মাকড়সা, মেলা আর ব্র্যাটউর্স্ট



বনে ফেরার পর তেরাত্তির কেটে গেছে। এবারের বনবাসে ফ্রাউ বার্শের গেস্টহাউস নেই, গেস্টহাউসের গা বেয়ে উঠে যাওয়া পাহাড় নেই, পাহাড়ের গায়ে জঙ্গল নেই, জঙ্গলের ভেতর খুদে খুদে রোমশ মাকড়সার ছানাপোনাও নেই যে থিয়াগোর ঘরের জানালা খোলা পেয়ে তারা গুটিগুটি ঘরের ভেতর ঢুকে আসবে। চারপাশ সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে মাথা নেড়ে বলবে, “এতদিনে সব ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। এমন আলোবাতাসহীন বদ্ধ ঘরে থাকে বলেই তো মানুষের ছানাদের মোটে চারটের বেশি হাত-পা গজায় না।”

এই দু’সপ্তাহের জন্য অ্যালফনস আমাদের যেখানে থাকার ব্যবস্থা করেছে সে বাড়িটা দেখলে মাকড়সার ছানার মানুষের প্রতি আরও করুণা বাড়ত বই কমত নাশহরের একেবারে মধ্যিখানে একটা হোটেল। কষ্টমষ্ট করে শরীরটাকে হোটেলের বাইরে কোনওমতে টেনে বার করতে পারলেই দু-দু’খানা সুপারমার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড, পোস্টঅফিস, লাইন দিয়ে অ্যালবেনিয়ান থেকে জুলু কুইজিনের রেস্টোর‍্যান্ট, জামাকাপড়ের ব্র্যান্ডেড দোকান, দোকানের গায়ে ক্রিসমাসের ঝিংচ্যাক আলো---সব মিলিয়ে জায়গাটা যাকে বলে হ্যাপেনিং-এর ঠাকুরদাদা।

আমাদের অফিসের বাইরেটাও বদলে গেছে। আড়াই মাস বাদে মিউজিয়ামস্‌মাইলি-র (মাইলখানেক রাস্তার এপাশ ওপাশ জুড়ে লাইন দিয়ে মিউজিয়ামের পর মিউজিয়াম বলে স্টেশনের ওই নাম) মেট্রোর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই বদলটা টের পাচ্ছিলাম। এই ডিসেম্বরের বাজারে আলোর এত তেজ তো স্বাভাবিক নয়। জুলাই-আগস্টের চনমনে সামারে এই রাস্তার হাবভাবই তো কেমন ছায়াঘন রূপসীর রহস্যময়তায় ঢাকা থাকত, হঠাৎ হল কী? ফুটপাথে উঠে বুঝলাম কী হল। শীত এসে রাস্তাশুদ্ধু গাছের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে। রোগা রোগা কালো ডালপালার হাত পা ছড়ানোই সার হচ্ছে শুধু, সূর্যের আলো তাদের প্রতিরোধের তোয়াক্কাও না করে সোজা নেমে এসে ফুটপাথ ভাসাচ্ছে।

প্যারিসের ফুটপাথে হেঁটে আসার পর সে আলোয় ভাসা ফুটপাথ দেখে চোখের যা আরাম হচ্ছে, বলার নয়। মনে হচ্ছে দরকার হলে কাঁধের গামছাখানা দিয়ে ওপরওপর ধুলো ঝেড়ে এর ওপর শুয়ে পড়ে রাত কাবার করতে পারি। কী চওড়া, কী পরিষ্কার, কী নিরিবিলি। অফিসটাইমে যা একটু লোকের ভিড়, বাকি সময় খাঁ খাঁ ফুটপাথ গা এলিয়ে পড়ে আছে।

বনের মূল চত্বর, যেখানে বিঠোভেনের মূর্তি বসানো আছে, সে জায়গাটা অবশ্য আর নিরিবিলি নেই। সেখানে ক্রিসমাস মার্কেট বসেছে। আমি কেশে কেশে কাবু বলে এখনও ভালো করে ঘুরে দেখতে পারিনি, ছবি তোলা তো দূর অস্ত। নাহলে আপনাদের বিফোর অ্যান্ড আফটার ফোটো দেখাতে পারতাম। ওপর ওপর দেখে যা বুঝলাম একেবারে আমাদের মাহেশের রথের মেলার মতো ব্যাপার। মাহেশের থেকে লোক সামান্য কম এই যা। তাছাড়া এখানেও পথের ধারে দোকানে লাইন দিয়ে লাল জামা পরা পুতুল, কানের দুল, ট্রাই-সাইকেলের চাকার সাইজের চিজ হুইল---তাসের ঘরের মতো একটা আরেকটার ওপর চুড়ো করে সাজানো। একটা ফাঁকা দোকানের সামনে একটা অল্পবয়সী মেয়ে বসে আছে, মেয়েটার সামনে একটা ফাঁকা চেয়ার আর একটা কাঠের হোল্ডারে একটা সাদা আর্টপেপার লটকানো। আপনি ওই ফাঁকা চেয়ারটায় গিয়ে বসলে মেয়েটা আপনার ছবি এঁকে দেবে। তখনও কেউ আসেনি ছবি আঁকাতে। অবশ্য যখনকার কথা বলছি তখনও খটখটে দুপুর, মেলা তখনও জমতে দেরি আছে। সন্ধ্যেবেলা যখন মেলা তুঙ্গে উঠবে, তখন আশা করা যায় মেয়েটার চেয়ারে বসার জন্যও লোকের লাইন পড়বে।

