থাম্বস আপ



নিজের মনকে চোখ ঠারিয়ে লাভ নেই। বুঝে গেছি মানবসম্পর্কের জটিল টানাপোড়েনের অকূল পাথারে সাঁতরানোর দম আমার আর নেই, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের চতুর রিক্যাপ মগজস্থ হওয়ার বুদ্ধিও না। এখন আমাকে বইয়ের পাতার ওপর টেনে রাখতে পারে একমাত্র খুনজখম রক্তারক্তি।

তাই যখন খবর পেলাম দেশ পত্রিকায় গজপতি নিবাস রহস্য ধারাবাহিক ভাবে বেরোতে শুরু করছে, আমি দেখলাম এই সুযোগ। এক ঢিলে একাধিক পাখি মারার। বাংলা উপন্যাস পড়ার আর তার সঙ্গে দেশ পত্রিকা পড়ার অভ্যেসটাকেও ঝালিয়ে নেওয়ার। মনে মনে শপথ নিলাম সুখেদুঃখে, ভালোয়মন্দেয়, খুনজখম কিডন্যাপিং-এ আমি গজপতি নিবাসের সঙ্গে থাকব, একটি সংখ্যাও মিস করব না।

বাজারে একটা কাগজের দোকান থেকে নিয়মিত দেশ কিনে পড়া শুরু করলাম। দোকান বলাটা অবশ্য বাড়াবাড়ি। বাজারের সীমানানির্ধারক চওড়া সিমেন্টের পাঁচিলের গায়ে লাগানো তক্তার টেবিল, তার ওপর সারি সারি কাগজ ম্যাগাজিন। টেবিলের চারদিকে চারটে বাঁশ গোঁজা। বছরের পাঁচ সন্ধ্যেয় বৃষ্টি হলে যাতে তার ওপর নীল প্লাস্টিকের ছাউনি টাঙানো যায়। বাঙালি পাড়া, কাজেই বাংলা পত্রপত্রিকার ভাগই বেশি। যদিও টেবিলের পাশে যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁর খাড়া নাক আর নাকের নিচে মেহেন্দি করা ঝুপো গোঁফ দেখে অবাঙালি বলেই আমি সন্দেহ করেছিলাম।

একদিন দোকানে গিয়ে কিছু একটা কিনলেই সন্দেহের নিরসন হয়ে যেত, কিন্তু আমি যাইনি কখনও। কেন যাইনি তার পেছনে একটা কারণ আছে, কারণের পেছনে আছে একটা ঘটনা, আর ঘটনার পেছনে একটা তাত্ত্বিক ‘এফেক্ট’। সে তত্ত্বটার সঙ্গে আমার আলাপ ইকনমিক্সের বইতে, তবু সেটাকে ফস করে ইকনমিক তত্ত্ব বলে বসতে ভরসা হচ্ছে না। সকলেই জানে ইকনমিক্স বিষয়টাই তৈরি হয়েছে এদিকওদিক থেকে চুরিচামারি করে।

যাই হোক, উৎস নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, বরং এফেক্টটার কথায় আসা যাক। এফেক্টটার নাম র‍্যাচেট এফেক্ট। উইকিপিডিয়া বলছে, A ratchet effect is an instance of the restrained ability of human processes to be reversed once a specific thing has happened.

উদাহরণ দিলে হয়তো ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে। আমার দ্বারা অর্থনৈতিক উদাহরণ দেওয়াই সম্ভব, কাজেই তাই দিচ্ছি। ধরুন আমাদের উদাহরণে ইনডিভিজুয়্যাল হচ্ছেন একজন ছাপোষা মধ্যবিত্ত লোক। বাসেট্রামে চেপে অফিস যান, ঠ্যালাগাড়ি থেকে গরমকালে পটল আর শীতকালে ফুলকপি কিনে খান, খুব যে কষ্টে আছেন তা মনে হয় না। এমন সময় হঠাৎ ছন্দপতন। ইকনমির চাকা বাঁইবাঁই করতে ঘুরতে শুরু করল, ভদ্রলোকের মাইনেটাইনে বেড়ে একাকার কাণ্ড হল। মাইনে বাড়ল অথচ খরচ বাড়ল না, এ জিনিস ইকনমিক্সের বইতে ঘটে না অতএব বাস্তব জীবনেও সে রকম ঘটার কোনও কারণ নেই। ভদ্রলোক বাস ছেড়ে অল্টো ধরলেন, বাজারে গিয়ে এবার সে দোকানে ঢুকলেন যেটায় এতদিন ঢোকার তো দূরের কথা, তাকিয়ে দেখারই সাহস হয়নি। ওই যে সব দোকানের দরজায় একটা পাহারাদার দাঁড়িয়ে থাকে আর ভেতরে শেলফে সারিসারি জিনিস সাজানো থাকে, নিজে নিজে সেগুলো তুলে একটা চাকাওয়ালা গাড়িতে নিয়ে ঠেলে ঠেলে ঘোরা যায়।

