তাওয়াং ৪ঃ পাহাড়ি পরিষেবা ও যশওয়ন্তগড়




এ ট্রিপের সবথেকে বেশিসংখ্যক রাত্রিবাস তাওয়াং-এ, একেবারে দু'দুটো। দ্বিতীয় দিন সকালে দরজায় টোকা। প্রত্যাশিত, কারণ চা বলা আছে, কিন্তু দরজা খুলে একটি অপ্রত্যাশিত দৃশ্য উদ্ভাসিত হল। দুটি মেয়ে। একজন মেরেকেটে আঠেরো, একজন টেনেটুনে পনেরো। আঠেরোর হাতে লিস্ট, পনেরোর হাতে ট্রে-ভর্তি কাপের গুচ্ছ। গত পরশু রাতে হোটেলে চেক ইন করা ইস্তক যতবার দরজা খুলে চা ইত্যাদি নিয়েছি এঁদের দেখিনি। ঘরে ডাকলাম। আঠেরো রিডিং পড়লেন। ব্ল্যাক কফি, মিল্ক টি? ঠিক ঠিক। পনেরো ট্রে থেকে দুটো কাপ টেবিলে নামালেন, যার দুটোতেই দুধের পরিমাণ প্রয়োজনের থেকে বেশি। মৃদু গলায় পয়েন্ট আউট করলাম। দুজনের মুখের মিল খেয়াল করলাম। যে ভদ্রলোক রিসেপশনে বসেন এবং মাঝে মাঝে অর্ডার বেশি চলে এলে রান্নাঘরে ঘোরাঘুরি করেন তাঁর মুখের সঙ্গে মিলও। ট্রে পর্যবেক্ষণ করে কালচে তরলওয়ালা একমাত্র কাপটির দিকে ছোটজনের দৃষ্টি থামল। উৎসাহব্যঞ্জক ঘাড় নাড়লাম। মেয়েটি আমার প্রতি সন্দেহজনক চোখ তুলে উক্ত কাপটি টেবিলের ওপর নামাল। নামিয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করল। তাড়াতাড়ি দুধ কফির কাপটা ট্রে-তে তুলে দিলাম না হলে পাশের ঘরে কনফিউশনের সৃষ্টি হবে। যে ঘরে একজনের নাম ডেফিনিটলি বাবু এবং কাল সারারাত যে ঘর থেকে উচ্চকণ্ঠে শ্যামবাজারি অ্যাকসেন্টেড বাংলায় বুমলা পাস ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা শুনেছি।

আমার ধারণা ছিল তাওয়াং টুরিস্টদের হটস্পট। কাজেই এঁরা টুরিস্টদের ছাগলের মতো চরাতে পারেন। ব্যাপারটা সে রকম নয়। ওখানে অধিকাংশ এসট্যাবলিশমেন্ট এখনও পরিবারচালিত। কাজেই পরিষেবায় মেশিনসুলভ অনুভূতিটা আসে না যেমন কর্মকুশলতাও মেশিনের থেকে খানিকটা কম পড়ে। যেমন ধরুন ভাত দিয়ে যাওয়ার পর সে ভাত বেড়ে নেওয়ার চামচটা আপনাকে চাইতে হতে পারে। কিংবা ডালের হাতা। অথবা আচারের চামচ। একটা নর্ম্যাল চা আরেকটা দুধ চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি আনতে বললে একটা চিনি ছাড়া চা আরেকটা দুধ ছাড়া কফি এসে উপস্থিত হতে পারে। এগুলোতে মাথা গরম করার কিছু নেই। অন্তত আমার মনে হয় করা উচিত না। কী হবে। বেড়ানোর প্রশান্তি মাটি। তাছাড়া প্রশিক্ষিত সার্ভিসের নৈর্ব্যক্তিতাটাই কি সর্বদা ভালো? একটা মানুষ ভুল করলেই তো তাকে বেশি মানুষ মানুষ লাগে। স্টারবাক্সে বসে কাজ করছিলাম, এ মিত্রা-র ক্যাপুচিনোর ঘোষণা হল। অর্চিষ্মান সেদিন এক্সট্রা গোমড়া হয়ে টাইপ করছিল, কফি নিয়ে হাসিহাসি মুখে ফিরল। বিস্ময় প্রকাশ করায় কাপটা দেখাল। ক্রিমের দলা মতো ভাসছে। বোঝা যাচ্ছে দলাটাকে একটা কিছুর আকৃতি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, পাইনগাছ কিংবা হৃদয়। ছেলেটা নাকি কাপটা হাতে দিয়ে বলেছে, কোশিশ কিয়া থা, নেহি হুয়া। অর্চিষ্মান উদাত্ত হেসে, নেক্সট টাইম হো যায়েগা, বলে ফেরত এসেছে। তেমনি আমিও তাওয়াং-এর প্রথমদিন ব্রেকফাস্টে মাখনপাউরুটির সঙ্গে নুনগোলমরিচ না দেখে একতলার রান্নাঘরে চাইতে গেলাম। থালার কোণে একচামচ নুন দিয়ে মহিলা যখন কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, পেপার দেখনা পড়েগা, বললাম, আরে কে খায় পাউরুটির সঙ্গে গোলমরিচ, রাখুন তো। বলে চলে এলাম।