যেন পড়ে, যেন পড়ে।

মেয়েটার দোকানে ভিড় হয়নি বলে যে সব দোকানেই শ্মশানের নিস্তব্ধতা তেমন নয়। মেলার মাঝেমাঝেই ছড়ানোছেটানো পালিশ-করা মেহগনি রঙের তিনকোণা ছাদওয়ালা দোকান, দোকানের মাথার ওপর কায়দা করে লেখা Grillhausঅবশ্য নাম ব্যাপারটা পুরোটাই বাহুল্য, কারণ দোকানটা কীসের সেটা জানার জন্য নাম পড়ার দরকার নেই, মাইলখানেক দূর থেকে গন্ধ শুঁকেই বলে দেওয়া যাবে। লম্বাটে গ্রিল উনুনের ওপর অন্তত পাঁচ থেকে সাত রকমের বিভিন্ন আকৃতি ও আয়তনের সসেজ শুয়ে আছে। আর আছে ব্রেড আর পটেটো। এই তিনের পারমুটেশন কম্বিনেশনে যত রকমের খাবার হওয়া সম্ভব, যে কোনওরকম আপনি অর্ডার করতে পারেন। “কারিউর্স্ট খাব” বললে দোকানি এসে শুয়ে থাকা সসেজের মধ্যে বেছে একটাকে তুলে নিয়ে কুচিকুচি করে কেটে তার ওপর লাল রঙের ঝোল ঢেলে, সসেজের টুকরোয় একখানা টুথপিক গুঁজে আপনার দিকে প্লেট এগিয়ে দেবে। “ব্র্যাটউর্স্ট চাই” বললে প্লেটের বদলে পাঁউরুটি পাবেন। ব্র্যাটউর্স্ট ব্যাপারটা টেকনিক্যালি অ্যামেরিকান হটডগের মতো, ফারাকটা হচ্ছে পাঁউরুটির সাইজে।

উৎস গুগল ইমেজেস

প্রথমদিকে ক্যামিলা সসেজ এবং ব্রেডের আয়তনের অসামঞ্জস্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করায় রেগিনা খুব অবাক হয়ে বলেছিল, “বাট দ্য ব্রেড ইস দেয়ার জাস্ট টু হোল্ড দ্য সসেজ, ইট’স লাইক...ইট’স লাইক...”

“লাইক আ ন্যাপকিন?”

“গেনাও। এক্স্যাক্টলি। ইট’স দেয়ার সো দ্যাট ইউ ডোন্ট বার্ন ইয়োর ফিংগার।”

প্ল্যানপ্রোগ্রাম অলরেডি শুরু হয়েছে। মেলায় যাওয়ার, ব্রেডের ন্যাপকিনে মোড়া ব্র্যাটউর্স্ট খাওয়ার, সময় পেলে মেয়েটার দোকানে গিয়ে নিজেদের পোর্ট্রেট আঁকানোরও। যাওয়া হলে ছবি তুলে এনে আপনাদের দেখাব। প্রমিস।

Comments

  1. বাকফিশ-টা খেও কিন্তু! আর মাশরুমটাও! এবং যদিও সন্দেহ হয় তুমি ও রসে বঞ্চিত, কিন্তু ধোঁয়া ওঠা গরম গ্লু ওয়াইন কিন্তু ওয়ান অফ আ কাইন্ড অভিজ্ঞতা! ওটা জার্মানির ক্রিসমাস স্পেশাল :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা শীর্ষ, সন্দেহ একেবারে নির্ভুল। বিশ্বাস করুন আমি চেষ্টা করেছি রসিক হওয়ার, কিন্তু বড় গন্ধ। বাকফিশ খাব, মাশরুমটাও বলছেন যখন খাব। Postdamer Fair-এ গিয়ে আমার বন্ধুদের মাশরুম খেয়ে আহা-বাহা করতে শুনেছি, কিন্তু "ধুর মেলায় এসে আবার কে ব্যাঙের ছাতা খায়" ভেবে আমি নিজে খাইনি। এবার সেটার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে দেখছি।

      Delete
  2. গাছের পাতা ঝরে গেলে সব কিরকম পাল্টে যায় তাই না? বিফোর এন্ড আফটার ফটো দেখার অপেক্ষায় রইলাম। আর পাঁউরুটিকে ন্যাপকিনের মতন ব্যবহার করবার ধারনাটাও বেশ মজার।

    ReplyDelete
    Replies
    1. জার্মান আইডিয়ার ব্যাপারই আলাদা। ছবি তোলবার জন্য আমিও মুখিয়ে রয়েছি সুগত।

      Delete
  3. খুদে রোমশ মাকড়সার ছানাপোনার পর্যবেক্ষণ - অসাধারণ। সবাইকার মতন ছবির অপেক্ষায় রইলাম :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা ইচ্ছাডানা, আমি দুশো শতাংশ শিওর মাকড়সার ছানারা ওই কথাগুলোই বলে। আমিও ছবি তোলার অপেক্ষায় রয়েছি। তুললেই আপনাদের পাকড়াও করে দেখিয়ে দেব।

      Delete

Post a Comment