টাকার গরমে তাঁর ভয় কেটে গেল, তিনি গটগটিয়ে গিয়ে দোকানে ঢুকে চাকাওয়ালা গাড়ি নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন। প্যাকেটে মোড়া টমেটো, প্যাকেটে মোড়া ধনে পাতা। দাম বেশি, তা তো হবেই, প্যাকেটের দামটাও ধার্য আছে যে। দামটা তাঁর গায়ে লাগল না, খালি দরাদরি যে করা যায় না এইটা পাঁজরে মাঝে মাঝে খোঁচা দিতে লাগল। করা যে যাবে না সেটা দোকানের কোথাও লেখা নেই, কিন্তু ভদ্রলোকের সাহস হল না। অত বড়লোক তিনি এখনও হননি। মনটা দমে গেল। পরক্ষণেই কাঁচের দরজার বাইরে দাঁড়ানো ঠ্যালাগাড়ির সামনের একটা লোকের দিকে তাঁর চোখ পড়ল। কাঠামোটা অবিকল তাঁরই, খালি খোলসটা ম্লান, আর মধ্যবিত্ততার সংকোচে কাঁধদুটো খানিকটা ঝোঁকা। প্যাকেটহীন আলু কুমড়ো টিপে টিপে দেখছে। আমাদের ভদ্রলোকের ছাতি নিমেষে দু’সেন্টিমিটার চওড়া হয়ে গেল। উনি যে ওই লোকটার থেকে বড়লোক সেই ফিলিংটাও তো অমূল্য নয়। সেটার জন্য দরাদরির সত্ব তিনি ছাড়তে রাজি আছেন।

তারপর যা হওয়ার হল। ইকনমির চাকা ধীর হল। মুদ্রাস্ফীতির গ্রাফ সাঁইসাঁই চড়তে শুরু করল, মাইনের গ্রাফ আটকে রইল যে কে সই। আমাদের ভদ্রলোককে বাধ্য হয়ে মাসের শেষে মাঝে মাঝে অল্টো ছেড়ে অটো নিতে হল, কিন্তু গাড়িটা তিনি যত সহজে কিনেছিলেন, তত সহজে প্রাণে ধরে বেচে দিতে পারলেন না। যত সহজে ঠ্যালাগাড়ি ছেড়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকে গিয়েছিলেন, তত সহজে বেরিয়ে আসতে পারলেন না। কাঁধটাই যা শুধু আগের মতো টানটান রইল না, একটু ঝুঁকে গেল।

আজ থেকে ক’বছর আগে আমার অবস্থাটাও ছিল অনেকটা ওই হঠাৎ বড়লোক হওয়া ভদ্রলোকের মতো। এ দেশে জন্মে, বড় হয়ে, এ দেশের চালডাল খেয়ে বড় হয়ে, এ দেশের চালচলনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা থেকেও মাত্র ক’দিনের জন্য বড়লোক দেশে ঘুরতে গিয়ে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। ক’বছর বাদে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এলাম, কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। দোকানবাজার করতে গিয়ে অকারণ হেসে কথা বলি, কথোপকথনের শেষে থ্যাংক ইউ, প্লিজ-এর ময়ূরপুচ্ছ জুড়ে দিই। সামনের লোক মনে মনে ভাবে, যত্ত সব দেখানেপনা।

সব ক্ষতির কথা এখন না পেড়ে বসলেও চলবে, আজকের গল্পের জন্য যে ক্ষতিটা প্রাসঙ্গিক সেটা বইয়ের দোকানসংক্রান্ত। বড়লোক দেশের বিরাট বইয়ের দোকান বিরাট দোতলার বিরাট সোফায় বসে যত খুশি বই পড় কেউ কিছু বলতে আসে না। প্রথম দিকে একটু ভয় ভয় করলেও দ্রুত সেটা কেটে গিয়েছিল, আমি ওই সোফায় বসে হ্যারি পটারের চার, পাঁচ, ছয় ও সাত নম্বর বই গোগ্রাসে গিলে ফেলেছিলাম। কেউ ফিরেও তাকায়নি। 

