তাওয়াং ৫ঃ বুম লা


যে কোনও লা-এর পর পাস বলা ‘চায় টি’ বলার মতো। কারণ লা মানেই পাস। বুম মানে পাহাড়। যদিও শুধু বুম লা বলতে কেমন লাগে বলে জেনেশুনেও কখনও কখনও বুম লা পাস বলে ফেলব হয়তো। তাওয়াং থেকে বুম লা সাঁইত্রিশ কিলোমিটার। অস্থানীয় গাড়ি নিয়ে বুম লা যাওয়া বারণ। কাজেই পঙ্কজ, অগ্নিক, হিমাংশুর আজ ছুটি। অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করেছে অগ্নিক, সকালে হোটেল থেকে পিক আপ করবে। যাওয়ার খরচও তাওয়াং টুরস-এর প্যাকেজের খরচের বাইরে। আগের দিন গোলটেবিল বৈঠকে স্থির হয়েছে, আমরা আর আরেকটি পরিবার একটিই গাড়িতে যাব তাতে খরচ অর্ধেক হয়ে যাবে।


সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ অগ্নিকের পিং এল। গুড মর্নিং জী, কার ইজ হিয়ার। আমরা বাইরেই ছিলাম। চা টোস্ট খেয়ে তাওয়াং বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। প্রথমটা বাজারে যাইনি। দুটো মোরগের পিছু নিয়ে একটা গলির মধ্যে ঘোরাঘুরি করছিলাম। তারপর মোরগদুটো আমাদের গাইডের কাজে ক্ষান্ত দিয়ে উড়ে গেল, তখন টের পেলাম যে শুকনো হাওয়ায় দুজনের মুখ চড়চড় করছে, এদিকে ক্রিমটিম কিছু আনা হয়নি। ক্রিমের খোঁজে বাজারের দিকে যাওয়া হল। সবই বন্ধ, অবশেষে একটা দোকান খোলা দেখলাম যেটাতে ক্রিম পাওয়া গেলেও যেতে পারে। পন্ডসও আছে, নিভিয়াও। প্রথমটা দেড়শো, পরেরটা তিনশো। পন্ডসের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। জিপে করতে গিয়ে মার্চেন্টের নাম দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা বাঙালি নাকি? দাদা জানালেন, এখানে সব দোকানদারই প্রায় বাঙালি। গোবিন্দ পাল বঙ্গাইগাঁও-এর লোক, তিনবছর ধরে তাওয়াং-এ আছেন। এই ক্রিমের বাক্সগুলো এত বেঢপ, আমাদের হাতে ব্যাগ নেই, দাদাও প্লাস্টিক অফার করেননি, সে ভালোই করেছেন। হাতে করে বাক্স নিয়ে হোটেলের দিকে যাচ্ছি, অগ্নিকের পিং এল। আমরা আর আরেকটি ফ্যামিলি যে গাড়িটাতে যাব তার ড্রাইভারের নাম দেভ। আলাপ হয়ে ভালো লাগল। চটপটে, ছিপছিপে, পঁচিশ পেরোয়নি।

যাত্রা শুরু হল। গোটা অঞ্চলটিই ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কব্জায়, কিছুদূর যাওয়ার পর থেমে আরেকটা পাস করাতে হল। হল মানে, দেভ দৌড়ে গিয়ে করে নিয়ে এল। তারপর শুরু হল চড়া। তাওয়াং-এর হাইট দশ হাজার ফিট, বুম লা-র পনেরো হাজার দু'শো। পথের দুপাশে রেলিং-এর ওপর চাবড়া চাবড়া বরফ ক্রমে বরফের নদী হল, দৃষ্টিপথ কুয়াশায় ঝাপসা হল, বাতাসের বেগ বাড়ল এবং তাপমাত্রা কমল। মারাত্মক আঁকাবাঁকা মোড়ের একটি পার হয়ে দেখা গেল সামনে সার দিয়ে গাড়ির দল দাঁড়িয়ে।