প্রথম রাতে শুতে গিয়ে মনে হল ম্যাট্রেস, বালিশ, লেপকম্বল বরফজলে চুবিয়ে তুলেছে কেউ। একটা ভিডিওতে দেখেছিলাম পেংগুইনরা সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে একে ওপরকে ঠেলে জলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা যা বুঝলাম হয়েই থাকে, কারণ সকলেই সতর্ক। ঠেলা আসার আগেই লাফ মেরে, পেঙ্গুইনদের পক্ষে যতখানি লাফ মারা সম্ভব, সাইডে সরে যাচ্ছে। প্রথমটা সমুদ্রতটসুলভ রঙ্গরসিকতা ভেবেছিলাম তারপর ভাষ্যকার বললেন ওটা নাকি জলে হাঙরজাতীয় প্রিডেটর যে নেই সেটার চক্ষুকর্ণবিবাদভঞ্জনের চেষ্টা। আমি যেমন কনট প্লেসে রাস্তা পার হতে গেলে গাড়ি যেদিক থেকে আসছে নিজেকে সর্বদা ঝাঁকের তার উল্টোদিকে রাখি, যাতে অন্যদের চেপ্টে আমি পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে ইম্প্যাক্ট যথাসম্ভব কম হয়ে যায়। শুধু অচেনা লোক নয়, প্রিয়জনদের ছাড় দিই না। এই যেমন দিল্লির শীতে ম্যাট্রেস, চাদর, লেপ ঠাণ্ডা হয়ে থাকলে এক্সট্রা মনোযোগ দিয়ে টাইপ করি আর আড়চোখে চাই। অর্চিষ্মানও আড়ে আড়ে চায় আর তেড়েফুঁড়ে টাইপ করে। একজনকে হার মানতেই হয়। সে প্রথম বিছানায় ঢুকে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো লাফায়। তখন অন্যজন গিয়ে, একটু ওদিকটায় সরে শোও না গো, বলে বিছানার বরফ হয়ে থাকা দিকটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়।

