তাওয়াং ৩ঃ সেলা পাস



দিরাং গ্রাম

দিরাং আসার পথের একটা হাইলাইট লিখতে ভুলে গেছি। সেভেন সিস্টারস না ব্রাদারস নামের একটা দোকানে অগ্নিক সবাইকে থামিয়েছিল। সেখানে ভেজ, চিকেন, পর্ক থালি আর চাউমিন পাওয়া যায়। ভেজ থালি নেব নেব করেও ভেজ চাউমিন নিয়েছিলাম। অর্চিষ্মান পর্ক না চিকেন কীসের থালি নিয়েছিল। চাউমিনটা খুবই ভালো এবং এত বহুল পরিমাণে যে খুব স্পিডে খেয়েও, যাতে ব্রেনে পেট ভরে যাওয়ার সিগন্যাল পৌঁছনোর আগেই যতখানি সম্ভব খেয়ে নেওয়া যায়, অর্ধেক প্লেটের পর আর এগোনো যায়নি। এদিকে অর্চিষ্মান নিজের খাবার মুখে দিয়ে থেকে হাহুতাশ শুরু করেছে। কী মিস করলে কুন্তলা। কেন ভেজ থালি নিলে না। ওর থালিতে যে নিরামিষ পদগুলো ছিল সেগুলো নাকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো ভালো। প্রমাণ হিসেবে আমার প্লেটের খালি অর্ধেকে ডাল, শাকের মতো কী একটা আর সয়াবিনের তরকারি তুলে দিল। ভালো বটে। বিশেষ করে সয়াবিনের তরকারিটা। চায়ের মতো খাবারের পলিসিতেও বদল আনলাম। এর পর থেকে সর্বত্র থালিি নিয়েছি। পাহাড়ের ডাল ভাত তরকারির জবাব নেই।


অর্চিষ্মান বলল, 'চলো লেট’স গো' মনে পড়ছে না?

গল্প সিনেমার নাম ভুলে যাওয়া আমার একটা কমন ঝামেলা। তার ওপর সিনেমার নাম আজকাল এত একরকম। ব্যোমকেশ গোত্র, ব্যোমকেশ পর্ব, ব্যোমকেশ ফিরে এল। আবার ব্যোমকেশ, হর হর ব্যোমকেশ, বিদায় ব্যোমকেশ। চলো লেট’স গো, চলো পালটাই, চলো মন নিজ নিকেতনে। মহা  কনফিউজিং।

ক্লু দিতে মনে পড়ল। সিনেমাটা আমাদের বেশ পছন্দের। একাধিক বার দেখেছি। চার বন্ধু শাশ্বত, পরমব্রত, রুদ্রনীল এবং ঋত্বিক - একটা ভ্রমণ কোম্পানি খুলে নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছে এবং পথে নানারকম কাণ্ডকারখানা ঘটছে।

বাড়ির ছাদে মাংস শুকোচ্ছে

অর্চিষ্মান যে দৃশ্যটা পার হয়ে এসে মন্তব্যটা করল সেটা দেখে সিনেমাটার কথা মনে পড়াই স্বাভাবিক। শনিবার সন্ধেয় আমাদের অর্থাৎ পঙ্কজের গাড়ি আর ইউটিউবারদের অর্থাৎ হিমাংশুদের গাড়ি এসে পৌঁছেছে দিরাং-এ। অনেক রাতে তাওয়াং টুরস-এর তৃতীয় এবং শেষ গাড়ি যেটা অগ্নিক নিজে চালাচ্ছে সেটা এসে পৌঁছেছে। অগ্নিক, পঙ্কজ, হিমাংশু ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে একই প্যাকেজে তিনটে বুকিং আসায়, তিনটে গাড়ি একসঙ্গে ছেড়েছে। এবং তিনজন একই সঙ্গে মুভ করছে। বা করতে চাইছে।

