একটি আদ্যোপান্ত বাস্তব কথোপকথন



চায়ের কাপ হাতে ই-কে হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারিনি ঘটনা কোনদিকে ঘুরতে চলেছে। পারলে উল্টোদিকে টেনে দৌড় লাগাতে আমাকে দু’বার ভাবতে হত না।

ই হাত পাঁচেকের মধ্যে এসে পড়ায় খাতা মুড়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বোঝালাম যে আমি পোলাইট কথোপকথনের জন্য তৈরি। করমর্দন, হাই হ্যালো ইত্যাদি সম্ভাষণের পালা ফুরোল। এরপর যা যা ঘটেছিল সেটা ইংরিজিতেই লিখছি। অনুবাদ করতে গেলে রসভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা।

ইঃ হাই কুন্তলা! আই অ্যাম গোয়িং টু ইন্ডিয়া উইথ মাই হাসব্যান্ড। ফর দ্য ফার্স্ট টাইম।

কঃ রিয়েলি? হাউ নাইস!

আমি যথাসাধ্য উৎসাহ দেখিয়ে ভালো গৃহস্থ হওয়ার চেষ্টা করলাম। পুরোটা যে অভিনয় তাও নয়। যখনই শুনি কেউ প্রথমবার ইন্ডিয়া যাচ্ছে আমার ভীষণ আনন্দ হয়। আমি রোজ যে রাস্তা দিয়ে হাঁটি এরা সেই রাস্তা দিয়ে পায়ে ফোস্‌কা ফেলে হাঁটবে, প্রথমবার তাজমহলের সামনে দাঁড়াবে, রাতের এরোপ্লেনের জানালা থেকে প্রথমবার আলোজ্বলা ভারতবর্ষকে দেখবে---ভাবলেই আমার মন খুশি হয়ে ওঠে।

ই-র মুখে আমার উত্তেজনার প্রতিফলন না দেখে খানিকটা দমেই গিয়েছিলাম আমি। হয়তো বেড়াতে ভালোবাসে না। হয়তো হাসব্যান্ডের অফিসের কাজের ছুতোয় সাতসমুদ্দুর পেরোতে হচ্ছে। কী ঝামেলা।

ই কাজের কথা পাড়ে।

ইঃ কুন্তলা, আই হ্যাভ রেড ইন নিউজপেপার দ্যাট গার্ল্‌স্‌ গেট রেপ্‌ড্‌ ইন ইন্ডিয়া? ইভ্‌ন্‌ ট্যুরিস্টস্‌? ইস ইট ট্রু?

কঃ অ্যাঁ?

ইঃ ডাস্‌ দ্যাট হ্যাপেন ভেরি অফ্‌ন্‌?

কঃ মানে...আই মিন্‌ ...সামটাইমস্‌। বাট...

ইঃ ক্যান ইউ গিভ মি সাম সাজেস্‌শন্‌স্‌? হাউ ক্যান আই টেক প্রিকশনস্‌?

কঃ মে বি...ডু নট গো আউট অ্যালোন ইন নাইট।

ইঃ ইভ্‌ন্‌ উইথ মাই হাসব্যান্ড?

কঃ ইয়েস। ইট ইস বেটার টু রিটার্ন টু ইয়োর হোটেল বিফোর এইট ও ক্লক। বাট ইফ ইউ আর উইথ আ বিগ গ্রুপ, আই গেস্‌ ইউ আর সেফ।  

ইঃ থ্যাংকস। অ্যানাদার কুইক থিং...আই হ্যাভ হার্ড উইমেন গেট গ্রোপ্‌ড্‌ ইন ক্রাউডেড প্লেস?

কঃ ইয়ে...সামটাইম্‌স্‌...।

ইঃ ডাস্‌ দ্যাট হ্যাপেন আ লট্‌?

কঃ নো। নট হোয়্যার আই লিভ।

ইঃ ইফ আই টেল দেম টু স্টপ, উইল দে লিস্‌ন্‌?