তাওয়াং-এর হোটেলে ক্লান্ত শরীরে অত কৌটিল্যপনার এনার্জি ছিল না, অর্চিষ্মান বিরক্ত মুখে বলল, ইলন মাস্ক মঙ্গলগ্রহ নিয়ে না লাফিয়ে একটা যন্ত্র বার করলে পারে তো। আমরা যতক্ষণ ডিনার সেরে এলাম আমাদের ম্যাট্রেস, লেপকম্বল সব সুটেব্‌লি টোস্টি করে রাখার? বললাম, এই তো। লাফিয়ে মেশিনে চলে গেলে? আমাদের মতো দেশে চাই লেবার ইন্টেনসিভ ইনোভেশন। ঠাণ্ডা খাটে গড়াগড়ি খাবে, দশ মিনিটে দশ টাকা পাবে। অর্চিষ্মান চোখ কপালে তুলল। মাইনেটা কাজের অনুপাতে অপ্রতুল নাকি অতিরিক্ত বলে কে জানে। আমি গড়াগড়ি খেয়ে দশ মিনিটে দশ টাকা রোজগার করতে খুবই রাজি। তারপর মনে পড়ল গতবছরের কাঁধের ব্যথাটার সময় একটা জাজিমের মতো জিনিস ফুটন্ত জলে চুবিয়ে, সাঁড়াশি দিয়ে তুলে প্লাস্টিকে পুরে কাঁধে চাপা দিয়ে রাখত। ও জিনিস সর্বাঙ্গে বেঁধে গড়াগড়ি খেলে কাজ অনেক দ্রুত এবং ফলপ্রসূও হবে। চার্জও দশটাকা থাকবে না, অফ কোর্স। এই সব কথোপকথন সেরে প্রথম রাতে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় ঢুকলাম। সকালবেলা ওর অলরেডি মৃদু গলা মৃদুতর করে অর্চিষ্মান রিসেপশনের ভদ্রলোককে বলল, এক রুম হিটার মিলেগা? ভদ্রলোক বললেন, অভি তক মিলা নেহি? বলে কড়া চোখে আশেপাশে ঘোরাঘুরি করা লোকজনদের দিকে তাকাতে লাগলেন।

হোটেলের বাইরেও অবস্থা উনিশবিশ। পৌঁছনোর পথেই হোয়্যার টু ইট ইন তাওয়াং সার্চ দিয়েছিল অর্চিষ্মান, চারপাঁচটা দোকানের নামও বেরিয়েছিল। ওল্ড মার্কেটের দিকটায় যদি থাকেন রেস্টোর‍্যান্টগুলোর অধিকাংশই পঞ্চাশ থেকে একশো পায়ের মধ্যে। তাতে সুবিধে নাও হতে পারে কারণ দোকানগুলো খোলা থাকবে কি না বলা মুশকিল। ড্র্যাগন রেস্টোর‍্যান্টের নাম সমস্ত লিস্টেই প্রথম দিকেই ছিল। আমরা যে হোটেলে থাকব, হোটেল দাওয়া, উইকি বলছে দাওয়া শব্দের তিব্বতি অর্থ মুন অথবা মান্থ, তার পঞ্চাশ পায়ের মধ্যে। হোটেলে ঢুকে চা আর পকোড়া বলা হল। চা নিয়ে অল্প কনফিউশন হয়েছিল, কিন্তু পকোড়া ফাসক্লাস। খেয়ে, একঘণ্টা শুয়ে, বেরোলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিপটিপ বৃষ্টি। সাতটার বেশি বাজে না, কিন্তু সমস্ত ঝাঁপ বন্ধ। প্রায়ান্ধকার রাতে ফেয়ারি লাইট দপদপানো বোর্ডে ‘ড্র্যাগন’। গেটের সামনে বেছানো চটে মটকা মারা কুকুরদের পেরিয়ে দোতলায়। সাজানো হোটেল এবং সাজের থেকেও যেটা বেশি আশ্বাসের, খদ্দেরে গমগম। যে কোনও দোকানেই ভিড় থাকাটা আশ্বাসের। কিন্তু ভিড়টা আমাদের এগেইন্সটে গেল। জনাপনেরো ছেলে একসঙ্গে খেতে এসেছে। তারা আসার আগে যা বুঝলাম মেনুর সবই পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু রান্নাঘরের ওয়ার্কফোর্স সম্পূর্ণ লেগে পড়েছেন গ্রুপটার অর্ডার মেটাতে, আমাদের মতো লেটে যারা আসবে তারা শুধু পাবে ফ্রায়েডরাইস, চাউমিন আর মোমো। ফ্রায়েড রাইস আর মোমো অর্ডার করলাম, আসতে নিল প্রায় একঘণ্টা। যাওয়ার কোথাও ছিল না, হোটেলে গিয়েও এইরকমই কিছু খেতে হবে, কাজেই সিটের ওপর হাত উল্টো করে পেতে, হাতের ওপর বসে পা নাচালাম।


