ঘুরে দাঁড়ানোর মরীচিকা


এই ক’দিন আগে যে বইটা পড়ে উঠলাম, ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’, সে বইটা নিয়ে বলতে চাইলে অনেক কথা বলা যায়। যেমন ধরুন, কী অপরূপ ভাষা, কী অদ্ভুত শব্দচয়ন, কথার ওপর কথা সাজিয়ে কী নিটোল একটা ছবি এঁকে চলা, পদ্যলিখিয়েরা যে গদ্যলিখিয়েদের থেকে ঢের ভালো গদ্য লেখেন সেটার আরও একবার হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু সেসব বলবো বলে আমি আজ অবান্তরে আসিনি।

যেটা বলতে এসেছি সেটা হচ্ছে, এই বইটাতেও দেখলাম প্রেমে দাগা খাওয়ার পর একজন ভয়ানক খেটেখুটে, দিবারাত্র পরিশ্রম করে, রাতজেগে পড়ে, দুর্দান্ত রেজাল্ট করে ফেললো। স্রেফ ছেলেটিকে ভুলবে বলে। প্রেমে পড়ার আগে, আর প্রেম ভাঙার পরে, মেয়েটি যেন দুটি সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। আগে সে কল্পনাপ্রবণ, রোম্যান্টিক, হয়তো খানিকটা ছেলেমানুষই। আর পরে সে-ই মেয়েই দুনিয়াদার, নিজের ভালো নিজে বোঝা, পরিশ্রমী, একবগগা, নিজলক্ষ্যে স্থির, অচঞ্চল।   

ইকনমিকসে যাকে বলে স্ট্রাকচারাল ব্রেক---একটা ঘটনা, একটা দুঃখ, একটা হৃদয়ভঙ্গ, মানুষের জীবনে শুনেছি সেরকম একটা ব্রেক এনে দিতে পারে। শুধু সাঁঝবাতির জীবনে নয়, আরও অনেকের জীবনে এরকম হয় পড়েছি। দেখেছি, শুনেছি। একটা বক্তৃতা শুনে কেউ জীবনের মায়া ত্যাগ করে বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে, একটা পরীক্ষায় ফেল করে কেউ শপথ নিয়ে পরের প্রত্যেকটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে, প্রেমিকা দাগা দেওয়ার পর আদা নুন খেয়ে লেগে সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করেছে। শুধু দেখিয়ে দেবে বলে। 

শুধু অচেনা অ্যানেকডোটস নয়, আমার চেনা অনেক বন্ধুবান্ধবও বলেছেন, “ওই রাতটা”, “ওই গানটা”, “ওই পরীক্ষার ওই রেজাল্টটা”... “আমার জীবন বদলে দিয়েছে।” ভালোর দিকে। অসহায়তার জায়গায় উদ্যম এনে দিয়েছে, অদৃষ্টবাদের বদলে পুরুষকারের জন্ম দিয়েছে। যেখানে কিছু ছিলো না, সেখানে এসে বাসা বেঁধেছে জেদ, নিষ্ঠা, তাগিদ, কঠোর পরিশ্রম।

অনেককে তো বলতে শুনেছি, ভাগ্যিস খারাপ জিনিসটা ঘটেছিলো জীবনে।

এসব শুনে কী যে উত্তেজনা হয় আমার কী বলবো আপনাদের। রক্ত গরম হয়ে ওঠে। মনে হয়, আছে আছে আশা আছে! এই ল্যাপাপোছা জীবন থেকে পালানোর সবকটা পথ এখনো রুদ্ধ হয়ে যায়নি। এক একটা প্রেমে ব্যর্থ হই, এক একটা পেপারে বি মাইনাস আসে, আর আমি ক্রমশ চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকি। এই বার! এই বার! এই বার কুন্তলার ভেতরের আগুন জেগে উঠবে। আজ রাতে যে কুন্তলা ঘুমোতে যাচ্ছে, কাল সকালে তার জায়গায় আনকোরা নতুন একটা কুন্তলা হাই তুলে, আড়মোড়া ভেঙে খাট থেকে নামবে।

