু নেওয়া হল না কারণ রাজস্থানে বেড়াতে এসে কফিশপের বাঁধাধরা ব্রুশকেটা আর ইয়োগার্ট বোল খেলে সোজা নরক। খেতেই যদি হয় সকালে গুলাবজীর চা খাবেন, দুপুরে মহাবীর রাবড়ি ভান্ডারের বাজরার রুটি তরকারি লংকার আচার, দুপুরের পরে বা বিকেলের আগে ডাল আর পেঁয়াজ কচোরির তেত্রিশটা মাস্ট ট্রাইয়ের মধ্য থেকে অন্ততঃ তিনটে ট্রাই করবেন। কলকাত্তা চাটের থালাওপচানো চাট খাবেন, মুগডালের ফুসকো ভাল্লার ওপর সাতাশরকমের চাটনি আর সাঁইত্রিশরকমের গুঁড়োমশলা ছড়ানো। শহরজোড়া তেত্রিশ কোটি লস্যিওয়ালার মধ্যে অরিজিন্যাল লস্যিওয়ালার দোকান খুঁজে বার করে লস্যি খেয়ে সাদা গোঁফ বানাবেন। রিসার্চের অঙ্গ হিসেবে সব দোকানের নামঠিকানা জোগাড় করেছি, ফুডভ্লগারদের ভিডিও দেখেছি, তবে সব দোকানে যাওয়া হবে না আমাদের। অন্য ট্রিপে হয়তো ট্রাই নিতাম, অমৃতসরে লাঞ্চে তিনটে দোকানে তিনবার কুলচা খাওয়ার স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে। এ বারের জয়পুর ট্রিপ সে রকম না। মন বলছে এর পর থেকে সব ট্রিপই এ রকম হবে।  ইন্টারনেটে সাজেশনের লিস্ট লম্বা থেকে লম্বাতর হচ্ছে। আমরা কুঁড়ে থেকে কুঁড়েতর হচ্ছি। সিনিসিজম বাড়ছে। সন্দেহ জাগছে ইন্টারনেটের টপ টেন লিস্টের দশটি দোকানের ডালকচুরির একে অপরের থেকে আদৌ তফাৎ আছে কি না, থাকলেও সে তফাৎ ধরায় আমাদের জিভের অক্ষমতা সম্পর্কে শিওর হচ্ছি।

কাজ সেরে বেরোতে সাড়ে চারটে হল। এদের কচুরটচুরি একেকটা বোমা, এখন খেলে আর রাতে খাওয়া যাবে না। লাঞ্চ আর ডিনার পাঞ্চ করার লক্ষ্যে হান্ডি রেস্টোর‍্যান্টের দিকে রওনা দিলাম। হান্ডি নামজাদা দোকান, সব মাস্ট ইট লিস্টেই নাম আছে। লোক্যাল এবং ফরেনার দুই রকম খদ্দেরই উপস্থিত। ভালো লক্ষণ। অর্চিষ্মান লাল মাস আর বাজরার রুটি নিল, আমি নিলাম গাট্টা মসালা আর কী যেন একটা স্টাফড রুটি, সঙ্গে ছাস। বেসিক্যালি ঘোল। হান্ডির দাদা যখন খাবারগুলো এনে আমাদের সামনে রাখলেন, ঝোলের রং দেখে বুক কাঁপল। অর্চিষ্মানের লাল মাসের লাল একেবারে সিঁদুরগোলা, আমার গাট্টা কারির লালে অল্প সোনালিমেশা। তন্দুরের ফোসকা পড়া রুটির শরীরে ঘিয়ের প্রলেপ। 