আমি হলেও চাইতাম। আমার দুই বন্ধু আমার কমন রুটে কমন সময়ে হাঁটলে আমিও তাদের সঙ্গেই হাঁটতে চাইতাম। আগেপিছে না। অর্থাৎ একজন যদি সকাল আটটায় বেরোতে চায় তাহলে বাকি দুজনও সকাল আটটায় বেরোতে চাইবে। সন্ধে ছ’টার মধ্যে একজন ফিরতে চাইলে বাকি দুজনও ওর মধ্যেই ফিরতে চাইবে। একজন যদি দেখে একটা সাইট থেকে বাকি দুটো গাড়ি হুশ হুশ করে বেরিয়ে গেল তাহলে তারও বেরিয়ে যেতেই ইচ্ছে করবে। অর্থাৎ যেটা দাঁড়িয়েছে, সেটা হচ্ছে যে যদিও আলাদা আলাদা গাড়ি, আলাদা আলাদা বুকিং, আসলে তিনটে ফ্যামিলির ছ’জন সদস্য একইসঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছে মনে হচ্ছে। এবার সেটাতে আপনি কতটা বিচলিত হবেন ডিপেন্ড করবে আপনার পরিস্থিতি ও মানসিকতার ওপর। আমাদের এবং আরেকটি ফ্যামিলির কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু ইউটিউবার পরিবারের হচ্ছিল। ওঁরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ঘুরতে চাইছিলেন। ওঁদের দরকারও ছিল। আমরা তো খালি চোখে দেখেই খালাস, ওঁদের তো ক্যামেরাকেও দেখাতে হচ্ছিল। এই কথাটা এত ফেনিয়ে লিখলাম মানে এই নয় যে এই নিয়ে খুব গোলযোগ  হয়েছিল, একটা অতৃপ্তি হয়তো লালন হচ্ছিল কারও মধ্যে। যেটার জন্য এই প্রসঙ্গটার অবতারণা সেটা হচ্ছে ওই ‘চল লেট’স গো’-র রেফারেন্সটা।

রবিবার সকালে হোমস্টে-র বারান্দার রোদে অগ্নিক, হিমাংশু আর পঙ্কজ গালে টুথব্রাশ গুঁজে ড্রোন ওড়াচ্ছিল আর হাসছিল। যেটা দেখেই অর্চিষ্মানের ওই উক্তি। দিরাং থেকে তাওয়াং-এর রাস্তা ঘটনাবহুল হলেও দূর নয়, দেড়শো কিলোমিটার। তিনশো কিলোমিটার পার হয়ে এসে দেড়শো কিলোমিটার বেশি ঠেকে না। ঘোড়ায় জিন দিয়ে বেরোনোর ব্যাপার নেই। কাজেই খেলাধুলো। আমাদের ব্রাশট্রাশ সারা অনেকক্ষণ। চা লুচিতরকারিও। এত তৎপরতার কারণ ছেড়ে যাওয়ার আগে অন্তত ঘণ্টাখানেক হাঁটাহাঁটি না করলে শহরটা দেখেছি দাবি করতে বাধবে।


বেরোনোর উপক্রম হলে পিং কোর, কাছেই আছি, অনুরোধ জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সুন্দর রোদ। ঝরঝর করে ঝরনা মিশেছে নদীতে। নদীর ধার বেয়ে গ্রাম, ছোট মন্দির, কমলালেবুর গাছ। গাছগুলো অদৃশ্য প্লাস্টিকে মোড়া বোকের মতো গোছানো। হেঁটে বেশিদূর যাওয়ার উচ্চাশা নেই, খালি নদীর ধার ধরে একটুখানি গ্রামের ভেতর সরেজমিন ঘোরাঘুরি। পিং আর আসে না। শেষে গ্রাম ঘোরা সেরে সদ্য খোলা মুদি দোকানের ফ্রেশ ঝাঁট দেওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুচুরমুচুরের ঝুলি রিপ্লেনিশ করার মতো চিপস্‌ আর লজেন্স কিনে বাড়ি এলাম। সবাই গা-মোড়া দিতে দিতে বেরোচ্ছে।


দিরাং ছাড়ার আগে একটা জিনিস দেখে নিতে হবে। দিরাং মনাস্টেরি। মনাস্টেরি দেখেছি আগেও। এমন গ্র্যান্ড এবং জমকালো আগে দেখিনি। এরা অম্লানবদনে এই পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি রাস্তায় রোজ ওঠে আর নামে কী করে ভগবান জানে। নুনের ছিটে দেওয়ার জন্য একজন ঘাড়ে একটা সিলিন্ডার নিয়ে আমাকে ওভারটেক করে গেলেন।

