ঘর হতে এক পাও না ফেলে




এখানে এসে থেকে এই প্রথম একটা উইকএন্ড পাওয়া গেছে যেটাতে আমার কোথাও যাওয়ার নেই। বেড়াতে না, কন্‌সার্ট দেখতে না, হারানো ফোন খুঁজতে না।

শুনে টেরেসার মুখ শুকনো হয়ে গিয়েছিল।

“অঅঅঅ, পুওর থিং। লেট মি অ্যারেঞ্জ সামথিং ফর ইউ।”

আমি হাঁ হাঁ করে উঠতে না উঠতেই মেয়ে ফোন তুলে খবর নিয়ে ফেলল রবিবার সবাই মিলে ড্র্যাকেনফেল্‌স্‌ যাওয়া হবে। আর শনিবার যদিও এখনও কিছু ঠিক করা হয়ে ওঠেনি, তবু করে ফেলতে কতক্ষণ? কিছু না পেলে ক্যারাওকে নাইট তো আছেই।

ক্যারাওকে নাইটের আইডিয়া নাকচ করে দিতে এক সেকেন্ডও লাগেনি। রক্ষে কর বাবা, পয়সা দিয়ে লোকের বেসুরো চিৎকার শোনার থেকে ঘরে বসে নিজে চেঁচাব তাও ভালো। আর ড্র্যাকেনফেল্‌সে যাওয়ার ইচ্ছে যদিও আমার এসে থেকেই, পাহাড়ের চুড়োয় শত শত বছরের প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসস্তূপ কেই বা না দেখতে যেতে চায়, কিন্তু আমি সাতপাঁচ ভেবে ঘাড় নেড়ে দিয়েছিলাম।

“ইউ নো হোয়াট? মে বি আই উইল জাস্ট স্টে অ্যাট হোম।”

টেরেসা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাট হোয়াআআআআই? বাড়িতে বসে থাকবে কোন দুঃখে? আফটার অল উই আর ইয়ং পিপল।

টেরেসা আমার সম্পর্কে এত ভুল ধারণা করেছে দেখে আমি আর কথা বাড়াইনি। হাতে পায়ে ধরে বলেছিলাম, না ভাই তোমরা যাও। আমার সত্যি বলছি দু’দিন বাড়িতে বসে থাকতে একটুও কষ্ট হবে না।

মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু ওর যুক্তিবুদ্ধিতে ঢোকেনি, কিন্তু স্রেফ আমার ওপর মায়া করে টেরেসা হাল ছেড়ে দিয়েছিল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ওকে। ইফ ইউ সে সো।

হাঁফ ছেড়ে শনিরবি আমি বাড়িতে বসে রইলাম। কিন্তু মাথার ভেতর একটা অপরাধবোধও বেয়াড়া মাছির মতো ঘুরেফিরে আসছিল। ভুল করলাম কি? এতদূরের দেশে এসে, এতকিছু দেখার শোনার ঘোরার জিনিসের মাঝে বসে আমি যদি সেই ইউটিউব দেখেই সময় নষ্ট করি, তাহলে কি সত্যিই সেটাকে জাস্টিফাই করা যায়? কে জানে আর কখনও এখানে আসার সুযোগ হবে কি না। আজ সকালে উঠে জানালার বাইরেটা দেখে অপরাধবোধ আরও চাড়া দিয়ে উঠল। নেটে দেখলাম পরের টানা চব্বিশ ঘণ্টা ঝকঝকে রোদ্দুরের বিরল ম্যারাথন চলবে। বাতাসের তাপমাত্রা পঁচিশ থেকে আঠাশ ডিগ্রির পারফেক্ট রেঞ্জের মধ্যে ঘোরাঘুরি করবে। এত ভালো আবহাওয়া আর হবে কি না কে জানে। হয়ত পরের উইকএন্ডগুলোতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়বে।

ভাবতে ভাবতে আমার মাথা এমন গরম হয়ে গেল যে আরেকটু হলেই টেরেসার নম্বর ডায়াল করে ফেলছিলাম। বলে বসছিলাম, বুঝেছি বুঝেছি, ভীষণ ভুল হয়ে গেছে, প্লিজ আমাকে ফেলে রেখে যেয়ো না। দয়া করে বল তোমরা কোথায় আছ, আমি পাঁচমিনিটে সেখানে পৌঁছচ্ছি।

কিন্তু বললাম না। জীবনে যে ক’টা সিদ্ধান্ত হুট্‌ করে নিয়েছি সেগুলোর পরিণতি মনে করে নিজেকে সামলে নিলাম। কোথায় যেন পড়েছিলাম পৃথিবীতে এমন কোনও দুশ্চিন্তা নেই, থাকতে পারে না, যেটা এক ঘণ্টা গল্পের বই পড়লে দূর হয় না। কাজেই আমি এক কাপ চা বানিয়ে, স্টিফেন কিং খুলে জানালার পাশে আরাম করে বসলাম। চেয়ারের কাঁধটা যতদূর সম্ভব পেছনে হেলিয়ে দিয়ে ঠ্যাং দুটো টেবিলের ওপর তুলে দিলাম, যাতে ম্যাক্সিমাম আরাম হয়।