রোজ কা নৌটংকি। স্টিয়ারিং-এ হতাশ চাঁটি বসাল দেভ। নৌটংকির উৎস গাড়িদের পিছলে যাওয়া চাকা। যাতে চেন পরাতে হচ্ছে, তাই জ্যাম। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। বুম লা তখনও দূর, তা বলে দৃশ্যের তো কমতি নেই। ছবির পর ছবি তুলতে লাগলাম। রোদের ছবি, কুয়াশার ছবি, কুয়াশাভাঙা রোদের ছবি, রাস্তার জিলিপি প্যাঁচের ছবি, ভুতুড়ে গাছের ছবি, এমনকি আমারও ছবি উঠল গোটাকয়েক। দেভ দৌড়োদৌড়ি করে চেন পরানোর তদারকি করতে লাগল। মাফলার পেঁচানো, বন্দুকধারী জওয়ান যথার্থেই কনফিউজড। আপ লোগ কেয়া দেখনে চলে আতে হো ইয়ার। উনি বারোঘণ্টা (জানি না ক’ঘণ্টা, আন্দাজে বললাম) ওই বরফে দাঁড়িয়ে থাকেন, উড়ে এসে জুড়ে বসা টুরিস্ট গাড়িদের শুশ্রূষার বাড়তি ঝক্কি সামলান, ওঁর মনে কনফিউশন জাগাই স্বাভাবিক।


গাড়ি ছাড়ল, কিন্তু নামেই। চাকা স্কিড করে। বরফে পিছল খায়। বাঁক নিতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে নালায় পড়ে যায়। তখন সমস্ত গাড়ির সারথীরা নিজেদের গাড়ি থেকে বেরিয়ে আটকা পড়া গাড়িকে ধাক্কা মারেন। ধাক্কা মেরে রাস্তায় তুলে ফিরে আসেন। অনেক সময় ফেরেনও না। ধরা যায় পেছনের কোনও গাড়ি আটকা পড়েছে, সামনের গাড়ির লোক থেমে, নেমে উদ্ধারকার্যে গেছেন। গাড়ি উদ্ধার হয়েছে এবার হৃত সময় পুনরুদ্ধার করতে দ্রুত মুভ করতে হবে। সামনের গাড়ির লোক যতক্ষণে হাঁটুর বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে, হাসতে হাসতে ফিরছে, ততক্ষণে হাতের কাছের অন্য গাড়ির লোক সামনের গাড়িটা সেটাকে চালিয়ে খানিকদূর এগিয়ে দাঁড় করান। দেভের অনুপস্থিতিতে, যা ঘন ঘন ঘটছিল, আমাদের গাড়িও কারা যেন সব চালিয়ে দিচ্ছিলেন। দেভ, লিডার টাইপ। সে যতবার, যে ক’টা গাড়ি আটকাচ্ছিল, ততবারই নেমে দৌড়চ্ছিল। অনেকসময় সামনের গাড়ির রকমসকম দেখে ঘটনাটা আঁচ করে, ঘটনা ঘটতে ঘটতেই নেমে পড়ে, চলো সবাই, বলে চেঁচিয়ে অকুস্থলের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল। অন্তত পনেরোবার এই রকম হওয়ার পর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে বলল, প্যান্ট পুরা গিলা হো গয়া। ঠেলতে গিয়ে আছাড় খেয়ে হাঁটুতেও নাকি ব্যথা। আজকের মতো এই শেষ। যে ঠেলে ঠেলুক, দেভ নাকি আর ঠেলছে না। ষোলতম বার কে সবার আগে দৌড়ল সেটা আশা করি বলে দেওয়ার দরকার নেই। আমাদের সঙ্গে গাড়ি ভাগাভাগি করছিল সাক্ষী আর দীপক, আদতে গোয়ালিয়রের আপাতত গুড়গাঁওয়ার, ভারি ভালোমানুষ। সাক্ষী খুবই মিশুকে এবং মজার। বলছিল, দেখবেন আমাদের গাড়ি আবার যেন ফাঁসাবেন না। দেভ নিঃসংশয়। কভি নেহি ম্যাডাম, সুমো নেহি ফাঁসতা। দেভের যত রাগ ইনোভার ওপর। ফাঁসেগা হি ফাঁসেগা।

