মায়া



ট্রেনটা খুব জোরে ছুটছিল। জানালার শিকে মুখ চেপে বসেছিল মায়া। দেখছিল ঘন অন্ধকারের বুকে চাকা আর রেললাইনের সংযোগস্থল থেকে কেমন আগুনের ফুলকি ছিটকে উঠছে মাঝে মাঝে। মায়া ঘাড় ঘোরাল। ট্রেনের ভেতরের ঘোলাটে নিস্তেজ আলোর সঙ্গে বাইরের অন্ধকারের বিশেষ ফারাক নেই। ভীষণ পুরোনো ট্রেনটা। ঝুলজমা লোহার জালের ভেতরের হলুদ আলো মায়ার কোলে রাখা বইয়ের পাতা পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। রাতের ট্রেন বলেই হয়তো, যাত্রী প্রায় নেই। মায়া বসেছে জানালার পাশের সিংগল সিটে, উল্টোদিকের সিট খালি। ওদিকের জানালা ঘেঁষে লম্বা সিটে, মায়ার কোণাকুণি, একটা মানুষ বসে আছে – তার মুখ খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা। মায়া খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল, কাগজের আড়াল সরল না। মায়া সামনের দিকে চোখ ফেরাল। সামনের দুটো কুপ খুব সম্ভবত ফাঁকা, তৃতীয় কুপে আবার লোক আছে। করিডরের লাগোয়া সিটটায় যে বসেছে তার শাড়ির আঁচল মেঝে ছুঁয়ে ঝুলে আছে। আঁচলের রংটা ঠাহর করার চেষ্টা করল মায়া। বোঝা যাচ্ছে না, মনে হয় জংলাছাপ।

ঝাঁকুনি দিয়ে দুলে উঠল ট্রেনটা। মায়া বাঁহাতের আঙুল দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল জানালার শিক। ওর খুব শীত করল হঠাৎ। কেঁপে উঠল সারা শরীর। বইয়ের পাতায় গোঁজা আঙুল ছাড়িয়ে নিয়ে শাড়ির আঁচলটা পিঠ থেকে কাঁধের ওপর দিয়ে টেনে আনল মায়া।

আঁচল দিয়ে নিজেকে মুড়ে যতক্ষণে আবার চোখ তুলল, জংলাছাপ আঁচল ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তার জায়গায় জমাট বেঁধে রয়েছে অন্ধকার।

মায়া কেঁপে উঠল আরেকবার। ঠাণ্ডাটা বাড়ছে। অন্ধকারটাও। জংলা আঁচল গিলে ফেলে গুটি গুটি এগোচ্ছে মায়ার দিকে। শীতে মায়ার চোয়াল ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে। হাতের আঙুলে কোনও সাড় নেই। বইটা হাত গলে মাটিতে পড়ে গেছে কখন। সামনের কুপটা ঘুটঘুটে অন্ধকার এখন। মায়ার মাথার ওপরের আলোটা আরও নিস্তেজ হয়ে আসছে। ট্রেনটা কি থেমে গেছে? আর কোনও দুলুনি টের পাচ্ছে না কেন মায়া? ভীষণ ঘুম পাচ্ছে মায়ার। লক্ষ লক্ষ অ্যালজোলাম গুঁড়ো করে কেউ যেন ছড়িয়ে দিয়েছে ট্রেনের ভেতরের বাতাসে। মায়ার সারা শরীর ঘুমিয়ে পড়েছে, চোখদুটো জেগে আছে শুধু। মাথার ওপরের আলোটা সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার আগের মুহূর্তে ডানচোখের কোণ দিয়ে মায়া দেখতে পেল, খবরের কাগজটা নড়ে উঠেছে।

একটা বীভৎস চিৎকারে তীর্থর ঘুম ভেঙে গেল। মায়া পাগলের মতো ছটফট করছে। সারা মুখ ঘামে লেপটে গেছে মায়ার। ঘুমের ভেতর হাউহাউ চিৎকার করছে মায়া।

‘মেরে ফেলছে! আমাকে ম্‌-মেরে ফেলছে!’

তীর্থ মায়াকে জাপটে ধরল।

‘মায়া! মায়া! কে মারছে? কী হয়েছে সোনা? কী স্বপ্ন দেখছ? কিচ্ছু হয়নি, এই তো আমি আছি, সোনা, ওঠ, সোনা . . .’