কঃ ইউ মাস্ট টেল দেম টু স্টপ। বাট আই অ্যাম শিওর নাথিং উইল হ্যাপেন টু ইউ।

ইঃ থ্যাংকস্‌ কুন্তলা। থ্যাংকস ফর ইয়োর টাইম্‌। 

কঃ ডোন্ট ওয়রি...আই অ্যাম শিওর ইউ উইল হ্যাভ আ ভেরি নাইস্‌ ট্রিপ।

ইঃ আই উইল। থ্যাংকস্‌। বাআআই...

কঃ বাআআই।

ই চায়ের কাপ হাতে ভেসে ভেসে আবার যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে প্রস্থান করল। আমি চেয়ার টেনে বসে খাতা খুললাম। কিন্তু খাতার দিকে তাকিয়ে থাকাই সার হল, মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। কী বললাম, কী বলা উচিত ছিল। নানারকম অনুভূতি মিশে মাথার ভেতর মোক্ষম জট পাকিয়ে গেল। জট খানিকটা ছাড়তেই পোস্টটা লিখে ফেললাম, যাতে ব্যাপারটা মনে থেকে যায়। অবশ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ না রাখলেও কথোপকথনটা ভুলতে পারতাম কি না সে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

এখন একটাই প্রার্থনা, যেন ই-র ইন্ডিয়া ট্রিপ নির্বিঘ্নে কাটে।


Comments

  1. এর পর আর যাস্ট কিছু বলা যায়না। ঃ(

    ReplyDelete
    Replies
    1. সিরিয়াসলি সোমনাথ।

      Delete
  2. hey hey..porechi joboner hate..khana khete hobe sathe..kolkatar kotha bolte pari...just bosobaser ojoggo hoye jachhe..sob milia e bolchi..ekta chobi tule dhori ai sujog e..amar company lady resource der khub kheyal rakhe..7 tar por e tader jonno with security escort cab provide kora hoy..gotonar ghonoghotay mas 3/4 age theke escort jara tader hat e ekta kalo moto danda dhoria diache.odia ki hobe k jane..but dekhte besh moja lage.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভাবুন একবার। সভ্য শহরে রাত সাতটার পর ডাণ্ডা হাতে ঘুরতে হচ্ছে। কিছু আর বলার নেই।

      Delete
  3. খুবই দুর্ভাগ্যের কথা। আমাদের খাজুরাহো, আমাদের হোলি, আমাদের ভীমপলাশি, আমাদের বলিউড সব মুছে গিয়ে রইল কেবল আমাদের অপরাধপ্রবণতা। দেশ তো আর আকাশ থেকে খসে পড়ে না, দেশ তৈরি করে দেশের মানুষ।
    আমি আপনার জায়গায় হলে হয়তো কিছুটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করতাম, কিন্তু ও করে আখেরে কোন লাভ হয় না।
    আমরা বড় দেশ, আমরা প্রাচীন দেশ, কিন্তু আমরা ভালো দেশ নই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. একদম ঠিক বলেছেন দেবাশিস। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকা, এই ইন্টারনেটের যুগে ইম্‌পসিবল। এসে থেকে নানা আলোচনায় অন্তত তিনজনের মুখে দিল্লির বাসে রেপের ঘটনার উল্লেখ শুনেছি। একজনও ভারতীয় নয়। কী বলব। চুপ করে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।

      Delete
    2. debasish babu'r katha ta ekdom thik. tobe aamar priyo lekhok mahfouz "kharap/bhalo" context e bole gechen je
      "The truth of the matter is that evil is a loud and boisterous debaucherer, and that Man remembers what hurts more than what pleases."