দৃশ্য তো অভূতপূর্বই। কিন্তু এই যে একটা ধুন্ধুমার, চলা, থামা, নামা, ধাক্কাধাক্কি, আবার চলা - এই অংশগুলোও কিছু কম ইন্টারেস্টিং না। তিলকমামাদের আন্দামান ভ্রমণের ছবি দেখেছি, সৌন্দর্য দেখে শ্বাস রুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু একটা দ্বীপে যেতে গিয়ে লঞ্চশুদ্ধু লোক দুলুনির চোটে বমি করে ভাসিয়েছিল, সে গল্প শুনে যে রকম পেটব্যথা হয়েছিল বলার নয়। মামার বলার গুণ একটা কারণ মানছি, কিন্তু আরও একটা কারণ আছে।


প্রকৃতি রাজকীয়। রাজকীয়তার সামনে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। এই যে দুপাশে প্রকাণ্ড ধবল পাহাড়, তাকিয়ে দেখছে পিঁপড়ের দল চলেছে হাসতে হাসতে, বীরদর্পে, নিজেদের অমরত্বে নিঃসংশয়, ফোর হুইলারের কলার তুলে, খুব কি লোভ হচ্ছে না, অল্প ঝুঁকে আঙুল দিয়ে সারিটাকে অল্প ঘেঁটে দেওয়ার? কিংবা না ঝুঁকেই, হাতের বদলে জাস্ট পায়ের আঙুল ছুঁইয়েই? তারপর দৌড়োদৌড়ি, প্যানিক, আতংকের ছবি দেখা বসে বসে? রাজকীয়তার ছবি তুলি। হাসুন তো দেখি বলার সাহস পাই না। ভিউ ফাইন্ডার দেখে বলি, আপনার ডান গালটা এই ছবিটায় আসবে না বুঝলেন, বাঁ কানটাও একটু বাদ পড়ে যাবে। আমার ক্যামেরাটা তেমন দামি নয় কি না। পরের ছবিটা শুধু গালটারই নেব, তার পরেরটা শুধু কানের, কেমন? সরি, রিয়েলি সরি। অ্যাপোলজি অ্যাকসেপ্টেড হল নাকি অবোধ্য থেকে যাওয়ার বেশি অস্বস্তির আর কিছু হয় না, পায়ে পায়ে পিছিয়ে আসি।

 

উল্টোদিকে মানুষ, হাস্যকর। এ হাস্যকরতায় ভয়ের তো কিছু নেইই বরং এই রিয়েলাইজেশন যখন ঘটে যে আমিও এই বিপুল, প্রগাঢ় হাস্যকরতারই অংশ, হইহই করে খেলতে নামা যায়। এ খেলাধুলোয় সম্ভ্রম না থাকলে কী হবে আদর আছে, আছে মায়া। এমন একটা ফুর্তি আছে যে মনের মধ্যে তীব্র ফোমো জাগতে বাধ্য। আঙুলে ভাসানের ঢাকের তাল রাখতে রাখতে যেমন অতি প্রুডও প্রার্থনা করে, মা মাগো, বর দিয়ে যাও মা, যেন সামনের বছর সাহস বাড়ে আর এই ফুর্তিযজ্ঞে নিজেই নিজেকে দেওয়া আমন্ত্রণপত্র ওড়াতে ওড়াতে ভিড়ে যেতে পারি। তেমনি এই গাড়ি ঠেলাঠেলি, দৌড়োদৌড়ি, হাঁকাহাঁকিতে ওই ঠাণ্ডাতেও চনমনে লাগে। একটা কিছু কাজে লাগার ইচ্ছে হয়। কাজের কাজে লাগব না জানি কারণ এই বরফমোড়া রাস্তা বেয়ে উঠে বা নেমে আক্রান্ত গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতেই জ্যাম খুলে সবাই বুম লা পৌঁছে যাবে। এই সব পরিস্থিতিতে বোঝা যায় মেন্টাল হেলথ নিয়ে যত হুলাবিলা, এদিকে ফিজিক্যাল হেলথের অবস্থা আরও কত বেশি শোচনীয়। কাজেই সবাই ছোটখাটো রামুগিরিতে নিয়োজিত হলাম। ড্রাইভারের মাথার ওপরের ফ্ল্যাপে তাড়াহুড়োয় গুঁজে রাখা পাস জানালা দিয়ে উড়ে গেলে, আহাহা এর জন্য আবার আপনি কষ্ট করবেন না দেভজী, বলে দৌড়ে গিয়ে সে সব কুড়িয়ে আনা। ওঁরা যখন দল বেঁধে গাড়ি উদ্ধারে চলেছিলেন, ছবি তোলা বন্ধ রেখে পথ ছেড়ে দাঁড়ানো, চাকায় চেন পরানোর সময় কেউ জোরে হেসে উঠলে ঠোঁটে আঙুল রেখে শ্‌শ্‌শ্‌ করা, পাছে কনসেন্ট্রেশনে ব্যাঘাত ঘটে।