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে হাসাহাসি করল ওরা। তীর্থ বলছিল, ‘রাত্তির আটটার সময় খাও আরও তেলেভাজা’। মায়া বেশি হাসতে পারছিল না। হাসতে গেলেই স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর। চাকার শব্দ, ঝাঁকুনি, অন্ধকার, জংলা আঁচল। আর ঠাণ্ডাটা। মার্চ মাসের সকালের ঝকঝকে রোদ্দুরভাসা বারান্দায় বসেও সে ঠাণ্ডার কথা মনে পড়ে কেঁপে উঠছিল মায়ার সারা শরীর।

*****

পরের তিন সপ্তাহে আরও চারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর ব্যাপারটা আর হাসির রইল না। অন্তত এটুকু পরিষ্কার হয়ে গেল যে কালপ্রিট তেলেভাজা নয়। তেলেভাজা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আর একটাই সম্ভাবনা পড়ে রইল।

মায়া পাগল হয়ে যাচ্ছে।

তীর্থ বা মায়ার চোদ্দপুরুষে কেউ কোনওদিন পাগল হয়নি। বিয়ে ঠিক হওয়ার সময়ই এ বিষয়টায় নিঃসন্দেহ হওয়া গিয়েছিল। মায়ার খুড়তুতো ভাই যখন বস্টন থেকে ফোন করে বলেছিল, ‘আর্‌রে বনিদি, ফাটাফাটি খবর তো! মেনি মেনি মেনি কনগ্র্যাচুলেশনস! বাই দ্য ওয়ে, বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া-ফেমিয়া টেস্টগুলো করাচ্ছ তো, নাকি প্রেমে ভেসে গিয়ে সব কাটিয়ে দিচ্ছ?’ তখন মায়ার ঠাকুমা হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করেছিলেন। ‘ও সব ছাড়, আগে খবর নে, বংশে পাগল আছে কি না।’

পাগল নিয়ে ঠাকুমার দুশ্চিন্তাটা অমূলক ছিল না। ঠাকুমার নিজের সেজমেসোমশাই ছিলেন পাগল। পাড়ার লোকে বলত বদ্ধ উন্মাদ, বাড়ির লোকে বলত ‘পাগল কেন হতে যাবে, বালাই ষাট। আমাদের গোপালের মাথায় সামান্য ছিট্‌ আছে, বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তাদের আশ্বাসে ঠাকুমার দাদু মেয়েকে ছিটেল গোপালের হাতে তুলে দিলেন। সেজমাসি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করলেন একা গোপাল নয়, গোপালের একান্নবর্তী পরিবারের নয় নয় করে আরও অন্তত তিনজন সদস্য ‘ছিটগ্রস্ত’। সকলের আশায় ছাই দিয়ে বিয়ের পর গোপালের ছিট কমার কোনও লক্ষণ দেখাল না, বরং উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল।

সেজমাসির জীবনভরের দুর্দশা ঠাকুমা দেখেছিলেন। নিজের ছেলেমেয়েরা যখন যে যার ইচ্ছেমতো বরবউ বেছে বিয়ে করে ফেলল, জাতগোত্র কারও মিলল কারও মিলল না, ঠাকুমা একটুও ঘাবড়ালেন না। বললেন, ‘ওইসব আবোলতাবোল নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, শুধু খবর নাও বংশে পাগল আছে কি না।

সংসারে একজন না একজন থাকেই, যে নিজের ভালো বোঝে না। মায়ার ছোটপিসি পিসেমশাইয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন – এ কথা পরিষ্কার জানা সত্ত্বেও যে মারা যাওয়ার ছ’মাস আগে পিসেমশাইয়ের বাবার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মায়ের সাবধানবাণীকে ‘যত্তসব বোগাস কুসংস্কার’ বলে উড়িয়ে দিয়ে পিসি পিসেমশাইকে বিয়ে করে ফেললেন, আর চল্লিশ বছরের জন্মদিন পেরোনোর সপ্তাহখানেকের মাথায় পিসেমশাই পাঁচপুরুষের রমরমা ওকালতি ব্যবসা ছেড়ে দিলেন, তিনমাসের মাথায় আলমোড়ার কাছে এক গ্রামে একখানা বাড়ি কিনে ফেললেন, ছ’মাসের মাথায় গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ইংরিজির মাস্টারমশাইয়ের চাকরি জুটিয়ে নিলেন, একবছরের মাথায় কলকাতার বাড়ি প্রায় বিনাপয়সায় ভাড়াটেকে দান করে দিয়ে সংসারশুদ্ধু আলমোড়ার গ্রামে নিয়ে গিয়ে তুললেন। ছেলেমেয়ে সব বাবার স্কুলে ভর্তি হল। বাড়িতে একগাদা ছাগল পোষা হল। ছোটপিসি নিজে হাতে ছাগলদের পরিচর্যা করতেন, পাতা খাওয়াতেন, দুধ দুইতেন, সে দুধ কাঠের উনুনে জ্বাল দিয়ে অমৃতের মতো রাবড়ি বানাতেন। মায়ারা বেড়াতে গিয়ে বাটি ভরে সে রাবড়ি খেত।