      Delete
    3. একমত শম্পা।

      Delete
  4. lekha-ta anek bhabna ene dilo mathay. ashale ei bhabna gulo thakei...shathe ekta kintu o. shudhu ektai prarthana...manush manush hoye uthuk...shubhobuddhi hok...basjoggo hoye uthuk amader desh ei prithibi... parer projanmo jeno uttaradhikarshutre shudhui lajja r nirapattahinota na pay...

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেবশ্রী, তুমি যেগুলো প্রার্থনা করলে সেগুলো বড় শক্ত জিনিস। মানুষ কথাটা মোটে তিন অক্ষরের, কিন্তু সেটা হতে গেলে জন্মজন্মান্তর লেগে যায়।

      Delete
  5. শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না তেমনই আমরা বড় দেশ, আমরা প্রাচীন দেশ, কিন্তু আমরা ভালো দেশ নই।
    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. স্যাড বাট ট্রু, মিঠু।

      Delete
  6. Amar ek colleague er bon geology niye research kore, tar topic er requirement er sathe North India'r soil texture khub match kore, tai se amake jiggesh korechilo j recent ghotonar nirikhe tar bon er India jaoa safe kina. Ami ki bolbo bhebe paini.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই, উত্তর দেওয়া শক্ত হয়ে যায় টিনা।

      Delete
  7. Two words: pepper spray.

    এখন ফ্লিপকার্টেও পাওয়া যাচ্ছে। জার্মানিতে নির্ঘাত পাওয়া যায়। নিয়ে যেতে বলিস্‌ মেয়েটাকে। সবার নিয়ে ঘোরা উচিত। জ্ঞান দিচ্ছি হয়ত, কিন্তু ভালর জন্যই বলছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. না না, জ্ঞানের কিছু নেই। ঠিকই বলেছ।

      Delete
  8. অভিষেক বাবুঃ পেপার স্প্রে কোথায় পাওয়া যায়, সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, পেপার স্প্রে কেন পাওয়া যায়, আর কেন কিনতে হয়?

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটা আমারও প্রশ্ন দেবাশিস। আমার ধারণা আমাদের সবারই।

      Delete
    2. ১) কেন পাওয়া যায় আমরা সবাই জানি। তবে এটার জন্ম ভারতবর্ষে নয়। তাতে অবিশ্যি আমার মূল বক্তব্য বদলায় না। বদল দরকার, সবাই বলে, কিন্তু চেষ্টাচরিত্র করতে খুব অল্প লোককেই দেখি। অন্ততঃ আত্মরক্ষাটুকু করুক সবাই।

      ২) আমাকে অনেকদিন পর কেউ 'বাবু' বলল। :D

      Delete
  9. কিচ্ছু বলার নেই, কিচ্ছু করার নেই। পরের দেশের লোকজনের কথা ভেবে মাথা হেঁট হয়ে যায়, আর নিজের পরিবার-পরিজনদের কথা ভাবলে একটা ভয়-ভয় ভাব হয়। ভারতবর্ষে যেতে চাওয়া মহিলাদের প্রতি ইউ.এস. ডিপার্টমেন্ট অফ্‌ স্টেটের এই সতর্কীকরন। লজ্জা!
    http://travel.state.gov/travel/cis_pa_tw/cis/cis_1139.html#crime

    ReplyDelete
    Replies
    1. লজ্জারই ব্যাপার আবির।

      Delete
  10. ki sanghatik kathopokathan !

    ReplyDelete
    Replies
    1. বিপদটা ভাব একবার।

      Delete
  11. Emon ekta bishoi nie ei kathopokathon je ei nie chinta bhabna korte gele sob kichhu uthal pathal, chinta ta ajker hotat noi , ei chintata sarakhonni moner modhyei roe jachhe ... 'Manush' sabdotar prokrito morjada ar artho amra kobe sikhbo janina. Keno dokane dokane ekhon 'pepper spray' ? Lojja pabaro jeno ar jaiga nei. Phuler moton nispap sishuder jonyeo nirapod noi somoikal... ki aschoryo prithibite bosobas korchhi amra.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটাই তো ইচ্ছাডানা। আর দিন কে দিন কমার বদলে বেড়েই চলেছে। আমি সত্যি বলছি ভয়ে খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি।