এই করে বুম লা-য় পৌঁছনো গেল।


জায়গাটা চিনের বর্ডার এবং আর্মির ঘাঁটি। এখানে আপনি নিজের মনে ঘুরে বেড়াবেন, হবে না। বোকার হদ্দ টুরিস্টদের দেখে শিউরে উঠে ঢাল বেয়ে নেমে পড়বেন কিংবা উঠে যাবেন, নেমে এসে মুচকি হেসে বলবেন, ওই দিকটাতে গেলে না, ওইখানটা থেকেই তো আসল ভিউ, হবে না। এত হবে না-তে ঘাবড়ানোর কিছু নেই কারণ আনন্দ হবে যথেষ্টর থেকে বেশিই, গ্যারান্টি। গাড়ি থেকে নেমে আপনাকে ঢুকতে হবে সামনের ওই লাল ছাদওয়ালা বাড়িটায়। বেসিক্যালি একটা ঘর, এক কোণে চেয়ার টেবিলে খাতাপেনসিল নিয়ে বসে আছেন একজন জওয়ান, নাম লিখে নেবেন গোটা গ্রুপের। তারপর সে সব নামের বদলে নতুন একটা নাম দেবেন। আমাদের গ্রুপের নাম বি-তেইশ। এবার কী করব জানতে চাইলে বলবেন, কী আর করবেন, কফি-শফি পিজিয়ে, সামোসা-ওয়ামোসা কা আনন্দ লিজিয়ে। যখন ডাকবে এই দরজার সামনে চলে আসবেন।

ঘরের উল্টোদিকে লম্বা কাউন্টার, একদিকে আর্মির ছাপসম্বলিত নানারকম পোশাক বিক্রি হচ্ছে, টুপি, জ্যাকেট, নাকঢাকা মাফলার। আরেকদিকে খাদ্যবস্তুসমূহ। আমরা কোথাও কিছু কিনি না কারণ আমাদের বাড়িতে সে সব জিনিস রাখার জায়গা নেই, সোজা খাদ্যের দিকে ধাইলাম। সুপ, কফি, ম্যাগি, সামোসা। সবের দাম একধারসে তিরিশ। চয়েসের চিরন্তন প্যারাডক্স। যখন একটামাত্র চ্যানেল, শিল্পজগৎ দেখতে বসলেও শিহরণ, এদিকে পঁচিশটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখার মতো একটা প্রোগ্রাম খুঁজে পাওয়া যায় না। বিগ চিল-এর ষোল পাতার মেনু থেকে গত ষোল বছর ধরে স্রেফ দুটি পিৎজা খেয়ে যাচ্ছি, মেনুতে যখন চারটে আইটেম তখন তার মধ্যে তিনটিই খাব। দু'কাপ করে কফি, এক প্লেট করে সিঙাড়া (এক প্লেটে দুটো থাকে), এক প্লেট করে ম্যাগি খেয়ে ফেললাম। একবারে নয়, খেপে খেপে। হাতে সময় ছিল। একটা গ্রুপ তক্ষুনি রওনা দিয়েছে, দেখেছি। তাঁরা হেঁটে হেঁটে বর্ডারে যাবেন, গাইড জওয়ানের বক্তৃতা শুনবেন, ফিরবেন, এইসব করতে টাইম লাগে। 