সত্যি বলব, হাণ্ডিতে যাওয়ার পথে আমাদের দুজনেরই, আচ্ছা নিজের কথাই বলি, ভোল্টেজ ডাউন ছিল। বেলা পড়ে আসছিল, বেড়ানো শুরুই হয়নি, কচুরি খাওয়া হয়নি, বিকেল পাঁচটায় ডিনার হচ্ছে, সব মিলিয়ে জুত লাগছিল না। হান্ডির গাট্টা কারি আর স্টাফড রুটি খেতে খেতে ভোল্টেজ দেখতে দেখতে হাই হয়ে গেল, মন থেকে যাবতীয় শ্রান্তি উধাও। রাজস্থানী খাবারের প্রতি আমাদের অসীম সমীহ। দিল্লিতে যে ক’টি রাজ্যের খাবার আমরা ঘন ঘন রিপিট করি তার মধ্যে রাজস্থান একটা। সিপি-র রাজস্থালী আমাদের অন্যতম ফেভারিট খাওয়ার দোকান। আমাদের দুজনেরই একটা বিশ্বাস আছে অবশ্য যে দোকানের খাবারের সঙ্গে একটা রাজ্যের বাড়ির খাবারের সংযোগ ক্ষীণ। আমাদের ছ'নম্বর বালিগঞ্জ প্লেসের সঙ্গে আমাদের বাড়ির খাবারের সংযোগের মতো। রাজস্থানী বাড়ির খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়নি, কিন্তু অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্র থেকে সে বাড়ির খাবারের প্রশংসাও পেয়েছি। আমাদের রিষড়া কোন্নগর হিন্দমোটরে একটা বিরাট রাজস্থানী বা মারওয়াড়ি পপুলেশন আছে। আমার জেঠুর বাড়ির চারপাশেও আছে। তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত বাটি চালাচালি হয়। জেঠি, জেঠতুতো দিদি বলে, মারওয়াড়ি বউগুলো কিছু রাঁধতে পারে রে সোনা। একদিন আসিস, ওদের বাড়ি নিয়ে যাব। জেঠি, দিদির কথায় গুরুত্ব দিই কারণ ওরা আমার মতো না। সপ্তাহে একদিন ঢ্যাঁড়স ভেজে বাকি ছ'দিন রেস্টোর‍্যান্টের খাবারের তুল্যমূল্য বিচার করে বেড়াচ্ছে। ওরা তেতোচচ্চড়ি থেকে পুলিপিঠে সব ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রেঁধে ফেলতে পারে। ওদের রান্না সম্পর্কে সার্টিফিকেট আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করি। রাজস্থানের খাবারের একটা বলার মতো বিষয় মশলার ব্যবহার। রাজস্থান হচ্ছে মশলার জায়গা। আমাদের মশলার ব্যবহারের ধরণের সঙ্গে ওঁদের মশলার ব্যবহারের কোনও মিলই নেই। ওঁরা প্রচুর, প্রচুর মশলা ব্যবহার করেন , তাতে অসামান্য সুগন্ধ এবং স্বাদের লেয়ার তৈরি হয় রান্নায়। হোটেলের রান্নাঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতেই সুগন্ধে নাক সুড়সুড় করছিল। অথচ অত মশলার ব্যবহারের পরেও একটা খাবার এত মৃদু আর মোলায়েম থাকে কী করে রহস্য।

আমার একটা ভীষণ অসুবিধের ব্যাপার হচ্ছে মনে কোনও একটা ভাব জাগলে শুধু মুখ না, গোটা শরীর  আয়নায় পরিণত হয়। রুটি দিয়ে নরম গাট্টা ভেঙে লালসোনালি ঝোলে ডুবিয়ে মুখে পুরে যে রকম আহাউহু করছিলাম, মাথা নাড়ছিলাম, খাবার সম্পর্কে আমার মনোভাব গোটা রেস্টোর‍্যান্টের জানতে বাকি ছিল না। বিল নিয়ে এসে দাদা জানালেন গুগলে হান্ডিকে রেটিং দিলে গুলাবজামুন ফ্রি। অর্চিষ্মানের দিকে তাকালাম। ওর মুখভঙ্গি বরাবরের মতোই Zen. আমি কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে গুগল ক্রোম খুলে টাইপ করতে শুরু করলেন। হান্ডি রেস্টোর‍্যান্টের পেজ বেরোলো। খাবারদাবার, অ্যামবিয়েন্স, ক্লিনলিনেস, সার্ভিস আরও কী কী ছিল খেয়ালও করিনি। দাদা একেকটার পাশে হাত রাখছিলেন আর আমি ফাইভ স্টার দিয়ে যাচ্ছিলাম। সবক'টা ক্যাটেগরি কমপ্লিট হলে কমেন্টের বাক্সটায় আঙুল রেখে বললেন, লিখুন বরুণ। বললাম, অ্যাঁ? দাদা বললেন, সার্ভারের নাম। লিখুন লিখুন। ভি এ আর ইউ এন। লিখলাম। সাবমিট-এ দাদা নিজেই ক্লিক করে দিলেন। করে ফোন আমাকে ফেরত দিয়ে অর্চিষ্মানের দিকে হাত বাড়ালেন। 