      Delete
  12. কী মর্মান্তিক আজকের বিষয়!যতই মনে না করার চেষ্টা করি কোন না কোন ভাবে আলোচনাটা সামনে এসে পড়ে। রোজ পেপার খুললেই এক সংবাদ। বিদেশ থেকে কেউ ফোন করলেই এই কথা। জোর গলায় বলার চেষ্টা করি, কেন, তোদের ওখানে কি এসব খবর হয় না?কিন্তু গলা মিইয়ে যায়। নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হই। নারকীয়তা কি তুলনা করার বিষয়? সেদিন টিভিতে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠল সমাধানের উপায় কি। কোন শাস্তিতে এই মনোভাবকে রোখা যাবে? এইজন্য কারো তো মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হয়েছে। আমার একবার মনে হল, রেপিস্টের সামনে তারই স্ত্রী-বোনকে রেপ করে দেখিয়ে দাও যে এর ফলে যন্ত্রণা কি মর্মান্তিক হয়। কিন্তু তার পরেই নিজের মাথাটাই ঝুঁকে গেল এই ভাবনার জন্য। তবে সইতে সইতে মানুষ যদি এভাবেই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে, তাহলে ভবিষ্যতের পৃথিবী নিঃশ্বাস নেবার অবস্থায় থাকবে তো? কুন্তলা, মনে হয়না, সভ্যতার সংকটকে বাড়িয়ে তুলে এই রোগ সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে যাচ্ছে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. উপরোক্ত কমেন্টটি সম্পর্কে আমার একটা বক্তব্য আছে। আমি জানিনা এই চিন্তাটা অন্য কারও এসেছে কিনা, কিন্তু আমার ধারণা এই কথা কয়টা বলা প্রয়োজন। এই বিষয়টা নিঃসন্দেহে খুবই সংবেদনশীল এবং মর্মান্তিক, তাই কমেন্ট-লেখিকার আবেগ এবং অনুভূতির মর্যাদা দিতে চাই; কমেন্টটার মধ্যে যে নৈরাশ্য এবং বিষন্নতা ফুটে উঠেছে তা অনস্বীকার্য, এবং আমি নিশ্চিত যে এই ধরণের ঘটনার কথা প্রতিনিয়ত শুনতে শুনতে আমাদের অনেকেরই মনে এহেন হতাশার জন্ম হয়। কিন্তু সে সব কথা মেনে নিয়েও একটা বাক্যের প্রতিবাদ করছিঃ
      "আমার একবার মনে হল, রেপিস্টের সামনে তারই স্ত্রী-বোনকে রেপ করে দেখিয়ে দাও যে এর ফলে যন্ত্রণা কি মর্মান্তিক হয়।"
      এই মানসিকতা অত্যন্ত অন্যায্য, অসভ্য এবং ন্যক্কারজনক। কমেন্ট লেখিকাকে একা দোষ দিচ্ছিনা, কারণ এই মানসিকতার সঙ্গে আমি অপরিচিত নই। ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হবার পরে টাইম্‌স্‌ অফ ইন্ডিয়া-র ওয়েবসাইটে কমেন্টগুলো পড়লে সেখানে অনেক সময়ই এহেন কথা শোনা যায়। আমি বুঝি যে সেগুলো চরম নৈরাশ্যের পরিচায়ক, কিন্তু দুটো প্রয়োজনীয় কথা আমরা অনেকেই নৈর্ব্যক্তিকভাবে কমেন্ট করার সময় ভুলে যাইঃ
      (১) সেই স্ত্রী-বোন, তারা দাবার গুটি, পাশার ছক বা খেলার পুতুল নয়, তারা মানুষ; সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার তাদেরও আছে। তাই ধর্ষণকারীকে মানসিক যন্ত্রণা ভোগানোর উৎসাহে তাদেরকে এভাবে কষ্ট দেওয়া বা ব্যবহার করা, বা ব্যবহারের কথা চিন্তা করাটুকুও মানুষ হিসেবে আমাদের সবাইকে খাটো করে, ঘৃণার্হ করে তোলে।
      (২) আমাদের দেশে এবং অন্যান্য দেশে সংখ্যাতত্ত্ব বলে যে ধর্ষণের অনেক ঘটনা বা নজীর ঘটে বাইরের অচেনা আততায়ী দিয়ে নয়, তাতে নিজের পরিচিত পরিবারের লোকজন লিপ্ত থাকে। বৈবাহিক ধর্ষণ বা ম্যারাইটাল রেপ আমাদের দেশে অপরিচিত নয়, এবং খবরের কাগজ খুললে ঝুরিঝুরি উদাহরণ পাওয়া যায় নিকট আত্মীয় বা পরিবারের কাছের লোকের এহেন দুষ্কর্ম। সেই সব অপরাধীর তাহলে শাস্তি কিসে হবে?