সুপটাই বা বাকি থাকে কেন ভাবছি, জলদগম্ভীর হাঁক এল। বি-তেইশ! দৌড়ে গেলাম। দরজার বাইরে ছোট্ট ভিড়ে জুটলাম। বি-চব্বিশও হাজির। খালি বি-পঁচিশ এলেই হাঁটা শুরু করা যায়। অনেকক্ষণ হাঁকাহাঁকির পর একজন জওয়ান নিজেই ভেতরে ঢুকলেন তদন্ত করতে। খানিকক্ষণ পর চেঁচিয়ে খবর দিলেন, বি-পচ্চিস ম্যাগি খা রহা হ্যায়। বি-পচ্চিস লজ্জিত মুখ মুছতে মুছতে এসে যোগ দিলেন। হাঁটা শুরু হল।

অ্যাকচুয়ালি, হল না। এরোপ্লেন গড়াতে শুরু করার আগে যেমন সতর্কতামূলক ডেমো দেওয়া হয়, বর্ডারের দিকে হাঁটা শুরু করার আগে প্রস্তুতিমূলক টক-এর ব্যাপার থাকে। গাইড জওয়ান ভদ্রলোক, খামোশ! বলে নিয়মাবলী শুরু করলেন। সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট। সরল এবং কার্যকরী। এক, ক্যামেরা বার করবেন না। দুই, যেখান দিয়ে যত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার বাইরে একটি পা রাখবেন না। আর তিন, ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হল উপায় থাকলে তিনি হাত জোড় করতেন, বর্ডারে গিয়ে চায়না মুর্দাবাদ গোছের কথাবার্তা বলবেন না।

এ ঘটনা আগে ঘটেছে, বোঝাই গেল।

রাস্তা অল্প, দুশো মিটার মতো। দু’পাশে বরফের সমুদ্রের মধ্যে কয়েকটা বাড়ি। আর্মির অফিস, হাই লেভেল মিটিংটিটিং হয়। ততক্ষণে আকাশ থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি সাদা সাদা কীসব পড়তে শুরু করেছে। ভিড়ে জনাপাঁচেক নি-রিপ্লেসমেন্টও ছিলেন, কাজেই সবাই ধীরে ধীরে হাঁটছিল। অবশেষে একটা নীল ফিতের সামনে গিয়ে ভিড় থামল। অনতিদূরে লেভেল ক্রসিং-এর মতো একখানা ডাণ্ডা। ভারতবর্ষের শেষ। হাতপঞ্চাশ খালি জমি। জমি পার হয়ে আবার একটা লেভেল ক্রসিং মার্কা ডাণ্ডা। চিনের শুরু। ডাণ্ডার ওপারে উর্দি পরা দুজন সৈন্য। পা বরফে গাঁথা, মাথায় টুপি, গলায় ঝুলন্ত বন্দুক। বেলুন ফাটানোর নয় যে স্পষ্ট। বন্দুকের বাঁটে হাত।