অর্চিষ্মান আলতো হাত তুলল। একটা ফিডব্যাকই কাফি। কী সাহস। চোখের ইশারায় বারণ করার চেষ্টা করলাম। অমান্য কোর না, করলে কী হবে কিছু বলা যায় না। হয়তো নাক কেটে দিল, কেটে ছেড়ে দিল। অর্চিষ্মানের কপাল ভালো সে রকম কিছুই হল না। ভদ্রলোক চলে গেলেন। বিল এল। মিটিয়ে বসে আছি, গুলাবজামুনের পাত্তা নেই। বললাম, উঠে পড়ব নাকি? হয়তো দেবে না। অর্চিষ্মান বলল, তোমার যা ইচ্ছে। গুলাবজামুন সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত তোমার। 

চড়া এসিতেও অল্প অল্প ঘাম হতে শুরু করল। আমরা গুলাবজামুনের জন্য বসে আছি দেখে কি ওঁরা হাসছেন? উঠে চলে গেলে কি কেমন বোকা বানিয়ে রেটিং নিয়ে নেওয়া গেল ভেবে বেশি হাসবেন? যাই হোক, এই গর্ভযন্ত্রণা মিনিটতিনেকের মধ্যেই মিটল। একটা মারাত্মক কায়দার হাতলওয়ালা রুপোলি বাটিতে একখানা গুলাবজামুন, একটি চামচ সহযোগে এসে উপস্থিত হল। দাদা নিজেই এনেছেন। আকণ্ঠ বিনয় ও আড়ম্বরের সঙ্গে অর্চিষ্মানের দিকে সম্পূর্ণ পেছন ফিরে আমার নাকের ডগায় বাটি নামিয়ে রাখলেন। রেখে বিদায় হলেন। একটু টেস্ট কর বলে অর্চিষ্মানকে বারবার সাধলাম। তোমার হার্ড আর্নড গুলাবজামুন তুমিই খাও বলে আমি যতক্ষণ গুলাবজামুন শেষ করলাম অর্চিষ্মান ফ্যাচফ্যাচ হেসে গেল।

 

জয়পুরের তিনচারটে দ্রষ্টব্য জিনিস পাশাপাশি। হাওয়ামহল, সিটি প্যালেস, যন্তরমন্তর। ওইদিকেই যাওয়া যাক। অটো ডাকলাম। যেটা ঘটল সেটা অমৃতসরেও ঘটেছিল। যিনি আমাদের কফির দোকান থেকে হান্ডি রেস্টোর‍্যান্টে ছেড়ে দিয়ে গেছিলেন তিনিই আবার হান্ডি থেকে হাওয়ামহল পৌঁছে দিলেন। যেতে যেতে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার দেখলাম। রাস্তার দু'পাশে একতলা গোলাপি রঙের বাজারে সারি সারি দোকান। সে সব দোকানের লাইনে কলকাত্তা হার্ডওয়্যার, কলকাত্তা স্যানিটারি শপ, কলকাত্তা পেইন্টস। শুধু এই বাজারেই নয়, জয়পুরের একটা বিখ্যাত চাটের স্টলের নাম কলকাত্তা চাট। আরেকটা দোকানের নাম তারকেশ্বর বুকস অ্যান্ড স্টেশনার্স। দেখতে  দেখতে একটা কথা মনে হচ্ছিল। আমরা খালি ভাবছি সব এসে লুটেপুটে সাফা করে নিয়ে গেল, ওঁরা হয়তো নিয়ে যাচ্ছেন দেশের অন্য প্রান্তের একটি শহর বা রাজ্যের প্রবাসবাসের স্মৃতি। ফিরে গিয়ে সেই শহরের নামটাকে পার্মানেন্ট করে রাখছেন যাতে কোনওদিন তাকে না ভুলে যান।