গমগম শব্দে মন্ত্রোচ্চারণ চলছে। মাঠে ঘাস খাচ্ছে পুষ্ট গরু, লামা বাচ্চারা দেড় হাত দেহে কে জানে কত শত হাত মেরুন কাপড় সামলে লালপিঁপড়ের ঝাঁকের মতো দৌড়োদৌড়ি করছে। বেঁকানো রাস্তায় উঠতে উঠতে এইসব দেখতে দেখতে একটা কথা ভাবছিলাম। অর্চিষ্মান একটু আগে আগে হাঁটছিল।  থেমে পেছন ফিরে হাঁটতে পেছন ফিরে আমার মনে হওয়া কথাটাই আমাকে বলল। সত্যজিৎ রায় হলে এই গোটা ব্যাপারটার দু’লাইনে বর্ণনা দিয়ে দিতেন, বল?

মূল মন্দিরে প্রধান পুরোহিত মূর্তির দিকে মুখ আর আমাদের দিকে পিঠ করে বসেছেন। উজ্জ্বল হলুদ পোশাক। হল জুড়ে মিনি ম্যাট্রেস পাতা। পেছনদিকের একটায় বসলাম। সামনের দিকে বাচ্চা লামারা, কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্কও আছেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লামা ঘুরে ঘুরে তত্ত্বাবধান করছেন। বাচ্চাদের বিশেষ করে। কার বসতে অসুবিধে হচ্ছে, কে ছোট হাতে পোশাক ম্যানেজ করতে পারছে না, কে  সহপাঠীর সঙ্গে হাঁটু ঠোকাঠুকি করছে - প্রসন্ন মুখে সমস্ত সমস্যার সমাধান করছেন। বহিরাগত দর্শনার্থীও আছেন কিছু, তাঁরা সম্ভবতঃ মন্ত্রেরই বই কোলের ওপর খুলে রেখে পড়ছেন। বেশ একটা হুমহাম গুঞ্জন ঘনিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ শুনলে মন্ত্রের সম ফাঁক আবর্তন বোঝা যায়। শুনলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে চার দেওয়াল, সিলিংজোড়া রংচঙে ছবি দেখলাম। বুদ্ধের অবতার, উড়ন্ত লামা, ড্রাগন, রাক্ষসখোক্কস। হঠাৎ দেখি একজন আমাদের দিকে হনহনিয়ে আসছে।

ধর্মস্থানে আমার অস্বস্তি হয়। যতই ঘাড় নিচু করে চলি না কেন কিছু না কিছু ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। হয় পোশাক ভুল, নয় মুখভঙ্গি ভুল, নয় যেখানে হাত না রাখার রেখে দিয়েছি, যেখানে পা না ফেলার ফেলে দিয়েছি। দুয়েকটা হোমরাচোমরা ধর্মের ঠেকে তো নিজেই বকা খেয়েছি, ঢের বেশি বার দেখেছি অন্যকে বকা খেতে। মেয়েটিকে আসতে দেখেই আমার ফ্লাইট মোড অন, ভাবছি বকা শুরু হওয়া পর্যন্ত থাকব নাকি এখনই দৌড়ব? অর্চিষ্মানের জন্য অপেক্ষা করব নাকি কা তব কান্তা আওড়াব? এইসব ভাঁজতে ভাঁজতে মেয়েটা একেবারে ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে। কাকে জিজ্ঞাসা করে ঢুকেছ? পুজো চলছে দেখতে পাচ্ছ না? সারা পৃথিবী কি তোমাদের বেড়ানোর জায়গা পেয়েছ যে ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে ঢুকে পড়েছ - শুরু হবে ভাবছি, ও মা মেয়ে দেখি হাসছে। আমাদের হাতে কী একটা গুঁজছে, ও মা এ যে কাপ। অন্য হাতের কেটলি থেকে কাপে চা ঢালছে। বলছে, ওয়েলকাম। আমাদের লোসার ফেস্টিভ্যাল চলছে, টিবেটান নববর্ষ। পনেরো দিনের ধুমধাম, পরশু পূর্ণিমায় কালমিনেশন। চা খাও, তারপর চল প্রসাদ দিচ্ছি।