অর্চিষ্মান বলছে এই ল্যাজেগোবরে ব্যাপারটা সম্ভবত প্যান্ডেমিকের পরে হয়েছে। তাছাড়া এটা সবে সিজনের শুরু তাই এঁরা তৈরিও নন। আমি অত শিওর নই যে ব্যাপারটা প্যান্ডেমিকের সঙ্গে সম্পর্কিত নাকি এমনিই হয়তো এঁরা তৈরি থাকেন না। দিরাং-তাওয়াং রাস্তায় যাতায়াতের সময় নর্থ-ইস্ট ধাবা বলে একজায়গায় দু’বারই খাবারের জন্য দাঁড়ানো হয়েছিল, প্রথমবার এক ভদ্রমহিলা ন্যাতাবালতি দিয়ে ঘর মুছছিলেন। অগ্নিকের চেনা। থালি নাকি আধঘণ্টা আগে পর্যন্ত ছিল, এখন খালি চাউমিন আর ফ্রায়েড রাইস। ফ্রায়েড রাইস অর্ডার করলাম। বাকিদের ভাত চাই। নাকি চাউমিন আর ফ্রায়েড রাইস খেতে খেতে ক্লান্ত।

মেঝে পরিষ্কাররত ভদ্রমহিলা কাজ থামিয়ে, মপে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। দুঃখিত গলায় জানতে চাইলেন আমরাও ভাত খেতে চাই কি না। ফ্রায়েড ভাত নয়, রিয়েল ভাত। নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলেন মহিলা, নিশ্চয় চাই, দুপুরবেলা কে আর রিয়েল ভাত না খেতে চায়। বলতে বলতে মহিলার মুখেচোখে সত্যিকারের আফসোস ফুটল। অগ্নিক ওঁর চেনা, উদ্দেশ করে বললেন, আরে অগ্নিক কাল থোড়া জ্যাদাই টুরিস্ট আ গয়া পাতা হ্যায়, কুছ জ্যাদা হি। আবারও ওঁর মুখে সত্যিকারের শ্রান্তি ফুটল। সঙ্গে দুশ্চিন্তা। এখনই এই, সামারে স্কুল ছুটি পড়লে কী হবে?

ভাতসন্ধানী পরিবারটিকে সম্ভাব্য ভাতসরবরাহকারী দোকানের সন্ধান দেওয়া হল, ব্রিজ পেরিয়ে যেতে হবে। অতখানি হেঁটে যেতে কষ্ট, তাছাড়া সময়ও লাগবে অনেক। দোনোমোনো দেখে দোকানি ভদ্রমহিলা বললেন, ফ্রায়েড রাইস আর চাউমিন ছাড়া ওঁর কাছে ম্যাগি হবে। বিপদ্গ্রস্ত পরিবারটির এক সদস্য অন্য সদস্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, ম্যাগি খাবে? তিনি ঝটকা দিয়ে বললেন, এটা কি ম্যাগি খাওয়ার সময়?

