ব্ল্যাংকেনহাইম




টর্চ শুনে আমি সিরিয়াসলি ভেবেছি আমাদের বাড়িতে যে রকম ছিল, সে রকম। দু’ব্যাটারির, লালরঙের গায়ে কালো রঙের সুইচ। বুড়ো আঙুল দিয়ে সুইচ ঠেললে আলো জ্বলে, টানলে নিভে যায়। হাত দিয়ে আলোর মুখ চেপে ধরলে চার আঙুলের ফাঁক দিয়ে লাল আভা বেরিয়ে আসে, ঠিক যেন ঠাণ্ডা আগ্নেয়গিরি। লোডশেডিং-এ চিবুকের তলায় সে আলো জ্বালিয়ে হাসিমুখে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে অতি সাহসী জ্যাঠতুতো দিদিরও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয়।


ব্ল্যাংকেনহাইমে পৌঁছে দেখলাম এ টর্চ অন্য টর্চ। অ্যালফন্‌সের ই-মেলে লেখাই ছিল বন থেকে বাসে চেপে ব্ল্যাংকেনহাইম পৌঁছতে বিকেল চারটে বেজে যাবে, আর এ তল্লাটে আজকাল বিকেল চারটে মানে আসন্ন সন্ধ্যে। তাছাড়াও আইফেল পাহাড়র গায়ে গোঁজা ব্ল্যাংকেনহাইম দেখতে গেলে ছোটখাটো একটা হিল স্টেশনই বলা চলে, কাজেই ঠাণ্ডাও নাকি পড়বে বেশ। ই-মেলে স্পষ্ট বলা ছিল, ঠাণ্ডার মোকাবিলার দায়িত্ব যার যার নিজের, অন্ধকার মোকাবিলার জন্য কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে টর্চ সরবরাহ করা হইবেক।


ড্রাইভারের আনাড়িপনার জন্য চারটের বদলে আমাদের পৌঁছতে বেজে গেল চারটে পনেরো, আর সেই পনেরো মিনিটের দুশ্চিন্তায় অ্যালফন্‌সের মাথার আরও অন্তত পনেরোখানা চুল সাদা হয়ে গেল। “আই ডোন্ট লাইক দিস। আই ডোন্ট লাইক দিস্‌ অ্যাট অল। এভরিথিং শুড বি পারফেক্ট। এভরিবডি শুড বি অন টাইম।” অ্যালফনসের অবিশ্রান্ত মাথা নাড়া আর বিড়বিড়ানির মধ্যেই বাস হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল জনপ্রাণীহীন একটা রাস্তার মধ্যিখানে। জানালার কুয়াশালাগা ঝাপসা কাঁচের ভেতর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখি ফাঁকা রাস্তার পাশে খাঁ খাঁ একখানা বাসস্ট্যান্ড, অর্থাৎ কিনা “এইখানে বাস থামবে” লেখা একখানা ব্যানার আর সেই ব্যানারের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের বাস লক্ষ্য করে হাত নাড়ছে একটা লোক, লোকটার হাতে একটা প্লাস্টিকের থলে।

বাস থেকে নেমে অ্যালফনস্‌ আলাপ করিয়ে দিল। ইনি হচ্ছেন হের শ্‌মিড্‌। গাইড বললে গাইড, কর্তৃপক্ষ বললে কর্তৃপক্ষ। হের শ্‌মিডের হাতের থলে থেকে বেরোল আমাদের টর্চ। হাত তিনেক লম্বা ডাণ্ডার গায়ে মোম আর কাপড় জড়ানো। নিচের ছ’ইঞ্চি হাত দিয়ে ধরার জন্য খালি রাখা, কাপড় জড়ানো অংশের সঙ্গে তফাৎ বোঝানোর জন্য ডাণ্ডা ঘিরে একটা গোল কাগজ। আগুনের ফুলকি উড়ে এসে হাতের ওপর জুড়ে বসা ঠেকাতে সে কাগজ কাজে দেবে।


ততক্ষণে সন্ধ্যে নেমে এসেছিল। স্ট্রিটলাইটের গল্প নেই ব্ল্যাংকেনহাইমে, দু'চারটে বাড়ির জানালার ভেতর থেকে যে আলো দেখা যাচ্ছে, তাতে পথ চলা যায় না। আমরা যে যার টর্চ জ্বালিয়ে নিয়ে হের শ্‌মিডের পিছু নিলাম। হের শ্‌মিড্‌ ব্ল্যাংকেনহাইমে ইতিহাস বলতে লাগলেন। শতশত বছর আগে ব্ল্যাংকেনহাইম ছিল স্থানীয় কাউন্টির রাজধানী। রাজধানীতে রাজা ছিলেন, রাজার থাকার জন্য রাজপ্রাসাদও ছিল। সে প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ এখনও দেখা যায়। প্রাসাদের ভালো অংশটুকু সারিয়ে ইউথ হোস্টেল বানানো হয়েছে।