এই মন ভালো করা মানুষটির নাম পেমা। মাই ফ্রেন্ডস কল মি অঞ্জলি, জানাল পেমা।

লোকে বলে সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র এবং বিন্দুমাত্র ভুল বলে না, কিন্তু মাত না দিতে পারলেও যে জিনিসটা, বা জিনিসগুলো, সৌন্দর্যর সঙ্গে কানায় কানায় টক্কর দিতে পারে তারা হল চার্ম আর লাইকেবিলিটি। পেমা সুন্দর তো বটেই, কিন্তু নাকচোখমুখের মাপের থেকে পেমাকে এককোটি গুণ সুন্দর করেছে ওর হাসিমুখ, বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার, বাদ দেওয়ার বদলে জুড়ে নেওয়ার অ্যাপ্রোচ এবং গোটা ব্যাপারটার নিখাদতা। পেমা সাজছে না, সাজাচ্ছে না। পেমা সত্যি চায় আমরা ওদের উৎসবে সামিল হই। চা খাই, প্রসাদ পাই। মিষ্টি পোলাও প্রসাদ, এক প্লেটেই আমাদের হয়ে যাবে শুনে বলল, দাঁড়াও তাহলে বেশি করে ড্রাই ফ্রুটস দিই। বলে একগাদা কাজু, কিশমিশ চামচে করে ঢেলে দিল। মঠ ঘুরতে ঘুরতে আরেকবার দেখা হল যখন, ওর হাতে গ্লাস, গ্লাসে চায়ের মতোই একটা পানীয়। উৎসাহভরে জানতে চাইল, একটু বাটার টি চেখে দেখবে নাকি? আমরা ফাটো ফাটো হয়েছিলাম, না করলাম। পেমার মুখ দেখে মনে হল, হ্যাঁ বললেই হত।

দিরাং-এর ঝকঝকে সকালটা ঝলমলে করে দিল পেমা। বন্ধুরা যাকে অঞ্জলি বলে ডাকে।


মনাস্টেরি মনে থাকবে, মাঠটা, গলায় ঘণ্টা বাঁধা গরুটা, আকাশবাতাস গমগমানো মন্ত্রোচ্চারণ, ছোট ছোট লামার দৌড়োদৌড়িও ভুলব না। ছবিও রইল। কিন্তু যার ছবিও নেই, যাকে দেখতে উজিয়ে পাহাড় চড়িনি, সেই পেমাকে এই সবকিছুর থেকে অনেক বেশি, অনেক স্পষ্ট করে মনে থাকবে। পেমা অনেকদূর যাবে, আমি জানি। পৃথিবীর পথে হাঁটতে যে বিরল গুণ লাগে তার অনেকগুলো আছে পেমার। আমার সমস্ত ভালোচাওয়া পেমার জন্য রইল।

চলতে চলতে মনে করে রাখার চেষ্টা করি রাস্তার কোন জায়গাটা মেঘ হয়েছিল, কোন জায়গাটা রোদ, কোন জায়গাটা বৃষ্টি। কোন মোড়ে যে কানের ভেতর তিমির বিশ্বাস, অনির্বাণ দাসের লেখা এবং সুর দেওয়া লাইনগুলো গেয়ে উঠলেন, 'এই কান্না চাপা রাতে, ভেজা কনকচাঁপা হাতে/ কালো আঁধারে মিলিয়ো, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো. . .'  মনে পড়ে না। কেবল মনে পড়ে উপত্যকা থেকে ঘনিয়ে উঠছিল সন্ধের কুয়াশা, পাহাড়ের মাথায় মাথায় মেঘেরা জমছিল, আর মনে হয়েছিল অটোচড়া দিনরাতে, ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষকোটিবার নয়, লাইনগুলো প্রথমবার শুনলাম জীবনে। যাওয়ার না ফেরার পথে, সকালে না বিকেলে, চড়াইয়ে না উতরাইয়ে মনে নেই, মনে আছে একটা ব্রিজের পাশে থামা হয়েছিল, ব্রিজটার শরীরময় তিব্বতি স্টাইলের তিনকোণা রঙিন রুমাল টাঙানো। আরেকবার চা খেতে নামলাম, সবাই কমলালেবু কিনল। অর্চিষ্মান বলল, নেব? লোভ হচ্ছিল, প্লাস্টিকের ভেতর উজ্জ্বল ফলের দল, কিন্তু নিতে হলে দু'কেজির প্যাকেট নিতে হবে। চিবোনোটিবোনো ছেড়ে দিলাম, দু'কেজি লেবু ছাড়ানোর উদ্যমই আমাদের নেই। আমাদের পক্ষে দুধচিনি ছাড়া দু’কাপ চা আর এক প্যাকেট বিংগো টেড়েমেড়ে নেওয়াই সমীচীন হবে।