রিসেন্টলি বাড়ি গিয়েছিলাম। চেনা এক দিদি এসেছিলেন গল্প করতে। দিদির সঙ্গে যিনি থাকেন, দু’দিনের জন্য কোথায় গেছেন। ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করলাম একা একা দিদির ভয় বা বোর লাগছে নাকি। সামনের ঘরের সি এফ এল বাল্বেও দিদির মুখের উজ্জ্বলতা স্পষ্ট হল। কী বলছিস, দুর্দান্ত লাগছে। মাঝে মাঝে একা থাকার দরকার আছে, বুঝলি সোনা। এঁর সঙ্গে আমার ঠিক হাই ফাইভ দেওয়ার সম্পর্ক নয়। হেসে বললাম, তা তো আছেই। দিদির ফ্লো এসে গেছিল। কেউ থাকলে একটা তরকারি, একটা ডাল, একটা মাছ তো করতেই হয় বল, অফিস থেকে ফিরে? আজ দেখ, তোর সঙ্গে গল্প করতে এলাম, বাড়ি গিয়ে হাঁড়িতে ভাত আর আলুটালু কিছু একটা বসিয়ে দেব। ঘি আছে। আর কিছু লাগে বল? আমি বললাম, মোটেই না। কিন্তু ম্যাগি নেই? দিদি থমকালেন, ম্যাগি খাব? বললাম, তোমার মেনুটাও ভালো কিন্তু আবার হাঁড়ি টানাটানি করতে হবে। থালাও লাগবে একটা। তেমন বুদ্ধি করে করতে পারলে ম্যাগি যেটাতে রাঁধবে সেটাতেই খেয়ে ফেলতে পারবে। তাছাড়া চামচ দিয়ে খাবে, হাত ধুতেও হবে না। আলুভাতে মাখামাখি করতে হবে না। তেল কোথায়, লংকা কোথায়, পেঁয়াজকুচি কোথায়। দিদির চোখের মণি দ্রুত নড়তে লাগল। পরদিন সকালে ভাবছি খোঁজ নেব, দিদির মেসেজ এসে গেল। কাল মোড়ের দোকান থেকে ম্যাগি নিয়ে ঢুকেছিলাম রে সোনা। এবার থেকে একা থাকলে ম্যাগিই খাব। হৃদয় সাইন।

সাতপাঁচ ভেবে ফ্রায়েড রাইসেই কমপ্রোমাইজ করলেন তাঁরা। কমপ্রোমাইজের সুবিধে হচ্ছে একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারলে অনেকটা হালকা হওয়া যায়। ট্র্যাভেলার পরিচয় তো পেয়েইছিলাম, এঁরা ফুডিও। খেতে ভালোবাসেন, ভালো খাবার খারাপ খাবারের বিচার করতে পারেন। আজ সকালেই নাকি একটা দারুণ কেক খেয়েছেন। ওই যে চায়ের দোকানটায়, মনে নেই? অর্চিষ্মান মনে করালো। সকালে দেখেছিলাম বটে অন্য গাড়িদুটোকে দাঁড়িয়ে থাকতে একটা ক্যাফের সামনে। আমরা দাঁড়াতে চাই কি না পঙ্কজ জিজ্ঞাসাও করেছিল, কিন্তু আমাদের তখন চা পায়নি তাই দাঁড়াইনি। তা সেখানে নাকি কেকও পাওয়া যাচ্ছিল। ভালো কেক, বুঝলেন? পশ্চিমবঙ্গের লোককে কেক খাইয়ে ইমপ্রেস করা কি সোজা? আমাদের নাহুম খাওয়া প্যালেট, হুঁ হুঁ বাবা (বুঝলাম পশ্চিমবঙ্গকে ওঁরা একটা শহরের সঙ্গে গুলোচ্ছেন, আরও অনেকের মতো)। সেটা যখন পেরেছে, বুঝুন কত ভালো কেক। অর্চিষ্মান চিবোতে চিবোতে মাথা নাড়ল, রেলের কামরার টুপিপরা সেই চতুর্থ ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ল। আমি মাথা নাড়লাম না। আমাদের খিদে নেই তাছাড়া প্রথম দিনের ভেজ চাউমিনের পরিমাণ স্মৃতিতে আছে বলে একটাই প্লেট নিয়েছি। থালার দু’দিক থেকে দুটো চামচে করে নিয়ে নিয়ে খাচ্ছি। সাইডে মোমোর চাটনির মতো একটা মারাত্মক ঝাল, মারাত্মক লাল, মারাত্মক ভালো খেতে চাটনি দিয়েছে, চামচের ডগা অল্প ছুঁইয়ে ভাতে মেখে নিচ্ছি। মনোযোগ দিচ্ছি, পাছে অর্চিষ্মান পঞ্চাশ পার সেন্টের বেশি চাটনি নিয়ে নেয়। তাছাড়া আমার প্যালেট বেসিক্যালি বাপুজি-র, আমি মাথা নাড়ার অধিকারীও না। আরও গল্প শুনলাম, হায়দেরাবাদের বিরিয়ানি দেখে ওঁদের কেমন অক্কা পাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের (আবার গুলিয়েছেন) বাঙালি, আরসালান আর দাদাবৌদি খাওয়া প্যালেট, ওই মশলাদার ঝাল কুটকুটে হলদে বিরিয়ানি পোষায়?