বন্দুক ছেড়ে হাত উঠল। আকাশে নড়ল। কাদের হাই বলছে, আমাদের নাকি? অর্চিষ্মান ভিড়ের কোথায় কে জানে, পাশের মহিলাকে জিজ্ঞাসা করতে যাব, দেখি ততক্ষণে রিফ্লেক্সে তাঁর হাত আকাশে উঠেছে, কাজেই ভুল দেখিনি। আমিও হাত নাড়লাম। ভিড়ের আরও কয়েকজন নাড়লেন। তারপর ওদিকের হাত আকাশ থেকে নেমে বুকের কাছে অন্য হাতের সঙ্গে জড়ো হল। স্পষ্ট গলায় চেঁচিয়ে দুই সেনানী বললেন, নমস্তে। এতক্ষণে ভিড়ের সবারই কানে পৌঁছেছে কথাটা। সবাই চেঁচিয়ে নমস্তে বলল। তারপর ওঁরা গলায় ঝোলানো ক্যামেরা, যা বন্দুকের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল, দিয়ে আমাদের ছবি তুললেন। আই গেস, ওঁদের পারমিশন আছে। পাশের ভদ্রমহিলা চমৎকার, বাঁ হাতে ভিক্টরি সাইন ডানহাতে কাঁচকলা দেখিয়ে পোজ দিলেন। বরফ বেশ জোরে পড়তে শুরু করেছে। যাঁদের দাঁড়াতে অসুবিধে হচ্ছে তাঁদের জন্য চেয়ার আনানো হয়েছে। গাইড জওয়ান জানতে চাইলেন, খারাপ ওয়েদারের জন্য যা বলার ডিটেলে বলবেন নাকি শর্টে, সবাই চেঁচাল, ডিটেলে ডিটেলে। তখন তিনি গলা ঝেড়ে উচ্চস্বরে উনিশশো বাষট্টিতে কবে কখন কীভাবে চিনা বাহিনী ভারত আক্রমণ করেছিল এবং ভারতীয় সেনা সীমিত ক্ষমতায় কীভাবে তাঁদের ঝেড়ে কাপড় পরিয়েছিল এইসব শুরু করলেন। ভাবছি কারও একটা বলা দরকার, কেউ না বললে আমিই বলব নাকি যে আস্তে বলুন শুনতে পাবে। লেভেল ক্রসিং-এর ওপারে আড়চোখ চালালাম। যাক বাবা ওঁরা শুনছেন না, কারণ একজন ভারতীয় জওয়ান ক্রসিং পার করে ওঁদের দিকে পৌঁছেছেন, ওঁদের পোস্টের খাম্বা জড়িয়ে ধরে গল্প করছেন। একটা কুকুর, বাদামী আর সাদা, মাতব্বর টাইপ, ভারতীয়, দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। পাছে কূটনীতিক আলোচনা কিছু মিস হয়ে যায়। এদিকে সেনা পোস্ট চব্বিশঘণ্টার হলেও ওদিকের পাহারা দিনে কয়েকঘণ্টার মাত্র। কাজেই দৈনন্দিন হাই হ্যালোর এটাই সময়। তারপর আশেপাশের বাড়িগুলোতে কবে কবে মিটিং হয়, কারা কারা আসেন এই সব বুঝিয়ে গাইড বললেন যে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, বাষট্টির পুনরাবৃত্তি আর হতে দেব না, আমরা সদাসতর্ক এবং প্রস্তুত। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, বাঁচালেন, ইত্যাদি বলে ফিরতি যাত্রা শুরু করার আগে চৈনিক প্রহরীদের টা টা করা হল, ওঁরাও প্রত্যুত্তরে টা টা করলেন।


আবার সেই সামোসা ম্যাগির হল পেরিয়ে এদিকে এসে আবার খেলাধুলো। বরফ ততক্ষণে জোরে পড়তে শুরু করেছে। শুনুন, আমরা খুব খারাপ ছবি তুলি, কাজেই এই সব ছবি দেখে জায়গাটার চেহারা আন্দাজ করার চেষ্টা করবেন না। জায়গাটা আসলে এর থেকে এককোটিগুণ সুন্দর। তাছাড়া কত ছবি তুলব? কোনদিকটার ছবি তুলব? কোন ভিউটা বেশি সুন্দর? কোনটা অল্প কম? কোনটা চলেব্‌ল্‌? কোনটার ছবি না তুললেও চলবে? অর্চিষ্মান শেষমেশ হাল ছেড়ে বলল, এ তো দৃশ্যের ভোজ। সে ভোজের মর্যাদা করার মতো খাইয়ে আমরা নই। কাজেই একটা সময় ক্যামেরা গুটিয়ে এই মহাভোজে দৃষ্টি ভাসিয়ে বসে রইলাম। পাথর জড়িয়ে সাক্ষী, ক্যামেরা বাগিয়ে দীপক, আমার মুখে অর্চিষ্মানের চোখ, আমাদের হেসে ওঠা, বরফ-ঠিকরোনো সূর্যে আমার তোবড়ানো জীবনের খণ্ডমুহূর্তটি ঝলমলিয়ে উঠল এবং চিরকালের মতো চলে গেল আমাকে ছেড়ে। চোখ যা দেখার দেখল, স্মৃতি যতটুকু যা কুড়োনোর কুড়িয়ে নিল। খানিকক্ষণ পর দেভ ডাকল, গাড়িতে ফিরে এলাম।