হাওয়ামহলের পাঁচতলা কাঠামো সতেরোশো নিরানব্বই সালের। ডানে জানালা, বাঁয়ে জানালা, ওপরে নিচে ঈশানে নৈঋতে অগ্নি বায়ুতে গিজগিজ জানালা। সিঁড়ি বাইতে হয় না, র‍্যাম্প বেয়ে উঠে যাওয়া যায়। হাওয়ামহলের ওপরের বারান্দায় বসে হাওয়া খেতে খেতে, জাফরির ফাঁক দিয়ে দেখলাম বেছানো শহর, শহরের সীমান্তে অস্তগামী সূর্য, সিটি প্যালেসের গম্বুজে উড্ডীন পতাকা, যন্তরমন্তরের যন্ত্রের ত্রিভুজ, পাহাড়ের ওপর কেল্লার ছায়া ।


সন্ধে নামছিল। প্রায় শেষরাতে ঘুম থেকে উঠেছি, ক্লান্ত লাগার কথা, কিন্তু লাগছে না। সিটি প্যালেসটাও সেরেই যাওয়া যাক নাকি?

যাক যাক। হাওয়ামহলে যে এসেছিলাম তার একটা প্রমাণ রেখে।



Comments

  1. Replies
    1. আরে সায়ন, খাওয়ার আগে মেজাজ ডাউন ছিল কাজেই ফোন তাক করে ছিলাম না। খেতে খেতে এত আনন্দ হচ্ছিল যে ছবি তোলার আগেই সব খাবার শেষ।

      Delete
  2. Etodin Delhi theke motey der bar (average) Jaipur??
    ami bodhoy 6/7 baar ghora. tai chena chena jaigar chhobi/experience gulo peye abaar shei smritigulo jege uthlo.

    Gangaur-er byapare ek mot. RTDC-r onyanyo jaiga joto bhaalo, gangaur toto tai jachhetai.

    Rajasthan-er khabaar amaar moto ghor mangshashi lokero khub pochhindo. Tumi bodhoy Udaypur ghure likhechhile je ekhankaar daal ta ekta onno level-er. sheta ekdom thik. Laxmi Mistann Bhandar-e khaoni? naki notun kichhu try korte cheyechhile?

    ReplyDelete
    Replies
    1. অর্পণ, অন্য কিছু ট্রাই করার চক্করেই তো মোটে দেড়বার জয়পুর। লক্ষ্মীতে খেয়েছি, পরদিন ব্রেকফাস্ট। তার পরদিন লাঞ্চও। এল এম বি অনেকটা চিপ্সের মতো, একবার গিয়ে থামা মুশকিল।

      গনগৌরের খপ্পরে তুমিও পড়েছ? আগে জানলে ও মুখো হতাম না। উদয়পুরের ডালের ব্যাপারে এখনও একমত। ইন জেনারেল, গোটা রাজস্থানের ডালই যাকে বলে নট ডাল অ্যাট অল।

      Delete
  3. জয়পুরে গাঠিয়ার তরকারি খেয়েছিলাম হোটেলের ডিনারে, খুব ভালো লেগেছিলো| লাল মাস ছিল উদয়পুরের হোটেলের স্পেশাল christnas ডিনারে| ডাল খুব ভাল লাগলেও ডাল বাটি চুর্মা আমার না পসন্দ | জয়পুরে আমাদের হোটেল ছিল জলমহলের ঠিক উল্টোদিকে | কয়েকবছর আগে সবাই মিলে গিয়েছিলাম ফর দা ফার্স্ট টাইম| তোমার লেখা আমাদের উদয়পুরের ট্যুর গাইড ছিল|

