বাগানের গেট



আগেই বলেছি, আমার অফিসের পেছনদিক দিয়ে গেছে একটা রেললাইন আর রেললাইনের ওপারে আছে একটা ঘন বন। বনের ভেতর দিয়ে সরু নুড়ি বিছোনো পথ। পরীক্ষা দিতে গিয়ে ওই পথে ঢুকেই আমাদের বুক শুকিয়ে এসেছিল। তখন অন্য কিছু ভাববার সুযোগ বা মেজাজ কোনওটাই ছিল না, তাই ভাবিনি। কিন্তু একটা ছোট্ট জিনিসের কথা মাথার ভেতর পুরে নিয়ে এসেছিলাম। সেই জিনিসটার কথাই এখন বলব আপনাদের।

বনের ভেতর পথের ধারে বাগানের কথা বলে ছিলাম মনে আছে? সেই যে প্লট করে করে বিক্রি করা বাগান? ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকা গৃহস্থদের জন্য, যাঁদের সাধ আছে কিন্তু জায়গা নেই, তাঁদের জন্য দারুণ ভালো ব্যবস্থা। বাগানের ভেতর উঁকি মেরে যতদূর চোখ যায় রংবেরং ফুলের গাছ তো দেখলামই, আরও দেখলাম মাচার ওপর সতেজ লাউডগা সামারের রোদ পেয়ে লকলকিয়ে উঠেছে। লাউ না হোক, লাউয়ের জার্মান ভায়রাভাই। মাচার ওপর হলুদ ফুল ফুটে আছে, আমাদের বকফুল যেমন থাকে। ঠাকুমা হাতের কাছে এ রকম একটা বাগান পেলে আনন্দে কী রকম আত্মহারা হতেন সেই ভেবে মুখটা আপনা থেকে হাসিহাসি হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু লাউডগা আর বকফুলের থেকেও আমার চোখ বেশি টেনেছিল বাগানের গেটটা। বিরাট সিংহদুয়ার গোছের কিছু নয়। গা বেয়ে মাধবীলতাও ওঠেনি, দরজার ওপরে উল্টোনো চাঁদের মতো গ্রিলের অক্ষর দিয়ে গার্ডেন সোসাইটির নামও লেখা নেই। পেরেক মেরে কাঠের পাটাতন জুড়ে বানানো সামান্য একটা দরজা। কতই বা উঁচু হবে, খুব লম্বা লোক হলে বড়জোর কোমর পর্যন্ত।

অনেক বছর আগে আমাদের বাড়ির গেটটা ঠিক যেমন ছিল।

কোন স্মৃতি যে আমাদের মনে থাকে আর কোনটা যে বেমালুম হাওয়া হয়ে যায় তার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। বাড়ি বললেই আমার মনে পড়ে সাদার ওপর সরু নীল বর্ডার দেওয়া একটা জিনিস, এদিক ওদিক যেমন তেমন পুঁতে দেওয়া একগাদা গাছের জঙ্গল, ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা কতগুলো নারকেল সুপুরির মাথার ভেতর দিয়ে দেখা যাওয়া চেরা নীল আকাশ আর এই সবকিছুকে আগলে থাকা একটা পাঁচিল। তারও রং সাদানীল। বাড়ির সামনের অংশটুকুতে আবার পাঁচিলের গায়ে কায়দা করে লম্বাটে কলসির মতো কী সব বসানো রয়েছে।

এই এত লক্ষ মাইল দূরের বনের ভেতরের একটা নামহীন বাগানের গেট দেখে যে সেই সাদানীলের স্মৃতি সরিয়ে দিয়ে অন্য কিছু মাথার ভেতর টুকি দেবে কে জানত? আমি যখন ভীষণ ছোট ছিলাম তখন কোথায় ছিল এই পাঁচিল, কোথায় ছিল পাঁচিলের গায়ে কলসি। তখন আমাদের হলুদ রঙের একতলা বাড়ির চারপাশ ঘিরে ছিল বুকপর্যন্ত লম্বা ঘন সবুজ বেড়া। বেড়ার ফাঁকে একটা বাঁশের কঞ্চির দরজা দিয়ে আমরা যাতায়াত করতাম। দুদিকে শক্ত মোটা বাঁশের ফ্রেমে সেই দরজা আঁটা ছিল। বাড়ির দিকে মুখ করে দাঁড়ালে সবথেকে বাঁ পাশের কঞ্চির মাথায় একটা নারকেল দড়ির ফাঁস পরানো থাকত। সেটা নিয়ে বাঁশের গায়ে আটকে দিলেই গেট বন্ধ, কোনও গরুর চোদ্দপুরুষের সাধ্য নেই গেট পেরিয়ে ঢুকে ঠাকুমার সাধের টমেটোচারা মুড়িয়ে খেয়ে যায়।

-আচ্ছা ঠাকুমা, গরুরা বেড়ার গাছগুলো চিবিয়ে খায় না কেন?