      আমার ধারণা, আমার উপরোক্ত চিন্তাগুলো কমেন্ট-লেখিকার মাথায়ও এসেছে, এবং সেকারণেই তিনি তারপর লিখেছেনঃ
      "কিন্তু তার পরেই নিজের মাথাটাই ঝুঁকে গেল এই ভাবনার জন্য।"
      এই সুস্থ চিন্তাটুকুর জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।

      Delete
    2. আরেকটু কথা ছিল বাকি। আসলে শাস্তি দিয়ে ধর্ষণ-এর ঘটনা রোখা যাবে - এই চিন্তাটা আর চলছেনা, বলে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন। সমাজে ধর্ষণের মত অমানবিক অপরাধ কমাতে গেলে যে কয়েকটা পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন, তার প্রথম হলো - একদম শিশু অবস্থা থেকে ছেলেদেরকে শেখানো - বাড়িতে, স্কুলে, যেখানে সম্ভব - কয়েকটি কনসেপ্ট বা ধারণা, যেমন কনসেন্ট বা সম্মতি; ব্যক্তিগত সীমা বা পার্সোনাল বাউন্ডারি; ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখা, শুধু যৌনাঙ্গ-সম্বলিত শরীর হিসেবে না ভাবা; ইত্যাদি। এগুলো খুব কঠিন ধ্যানধারণা নয়, কিন্তু বারংবার করে দেখিয়ে-শিখিয়ে-বুঝিয়ে এগুলো মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে।

      এই কথা বললেই সাধারণত একটা ধুয়ো ওঠে, যে শুধু ছেলেদেরকে শেখানো হবে কেন। হ্যাঁ, এই ধারণাগুলো ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই দেওয়া উচিত, তবে ছেলেদের জন্য এগুলো বিশেষ প্রয়োজন কারণ আমাদের সমাজে ছেলেরা এখনো ডমিনেন্ট জেন্ডার, আমাদের সমাজে এখনো মহিলারা ইনহেরেন্টলি বা প্রকৃতিগতভাবে ক্ষমতাহীন। যৌন নিগ্রহের শিকার ছেলেরাও হয়, এবং তাদেরও নিরাপত্তা দেবার প্রয়োজন এবং দায়িত্ব সমাজের, কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে সেটা অত্যন্ত নগণ্য।