জ্ঞানীগুণীদের কথা, অত সহজে মিথ্যে কি হয়? দেখতে দেখতে আমার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে এল। জিলিয়াড দেশের বীর রোল্যান্ডের সঙ্গে স্কিনম্যানের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে বাড়িতে বসে থাকার অপরাধবোধটোধ কোথাও হাওয়া হয়ে গেল কে জানে। স্কিনম্যান কে? কে না বলে কী বলাই ভালো। সে এক ভয়ংকর জানোয়ার। কখনও হিংস্র কুমীর, কখনও নৃশংস ভালুক, কখনও বা অন্য কোনও ভয়াল শ্বাপদের চেহারা ধরে সে গভীর রাতে মানুষ শিকার করে বেড়ায়। এক কামড়ে মুণ্ডু ছিঁড়ে ঘাড় থেকে আলাদা করে ফেলে, থাবার আঁচড়ে শরীরের সমস্ত মাংস তুলে নিয়ে শুধু কংকালটুকু ফেলে রেখে রাতের অন্ধকারে উধাও হয়ে যায়।

পড়তে পড়তে যখন ঘাড়ের সবকটা চুল সায়েন্সসিটির সেই বিজ্ঞাপনটার মত নব্বই ডিগ্রি খাড়া গিতে গেছে, হৃদপিণ্ডের ধুপ্‌ধাপ্‌ স্পষ্ট কানে শুনতে পাচ্ছি, তখন বই মুড়ে উঠে পড়লাম। বাপ্‌রে বাপ্‌। কী সাংঘাতিক কল্পনা। গল্পের বই পড়া থেকে ব্রেক নিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে উঠলাম। ডিম পাঁউরুটি খেতে খেতে জানালার বাইরে রেলিং আর গাছের ডালের ছায়ার ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা দেখলাম, রেলিং-এর গোড়া ফুঁড়ে এক বেওয়ারিশ চারা উঠেছে, মৃদুমন্দ হাওয়ায় তার মাথা ঝাঁকানো নাচ দেখলাম। নেচে নিক বেচারা, দু’দিন বই তো নয়। মিস্‌ বার্চের নজরে পড়লেই তো এক ওপড়ানিতে ভবলীলা সাঙ্গ হবে।



হয়ত নিজের মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই, কিন্তু আমার সত্যি মনে হল, ভাগ্যিস কেল্লা দেখতে যাইনি। কেল্লা তো থাকবে আরও একশো বছর, কিন্তু এই আগাপাশতলা ফাঁকিবাজির সকালটা, এই নৃত্যরত গাছের চারাটা, এই দুনিয়ার সব চিন্তা ভুলে পায়ের ওপর পা তুলে গল্পের বই পড়াটা তো নাও থাকতে পারে? কে বলে শতশত বছরের পুরোনো ভাঙাচোরা কেল্লার থেকে এরা কম দামি? দিনরাতের প্রতিটি মুহূর্ত নিংড়ে সাইটসিয়িং-এ খরচ না করলে, মিউজিয়াম না চষলে, কোমর কষে সকালবিকেল হাইকিং-এ না বেরোলে বুঝি একটা জায়গাকে চেনা যায় না? যদি না যায় তো না যাবে। ঘরের জানালা দিয়ে যতটুকু আকাশজঙ্গল দেখা যাবে, তাতেই আমার সাইটসিয়িং সাঙ্গ হবে। প্রতিবেশীর ঘর থেকে ভেসে আসা অবোধ্য কথা, অচেনা সুরের ছেঁড়া ছেঁড়া গান শুনে আর গাছের চারার নাচ দেখেই আমার কন্‌সার্টের শখ মিটবে।

তা বলে ভাববেন না যেন একেবারে ফাঁকি দিলাম। ভোরবেলা উঠে লন্ড্রি করেছি, খেলাখেলা রান্না করেছি, ভগবান যদি সুমতি দেন তবে বিকেল সন্ধ্যেয় খানিকটা পড়াশোনাও হতে পারে। মাথার ভেতর আর কোনও অপরাধবোধ নেই আমার। পড়ে পাওয়া একখানা রবিবার প্রাণ ভরে চেটেপুটে নিচ্ছি। ঠিক যেমন করে আমার মন চায়।







Comments

  1. ekdom niche ota kisher chabi re???? lekhata durdanto

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওটা ইংরিজিতে বললে সসেজ স্টু, আর বাংলায় বললে সসেজের ঝোল। আমার সসেজগুলো এক্সপায়ার করে যাচ্ছে কি না, তাই তিনবেলা ঝোলঝালমোরব্বা বানিয়ে খাচ্ছি। রান্নাটা খারাপ হয়নি তবে নুন আরেকটু কম হলেও হত।

      Delete
    2. eti amar o proshno chilo...oti ki khaddobostu..proshno/uttor er porbo sara...kintu uttor osompurno...সসেজের ঝোল e cholbe na...সসেজের er bangla ki bolte hobe.. :P

      Delete
    3. এই রে, জানি না তো।

      Delete
    4. @Soumesh: bhalo bolechen.....