-ধুর ও গাছ কি খাবার মতো? ও পাতা ভয়ানক তেতো। গরু বলে কি যা খুশি খাবে নাকি? গরুতে খায় না বলেই তো ওই গাছ দিয়ে বেড়া বাঁধা হয়।

বলে টগরফুল তোলা থামিয়ে পটাস করে বেড়ার পাতা ছিঁড়ে ঠাকুমা আমার হাতে দিতেন। বলতেন শুঁকে দেখতে। শুঁকেই আমার মুখ ছেতরে যেত। সত্যিই পাতাগুলো ভীষণ মোটা মোটা আর তেতো গন্ধওয়ালা। গরুদের এ জিনিস ভালো লাগার কোনও কারণই নেই।

পাড়ার বেশিরভাগ বাড়িতেই তখন বেড়ার পাঁচিল ছিল। শম্ভু গরানের জমি তখন সবে প্লট করে বিক্রি শুরু হয়েছে, খাঁ খাঁ মাঠের ধারে দাঁড়ালে ইতিউতি দুয়েকটা বাড়ির ভিত দেখা যায়। কোনও বাড়ির ভিত শেষ হয়ে খানিকটা দেওয়াল গাঁথা হয়েছে। চারধারে ইঁটের পাঁজা। দূর থেকে দেখলে অনেকটা ইতিহাস বইয়ের হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়োর ছবির মতো লাগে। গরমের নিস্তব্ধ দুপুরে লরি করে ইঁট আসত। ইঁট নামাতে গিয়ে মজুরেরা মাধুরীপিসিদের বাড়ির বেড়া ভেঙে দিয়েছিল বলে মাধুরীপিসির মা কী রকম চেঁচিয়েছিলেন সেটা এখনও মনে আছে। মজুরগুলো অবশ্য একটুও ঘাবড়ায়নি, দাঁত বার করে হাসছিল শুধু।

আমাদের বাড়ির বেড়াও জখম হত মাঝে মাঝে। গোপাল আসত বেড়া বাঁধতে। গোপালের তখন কতই বা বয়স হবে, ম্যাক্সিমাম পনেরো। আমি ঠাকুমার কোলে বসে বেড়া বাঁধা দেখতাম। ঠাকুমা গল্প বলতেন। কেমন করে রামপ্রসাদের বেড়া মাকালী কবির মেয়ের রূপ ধরে এসে বেঁধে দিয়েছিলেন। এর পরেও যারা বলে ভগবান বলে কিছু নেই, তারা বদ্ধপাগল নয় তো কী?

তারপর শম্ভু গরানের জমির শেষ প্লটটাও বিক্রি হয়ে গেল। আমাদের সামনের ফাঁকা জমিটায় শেষবারের মতো ন্যাড়াপোড়া হয়ে, দোলের ঠিক পরপরই বুবুনদের বাড়ির ভিতপুজো হল। বাড়ি যখন হচ্ছিল তখন পাড়ার সবাই বলাবলি করত কিছু আধুনিক কায়দার বাড়ি হচ্ছে বটে। বাড়ি বানানো শেষ হলে তুমুল ঘটা করে গৃহপ্রবেশ করলেন ঠাকুরকাকু। পাড়ার সবাই নেমন্তন্ন খেয়ে ধন্যধন্য করল। কয়েকমাস পর কাকিমার দেশীবিদেশী ফুলগাছের টব বাঁচাতে বাড়ির চারপাশে কাকু একমানুষ উঁচু ইঁটের পাঁচিল তুলে দিলেন।

লোক আর সেফটির সম্পর্কটাই এমন যে একটা বাড়লে অন্যটা কমে। আমাদের বাড়িও ততদিনে ভোল পালটাতে শুরু করেছে। কোণের পেয়ারাগাছটা কেটে সিঁড়ি উঠেছে, রান্নাঘরের অ্যাসবেসটসের ছাদ ঢালাই হয়েছে। কয়েকবছর পর সেফটির মুখ চেয়ে বেড়া উড়িয়ে দিয়ে পাঁচিল বসালেন বাবা। প্রথম দিন স্কুল থেকে ফিরে গ্রিলের গেট দেখে কী রকম অদ্ভুত লেগেছিল মনে আছে। আমাদের আগের বাঁশের গেট খুলতে বন্ধ করতে কত আরাম, তার বদলে এ কী বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।