আর নেমেই বিশ্বজয়।   

*****

এরপরের বাক্যটা কী হতে চলেছে সেটা নিশ্চয় আপনারা অলরেডি বুঝে ফেলেছেন, আমার আর বানান করে লিখে দেওয়ার দরকার নেই। নিজের জীবনে স্ট্রাকচারাল ব্রেকের অপেক্ষা করে করে আমি সিরিয়াসলি শ্রান্ত, ক্লান্ত, বীতশ্রদ্ধ। আমি জানিনা আমার ভেতরের আগুন জ্বালানোর জন্য আর ঠিক ক'টা ব্যর্থতা দরকার। আর ঠিক ক'টা প্রত্যাখ্যান আমাকে আমার এই অর্থহীন অস্তিত্বের ভেতর থেকে কলার ধরে হিঁচড়ে টেনে বার করে আনতে পারবে, আমার জানা নেই। 

সত্যি বলছি, আর জানার আশাও নেই। চাইও না। তার থেকে আমি বরং বসে বসে বাকি সব সফল লোকেদের ব্যর্থতার রূপকথা শুনবো। আমার চোখের সামনে দিয়ে লাইন দিয়ে সব শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হয়ে যাবে, হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখবো।

জঘন্য।


হোয়াটেভস। নিজের কাঁদুনি অনেক হলো, আপনাদের কথা বলুন। আপনার জীবনে এরকম স্ট্রাকচারাল ব্রেক এসেছে কখনো? সে ব্রেকের আগে আপনি কীরকম ছিলেন, আর এখনই বা কীরকম হয়েছেন? গল্পটা বলুন প্লিজ আমায়। শুনে আমি আপনাকে একটুও হিংসে করবো না, কথা দিচ্ছি। অন গড ফাদার মাদার।

Comments

  1. Erokom onek shona jaye sotyii kintu amar erokom kichu hoyni ekhono porjonto. Ami bishal faakibaj chilam engineering porjonto, moter opor result ja hoto taite amar cholto bhaloi tai bishal kichu "structural break" er dorkar dekhini. MS er somoy ektu porashuno korte hoyeche, faaki marbar scope petam na. Kono paper e bhalo peyechi, kono paper e jachhetai o peyechi...khub kichu ashe jayeni konotatei!
    Amar golpe "structural break" nei, kintu onek miracle ache! Jonme chinina, life e dekhini loker friend request accept korechilam bole ekhon roj sokal e coffee'r cup ta shei niye ashe (mane Arnab ar ki!!), hotat chena ekjon recommend korlo ekta job er jonye. Tara 5 yrs experienced lok chaichilo, kintu ultimately ami ekhon shei position ei jnakiye boshe sobar matha kheye saaf kore dichhi :-) Ei gulo amar besh onek onek hoyeche...
    Steve Jobs er bhashay "connecting the dots"..seta majhe majhe kori ar besh moja payi...koshto peye knee jerk reaction hoya ki bhalo? Tumi chinta koro na...tomar life ghyama cholche ar cholbeo :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. সুন্দর বলেছো সায়রী। মির‍্যাকল, ব্রেকের চাইতে অনেক ভালো জিনিস। তোমার ওই কথাটা "খুব কিছু আসে যায়নি কোনোটাতেই" মনে রাখার চেষ্টা করি বার বার কিন্তু পারিনা। এবার থেকে বেশি করে চেষ্টা করবো। তোমার শুভেচ্ছার জন্য অজস্র অজস্র ধন্যবাদ। খুব ভালো লাগলো। সত্যি।

      Delete
  2. ekbar aamio ekta "structural break" gocher pon korechilam. jakhon stiletto pore paa mochke hairline fracture holo, takhon jor golay bolechilam "haala zutai porum na"

    seta chilo gorom kaal....kintu hawai goliye to aar sheet kaal paar kora jay na.