কাল গুয়াহাটি থেকে দিরাং আসতে সমতল বদলে পাহাড় হয়েছিল, আজ দিরাং থেকে তাওয়াং যেতে পাহাড় আরও উঁচু হবে। তাওয়াং-এর হাইট দিরাং-এর ডবল। আর যোগ হবে বরফ। বরফের সঙ্গে প্রথম দেখা হবে সেলা পাসে। সেলা পাস হল গিয়ে একটা ভীষণ উঁচু মোটরযোগ্য রাস্তা,  পশ্চিম কামেং আর তাওয়াং জেলার বর্ডারে। রাস্তায় বর্ডার রোডস অ্যাসোসিয়েশন-এর বোর্ডে লেখা দেখেছি, সেলা পাস স্টেটাস গ্রিন। অর্থাৎ রাস্তা খোলা। বাবা সাবধান করে রেখেছিলেন, সেলা পাসে ঠাণ্ডা হবে।  হাল্কা সোয়েটার পরে বেরিয়েছিলাম, গামবাট কোটপত্র সিটে রাখা ছিল। দূর থেকে বরফ দেখতে পেলাম, সেলা পাস এসে গেল, নামার আগে কোট পরে নিলাম তাতেও হাড় নড়ে গেল। মেঘ, টিপটিপ বৃষ্টি, হু হু হাওয়া। সহযাত্রীরা এমনি জামাকাপড় পরে নেমে পড়ে বাবাগো মাগো বলে দৌড়ে দৌড়ে গাড়ি থেকে গরমজামা জোগাড় করতে লাগলেন।


সত্যজিৎ রায় ছাড়াও অর্চিষ্মান আর আমার কিছু টেলিপ্যাথি আছে। গাড়ি থেকে নামারও আগে দুজনেই দেখে ফেলেছি 'প্রহরী ক্যাফে' লেখা ছোট্ট বোর্ড। বরফভেজা সিঁড়ি উঠে ছোট্ট গুহা, গুহার ভেতর দিকের দেওয়ালে চৌখুপি জানালা একমাত্র আলোর উৎস। ওমের উৎসও ওইদিকেই কোথাও হবে। কাউন্টারের  জওয়ান, আমাদের, অর্চিষ্মান ভুরু কোঁচকানোর আগেই বলি, আমার অবস্থা দেখে বললেন, আপ উধর যাকে বৈঠিয়ে ম্যাডাম, হিটার কে পাস।


এবারের তাওয়াং ভ্রমণ আমাকে এত উদ্বেলিত করেছে কারণ এই ভ্রমণে আমি এমন কিছু জিনিস অভিজ্ঞতা করেছি যা আগে করিনি। অনেকে হয়তো আমার থেকে ঢের কম বয়সে করে, বা অভিজ্ঞতা করতে লাগে না, নিজেরাই বুদ্ধি খাটিয়ে কোন সত্যিটার প্রকৃত রূপ কী ফিগার আউট করে ফেলে। আমি পারি না। শিখতে হলে আমার দেখতে, চাখতে লাগে। সে রকম একটা শিক্ষা আমার হল সামরিক বাহিনীসংক্রান্ত। এতদিন ওঁদের প্রতি আমার ভঙ্গিটা ছিল, আপনারা বর্ডারে থাকুন, আমি আমার বাড়িতে, দুপক্ষের দেখা না হওয়াই ভালো। বন্দুকটন্দুক চালাতে পারে এ রকম ব্যক্তিলোকের কাছাকাছিই আমি থাকতে চাই না, এঁরা তো গোটা বাহিনী। এক সহভাড়াটের বন্দুক আছে জেনে, এবং ফ্রাইডে নাইটে বন্ধুবান্ধবদের ইমপ্রেস করার জন্য তিনি পাঁচিলে সেন্টের শিশি রেখে সেই বন্দুকের তাক প্রদর্শন করেছেন শুনে, সামনের রাস্তা, যাতে সহভাড়াটের দরজা পার হয়ে পড়তে হয়, ত্যাগ দিয়ে  পেছনের পাঁচিল ডিঙিয়ে গতায়াতের ব্যাপারটা সিরিয়াসলি কনসিডার করেছিলাম। তাছাড়া রাষ্ট্রপুষ্ট কিলিং মেশিন ইত্যাদি তত্ত্ব তো আছেই।