ব্যস, আমার অভ্যেস খারাপ হয়ে গেল। ক’বছর বাদে অভ্যেসের বশে বাজারে ঘুরতে ঘুরতে একটা বইয়ের দোকান দেখে দাঁড়ালাম। গরিব দেশের গরিব দোকান। দোকান বলাটা অবশ্য বাড়াবাড়ি। চারদিকে মুদির দোকান আর মোবাইল ফোনের দোকানে ঘেরা চত্বরের মাঝখানে একটা তক্তার টেবিল, তার ওপর সারি সারি কাগজ ম্যাগাজিন। টেবিলের চারদিকে চারটে বাঁশ গোঁজা। বছরের পাঁচ সন্ধ্যেয় বৃষ্টি হলে যাতে তার ওপর নীল প্লাস্টিকের ছাউনি টাঙানো যায়। বাঙালি পাড়া, কাজেই বাংলা পত্রপত্রিকার ভাগই বেশি।

পুজোবার্ষিকীর ঋতু ছিল, চকচকে নতুন বইগুলো দেখে আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে আনন্দমেলার প্রথম পাতাটা উল্টে দেখলাম। সূচিপত্রটুকুই। তার বেশি সময় ছিল না, ইচ্ছেও না। বড় জোর আধ মিনিট দাঁড়িয়ে সূচিপত্রটায় চোখ বুলিয়ে এগিয়ে আসছি এমন সময় পরিষ্কার বাংলায় পেছন থেকে শুনতে পেলাম, “এরা শুধু দেখবে, কিনবে না।” সঙ্গে একটা বিদ্রূপাত্মক হাসি। হাসি এবং কথা দুটোই দোকানে দাঁড়ানো কোনও একজন শ্রোতার উদ্দেশ্যে বলা, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য আমাকে শোনানো।

মনে হল কথাগুলো আর হাসিটা আমার পিঠে এসে বিঁধে গেলযেন লোহার শিক আগুনে পুড়িয়ে কেউ আমার পিঠে লিখে দিল, “এ শুধু দেখে, কেনে না।” সর্বাঙ্গ জ্বালা করে উঠলেও আমি থামলাম না, সোজা হাঁটতে থাকলাম। আর কী-ই বার করার ছিল? আমার জায়গায় ব-দিদি থাকলে ফিরে গিয়ে চেঁচিয়ে বলতে পারত, “আপনি তো আচ্ছা ছ্যাঁচড়া ছোটলোক মশাই, দেখা বারণ তো সেটা লিখে দোকানে টাঙিয়ে রাখলেই পারতেন, দেখতে আসতাম না। আর দেখেছি তো কী হয়েছে, ছিঁড়ে তো দিইনি।” উত্তরে ভদ্রলোক যে কিছু বলতে পারতেন না সেও জানি। নার্ভাস হাসি হেসে প্রাণপণে ব-দিদির সঙ্গে আই কনট্যাক্ট এড়িয়ে যেতেন। পাঁচদশটা লোক জড়ো হত। বেশিরভাগই নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করত, দুয়েকজন মাতব্বর এগিয়ে এসে বলত, “ছেড়ে দিন দিদি, ছেড়ে দিন।” ব-দিদি শ্রবণসীমার বাইরে চলে গেলে বলত, “কী খাণ্ডারনি, মাইরি!” যেটা কেউ বলত না সেটা হচ্ছে, “কী কাওয়ার্ড, মাইরি!” কিন্তু আমি ব-দিদি নই, আমি মনে মনে বিশ্বাস করি খাণ্ডারনি হওয়ার থেকে কাওয়ার্ড হওয়া ঢের ভালো। কাজেই আমি বাক্যব্যয় না করে পিঠটান দিলাম।

এর পর আমি আর কখনও ওই রকম দোকানে যাইনি। দেখতে তো নয়ই, কিনতেও না। র‍্যাচেট এফেক্টের হাতযশ মেনে নিয়ে, যেতে হলে বড় দোকানেই যেতাম, যেখানে সারি সারি সব ইংরিজি বই সাজানো, আইলের আড়ালে দাঁড়িয়ে একটা টেনে নিয়ে পাতা উল্টে দেখলে চট করে চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম। তাও আমি ঘড়ির দিকে নজর রাখতাম, কেনাকাটির ইচ্ছে না থাকলে পাঁচ মিনিট হয়ে গেলেই চম্পট দিতাম।