      দ্বিতীয়ত, আমাদেরকে এবং আমাদের সমাজকে এই তথাকথিত পুরুষত্বের সংজ্ঞাটা বদলাতে হবে। এই ছেলে-মেয়ে বিভাজন আমরা শুরু করি জন্মানোর পর থেকেই; এটা ছেলেদের রঙ, ওটা মেয়েদের রঙ। এটা ছেলেদের কাজ, ওটা মেয়েদের কাজ। ছেলেরা এরকম ব্যবহার করে, মেয়েরা ওরকম। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। এই কৃত্রিম বিভাজন, যা কিনা শুধু মানুষের মনেই নেই, সেটা সর্বত্র, দৈনন্দিন জীবন, খেলনাপাতি, প্রচারমাধ্যম, বিনোদন - সবকিছুর মধ্যে দিয়ে নিরন্তর প্রকাশ পাচ্ছে সমাজে, সেই বিভাজন আখেরে আমাদের ক্ষতি বই ভাল করেনা। এই বিভাজনটা আছে বলেই আমরা এখনও ধর্ষিত হবার দায়টা অক্লেশে মহিলাদের ওপর, তাদের ব্যবহার, বেশভূষা ইত্যাদির ওপর চাপিয়ে দিয়ে খুশী থাকি, কারণ "ছেলেরা তো এরকম করেই থাকে" - এই কদর্য ধারণাটা ছেলেদের পক্ষেও অত্যন্ত অবমাননাকর।

      তবে কাজটা কিন্তু সহজ নয়। ধর্ম এবং ঐতিহ্যের ধুয়ো তুলে আমাদের সমাজে অনেক কিছু চলে আসছে বহুযুগ থেকে, এবং সমস্ত গন্ডগোলের ব্যাপারের চাপটা দেখা যায় সেই মহিলাদের ঘাড়ে গিয়েই পরে - বিধবা মহিলারা নিরামিষ খাবে, উপোষ করবে আর কাশীতে গিয়ে থাকবে; রজঃস্বলা মহিলা মন্দিরে ঢুকবে না; পরিবারের সবাই খেতে বসলে, আগে ছেলেদেরকে বেড়ে খাওয়াতে হবে; পতি পরমেশ্বর, তার কথা অমান্য করা যাবেনা, সে যেরকম ব্যবহারই করুক না কেন, মহিলাদের পাপোষ হয়ে থাকতে হবে; পাণ্ডবদের উপর রাগ? নে দ্রৌপদীর কাপড় খুলে ভরা সভার মাঝখানে। পতি দু'চার ঘা বসিয়ে দিলেও নিশ্চুপে সহ্য করে যেতে হবে। গুষ্টির পিণ্ডি, নিকুচি করেছে। আর কতদিন?

      শুভবুদ্ধির উদয় হওয়াটা খুব মুশকিলের, কিন্তু এটা আমাদেরকে করতেই হবে - এক প্রজন্মে না হোক, দুই তিন চার প্রজন্মেও করতে হবে। নইলে মানুষ হিসেবে আমাদের জাতির বিপদ আসন্ন।

      Delete
    3. মালবিকা, আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। রেপ শব্দটা আমাদের মনে খুব স্ট্রং কিছু অনুভূতির জন্ম দেয়। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই।

      কৌশিক, প্রতিটি কথার সঙ্গে একমত। অনেক ধন্যবাদ সময় নিয়ে এত কথা বলার জন্য। আর শেখাতেও যেমন হবে, শিখতেও হবে। নিজেদের আচরণ, কথাবার্তা---সবকিছু খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার সময় এসে চলেও গেছে।

      Delete
  13. কিছু করার নেই দাদা ... এমন কি আমাদের বাংলাদেশে যারা পর্যটক আসেন ... তারা ইন্ডিয়া যেতে চাইলে আমাদের মনের মাঝে সবার আগেই মেয়েদের নিরাপত্তার কথা মাথায় আগে আসে । বিদেশী বন্ধুদের কষ্ট করেই বলতে হয় ... ইন্ডিয়া ইজ নট সেইফ রাইট নাও ... আমাদের মুভী গুলোতে কোন পেরেন্সিয়াল গাইডেন্স নাই ... আগামী ভবিষ্যৎ কিভাবে স্বাভাবিক মানসিকতা নিয়ে বড় হবে তা বলা মুশকিল ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. শ্রাবণ, আশা করতে তো দোষ নেই। আমি আশা করছি সবার মাথা খুলবে।

