সমুদ্রস্নানের সাত রকম




১। এঁরা সবার আগে বিচে আসবেন। সুইমসুট, সানগ্লাস, তোয়ালে, শতরঞ্জি, ছাতা, জুতো পাহারা দেওয়ার লোক -  সমুদ্রস্নানের সমস্ত প্রয়োজনীয় গিয়ার ঘাড়েবগলে করে। এর পর শতরঞ্জি পেতে ছাতা মেলে কিংবা নুলিয়াদের ছাউনি ভাড়া করে আরাম করবেন কিংবা স্রেফ সানগ্লাস আর শতরঞ্জির ভরসায় ডেয়ারডেভিল নেমে পড়বেন ট্যানের সাধনায়। কেউ মালিশওয়ালা ডেকে মাল্টিটাস্কিং-এ নিমগ্ন হবেন। এঁদের সন্তানসন্ততিরা প্যাস্টেল রঙের ছোট্ট বালতি বেলচা নিয়ে বালিতে শিল্পকর্ম ফাঁদবে। এঁদের আশপাশ দিয়ে কোটি কোটি লোক সমুদ্রে নেমে, স্নান করে, উঠে বাড়ি চলে যাবে। এঁদের জলে নামার ওয়ার্ম আপ ফুরোবে না। আদৌ জলে নামা হবে কি? আমি জানি না। আমি যতক্ষণ আশেপাশে থেকেছি নামতে দেখিনি কোনওবার, আমি চলে আসার পরে নেমে থাকলে আমার জানার কথা নয়।

আমার সন্দেহ হচ্ছে ইনি ওয়ার্ম আপ ক্যাটেগরিতেই পড়বেন, নিশ্চিত হতে পারছি না বলে আলাদা লিখছি। এঁকে প্রথম দেখা যাবে ডান কিংবা বাঁ দিকে, বহুদূরে, একটি কালো বিন্দু হিসেবে। বাড়তে বাড়তে সেটি অবশেষে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের আকার ধারণ করবে। দৃষ্টি নিচু বা সামনে, সমুদ্রের দিকে কদাচ নয়। কাঁধের তোয়ালে তাঁর স্নানের ইচ্ছের সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিন্তু যে রকম ফোকাস এবং গতির সঙ্গে হাঁটছেন, চট করে থামবেন বা জলে নামবেন মনে হচ্ছে না। ক্রমে তিনি আপনাকে পার হয়ে করে দূরে চলে যেতে যেতে আবার বিন্দু হয়ে যাবেন। কোথা থেকে আসছেন? শংকরপুর হতে পারে, কোথায় যাচ্ছেন? কন্যাকুমারিকা হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। 

২। ওয়ার্ম আপ দলের একশো আশি ডিগ্রিতে আছেন ইনি। পায়ের তলায় বালি শুরু হওয়া মাত্র দুই হাত মাথার ওপর তুলে দৌড়তে শুরু করবেন, সমুদ্রে ঝাঁপানোর আগে পর্যন্ত থামবেন না। এঁর উল্লাসজনিত চিৎকার এঁর সমুদ্রস্নানের আনন্দ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রাখবে না। কিন্তু ইনি স্বার্থপরের মতো একা আনন্দ করতে চান না। সঙ্গীরা, যাঁরা নিজের মতো করে স্নান করছেন বা করছেন না, তাঁদের নিজের আনন্দের ভাগ দেওয়ার জন্য ইনি উৎকণ্ঠিত। কোনও সঙ্গী সমুদ্রস্নানে অনুৎসাহী হলে  এঁর অন্নপ্রাশনের ভাত হজম হবে না। জলকেলি ছেড়ে উঠে এসে সঙ্গীর হাত ধরে টানতে শুরু করবেন। সঙ্গী বিপদ বুঝে ত্রাহি চেঁচাবেন। চিৎকারে এফেক্ট উল্টো হবে, এঁর পরোপকারের স্পৃহা লকলকিয়ে উঠবে, সঙ্গীকে জলে চুবনোর প্রতিজ্ঞা দৃঢ় হবে। বালির ওপর দিয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে তিনি সঙ্গীকে সমুদ্রের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকবেন। কনটেক্সট ছাড়া দৃশ্যে ঢুকে পড়লে পুলিসকে ফোন করা কিংবা নিকটবর্তী চ্যালাকাঠ তুলে নিয়ে এঁর মাথায় বসিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে অস্বাভাবিক নয়। 

৩। ভিড়ে দাঁড়িয়ে বালিঘোলা ঢেউয়ের গুঁতোয় হাঁচোড়পাঁচোড় স্নানে ইনি নেই, গোলযোগ ছাড়িয়ে দূরে চলে যাবেন, তারপর ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে বাকিদের আনাড়িপনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবেন।

৪। এঁরা হারার আগেই হেরে বসে থাকবেন। ঢেউয়ের গুঁতোয় পড়ে গিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে করতেই পরের আরও বড় ঢেউটার আঘাতে পুনরায় পর্যুদস্ত হওয়াতেই যে সমুদ্রস্নানের আসল মজা, এই মতে এঁরা বিশ্বাসী নন। হারবই যখন ফাইট দিয়ে কী হবে ভেবে নিয়ে এঁরা বিচের ওপর হাত পা এলিয়ে বসে বা শুয়ে থাকবেন। ঢেউ সরে গেলেও উঠে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখাবেন না। কী হবে উঠে, আবার তো শুইয়েই দিয়ে যাবে।