তারপর ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটে আমাদের আর আঁটল না, আমরা পাড়া বদল করলাম। নতুন পাড়া, নতুন বাজার, নতুন তক্তার টেবিলে নতুন ম্যাগাজিনের দোকান, নতুন দোকানি। খাড়া নাক, গোঁফে মেহেন্দি। বেশ কিছুদিন পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কিছু একটা গোল বাধল, অটো থেকে নেমেই অর্চিষ্মান বলল, “চল চল দেখি বাংলা কাগজে কী লিখেছে।” এই না বলে ওই গুঁফো দোকানির দোকানের দিকে হনহনিয়ে হাঁটা দিল।

আমি আঁতকে উঠে কনুই টেনে ধরে বললাম, “কিনবে কি? তাহলে যাব। যদি না কেন, তাহলে আমি এই এখানেই বসলাম।” বলে আমি এগরোলের দোকানের সামনে তাঁবু ফেলার উপক্রম করলাম।

অর্চিষ্মান আকাশ থেকে পড়ল। “মানে?”

নিজের অপমানের কথা তো যেচে আর কত বলব, সে যতই ঘরের লোক হোক না কেন। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু অর্চিষ্মানের গোঁ ফ্যামিলিবিদিত। শুনেই ছাড়ল। বলতে গিয়ে ওই অতদিন পরেও জ্বালাটা আবার টের পেলাম। মনে হল ক্ষতের জায়গাটায় আবার কেউ ছুরি বুলোচ্ছে। “এ শুধু দেখে, কেনে না।”

শুনেটুনে অর্চিষ্মান মুখের এমন একটা ভঙ্গি করল যেটার মানে “সিরিয়াসলি?/ পারোও বটে/ বাড়াবাড়ি কোরো না” তিনটের যে কোনও একটা হতে পারে। তারপর আমার হাত ধরে টেনে একেবারে দোকানের সামনে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হল। এই কাগজ ওই ম্যাগাজিন নেড়েচেড়ে দেখল। আমি ভয়ে চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখলাম। পাক্কা পাঁচ মিনিট পর একটা কাগজ বেছে নিয়ে ভদ্রলোকের হাতে দিতে তিনি দাম বললেন। এতক্ষণে আমার সাহস হল চোখ ফেরানোর। টাকা কাগজ দেওয়ানেওয়া হল, আমি ওঁর বদান্যতায় গলে পড়ে “থ্যাংক ইউ” বললাম, তার উত্তরে ভদ্রলোক আমাকে জোড়া থাম্বস আপ দেখালেন।

আমার ভয় কাটতে শুরু করল।

অর্চিষ্মান না থাকতেও তারপর একা একাই ওঁর দোকানে যেতে শুরু করলাম, যদিও না কিনে ফিরিনি কখনও। তার পর গজপতি নিবাস রহস্য ছাপা শুরু হল, ওঁর দোকান থেকেই কিনতাম দেশ। মাসে দুটো। শেষ দিকটায় আমার সাহস এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে কেনার আগে পাতা উল্টে সূচিপত্র দেখে পাতা বার করে ‘আগের সংখ্যায় যা ঘটেছে’টা পড়েও দেখে নিতাম যে মাঝখানে কোনও সংখ্যা বাদ পড়েছে কি না।

সেটা করতে গিয়েই নজরে পড়ল। একটা সংখ্যা শুধু মিসই হয়নি, হবি তো হ সেই সংখ্যাটাই, যেটায় একটা খুন হয়েছে। খুন! মিস! আতংকে আমার মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম হল। যে কোনও উত্তেজনার মুহূর্তে আমার বাংলাটাই গোলমাল হয়ে যায়, হিন্দিইংরিজির কথা তো ছেড়েই দিলাম। আমি বলতে লাগলাম, “মিলেগা? নেহি মিলেগা? কী সাংঘাতিক। মিলনা হি পড়েগা, ভাইসাব, নেহি তো অনর্থ হো যায়েগা।”

পাশেই একজন জেঠু দাঁড়িয়ে ছিলেন, বেশ দয়ালু দেখতে। তিনি বললেন, কী হয়েছে? আমি বললাম, “আরে ধারাবাহিক উপন্যাস মিস হয়ে গেছে, তাও আবার রহস্য উপন্যাস।” তিনি বললেন, “গজপতি নিবাস?” আমি বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ!”

ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তিনিও আমার হয়ে সওয়াল করা শুরু করলেন। তাঁর সওয়াল শুনে আর আমার বাজ-পড়া চেহারাটা দেখে দোকানি ভদ্রলোকের দয়া হল। তিনি মেহেন্দি গোঁফ দু’বার নাচিয়ে বললেন, তিনি আমাকে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য বইখানা ধার দিতে পারেন। অন্য এক পাঠকও নাকি আমার মতোই ভুল করেছেন, কিন্তু আমার আগে সেই ভুল আবিষ্কার করেছেন ও বলে রেখেছেন তাঁর জন্য এক পিস বাঁচিয়ে রাখতে। সেই পাঠকের সঙ্গে তাঁর ডিল “ডান” হয়ে রয়েছে, কাজেই বইখানা তিনি সেই পাঠককেই দেবেন, আমাকে নয়।

আমি একেবারে লাফিয়ে উঠলাম। এক নিঃশ্বাসে থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ বলে যেতে লাগলাম। ভদ্রলোক কান না দিয়ে জানতে চাইলেন,

“চব্বিশ ঘণ্টা বলতে আপনি কত ঘণ্টা বোঝেন?”

“চব্বিশ ঘণ্টাই। সেটা তেইশ ঘণ্টা আঠাশ মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ডও হতে পারে।”

(কোন গল্পের ছায়া অবলম্বনে?)

“তব ঠিক হ্যায়। লেকিন সির্ফ এক দিন। যো ডান হ্যায়, ও ডান হ্যায়।”

একটু দূরে দাঁড় করানো একটা স্কুটারের সিট তুলে কুঠুরি থেকে একটা বই বার করে আনলেন ভদ্রলোক। সেই মিসিং দেশ! কোণাদুটো সামান্য দুমড়ে গেছে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। মলাটের ভেতর খুনটা ঠিক ততখানি টাটকাই আছে যেমন পনেরো দিন আগে ছিল।

আমি বই বগলে বাড়ি চলে এলাম। জামাকাপড় ছাড়ারও আগে সূচিপত্র দেখে পাতা খুঁজে উপন্যাসটা বার করে গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। মাথা ঠাণ্ডা হল।

পরদিন বই ফেরৎ দিতে গিয়ে দেখি টেবিল তখনও ঢাকা দেওয়া। পাশের চায়ের দোকানের খদ্দেররা জানালেন, “বাংলা কাগজ আনতে গেছে। এক্ষুনি এসে পড়বে।” আমি এক ঠোঙা ঝালমুড়ি নিয়ে খেতে খেতে দোকানের ওপর নজর রাখলাম। ঠোঙা শেষ হতে না হতেই ভদ্রলোক এসে পড়লেন। আমি এগিয়ে গিয়ে ওঁর হাতে বই প্রত্যর্পণ করলাম। গোঁফের ফাঁকে ভদ্রলোক হাসলেন কি না বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমি আর অপেক্ষা করলাম না। দু’হাতের বুড়ো আঙুল তুলে ওঁকে থাম্বস আপ দিলাম। দেখানো নয়, নিখাদ আন্তরিক।


Comments

  1. বাক্স রহস্য। আর ওই থ্যাঙ্ক ইউ এর ময়ুরপুচ্ছের জন্য হাই ফাইভ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক উত্তরের জন্য অভিনন্দন আর মিলে যাওয়ার জন্য হাই ফাইভ, সুগত।

      Delete
  2. Amar duto sonkhya miss hoyechhey!

    ReplyDelete
  3. বাক্স রহস্য। দোকানদারকাকু বেশ দয়ালু তো, এরকম কেউ বই ধার দেয় বলে জানতাম না। সাধে কি বিজ্ঞাপনে বলে, বাত করনে সে হি বাত বনতি হ্যায়।
    দেশ পড়ি না। ২০০৯ সালের অগাস্ট নাগাদ প্রতিজ্ঞা করি যে আর দেশ কিনব না। প্রতিজ্ঞা তার আগেও অনেকবার করেছিলাম, কিন্তু দুর্বলচিত্ত বাঙালি, প্রতিজ্ঞা ধোপে টেকেনি। তবে শেষ প্রতিজ্ঞাটা এখন অবধি টিকে আছে দেখতে পাচ্ছি।
    অফিস পৌঁছেছেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও তো তাই ভাবতাম, দেবাশিস, ইনি দেখলাম দিলেন। দেশসংক্রান্ত প্রতিজ্ঞাটা আমিও করেছিলাম কিন্তু দেখাই যাচ্ছে বাকি সব প্রতিজ্ঞার মতো এটাও রাখতে পারিনি।