    ReplyDelete
    Replies
    1. ডাল বাটি চুরমা আমারও টপ রাজস্থানী খাবারের মধ্যে পড়বে না, অমিতা। কম্বিনেশনটার টেক্সচারের বৈচিত্র্য আমাকে কনফিউজড করে। বানানোর প্রণালী জানার পর আরও ঘেঁটে গেছি। ভুল বলতে পারি, অনেক দিন আগে দেখেছিলাম, যতদূর মনে পড়ছে, বাটি বানিয়ে তারপর সেটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে চিনি মিশিয়ে চুরমা বানানো হয়। এত ঘুরিয়ে নাক দেখানোর কী আছে কে জানে।

      জলমহলে বান্টা খেলাম। সে গল্প আসছে। উদয়পুর ভালো লেগেছিল আশা করি। আমার খুব ভালো লেগেছিল।

      Delete
  4. রাজস্থান ট্যুরিজম বিক্রি বাটা করে দেবার প্ল্যানে আছে নাকি কে জানে! গনগৌরে আমারও অভিজ্ঞতা খারাপ ছিল মনে পড়ছে। রাজস্থানী খাবার সততই বড় ভালো। আমরা হামহাম করে রাজস্থানী কের সাংরি চেয়ে খেয়েছি উদয়পুরে। ফিরেও। চাট ইত্যাদি তো আছেই। কোন একটা মিষ্টির দোকানে নিতে গেছিলাম দুশো গ্রাম ঘেবর না কি যেন নিতে গিয়ে বিস্তর জিনিস কিনে ফিরেছিলাম মনে আছে।
    ও আর একটা কথা, রাজস্থানী লোকেদের বড় ভালো লাগে। সকলেই কী আর ভালো, কিন্তু ভালোর সংখ্যা বেশী মনে হয়।

    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমার বলা সব খাবারগুলোই চমৎকার, প্রদীপ্ত। কের সাংরি আমারও ভীষণ ভালো লাগে। ঘেওয়র আমার খুব খাওয়ার ইচ্ছে কিন্তু দেখলেই মনে হয় ভীষণ মিষ্টি আর ঘি চপচপে হবে, তাই আর খাওয়া হয় না। একবার ঝাঁপ মেরে দেখতে হবে।

      Delete
  5. এই তো - ভুল ট্রেন না হলেও ভুল স্টেশনটা কভার হয়ে গেছে !

    হার্ড আর্নড গুলাবজামুনের এপিসোডটা দারুন।

    অনেক ছোটবেলায় রাজস্থান ঘুরেছিলাম - জয়পুর, জয়সালমীর, যোধপুর, আজমের, ইত্যাদি অনেকগুলো শহর কভার করে। দু সপ্তাহের মতো ট্রিপ ছিল। ছবিগুলো দেখে সেসব যা একটু একটু মনে আছে, মনে পড়ছিলো। জয়পুরের হাওয়া মহল, শীশ মহল। মরুভূমিতে উটের পিঠে চড়া। আর রাজস্থানের ফোর্টগুলো - ওই ঘোরানো রাস্তাগুলো দিয়ে উঠে পাহাড়ের চূড়োয় ফোর্টগুলো দারুন লেগেছিলো তখন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. "ঘোরানো রাস্তাগুলো দিয়ে উঠে পাহাড়ের চূড়োয় ফোর্টগুলো..." একদম ঠিক বলেছেন, রাজর্ষি, এই ছবিটা রাজস্থানের সঙ্গে ওতপ্রোত। এত সুন্দর রাজ্য , ভাবা যায় না। আর দেখার জিনিসের অন্ত নেই। ছোটবেলার ট্রিপগুলোর মতো লম্বা ট্রিপ এখন আর হওয়ার চান্স নেই, তাই ভাবছি এ রকম খাবলা মেরে মেরে আরও একবার করে ঘুরে আসব। জয়সলমীর মাঝে মাঝেই মাথায় ঘাই মারে। যেতে হবে একবার।

      Delete

Post a Comment