ফরাসি বিপ্লবের সময় পর্যন্ত ব্ল্যাংকেনহাইমের রাজারা বেশ শান্তিতেই ছিলেন। প্রজাদেরও যে তাঁরা খুব অশান্তিতে রেখেছিলেন তেমন সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। বাচ্চাদের পড়তে পাঠানোর জন্য স্কুল খোলা হয়েছিল, পাহাড় কেটে জল আনানেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। ব্ল্যাংকেনহাইমের পাহাড়ের মাথায় যে জলব্যবস্থার ভাঙাচোরা প্রমাণ এখনও দেখতে পাওয়া যায়।


কিন্তু বিপ্লবীদের সে কথা কে বোঝাবে। সাম্য, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্বের প্রকাণ্ড সব আইডিওলজির ঝড়ে ছোট্ট ব্ল্যাংকেনহাইমের তুচ্ছ প্রগতি আর ভালো-থাকা শুকনো পাতার মতো উড়ে গেল। তবে ব্ল্যাংকেনহাইমের রাজারা দুর্বল হলেও বোকা ছিলেন না, হাওয়া কোনদিকে ঘুরতে চলেছে সেটা আঁচ করতে তাঁদের কষ্ট হয়নি। গিলোটিন ঘাড়ে করে বিপ্লবীরা হইহই করে এসে পড়ার আগেই তাঁরা পালালেন বাভারিয়ায়।

আর সেই শুরু হল ব্ল্যাংকেনহাইমের বাসিন্দাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ট্র্যাডিশন। ব্ল্যাংকেনহাইম শব্দের মানেই হল ব্ল্যাংক হোম, খালি বাড়ি। এমন সার্থকনামা জায়গা আমি কমই দেখেছি। পাথর বাঁধানো রাস্তার পাশে সারি সারি হাফ-টিম্বারড বাড়ির বেশিরভাগই খালি। আশেপাশের দু-চারটে পাহাড় মিলিয়ে গোটা মিউনিসিপ্যালিটিতে এখন পড়ে আছে আটহাজারের মতো লোক, যাদের বেশিরভাগই বুড়োবুড়ি। নতুনেরা বাড়ি খালি করে চলে গেছে অন্য কোথাও, যেখানে শহর বাড়ছে, কাজ বাড়ছে, ভিড় বাড়ছে। যেখানে সন্ধ্যে ছ’টা বাজতে না বাজতে সবাই ঘরের দরজা টেনে ঘুমিয়ে পড়ছে না।


আমাদের হের শ্‌মিড্‌ অবশ্য ব্যতিক্রম। পঞ্চাশ বছরের জীবনের বেশিরভাগটাই ব্ল্যাংকেনহাইমের পাহাড়ের খাঁজেভাঁজে কেটেছে তাঁর। বাবা স্কুলমাস্টার ছিলেন, হের শ্‌মিডও স্কুলে পড়ান। ইতিহাস আর ইংরিজি। পড়িয়েশিখিয়ে ব্ল্যাংকেনহাইমের ছেলেপুলেদের ডানা শক্ত করেন, যাতে সময় হলেই তারা আইফেল পাহাড়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে উড়ে যেতে পারে।


হের শ্‌মিড্‌ পথ দেখিয়ে আমাদের নিয়ে গেলেন পাহাড়ের চুড়োর প্রাসাদে। মনের ভেতর বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের অনুভূতি হচ্ছিল। ওই কাদামাখা চড়াই রাস্তায় হের শ্‌মিড্‌ অত হনহনিয়ে হাঁটছিলেন কী করে কে জানে। এক হাতে মশাল নিয়ে তাঁর সঙ্গে তাল রাখতে আমাদের ওই ঠাণ্ডাতেও ঘাম ছুটে যাচ্ছিল। চলতে চলতেই পেছন থেকে হঠাৎ দেখি একজোড়া হেডলাইট এসে আমাদের গায়ের ওপর পড়েছে। মশালের জটলা সুসংবদ্ধ দু’সারিতে ভাগ হয়ে গিয়ে রাস্তা করে দিল, আর মাঝখান দিয়ে একটা পুরোন লজঝড়ে গাড়ি চেপে চলে গেলেন ব্ল্যাংকেনহাইমের চার্চের সিস্টার। চলে গেলেন বলাটা অবশ্য ঠিক হল না, যেতে যেতে গাড়ির জানালা নামিয়ে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করলেন, হের শ্‌মিড্‌কে দেখে গাড়ি থামিয়ে আলাপ করলেন---আলাপচারিতার মধ্যে খালি “ইংলিশ গ্রুপ” কথাটা আমার মগজে ঢুকল।