আমার ঠাকুমা এই ক্যাটেগরির স্নানার্থী ছিলেন। আমি একবার ঠাকুমার দেখাদিখি গড়াগড়ি স্টাইলে সমুদ্রস্নানের অ্যাটেম্পট নিয়েছিলাম। জঘন্য আইডিয়া। সারা গায়ে বালি কিচকিচ। বারদুয়েক গড়াগড়ি খেয়ে উঠে পড়ে নালিশ করাতে ঠাকুমা বলেছিলেন, এই সেম বালি মহাপ্রভু গায়ে মেখেছিলেন। কাজেই কিচকিচানি নন-ইস্যু। 

৫। এঁদের শুধু স্নান করলে হবে না, স্নানের মুহূর্তটিকে অমর করে রাখতে হবে। যারা অ্যাথলেটিক নন তাঁরা হাঁটু ভাঁজ করে জলে এক হাত ছুঁইয়ে, অন্য হাতে ভি দেখিয়ে ক্ষান্ত দেবেন। অ্যাথলেটিকরা নিজস্ব ক্ষমতা অনুসারে ঢেউয়ের মাথার ওপর দিয়ে লাফিয়ে, কাউকে ঘাড়ে নিয়ে/ কারও ঘাড়ে উঠে, কার্টহুইল করতে করতে সমুদ্রে নামার ছবি তোলাবেন।

সকলেরই ঠিক সেই মুহূর্তের ছবি চাই যে মুহূর্তে সফেন ঢেউ তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বল। সমস্যাটা হচ্ছে মুহূর্তটা আগে থেকে গেস করা অসম্ভব। কখনও ঢেউ মাধ্যমিকে সাতখানা লেটার বাগিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে টায়টায়, এদিকে ইনি শুকনো বালিতে ছাদের সমান লাফিয়ে আহাম্মক। আবার কখনও কখনও লাস্ট মোমেন্টে পিক আপ নিয়ে ঢেউ ভিক্টরি সাইন ডুবিয়ে তাঁকে চুবিয়ে চলে যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে একগলা নোনাজল গেলা মুখ আর যাই হোক ফোটোজেনিক থাকছে না। একটাই বাঁচোয়া, ডিজিট্যাল জমানা, মেমোরি মেকিং মনোমত না হওয়া পর্যন্ত ক্লিক করে যাওয়া যাবে। ততক্ষণ সমুদ্রতট শোয়া, বসা, শূন্যে ত্রিভঙ্গ অবস্থা থেকে ‘এবার!’ ‘এবার!’ ‘এবার!’ কলরবে মুখরিত হয়ে থাকবে, এই যা।

৬। এঁরা পেটের-ভেতরটা-কেমন-করে-বলেই-তো-জায়েন্ট-হুইল-চড়ি, মুখ-চুলকোয়-বলেই-তো-বেগুন-খাই মোটো নিয়ে জীবনের মধ্য দিয়ে চলেন। মাথার দু’হাত ওপর থেকে ঢেউ যখন প্রচণ্ড বেগে নেমে আসছে গিলে খাবে বলে, মাথা ফাঁকা, চোখ বোজা, শ্বাস রুদ্ধ, ভেসে যাওয়ার অত কাছাকাছি আর আসা হবে না কখনও, ওই মুহূর্তের ওপারে কী আছে জানা নেই, সেই মুহূর্তটাই এঁদের মতে পুরীর বেস্ট মুহূর্ত। 

ইন ফ্যাক্ট, সেই মুহূর্তটাই পুরী। 

আর সেই মুহূর্তের মুখোমুখি হওয়ার একটাই স্ট্র্যাটেজি এঁদের জানা আছে। ঢেউয়ের উচ্চতা এবং শক্তি এবং নিজের নাস্তানাবুদ হওয়ার মাত্রা বুঝে ভিন্ন স্কেলে, ভিন্ন পিচে গলা ছাড়া। চেঁচানোটা এঁদের কোপিং মেকানিজম।

৭। এঁরা নাকেমুখে জল ঢুকতে ঢুকতেও, আছাড় খেতে খেতেও লোকলজ্জায় মরবেন। বলবেন, ওরে বাবা কুন্তলা অত চেঁচিয়ো না, ওই যে ওরা তাকাচ্ছে। 



Comments

  1. Replies
    1. চল একবার সবাই মিলে পুরী যাই আর খুব চেঁচামেচি করে স্নান করি।

      Delete
  2. Haha.. 4 no obdi bhabchilam tumi kon rokom bhabe jole namle... Last ta darun... ��

    ReplyDelete
    Replies
    1. একেবারে অকাট্য সত্যি কিন্তু।

      Delete
  3. chechanota bade ami 6 nombor. 6 ar 7 nomborer chaner dhoron shune khub moja pelam

    ReplyDelete
  4. Haha khub haslam sokkal sokkal. 6 no k samlanor jonno 7 no er juri nei.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, সাতেরও সেই রকমটাই দাবি, সুহানি।

      Delete
  5. darun likhechho. ami 4 aar 5 er majhamajhi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, তিলকমামা।

      Delete
  6. Darun laglo ei rokom-fer ta. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অরিজিত।

      Delete
  7. "কখনও ঢেউ মাধ্যমিকে সাতখানা লেটার বাগিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে টায়টায়" - dheu bhangar asadharon imagery!

    ReplyDelete

Post a Comment