এরপর ঠাকুমা আর কোনও ঝুঁকি নেননি। প্রত্যেক নাতিনাতনির বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর বংশে পাগলের খোঁজে চিরুনিতল্লাশি চালিয়েছেন। মায়ার বেলাও অন্যথা হয়নি। তীর্থর বংশলতিকা ঝেড়েঝুড়ে যখন পাগলের চিহ্নমাত্র পাওয়া গেল না, তখন ঠাকুমা নিজে বাঞ্ছারাম থেকে এক ট্রে সন্দেশ কিনে নিয়ে গাড়ি চেপে কুটুমবাড়ি গেলেন পাকা কথা বলতে।          

আর এখন কিনা মায়া নিজেই পাগল হয়ে যাচ্ছে?

আশঙ্কার কথা মায়া প্রথম প্রকাশ করল পল্লবীর কাছে। পল্লবী ছটওয়াল, মায়ার সহকর্মী। একটা মানুষের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ – গোটাটাই যে বাস্তববুদ্ধি দিয়ে তৈরি হতে পারে, সেটা পল্লবীকে না দেখলে বিশ্বাস হত না মায়ার। লাঞ্চে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে মায়া সব খুলে বলল পল্লবীকে। স্বপ্ন, শীত, ঠাকুমার পাগল-ফোবিয়া, ছোটপিসির রাবড়ি। পল্লবী চুপ করে শুনল। একবারও মায়াকে থামিয়ে কথা বলল না।

কথা শেষ করে মায়া যখন ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফির কাপের মুখে আনমনে আঙুল বোলাচ্ছে, তখন পল্লবী মুখ খুলল। মুচকি হেসে বলল, ‘তোমার ঠাকুমা যেটাকে পাগলামি বলতেন সেটাকে এখন আমরা ডিপ্রেশন বলি ডার্লিং।’ মোবাইল থেকে একটা নম্বর বার করে মায়াকে দিয়ে বলল, ‘এই নাও ডক্টর চৌধুরীর নম্বর। তোমার স্বপ্ন সারানোর জন্য এর থেকে বেটার লোক আর পাবে না। গিয়ে আমার কথা বোলো, যত্ন করে ট্রিটমেন্ট করবে।’

মায়া অবাক হয়ে গেল। ‘তুমিও দেখাও নাকি?’

পল্লবী কাঁধ ঝাঁকাল। ‘সবাই দেখায়। ডক্টর চৌধুরী অফিসের অন্তত ফিফটি পার্সেন্ট লোকের হাউস-সাইকায়াট্রিস্ট। তুমি লাকি, তাই তোমাকে এতদিন দেখাতে হয়নি।’

অভদ্রতা করবে না বলে নম্বরটা সেভ করে নিল মায়া, কিন্তু ও জানত ও ডাক্তারের কাছে যাবে না। মায়া পাগল নয়। সাইকায়াট্রিস্ট দেখানোর ওর দরকার নেই। মায়া মন শান্ত রাখার জন্য মেডিটেশন শুরু করল। ভোররাতে উঠে ঝাড়া চল্লিশ মিনিট মর্নিংওয়াক। উপকারও পেল ম্যাজিকের মতো। টানা দু’সপ্তাহ মায়ার ঘুমে ভালোমন্দ কোনও রকম স্বপ্নেরই কোনও ছোঁয়াচ লাগল না। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মায়া। ‘ভাগ্যিস সাইকায়াট্রিস্টের কাছে যাইনি, কী বোকাটাই না বনতাম। ডিপ্রেশন না হাতি। তীর্থই ঠিক, পেটগরম ছাড়া এ সব আর কিচ্ছু না।’