Comments

  1. osadharon bhalo laglo.. ekbar jemon kore hok jetei hobe..

    khub bhalo thakben

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী।

      Delete
  2. সব কটা পর্ব একসাথে পড়লাম। দারুণ ঘুরেছ, দারুণ লিখেছ। খুব ভালো লাগলো।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রে, এখনও একটা পর্ব বাকি আছে তো।

      Delete
    2. সেটা জানি। এখনো অব্দি যতগুলো পড়েছি তার হিসেবেই বললাম আর কি।
      -প্রদীপ্ত

      Delete
  3. Ki chomotkar ghurlen! Aro chomotkar tar bornona. Amar sob somoy e ghorar thekeo porey ghorar golpo kortei beshi bhalo lage. Ha, chobir thekeo jaega ta beshi sundor hoar kotha. Kintu chobi gulo o khub sundor hoeche.......Moutushi

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, মৌটুসি। ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল। না না ছবি খুবই খারাপ। কিন্তু এক, আমি ছবির পেছনে পরিশ্রম করি না যেহেতু এর খারাপত্ব মেনে নিতে আমার কষ্ট হয় না। দুই, আমার হাতে থাকলে আমি ছবি দিতামই না। বিশ্ববিখ্যাত ভ্রমণকাহিনীর কোনওটাই ছবি দিয়ে লেখা হয়নি, কিন্তু এই লেখাটা সেই স্ট্যান্ডার্ডের তো নয়, আর লোকে ইন্টারনেটের কনটেন্টে ছবি এক্সপেক্ট করে। কাজেই।

      Delete
  4. অসাধারণ অভিজ্ঞতা, লেখাও তেমনি তোমার কাছ থেকে যেমন হবার কথা| এটা ঠিক যে ছবি কখনো আসল সৌন্দর্যকে ধরতে পারেনা| ছবি তুলতে গেলেই মনে হয়, এ কেন তুলছি, এ তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না| কিন্তু না তুললেও নয়| এই যে তোমরা তুলে শেয়ার করলে তবে আমরা কিছু হলেও তো বুঝতে পারলাম| খুব ভালো লাগলো| তোমার ছবিটা সুন্দর, জ্যাকেটটা জব্বর|
    ওখানকার জওয়ানরা মনে হয় লোকজনকে সেবা করে একটু মনোটোনাস জীবন থেকে মুক্তি পান| রাস্তা থেকে তো বরফ তুলে ফেলা হয়েছে, তবু গাড়ির চাকায় চেন পড়াতে হয়েছে?
    ওখানকার নুডলসের বর্ণনা খুব লোভনীয় লাগলো, ম্যাগি তো খাইনা| ম্যাগি নিয়ে এত রোমান্টিসিজম, এই জন্য খেতে আর ভালোবাসতে হবে মনে হচ্ছে|

    ReplyDelete
    Replies
    1. জ্যাকেটটা খুব খুশি হয়েছে, অমিতা। কেউ ওকে নজর করেছে দেখে। আমারও খুব পছন্দের জ্যাকেট। খুব কাজের, আমার তো দেখতেও ভালো লাগে।

      গাড়ির চাকায় চেন পরাতে হল বোধহয় সাইডের চাকাগুলো বরফে ঢুকে যাচ্ছিল বলে। এর বেশি আমি জানি না টেকনিক্যাল ব্যাপারস্যাপার। জওয়ানদের ব্যাপারটা ঠিকই বলেছেন হয়তো। ওখানে একা একা বরফে বসে থাকার পর বাঁদর টুরিস্ট সামলাতে হয়তো অত খারাপও লাগে না। যদিও আমি নিজে সেই টুরিস্টদের চেহারা দেখেছি বলে (নিজেকেও ফেলছি ওই দলে) বিশ্বাস করি না যে ও কাজটা কারও ভালো লাগতে পারে। তবে কিছুই বলা যায় না।