      Delete
  2. bah! lekha, chobi aar pore pawa robibar tintei daroon :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ শম্পা। কিন্তু বিকেল হয়ে এসেছে কি না, অচিরেই ঘাড়ে এসে পড়া সোমবারের কথা মনে করে দুঃখ হচ্ছে।

      Delete
  3. mil-mil. puro weekend gaan shune (aha! amonkar er golay hamsadhwani aar barkat ali'r golay piloo), adda mere aar golper boi pore kete gelo...ehhon shombar ailo bole...ki ze korum :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ধুর ছাড়ো তো। কত সোমবার এল গেল, এখনও ঘাবড়ালে চলবে। দিস টু শ্যাল পাস্‌।

      Delete
  4. Tumi sref food photographer hisebeo naam korte parbe. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এইবার আমি সিরিয়াসলি লজ্জা পেয়ে যাচ্ছি টিনা।

      Delete
  5. amar agami koyekdin erom e kat te choleche...ki moja

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে দারুণ ব্যাপার তো, কনগ্র্যাচুলেশন্‌স্‌ রাখী।

      Delete
  6. স্যান্ডুইচ্‌টার চেহারা বেশ ম্যাকডি টাইপের হয়েছে। ভালই লাগল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ মালবিকা।

      Delete
  7. Amar ei weekend taa praay puro taai outdoorsy chhilo. Tobe tomar moto weekend majhe majhei katai. Oi ekti ghaash er shisher upor ekti shishir bindu holei holo. Imagination achhe ki korte, hun!

    Tomar recipe follow kore pasta (sausage er tukdo diye) baniye kheyeo phellam. Bangal toh, jhaal taa ektu beshi e hoye gechhhilo, kintu kuch parwa nahi. Ebaar sausage er jhol er recipe taa daao dekhi, laal rang taa dekhei jibh ey jol ashchhe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ তোমার দেখছি কালক্ষয় দোষটা একেবারেই নেই সোমদত্তা। এই ঝোলের রেসিপিটা হচ্ছে, সসেজ টুকরো করে কাটবে, নুন গোলমরিচ দিয়ে ভাজবে, তুলে রাখবে। টমেটো, নুন ঝাল, পাপরিকা দিয়ে নাড়বে চাড়বে। আমি ঠেসে পাপরিকা দিয়েছিলাম বলে লাল রং বেশি হয়েছিল। পাপরিকার বদলে কাশ্মীরি দেগি মিরচেও একই এফেক্ট হবে। তারপর ইচ্ছেমতো জল ঢেলে ঝোল বানাবে। ফোটাবে। নুন ঝাল চেক করবে, সসেজ ঝোলে ফেরৎ পাঠিয়ে কিছুক্ষণ ফোটাবে। নামিয়ে খাবে।

      সবশেষে বলি, বুঝতেই পারছ, এই রান্নাগুলো অনেক অনেক ভালো করে করা যায়। সসেজের সঙ্গে খানিকটা পেঁয়াজ ভেজে নিলে দারুণ লাগবে আমি শিওর। শেসে পার্সলেকুচি দিলেও মন্দ হবে না। আমার ওসব ছিল না বলে দিইনি। তোমার থাকলে অবশ্যই দিয়ো।

      Delete
  8. পুরোটাই মিল মিল মিল । কী যে ভাল লাগে নিজের মতো করে সময় কাটাতে দুনিয়া তা বুঝবে না ।আবার করুণাও করবে মাঝে মধ্যে।
    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. করতে দাও করতে দাও মিঠু। আমরা আমাদের কাজ করে নিলেই হল।

      Delete
  9. ছবিগুলো দারুণ হয়েছে, লেখাটাও। ব্রেকফাস্টের স্যান্ডউইচটা দেখে ক্ষিদে পেয়ে গেল। আর ওই সসেজের ঝোল আমিও এককালে সময় বাঁচাতে এবং ল্যাদজনিত কারণে অনেক বানিয়েছি। রান্নার ব্যাপারে বিদেশে নিয়ম নাস্তি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই প্রিয়াংকা। নিয়ম মানব না খেয়ে প্রাণে বাঁচব?

      Delete
  10. tor jhorjhore sundor bangla haater lekhatao mone porche....bangla horofgulo tor haater lekhai mone hochche........ chobigulo durdanto...aar lekhagulo osadharon...pore fellam onek onek lekha.... :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। পড়ে আবার সময় করে কমেন্টও যে করছিস, সত্যি ভালো লাগছে। থ্যাংক ইউ সাহানা।

      Delete

Post a Comment