*****

অনেক ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে থিয়েটার দেখতে যেত মায়া। গিরিশ মঞ্চ, সারকারিনা, রবীন্দ্রসদন, অ্যাকাডেমি। স্টেজের নিচে অন্ধকারের উষ্ণ ওমে গা ডুবিয়ে বাবার পাশে বসে থাকত ও, আর ওপরে উজ্জ্বল আলোর নিচে হেঁটেচলে বেড়াতেন অভিনেতারা। গলা কাঁপিয়ে সংলাপ বলতেন। হা হা করে হাসতেন। উদ্বেলিত কান্নায় ভেঙে পড়তেন। মায়ার চোখের পলক পড়ত না।

মর্নিংওয়াক শুরু করার ঠিক পনেরো রাতের মাথায় নিজেকে ঠিক সে রকম একটা আলোঝলমল মঞ্চের ওপর আবিষ্কার করল মায়া।

কুচকুচে কালো অন্ধকারের সমুদ্রে দ্বীপের মতো ভাসছিল মঞ্চটা, আর তার ওপর এসে পড়া একটা হলুদ আলোর নিচে দাঁড়িয়েছিল মায়া একা। স্থির, অচঞ্চল, বরফের মতো ঠাণ্ডা আলো। বর্শার ফলার মতো সে আলো এসে বিঁধছিল মায়ার সর্বাঙ্গে। আঙুলের প্রান্ত, নাকের ডগা, চোখের পাতা বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে যাচ্ছিল ওর শরীরের ভেতর।  

মৃত্যুর মতো স্থির ছবিটিতে একটি জিনিসই চলমান ছিল শুধু। অন্ধকার। চারপাশ থেকে গুঁড়ি মেরে সে এগোচ্ছিল মায়ার দিকে। আলোর বৃত্তের সীমানা ক্রমে ছোট হয়ে আসছিল, ঘিরে ধরছিল মায়াকে। ভয় আর শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছিল মায়া। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে সে ডুবে যাবে অন্ধকারের সমুদ্রে। আজ আর অন্ধকার একা নয়, ওর আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য কেউ। সে কে মায়া জানে না। শুধু জানে সে ওর বন্ধু নয়।

আলোর লক্ষ্মণরেখা যখন মায়ার পায়ের পাতা ছুঁয়েছে, শীতে পাথর হয়ে যাওয়া চোখের মণির এক তিল দূরে ঘন হয়ে এসেছে অন্ধকারের মুখ, মুখের ওপারে একটা কিছু নড়ে উঠল। একটা অবয়ব। আর শরীরের কানায় কানায় জমে ওঠা বরফের স্রোতকে প্রাণপণে ধাক্কা মেরে সরিয়ে মায়ার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা বীভৎস চিৎকার। ঘুম-ভাঙা তীর্থর বাড়িয়ে দেওয়া দু’হাতের ভেতর মায়া ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘মেরে ফেলছে! আমাকে মেরে ফেলছে! মা, আমাকে মেরে ফেলছে মা, মাগো . . . ’

*****

পল্লবী ছটওয়ালের রেফারেন্স ছিল বলে, না হলে ছ’মাসের আগে ডক্টর প্রলয় চৌধুরী, এম. ডি.-র অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যেত না। এক বুধবার অফিস থেকে আগে বেরিয়ে তীর্থ আর মায়া ডঃ চৌধুরীর চেম্বারে গিয়ে হাজির হল। সুসজ্জিত প্রকাণ্ড হলে এ. সি. কড়া ঠাণ্ডায় অন্তত ষাট জন লোক শান্ত মুখে বসে অপেক্ষা করছে। এত পাগল! কথাটা মনে হতেই মায়া নিজেকে বকুনি দিল। এরা কেউ পাগল নয়। ঠিক যেমন মায়াও পাগল নয়। আধুনিক জীবনের স্ট্রেস সহ্য না করতে পেরে এদের সকলের মনোজগতে সাময়িক বিচলনের সৃষ্টি হয়েছে, চিকিৎসা করলেই ঠিক হয়ে যাবে। তীর্থর আঙুলগুলো ভালো করে জড়িয়ে ধরল মায়া। তীর্থ হাসল। ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় বলল, ‘দেখেছ, কত লোকের হয় এ’রকম? তুমি মিছেই ভয় পাচ্ছ। দু’ডোজ ওষুধ পড়লেই স্বপ্নটপ্ন সব বাপবাপ বলে পালাবে, দেখো।’