পাহাড়ের মাথায় যখন পৌঁছলাম তখন মশালের আলো ছাড়া একে অপরের মুখও দেখতে পাচ্ছি না আমরা কেউ। আকাশে একটাও তারা নেই, হলুদ টিপের মতো চাঁদ খালি ভেসে আছে। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে চাঁদটাকে কত কাছে দেখতে লাগে, পাহাড়ের চুড়োয় উঠে সেটাকে অত দূরের মনে হচ্ছিল কেন কে জানে। দলের কেউই বেশি কথা বলছিল না। অ্যালফন্‌সের সঙ্গে এটাই আমাদের শেষ ট্রিপ। আর এক সপ্তাহ বাদে এই সময় ক্যামিলার প্লেন অলরেডি ব্রাসিলিয়ার দিকে রওনা দিয়েছে, ফাউজির প্লেন উড়ে চলেছে জাকার্তার দিকে। সবাই কি সেই কথাই ভাবছিল? কে জানে। ঠিক এমন সময় চার্চের ঘণ্টা বেজে উঠল। ঢং ঢং ঢং। আকাশ, জঙ্গল, পাহাড়, আর পাহাড়ের কোলে বিস্মৃত ব্ল্যাংকেনহাইমের খালি বাড়ির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফেরা সে শব্দের সাগরে ডুবে গিয়ে, চারদিক থেকে ঘিরে আসা উঁচু উঁচু গাছের ছায়াবয়ব আর দূর পাহাড়ের গায়ে আলোর টিমটিমানির দিকে তাকিয়ে, ঠাণ্ডায় গুটিসুটি মেরে আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম।


  

Comments

  1. Ki daroon daroon DAROON lekha hoyechhe, Kuntala di. Porte porte amar chhotobelar priyo Russian boi gulor kotha mone pore galo. Kaporer molatey mora, universal communist brotherhooder sakkhi hisebe communist poshchimbonger chhelepuleder jonyo banglay onubaad kora, Roosh desher duronto sob bachchader goppo. Sekhaneo chhoto chhoto graam, shohorgulor bornona eirom thakto. "Taigay chaandta bodh hoy aro kachhe eshe jay. Sei ashchorjo chaander aloy kon dike je amra chhute cholechhi, ke jaane..."...eirom sob bakyo. Mon ta ektu bhalo ar ektu kharap hoye galo lekhata pore. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ বিম্ববতী। রুশ দেশের গল্প আমাদের সবার ছোটবেলার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই না?

      Delete
    2. আহা আমারও কত কত বই ছিল, রাশিয়ান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা। মনে পড়ে মনটা উদাস হয়ে গেল।

      Delete
  2. অসাধারণ লেখা, তার সঙ্গে অসম্ভব সুন্দর সুন্দর ছবি। যাক তাহলে মশাল হাতে ঘোরার অভিজ্ঞতাও হল আপনার। ঐরকম ব্ল্যাঙ্ক হোম কয়েকশো কি আরো বেশি আছে বাল্টিমোরে। নিউ ইয়র্ক থেকে বাসে গেলে দেখা যায়। পাড়ার পর পাড়া, রাস্তার পর রাস্তা, শুধু সারি সারি খালি বাড়ি দাঁড়িয়ে, লোকজন নেই। মাঝে কোনো একটা হয়ত ভেঙ্গে পড়ছে, আবার হঠাত কোনো একটার ভেতর পর্দা আর আলো - তার বাসিন্দারা চলে যেতে পারেনি। সারা পাড়ায় একটি পরিবার থাকে। বেশ গা ছমছমে ব্যাপার

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী সাংঘাতিক। বাল্টিমোরের লেখাটার কথা বলছি। একটা জলজ্যান্ত শহর কী রকম মরে যায়, হ্যাঁ? লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি। থ্যাংক ইউ সুগত।

      Delete
  3. খুব সুন্দর লেখা আর ছবি , ধন্যবাদ কুন্তলা :-) .

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ধন্যবাদের কী আছে ইচ্ছাডানা...আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।

      Delete
  4. ki sundar ,apurbo ..lekha o chobi dutoi

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ তিন্নি।

      Delete

Post a Comment