যাই হোক, প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে অন্যান্য টুরিস্ট স্পটে যদি আপনার প্রম্পট এবং পটু পরিষেবার অভিজ্ঞতা এবং আশা থাকে, এই ধরণের যাত্রাপথে আশাহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবারও বলছি, মানুষজন এত ভালো যে এইটুকু আশাভঙ্গ মানিয়ে নেওয়াই যায়।

সেলা পাস থেকে তাওয়াং পৌঁছনোর পথে একটা জায়গায় থামা হয়েছিল। যশওয়ন্তগড়। যাত্রা শুরুর আগে নিয়মরক্ষা রিসার্চের সময়েই নামটা চোখে পড়েছিল। সেলা, বুমলা, বমডিলা, ভালুকপং ইত্যাদির মাঝে যশওয়ন্তগড় চোখে না পড়লেই অদ্ভুত। তখনই ইতিহাসটা পড়েছিলাম। যশওয়ন্তগড়ের নাম যশওয়ন্ত সিং রাওয়াতের নামে, যিনি উনিশশো বাষট্টির ভারত চিন যুদ্ধের সময় ছিলেন বাইশ বছর বয়সী রাইফেলম্যান। বাষট্টির অক্টোবর মাসের নুরানাং-এর যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। গাড়ওয়ালের ছেলে, ৪র্থ গাড়ওয়াল রাইফেলের হয়ে লড়তে গিয়েছিলেন সীমান্তে। এখনকার যশওয়ন্তগড় ছিল তখনকার নুরানাং। সেখানে ছিল ওঁর পোস্ট। ওই যুদ্ধটি, যা বুঝলাম, ছিল সর্বার্থে অসম। চিন সংখ্যায়, অস্ত্রে বলীয়ান। ভারতের সৈন্য অল্প, অস্ত্রশস্ত্র মিনিম্যাল। চিন যতক্ষণ লাইট মেশিনগান দিয়ে আক্রমণ শানিয়েছিল, ভারত প্রতিরোধ গড়েছিল, বিপদ হল যখন ভারতীয় বাংকারের তিরিশ মিটার দূরে একটি মিডিয়াম মেশিনগান দিয়ে চিন আক্রমণ শুরু করল। সেটিকে সামলানোর জন্য তিন ভলান্টিয়ার, যশওয়ন্ত সিং, ত্রিলোক নেগী, গোপাল গোসেইনকে রেখে বাকি ইউনিট পিছিয়ে এল। নেগীর কভারিং ফায়ারের ভরসায় গোসেইন এবং রাওয়াত হ্যান্ড গ্রেনেড সম্বল করে চাইনিজ শিবিরের কাছাকাছি গেলেন এবং যশওয়ন্ত সিং বেসিক্যালি চাইনিজ শিবিরে ঢুকে হাতে যুদ্ধ করে মেশিনগানটি নিয়ে পালালেন। ফেরার পথে নেগী গুলিতে নিহত হলেন, যশওয়ন্তের মাথায় গুলি লাগল কিন্তু তিনি আর গোসেইন ভারতীয় বাংকার পর্যন্ত মেশিনগানটি নিয়ে পৌঁছলেন এবং যশওয়ন্ত শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গোপাল সিং গোসেইনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