    tai agotya "break" ta maintain korte parlam na, aar ekhon abar je ke shei!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহাহাহাহা শম্পা, তোমার impeccable বাঙাল শুনে আমি এদিকে যাকে বলে LOL. হালা বলে হালা? একেবারে হালার পো হালা। জুতো জুতোর মতো থাকবি, তা না...যত্তসব। আমাদের হাওয়াইয়ের জবাব নেই কিন্তু, তাড়াতাড়ি পরা যায়, তাড়াতাড়ি খোলা যায়, পায়ে সর্বক্ষণ মুক্ত হাওয়া খেলে, বিপদে পড়লে হাতে গলিয়ে দৌড়নো যায়, সবথেকে ভালো জিনিসটা হচ্ছে কাউকে পেটানোর জন্য আদর্শ।

      তোমার কমেন্টটা লাখটাকার হয়েছে, সিরিয়াসলি। চলো আমরা একটা বাঙালভাষাচর্চা সমিতি খুলি।

      Delete
  3. Heida bhalo kotha koiszo....kintu bangal bhashay lyakhbe keda!! aami abar lehha-lehhi te nai!

    ReplyDelete
    Replies
    1. সর্বনাশ শম্পা, তুমি তো পুরো প্রো মনে হচ্ছে বাঙাল বলায়! আমার তো কমপ্লেক্স হয়ে যাবে, না না ক্লাব খুলে দরকার নেই, যেমন চলছে চলুক।

      Delete
  4. Sedin jokhon gym e giye dekhlam ojon ekdom obichol ache…. Eto lompho jhompho kichur e kichu fol hoi ni... tokhon amar life e ekta structural break elo…. Ami thik korechhi r nije kine chips khabo na..... khabo e na… obosso onno keu kinle je ki korbo bola jai na.....

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার অনেক সিগারেট খাওয়া বন্ধুকে আমি এই স্ট্র্যাটেজিটা নিতে দেখেছি। নিজে কিনতো না, অন্যের থেকে কাউন্টার নিয়ে খেতো শুধু। কাজে দেয় নাকি শুনেছি, কাজেই তুমিও লেগে পড়ো গোবেচারা।

      Delete
  5. Ekhane "like" button thakle ami Shampa'r comment gulo definitely "like" kortam! Habul Sen er por eto bhalo bangal shunini :-) Jodio ami bangla noi, tobu "halar po hala" katha ta amar boroi bhalo lage!!

    ReplyDelete
  6. ঠিক এই ধরণের ব্যাপার না ঘটলেও একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল আমার ইন্জিনিয়ারিঙ্গের শেষ সেমেস্টারে আই এস আই কলকাতায় করা ইমেজ সার্চ নিয়ে প্রজেক্ট| সেই চার মাসেই আমি কেমন জানি বুঝতে পারি এই কাজটাই আমার সারা জীবন করে যেতে ভাল লাগবে| তার পরে তিন বছর সফটওয়ার কোম্পানিতে আরামের চাকরি করবার সময়েও প্রতি মুহুর্তে মনে হত কবে আবার ইমেজ সার্চ নিয়ে রিসার্চ করতে যেতে পারব | তার ফলেই আজ আমি এখানে পি এইচ ডির পিছনে ধাওয়া করছি | সুখে থাকতে ভুতে কিলোনো আর কাকে বলে!

    পূঃ - শম্পার কমেন্ট এখানে একটা অন্য মাত্রা যোগ করেছে | এরকম কমেন্ট আরো চাই| বাঙাল ভাষার ক্লাব খুললে জানাবেন, আমি যদিও ঘটি, তবু আমার শুনতে ভারী ভাল লাগে বাঙাল ভাষা |

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার টারনিং পয়েন্টের গল্প শুনে ভাল লাগল সুগত।

      আমি একেবারে একমত। শম্পা, তুমি শুনছ আশা করি। বাঙাল ভাষায় শান দিয়ে রাখ, আমরা যখন তখন শুনতে চাইতে পারি কিন্তু।

      Delete

Post a Comment