      Delete
  14. আমরা ভীষণ আশাবাদী, কুন্তলা. আমি তোমার জায়গায় থাকলেও ওই, "হুম, ইয়ে..." তেই উত্তর হত.
    আমার নিজের শহর, দেশ সম্পর্কে কখনো এইসব শুনতে ভালো লাগেনা. এই যে নর্থ ক্যারোলিনা তে আমাদের সুইত্কেস চুরি গেল, তা আমি কি রাজ্যের মার্কিন ধরে বলব, "ভাই, কি করা উচিত ছিল?"
    ই চলে যাবার সময় বাংলায়ে বলে উঠতে হত, "ইলিশ ও খাবে আর হাতে গন্ধও হবেনা, হয়? " (কি খারাপভাবে biased আমি!)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এঃ এটা এক্কেবারেই মানতে পারলাম না। মেঘবালিকার সঙ্গে একমত হয়েই বলি, হ্যাঁ উনি খুব খারাপভাবেই বায়াস্‌ড্‌ - হেহে :)

      একটা কথা প্লীজ্‌ খেয়াল করুন, কুন্তলা কিন্তু কখনোই যেচে নিজের দেশের নামে গালমন্দ করতে যায়নি। তাকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছিল একটা বিশেষ অবস্থার সম্পর্কে। কুন্তলা অন্ধ বা বধির নয়, নির্বোধ তো নয়ই - সুতরাং তার পক্ষে সঠিক অবস্থার সম্পর্কে সঠিক উত্তর না দেওয়াটা অনৈতিক এবং অন্যায় হত।

      চুপ করে থাকার একটা সময় আছে, এবং আওয়াজ ওঠানোরও একটা সময় আছে, কিন্তু আমাদের সমাজের যে কাল্‌চার অফ সাইলেন্স বিদ্যমান, সেটা আমাদের সমাজের ক্ষতি বই ভাল করে না। শুধু আমাদের সমাজে কেন, পৃথিবীর যে যে সমাজব্যবস্থায় এটা আছে, সেখানেই ক্ষতিকর।

      নর্থ ক্যারোলিনায় আপনার স্যুটকেস চুরি গেছে জেনে দুঃখিত হলাম। কিন্তু রাজ্যের মার্কিন ধরে আপনি যেমন জিজ্ঞেস করবেন না বোকার মত, ঠিক তেমনি কুন্তলার বিদেশিনী বান্ধবী কিন্তু রাজ্যের ভারতীয় ধরে ধরে জিজ্ঞেস করেনি। কুন্তলাকে বন্ধু বলে মনে করেছে বলেই সন্তর্পনে জিজ্ঞেস করে নিয়েছে। এবং কুন্তলাও মিথ্যার সাহায্য না নিয়ে যতটা আলোকদান করা যায়, তাই করেছে। বেশ করেছে।

      Delete
    2. দেবিকা, আমিও আশাবাদী। আমিও চাই আমার দেশ সবার সেরা হোক। দেশকে ডিফেন্ড করার জায়গাটা খুব গোলমেলে আসলে। অনেকটা নিজের বাচ্চার মতো। আমার বাচ্চার নিন্দে আমি যতখুশি করব। কিন্তু পড়শি একটা ন্যায্য কথা বললে চেঁচিয়ে উঠে বলব, নিজের চরকায় নিজে তেল দাও।

      আমি কৌশিকের সঙ্গে একমত। এই পদ্ধতিতে বাচ্চার আদতে ক্ষতি বই লাভ হয় না।

      Delete
    3. Amio Koushik er shonge ekmot. Ami motei nijer biased howa justify korchhina. Ota just bolar jonyo bollam. Orom hoy? :)

      Delete

Post a Comment