      উঁহু, পৌঁছইনি। সিলেবাস পাঁচ দিনের, আজ সবে তিন নম্বর দিন। ভালোই হয়েছে অবশেষে। বাড়িতে বসে দেশের বাকিটা পড়ার চেষ্টা করা যাবে।

      Delete
  4. Ami jekhane thaki, sekhane oto sohoje 'Desh' pawa jay na. Ek haasyomukh bhodrolok ekdin bari boye eshe 'Desh' er grahok koriye, onek form ey soi koriye, ek bochhorer taka niye gelen. Bollen porer mash theke barir dakbakshe 'Desh' ashbe. Sey toh ar eloi na konodin, uporontu khoj korte giye bhodroloker phone number dial kore dekhi 'number not in use'. Tarpor thekei moner dukkhe ami Desh pora chhere diyechhi. Majhe majhe Kolkata gele pori shudhu. :(

    Tobe 'Desh' ey je ekta goyenda uponyas berochchhe jantam-i na. Eibar abar jogar korte hobe dekhchhi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ, বাঙালি চিটিংবাজিতে এত উন্নতি করেছে দেখলেও ভালো লাগে।

      Delete
  5. Apni to Economics er bibhinno layer-er ekta edifice sthapon korlen dekhchi!

    Ratchet effect, De-leveraging ebong Pathon-pathon-er jagote pray Fractional Reserve Banking equivalent.

    Jakge, tattwo-katha chhere asol kathay asi. Aporadh-bhittik "Thriller" sei chhotobela thekei priyo. Aboshyo Fiction pora'r abhyes tao sei time warp ei chhere eyechi. Space-time continuum e hoyto ami(ba amar temporal conjugate) ekhono pore cholechi sei Debendra Bijoy Raha/Swapan Kumar/Kaushik theke shuru kore Kumar-Bimal/Byomkesh/Kireeti/Feluda/Col. Bhaduri/Ki.Ki.Ra-der ek ekta adventure-er goppo.

    Bere lekhen kintu Didibhai. Aageo bolichi..aalo chhoran.

    Pore asbo abar :) Once the jnata-kol is due for a maintenance shutdown.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বই পড়ার অভ্যেসটাই হয়তো একটা নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক, অন্তত আমার তো তাই। পরেও অনেক বই পড়েছি, কিন্তু মনে মনে, বাস্তবে, ফিরে ফিরে যেগুলো পড়ি সেগুলো সব ছোটবেলায় পড়া বই।

      আসবেন তো বটেই। অবান্তর ও আমি দুজনেই অপেক্ষায় থাকব।

      Delete
  6. Ami ei golpo ta porini.. oi sob dharabahik uponnyas pore hobe na.. boi ache etar???

    ReplyDelete
    Replies
    1. বই হিসেবে তো এর পরে বেরোবে, অর্ণব। ধারাবাহিক হিসেবে শেষ হলে। অন্তত তেমনটাই তো হয় জানি।

      Delete
  7. আমি কিন্তু বই দেখলেই গন্ডার হয়ে যাই। বইয়ের দোকান, কাগজের দোকান, যেখানেই যাই না কেন, বই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে, গন্ধ শুঁকে, দু'চারপাতা পড়েটড়ে তারপর নামাই। কে কি বলল, কেয়ার করিনা, বৃহত্তর কার্যসাধনে ওইসব ছোটোখাটো বাধাবিপত্তি আসবেই!
    'গজপতি'র সম্পর্কে অন্য এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, বেশ ভাল হচ্ছে নাকি। আপনিও জানাবেন কেমন লাগছে। বই হয়ে বেরোলে কিনব। আহা, কতদিন ভাল গোয়েন্দা উপন্যাস পড়িনি বাংলায়!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও ভালো লাগছে, অরিজিত। গোড়ায় একটা অন্তর্ধান দিয়ে শুরু হয়েছিল, আমিও বিশেষ গা করছিলাম না। দ্রুত দু'খানা খুন হয়ে যাওয়াতে নড়েচড়ে বসেছি।