সে সব তত্ত্বের বাস্তবতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ নেই এবং কাছ থেকে দেখলে হয়তো আরও অন্যান্য হরর প্রস্ফুটিত হবে, কিন্তু এই ট্রিপে ওঁদের যেটুকু কাছাকাছি এলাম, আসতেই হল কারণ তাওয়াং বমডিলা সেলা বুমলা ওঁদের ঘাঁটি, দেখলাম ওঁরা হয় বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে টুরিস্ট গাড়ির পিছলোনো চাকায় চেন পরাচ্ছেন, নয় ক্যাফে খুলে কাপে কফি ঢেলে আর প্লেটে ম্যাগি তুলে  হাতে ধরাচ্ছেন। আর্মির এ'রকম গৃহকর্মনিপুণ লক্ষ্মীশ্রী আগে দেখিনি, হতে যে পারে কল্পনাও করিনি।


অরুণাচল প্রদেশের স্টাফ সিলেকশন বোর্ড স্থানে স্থানে আর্মিচালিত ক্যাফে খুলে রেখেছে। সেলা পাসের তেরো হাজার সাতশো ফুট উচ্চতায় প্রহরী ক্যাফের দাম রিজনেবল। মেনু সীমিত। চা, কফি এবং ম্যাগি।  ও হ্যাঁ, সুপও আছে। সুপ ওখানে সর্বত্র। দেওয়ালের তাকে গুড ডে আর পার্লে জি-ও । কাগজের বাক্সে বেগুনি রঙের চনমনে কাগজের বাক্সে মাঞ্চিস্‌। একটা নিয়ে হাফ হাফ খাওয়া বাবদে অর্চিষ্মানের ভোট নিতে যাব, ভদ্রলোক বললেন, মাঞ্চিস খতম, ম্যাডামজি।

ম্যাগি তো আছে। পুঁচকে ক্যাফের সব সিটই ভর্তি। অর্ডার দিতে দিতে একটা তিনজনের ফ্যামিলি উঠে বেরিয়ে গেল আর আমরা কফির কাপ হাতে একেবারে হিটারের ঘাড়ের ওপর প্রিমিয়াম স্পট দখল করলাম। ভাইসাব হাঁক দিলেন, ম্যাগি রেডি।

 

ছোট্ট গুহার মতো ক্যাফেটির গুনগুন, হিটারের ওম, ম্যাগির আরাম, দেওয়ালের মিউট টিভিতে হাসপাতালের খাটে লম্বমান, ব্যান্ডেজবাঁধা সুলতানরূপী সলমান খানের কাঁদো কাঁদো মুখ - পঁচিশ বছর পরেও তাওয়াং বললে প্রথম তিনটে ভেসে ওঠা দৃশ্যের মধ্যে এই দৃশ্যটা থাকবে।