      আমাকে একজন এই অবান্তরেই না গুরুচণ্ডা৯-তে যেখানে পান্তাভাত নিয়ে একটা লেখা বেরিয়েছিল, বলেছিলেন যে পান্তাভাত হচ্ছে সেই টাইপের খাবার যেটা ভালোলাগতে হলে ছোটবেলায় খেতে হয়। আমার বিশ্বাস, ম্যাগিও সেই ধরণের খাবার। ছোটবেলার থেকেও বেশি করে হোস্টেলে মাঝরাতে খিদে পেলে ম্যাগি খাওয়া, ম্যাগির প্রতি একটা আমরণ কমিটমেন্টের জন্ম দেয়। কাজেই আপনার খেয়ে মনে হতে পারে যে এর জন্য এত কী, কিন্তু একটা বয়সের পর ম্যাগিকে ভালোবাসা যত না ম্যাগির খাতিরে, তার থেকে বেশি ফেলে আসা একটা সময়ের জন্য।

      Delete
    2. জ্যাকেটটা দেখতে তো খুবই ভালো, আর কাজের সেটাও দেখে মনে হলো| তাই সব দিক দিয়ে জব্বর|
      ম্যাগীর এই রাত জেগে হোস্টেলে খাবার ব্যাপারটা আর সেই থেকে যে ভালোবাসার জন্ম সেটা অনেক জায়গায় পড়ে শুনে খুব ভালো জানি| আমিও দুবছর মাস্টার্সের জন্য হোস্টেল, তারপর চার বছর শিলঙে ওয়ার্ককিং উইমেন্স হোস্টেলে ছিলাম কিন্তু কি করে জানিনা ম্যাগী বাদ পড়ে গেল| বোধহয় আরো পরে ম্যাগি চালু হয়েছে| হোস্টেলের রুমে লুকিয়ে হিটার বা এমনকি কেরোসিন স্টোভে রুটি বা পরোটা আর বেগুনভাজা অমৃত লাগতো| বাড়িতে নানা রকম ম্যাগি আছে, সুপার হট কোরিয়ান ইনস্ট্যান্ট নুডল, জাপানীজ সেও আছে| ছেলে মেয়ে সব চলে গেছে, এখন একদিন বানিয়ে খাবো|

      Delete
    3. অমিতা, আপনার সঙ্গে এতদিনের আলাপ এই কমেন্ট বক্সে, সেই অধিকারে এই আবদার করছি। ম্যাগির সঙ্গে জাপানিজ, কোরিয়ান নুডলদের এক করে দেখবেন না। ওরা হয়তো ম্যাগির থেকে বেশি ভালো কিংবা কম ভালো, কিন্তু ম্যাগি না। ম্যাগির ব্যাপারে আমি নির্লজ্জ জাতীয়তাবাদী। এমনকি ওয়াই-ওয়াইকেও যারা ম্যাগির থেকে ভালো বলে তাদের সন্দেহের চোখে দেখি।

      ম্যাগি খান। অন্যগুলোও খান। কিন্তু কথা দিন, ম্যাগির তুলনা আর কারও সঙ্গে করবেন না।

      Delete
    4. হাহাহা, লেখার পরেই মনে হয়েছে এই রে কুন্তলা রেগে যাবে, কেন বললামনা যে ম্যাগিও খাবো, বাড়িতে সেটাও আছে| অন্যগুলোকে ম্যাগি না বলে জাস্ট ইনস্ট্যান্ট নুডল বলা উচিত ছিল| তবে Indomie Mi Goreng ইনস্ট্যান্ট নুডলটা খেয়ে দেখতে পারো কেমন লাগে|

      Delete
    5. খেয়েছি, অমিতা। আমার মিষ্টি লেগেছে। অর্থাৎ ভালো লাগেনি।

      Delete
    6. ও আচ্ছা আমি খাইনি কিন্তু ছেলেমেয়েদের জন্য কিনেছিলাম আর ওরা বানানোর সময় গন্ধটা ভালোই লাগছিলো

      Delete

Post a Comment