      গণ্ডার হওয়ার থিওরিটা ভালো, অরিজিত। চেষ্টা করব।

      Delete
  8. besh moja laglo golpota pore... Tobe boi kaku der songe erom obhigyota notun na. Tokhon sodyo din dui holo harry potter ar half blood prince published hoyechhey. Kolkatay esechhey kina janina. Bose institute e gechhi class korte. Professor asen ni. Ferar pothe bondhura bollo chol tahole ektu goriahat e ghure jai. R sekhane ghurte giyei hothat kore ekta footpath er boi er dokane dekhi notun harry potter sajano. R amake pay ke. lafiye giye dam jiges korlam.. Uttor elo 480 taka. sobe beriyechhey, prochondo bikri tai doradori nei. M.Sc pori, pocket e serom taka thake na. Anek jherejhure 200 taka moton berolo. Bondhu dujoner theke dhar kore 300. Boita kena hobe na, prochondo mon kharap. ektu nara chara kore mukh kalo kore aschhi, hothat dokandar pechhon theke daklen "boita niye jao." ami khub kintu kintu kore bollam "kintu amar kachhey to oto taka nei" uni bollen "ja achhey tatei hobe.. jebhabe boi ta dhorchhile, bujhte perechhi boi bhalobaso." 300 taka dite jetei abar sosneho dhomok "bari ferar bharata to ontoto rakhbe, naki? Sudhu boi kinlei cholbe?"

    R tomar chhayata baksho rohosyo hobe.. Tobe arektu strech korle Anish Deb e 23 ghonta 60 minute o hote pare. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী ভালো অভিজ্ঞতা, চুপকথা। মন ভালো হয়ে যায়্ শুনলে।

      কিন্তু আমার আপনার অন্য একটা অভিজ্ঞতার কথা জানতে বেশি ঔৎসুক্য হচ্ছে। আমার চেনা একজন বোস ইন্সটিটিউটে পড়ত বা পড়াত। তাকে কেউ "কোথায় আছ?" জিজ্ঞাসা করলে সে স্বাভাবিকভাবেই বলত, "বোসে আছি।" তাতে প্রশ্নকারী ভয়ানক করুণ মুখ করতেন। এত লেখাপড়া করে কিনা শেষমেষ বসে? তখন আবার তাকে ব্যাখ্যা করে বলতে হত। হয়েছে নাকি আপনার সঙ্গে এ রকম?

      Delete
  9. Ami Bose institute e porini kokhono as such. Portam Kalyani University te kintu Bioinformatics poraten Bose er ekjon professor. Ta tini bysto thakle Kalyani asten na, tar bodole amra thengiye weekend e Bose institute e jetam class korte.

    ReplyDelete
  10. Achha tumi blog e ki kore banglay lekho/ comment karo baloto?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এত দেরিতে উত্তর দেওয়ার জন্য ভেরি সরি, চুপকথা। আমার বাংলা লেখার রহস্যের সূত্র নিচের লিংকটা। অভ্র ডাউনলোড করুন, তারপর মনের সুখে বাংলা লিখুন।

      https://www.omicronlab.com/avro-keyboard-download.html

      Delete
  11. Ooff, ami generally comment gulo porina, sudhu comment korar samay just ager comment tay chokh pore jay, kintu ebar dekhchhi labh i holo chokh pore. Kuntala, ami Bose theke PHD korechhi, r "bose e achhi" and "bose acchi " er mormo ami khub bujhte parchhi :) kotobar je hoechhe ei byaparta amar sathe. Ar Chupkotha ami to Bose e Bioinfomatics thekei PHD korechhi, tomake ki ami chinte pari :ishh mon bhalo hoe gelo ei -20 r thanday bose purono goppo dekhe :) thank you Kuntala and Chupkotha.. -- Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ব্রততী, নিজের পায়ে কুড়ুল মারার মতো করেই বলছি, অবান্তরের বেস্ট পার্ট হচ্ছে অবান্তরের কমেন্ট। তুমি 'বোসে' বসে পি এইচ ডি করে ফেলেছ শুনে খুব হিংসে করলাম।।

      Delete
  12. Economics + natun rahasya uponyas er khoj + anortho ho jayega = apnar blog to stalk korte suru korlum. bhalo thakbe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। অবান্তরে স্বাগত জানাই।

      Delete

Post a Comment