সেলা পাসে প্রহরী ক্যাফের স্টেটাস অনেকটা আমাদের শৈশবের দূরদর্শনের মতো। পাসে নেমে সকলেরই ঠাণ্ডা লাগবে, ঠাণ্ডা লাগলে গরম কিছু খেতে ইচ্ছে করবে, আর ইচ্ছে করলে প্রহরী ক্যাফেতেই যেতে হবে। ঠাণ্ডাটান্ডা যদি নাও লাগে, ম্যাগিট্যাগিতে যদি রুচি নাও থাকে স্রেফ সবাই যাচ্ছে বলেই যেতে ইচ্ছে করবে। আমরা যেমন নেমেই কফির সন্ধানে ছুটেছি, বাকিরা দৃশ্যের সন্ধানে। ক্যাফে থেকে বেরোচ্ছি যখন তাঁরা ঢুকছেন। ম্যাগি খেয়েছি শুনে প্রশ্ন করছেন, ভালো বানায়? যেন খারাপ বানালে খাবেন না।


ঘুরলাম ফিরলাম, বরফের মধ্যে হাঁটু ডুবিয়ে উঠলাম, নামলাম। ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে পা হড়কে  অর্চিষ্মান নতুন করে অনুধাবন করল, ও নাকি এসেনশিয়ালি ক্যাবলা। করে মুখ ব্যাজার করল। বললাম, তো? এমব্রেস ইয়োর ক্যাবলামো। বলে পা হড়কানোর অপেক্ষা না করে নিজেই হড়কে গিয়ে, অর্থাৎ বসে বসেই স্লিপ খেয়ে ঢাল বেয়ে নামলাম। অনেক নিচে আধজমা সেলা লেক। জমা বরফে গোটা দশ তরুণ তুর্কি চরম হুপহাপ লাগিয়েছে। আকাশবাতাস কাঁপিয়ে উউউউউ উউউউউ ডাক ছাড়ছে। গ্রুপ চরিত্র পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ অর্চিষ্মানের বেশি। বলল, গ্রুপের সবাই কিন্তু এ রকম হয় না। দশজনের মধ্যে তিনজন এ রকম হয়, বাকিরা দিব্যি সুস্থস্বাভাবিক। কিন্তু ওই তিনজনই যেহেতু মাতব্বর এবং লাউড, নিজেদের রঙে গোটা গ্রুপকে রাঙিয়ে নেয় এবং সবার রেপুটেশন খারাপ করে। প্রহরী ক্যাফেতে বসার জায়গা ফুরিয়েছে বোধহয়, অগ্নিক, পঙ্কজ, হিমাংশু এক হাতে ম্যাগির প্লেট অন্য হাতে চা নিয়ে বেরিয়ে গুলিচামচ রেসের ভঙ্গিতে হেঁটে এল। একটা পাথরে প্লেট রেখে শিরদাঁড়া টান করে চায়ে চুমুক দিয়ে দু'মিনিট নিচের বাঁদরামো পর্যবেক্ষণ করে অগ্নিক বলল, এক লড়কি ভি হ্যায়।

তাই বল। শুধু প্রকৃতিকে অ্যাপ্রিশিয়েশন থেকে এত দাপাদাপি আসে না, আদিমতর তাড়না লাগে। একটু পর, অন গড ফাদার মাদার, ওই জিরোর কাছাকাছি টেম্পারেচারে দুটো ছেলে জামা খুলে ফেলল। ফেলে নাটু নাটু নাচতে লাগল। মেয়েটিরও হাসি ধরে না। হরমোন আমাদের দিয়ে কত হাঁদামো করিয়ে নেয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, অগ্নিক বলল, চলে? অর্চিষ্মান বলল, চলো। বলে আমার কনুই ধরে টানল।

 


Comments

  1. দারুন বেড়ানো হয়েছে আপনার। (একদম সুইপিং স্টেটমেন্টই করে ফেললাম।)

    ওই নুনের ছিটের কথাটায়, আমার নিজের এই ধরণের একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লো, লিখে ফেলি।
    কলেজ পড়ি তখন, চারজন বন্ধু মিলে ট্রেকে গেছি। ট্রেকের মধ্যে একদিন, কিছুটা রাস্তা কভার করে যখন মাঝখানে একটা জায়গায় খাবারের জন্যে থেমেছি, তখন সেখানে সেকেন্ডারি স্কুলে পড়া একজন স্থানীয় মেয়ের সাথে আলাপ হয়েছিল, এবং সে কথার মাঝে বলে ফেললো যে আমাদের পরের হল্ট যেখানে, (যেটা আমাদের হিসেবমতো তিন/চার ঘন্টা আরো লাগাবো পৌঁছতে), সেখানে তার স্কুল, রোজই যায়, এবং মোটামুটি এক ঘন্টা লাগে তার। বুঝুন এবার! আমরা আধা দিন ধরে যেটা কভার করে "বিশাল কিছু করে ফেলেছি" ভাবতাম, সেই রাস্তাটা সে রোজ দুবার কভার করে, তাও আধা দিনের মধ্যে।