ঘটনাপ্রবাহের আরেকটা বয়ানও চালু আছে। ভারতীয় সৈন্যদল পিছিয়ে আসার পর এবং নুরানাং পোস্টে থেকে যাওয়া সঙ্গীদের মৃত্যুর পর বাহাত্তর ঘণ্টা ধরে যশওয়ন্ত একা চাইনিজ বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখেন। একাধিক জায়গায় রাইফেল বসিয়ে একাই দৌড়োদৌড়ি করে সেগুলি ফায়ার করে ইম্প্রেশন দেন যে ভারতের দিকে তিনি ছাড়াও আরও সেনা আছে। ব্যাপার দেখে গ্রামের স্থানীয় লোকেরা যশওয়ন্তকে সাহায্য করতে এগিয়ে যান, যাঁদের মধ্যে সেলা এবং নুরা নামের দুটি মেয়ের নাম পাওয়া যায়। বাহাত্তর ঘণ্টা এই অসম যুদ্ধ চলে। অবশেষে ভারতের সীমা রক্ষীশূন্য হয়।

অরুণাচল টাইমসের একটা রিপোর্টে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার বলেছেন, যাঁরা দিনরাত কঠিনতম পরিস্থিতিতে কঠিনতম দায়িত্ব পালন করা সেনাবাহিনীর পক্ষে কিছু গ্যালান্ট মিথ অসুবিধের তো নয়ই, বরং প্রয়োজনীয়। সত্যি যেটাই হোক, যশওয়ন্ত ও তাঁর সহযোদ্ধারা যে ওই যুদ্ধে মানুষিক সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছিলেন তা নিয়ে সংশয় নেই। বাইশ বছরে থেমে যাওয়া যশওয়ন্ত সিং রাওয়াতের আবক্ষ স্বর্ণালী মূর্তি স্থাপিত আছে যশওয়ন্তগড়ের ওয়র মেমোরিয়ালে। যশওয়ন্তের ছবির নিচে এখনও তিনবেলা খাবার দেওয়া হয়, কাচা জামাকাপড়, তোয়ালে রাখা হয়। গোটা ৪র্থ ব্যাটেলিয়নকে যুদ্ধ চলাকালীনই সম্মানিত করা হয়। ত্রিলোক নেগী মরণোত্তর বীর চক্র, গোপাল গোসেইন বীর চক্র এবং যশওয়ন্ত সিং মরণোত্তর মহা বীর চক্র পান।

যশওয়ন্তগড়ের ওয়র মেমোরিয়ালে এখনও বাংকার আছে। মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া ছোট ছোট সুড়ঙ্গের মতো। নুরানাং-এর যুদ্ধে মারা যাওয়া তিনশোরও বেশি চিনা সৈনিকের সমাধি চিহ্নিত করা আছে। চারদিকের পাহাড়, জঙ্গলের শান্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই সময়ের বিভীষিকা ও তাণ্ডব কল্পনা করতে শুধু অসুবিধে হয় না, অসম্ভব লাগে। ফিরছি, অর্চিষ্মান আঙুল তুলে দেখাল। একটা বাংকারের মাথায় গোটা সাতেক কুকুরছানা, দিনের গুনতিতে বয়স, একে ওপরের ঘাড়ের ওপর উঠে ঘুমোচ্ছে। অর্চিষ্মান বলল, যে সবথেকে মাঝখানে ঢুকতে পেরেছে তার আরামটা ভাব দেখি। সেটা তো ভাববার বিষয়ই, তার সঙ্গে এটাও চাওয়ার যেন বাংকারের মাথায় মাথায় এমন পাহারাই বসে চিরদিন।