সময়ে সব সয়, গ্রিলগেট শুদ্ধু। এই এত বছর পরে সেদিন বাগানের ওই গেটটা না দেখলে আমার সেই বেড়ার পাঁচিল আর কঞ্চির গেটের কথা মনেই পড়ত না। আর দেখুন গেটের সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে কত কথা মনে পড়ে গেল যাদের একে অপরের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই, গেটের সঙ্গে তো নেইই। শম্ভু গরানের জমি, মাধুরীপিসির মা, ন্যাড়াপোড়া। স্মৃতি ব্যাপারটা কীভাবে কাজ করে ভগবানই জানেন। অনেক ভেবে একটা মিল পেলাম অবশেষে। এরাও নেই হয়ে গেছে অনেকদিন হল, বেড়ার গায়ে কঞ্চির গেটের মতো। 


Comments

  1. Yaadein mithai ke dibbe ki tarah hoti hai...ek baar khula, to sirf ek tukra nahin kha paoge...
    :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ, দারুণ কোটেশন তো। কে লিখেছে, আপনি নাকি?

      Delete
    2. yeh to chinema ta dialogue hai :)

      Delete
    3. Dhur..ami likhini..cinemar dialogue..ebar bolte hobe kon cinemar..eta amar quiz.. :D

      Delete
    4. আমি অবভিয়াস উত্তরটাই দিচ্ছি। ইয়াদেঁ, সুভাষ ঘাই পরিচালিত। ঠিক হল?

      Delete
    5. Daha fail merechen...sothik uttor holo Yeh Jawaani Hai Deewani..darun ekta gan dia ai dialogue gulo dia cinema ta suru hochhe...movie ta amar khub bhalo legeche...parle dekhe felun..

      Delete
  2. post ta porey amar arekta choto gate er katha mone pore gelo...tar jaygay ekhon ya boro loha'r deyal....phonkor e tool niye society'r uniform pora darowan babaji boshe thaken :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. সব ছোট গেটেরই একদিন ওই পরিণতি হতে চলেছে শম্পা। ভবিতব্য। এড়ানোর উপায় নেই।

      Delete
  3. Khub sundor hoyechhe lekhata Kuntala di. :)

    Amar kolkatar byasto rastar modhye chhotto neel griller dorjatar kotha mone poriye dile. Ekhon boka typer ekta flat baritey thaki. Purono barir aam gachh kete jhinchak marble bosano ghor banano hoyechhe. Kintu sotyi kotha bolte ki, ekhono purono barir neel griller gate ta dekhle jerom "bari!" mone hoy amar, seirom ar kichhuti dekhle hoy na. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ বিম্ববতী। এই হয়। বাসা বদলায়, বাড়ি বদলায় না। ওটা একটাই থাকে, সারাজীবন। বোকা টাইপের বাড়ি---ফ্রেসটা মনে ধরল বেশ।

      Delete
  4. Amake anek kichu mone koriye dile toh. amadero aage orokom bera deoa chilo mehndi gachh er. shei pata diye ami r amar bandhobira ki ghota kore anari haate deshlai kathi diye joborjong design aanktam. r thik bolecho, amio mamabari theke phire ese dekhechilam grill er gate, amaro khub odbhut legechilo. ajker aage obdi toh oi bera'r katha bhulei gechilam!

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখেছ কতকিছু মিলে গেল টিনা। ছোটবেলা থেকেও তোমার বেশ আর্টে ঝোঁক ছিল দেখছি। গুড গুড।

      Delete
  5. Replies
    1. আরে ধন্যবাদ ধন্যবাদ।

      Delete
  6. তোমার লেখা না সত্যি দারুন.....এটা পড়ে আমার ও কত কিছু মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলার.... উঠোন- বাগান-আর দিদা.....কত কিছু হারিয়ে যায় না জীবন থেকে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. তেমনি হয়ত নতুন নতুন অনেক কিছু জীবনে এসে জোড়েও দেবশ্রী। না হলে তো বাঁচা মুশকিল হত।

      Delete
  7. Replies
    1. থ্যাংক ইউ সুমনা।

      Delete
  8. Ki sundor likhechho. Thik eirakom ekta gate amader barir o chhilo ar ekhon sekhane inter pnachil ar lohar gate. oi Konchir berar ga e lagano chhilo mehendi r gachh. onek purono kotha mone korie dile Kuntala.

    ReplyDelete

Post a Comment