    পেমার পরিচয় আর অভিজ্ঞতাটা আপনি আমাদের সাথেও কত সুন্দরভাবে ভাগ করে নিলেন। ভালো লাগলো পরে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, রাজর্ষি। আপনার গল্পটাও চমৎকার। ওসব জায়গার লোক মানুষ না, যদি আমরা মানুষ হই, আর আমরা মানুষ হলে ওঁরা অন্য কিছু।

      ট্রেকে কোথায় গেছিলেন?

      Delete
    2. ট্রেকটা ছিল "সিঙ্গালিলা পাস"এ।
      https://mraj83rm.blogspot.com/2007/01/singalila-pass-trekking-experience-day.html
      এটা আপনার মতো সুন্দর করে লেখা নয়, শ্রেফ কাঠখোট্টাভাবে ঘটনাবলী ধরে রাখা। ছবিগুলো সেই সময় লেখার মাঝে প্রপোর্শনাল সাইজে দেখানোর জন্যে ছোট করে ফেলেছিলাম, পরে আর ঠিক করে বড়ো করা হয়নি।

      Delete
    3. আরে থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, রাজর্ষি। ছবির সাইজ লেখার সঙ্গে আনুপাতিক থাকাই তো ভালো। আমার তো ভালো লাগল। পড়িনি এখনও। দুয়েকদিনের মধ্যে পড়ব। ছবি দেখেই বুঝলাম কত মজা হয়েছিল। দেখা যাক আমাদের দ্বারা কোনওদিন হয় কি না।

      Delete
  2. darun likhchho Kuntola. Travel blog tomar forte !!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. Ami Tilakmama.

      Delete
    2. থ্যাংক ইউ, তিলকমামা 😀

      Delete
  3. এত ভালো লেখা বহুদিন পড়ি নাই।
    এক কথায় যদি বলি, লেখাটা এত জীবন্ত, মানুষ, প্রকৃতি পরিবেশ বর্ণ গন্ধ শব্দ সমেত আটকে গেছে লেখায় এমন যে মনে হচ্ছে, তোমার সঙ্গেই ঘুরছি- এতে সব বলা হয় না।
    লেখাটায় এত প্ররোচনা রয়েছে নানাভাবে, যে ভ্রমণবৃত্তান্ত পেরিয়ে অন্য কথা ভেবেছি, অথচ লেখা থেকে একচুলও বেরিয়ে আসি নি।
    আশ্চর্য লেখা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বিশ্বাস করলাম, ইন্দ্রাণী। ভালোবাসা জানবেন।

      Delete
  4. পোস্টের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

    বিভিন্ন বিষয়ে আপনার লেখা আমাকে অনেকভাবে সাহায্য করেছে। তিন-চার বছর আগে ব্রেকআপ নিয়ে আপনাকে লিখতে বলেছিলাম। আপনি লিখেছিলেন। বলাই বাহুল্য, সেই লেখা খুব সাহায্য করেছিল আমাকে। এখন আবার একটা বিষয়ে লিখতে বললে কি বাড়াবাড়ি হবে? একাকীত্ব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. না না, বাড়াবাড়ি কীসের। একাকীত্ব আমার প্রিয় টপিক তো। চেষ্টা করব লেখার। সাহায্য হবে কি না জানি না, কিন্তু লিখব। ক'দিন সময় চেয়ে নিচ্ছি। তাওয়াংটা শেষ হোক। তারপর আরেকটা পোস্ট প্রায় রেডি হয়ে আছে, তারপর একাকীত্ব নিয়ে পড়ব। ব্রেক আপ বিষয়ক আমার প্রলাপে কাজ হয়েছিল জেনে সত্যি খুশি হলাম। ওটা আমার সেকেন্ড ফেভারিট টপিক।

      Delete

Post a Comment