Comments

  1. বেড়ানোর গল্প মচৎকার! এই ঠান্ডায় roomheater ছাড়া একরাত ছিলে? আমরা তো ডিসেম্বরে কাজিরাঙা আর মানসে হিটার ছাড়া থাকতে পারিনি| আমাদের এদেশে সেন্ট্রাল হিটিং-এ এমন খারাপ অভ্যেস হয়েছে যে দেশের ঠান্ডায় আমাদের বেশি ঠান্ডা লাগে| হাস্যকর- জানি|
    ইতিহাসের অনেক কিছু জানতে পারলাম, আগে জানতাম না |
    পশ্চিমবঙ্গ আর কলকাতার কথা যেমন বললে, আমাদের আসামবাসীদের অভিজ্ঞতাও অনুরূপ| আমরা আসামে ছিলাম, কোনো বিশেষ শহরে না, ফলে আসামের যে কোনো জায়গার লোককে আমরা চিনে ফেলতে পারি, কারণ সেও "আসামে" থাকে ( হাসিমুখ ইমোজি )

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাস্যকর একেবারেই না, অমিতা, এ রকমটাই হওয়ার কথা। এ ইতিহাসের অনেকটা জনশ্রুতি, তবে তাতে ধক কমে না। নিজেদের জায়গার লোককে চিনে ফেলা ভীষণ সহজ আর ভীষণ মজার একটা খেলা। আমার তো বাঙালি অধ্যুষিত জায়গার বাইরে গেলেই বাঙালি-রাডার অন হয়ে যায়। আর টপাটপ বাঙালি চিহ্নিত করতে থাকে।

      Delete
    2. আসলে আমি ঠিক বোঝাতে পারিনি| কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গকে যেমন সেই ভদ্রলোক গুলিয়ে ফেলছিলেন আমি সেটার কথা বলছিলাম| আমরা আসামবাসী হিসেবে পরিচিত হতাম, আসামের কোনো বিশেষ শহরের নয়| তাই যখন কেউ বলতো তুমি একে চেনো, এ আসামে থাকে, সেটা খুব অদ্ভুত লাগতো| আসাম তো একটা ছোট শহর না!
      বাঙালি রাডার তো অবশ্যই আমারও অন হয়| মানসে পশ্চিমবঙ্গের এক বাঙালি ফ্যামিলিকে সাফারিতে পেয়েছিলাম| ভদ্রলোক জোরে জোরে কথা বলছিলেন আর মানস ওনার খুব ভালো লাগছিলো, বলছিলেন জলদাপাড়া এর তুলনায় নাকি সাজানো বাগান|

      Delete
    3. এটা চমৎকার বর্ণনা দিলেন, অমিতা। এ রকম যে একজন বাঙালি করবেন, এই জোরে জোরে মতামত দেওয়া, এটা প্রত্যাশিত। তবে ওঁর সঙ্গে আমি একটা বিষয়ে একমত, মানস সত্যি একঘর। জলদাপাড়া দেখিনি, কাজেই অন্য বিষয়টায় একমত কি না জানি না।

      আমি বুঝতে পেরেছি আপনি শহর আর রাজ্যের গোলানোর ব্যাপারটা বলতে চাইছিলেন যে। লোকে আসলে নিজের জায়গাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আর কেউ না চিনলে অবাক হয়। এদিকে অন্য লোকের জায়গা সম্পর্কে ততটাই অজ্ঞতা পোষণ করে এবং করছে যে সে নিয়ে ভাবিতও হয় না। এটাই মনুষ্যচরিত্র আই গেস।

      Delete
  2. Khub bhalo lagche tomar beranor golopo porte Kuntala.
    Ekta electric blanket ba ekta lumbar heating pad shonge rakhte paro eyi shob thanda jaayega e jawar shomoye. Otota koshto hobe na tahole.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এইটা ভালো বুদ্ধি দিয়েছ তো, শর্মিলা। কাজে লাগবে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. অনেকদিন পরে অবান্তর খুলে তাওয়াং দেখে দিল খুশ। আমরা আগের বার গেছিলাম। আপনার কলমে আবার ঘোরা হচ্ছে। নুরানাং জলপ্রপাত যাননি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে চন্দ্রচূড় যে। সত্যিই অনেকদিন পর।

      Delete

Post a Comment