ডঃ চৌধুরীকে দেখে তীর্থর কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল মায়ার। শান্ত অমায়িক চেহারা, মুখে একটা ভরসা দেওয়া হাসি ফুটেই আছে। ডাক্তারবাবু মন দিয়ে মায়ার স্বপ্নের কথা শুনলেন। বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলেন, অফিসের কথা। তীর্থর সঙ্গেও নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন। ছুটিতে বেড়াতে যেতে ভালোবাসে কি না, উইকএন্ডে কী করে সময় কাটায়। মায়ার সকালে হাঁটাহাঁটির কথা শুনে খুশি হলেন। অবশেষে অসুখের কথা উঠল।। পল্লবী যেটা বলেছিল, সেই কথাটাই অনেক ভালো করে, গুছিয়ে বললেন ডাক্তারবাবু। এখনকার স্ট্রেসফুল লাইফে এ’রকম সমস্যা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। তবে চিন্তার কিচ্ছু নেই। সব অসুখই তো শেষ পর্যন্ত হরমোনের ইমব্যালেন্স। ওষুধ পড়লে সব ভারসাম্য ফিরে আসবে। প্রেসক্রিপশন টেনে নিয়ে একটা নার্ভের ওষুধ, আর একটা ভিটামিন লিখে দিলেন ডঃ চৌধুরী। আপাতত এই চলুক। একমাস বাদে প্রোগ্রেস দেখবেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে কোনও অসুবিধে হবে না, পুরোনো পেশেন্টদের সবসময়েই প্রায়োরিটি দেওয়া হয়।

মায়ারা যখন নমস্কার করে উঠে চলে আসছে, ডাক্তারবাবু মনে করিয়ে দিলেন, সকালের হাঁটাটা যেন মায়া না ছাড়ে।

‘অ্যান্ড সে হ্যালো টু পল্লবী।’

*****

প্রাক্‌বিবাহ ডেটিং-এর প্রথম ভেনু স্থির হয়েছিল অক্সফোর্ড বুকস্টলের চায়ের দোকানে। পুজোর ঠিক আগে আগে। এমন কিছু গরম ছিল না মোটেই, বৃষ্টি হচ্ছিল খুব মনে আছে। অথচ দোকানের এ. সি. র ভেন্টের ঠিক নাকের ডগায় বসেও টেনশনে ঘেমে উঠছিল মায়া। সময়ের আধঘণ্টা আগে পৌঁছেছিল, যাতে তীর্থ ওকে দেখার আগে ও তীর্থকে দেখতে পায়। হাতে একটা নামকাওয়াস্তে বই নিয়ে চোখদুটো সেঁটে রেখেছিল একতলার কাঁচের দরজায়।

তবুও কী করে যে মিস হয়ে গেল ভগবানই জানেন। সেদিন নিজেকে ধরে চড়াতে ইচ্ছে করেছিল মায়ার, পরে যতবার ভেবেছে ততবার হাসি পেয়েছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দোকানের সামনে শেডের তলায় একটু ভিড় মতো জমেছিল, হাতে বই নিয়ে গালে হাত দিয়ে হাঁদার মতো সে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে, এমন সময় পিঠে আলতো টোকা। আঁতকে উঠে পেছন ফিরে মায়া দেখে একটা রোগা লম্বা ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। শার্ট ভিজে লেপটে গেছে গায়ের সঙ্গে, মাথার চুল থেকে টপটপ জল ঝরছে, হাতে কুচোমুচো করে ধরা অস্বাভাবিক রকম ছোট একটা রুমাল। বোঝাই যাচ্ছে সেটা দিয়ে চুলের জল মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে, জল কিছুই শুকোয়নি, শুধু মাথাটা কাকের বাসা হয়ে গেছে।

‘মায়া?’

উত্তর পাওয়ার আগেই ছেলেটা উল্টোদিকের চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল। মুখের হাসি তখনও মেলায়নি।

‘আমি তীর্থ। তীর্থশংকর। তুমি তীর্থ বলেই ডেকো। আই মিন . . . যদি তোমার ইচ্ছে করে।’

মায়া তাকিয়ে ছিল ছেলেটার দিকে। বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল ওর। আগে কখনও হয়নি ও’রকম। অচেনা, আনকোরা অনুভূতিটাকে মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল মায়া। কারণ ওর মন বলছিল বোঝাটা জরুরি। ছেলেটা তখনও তড়বড় করে কী সব বলে যাচ্ছিল। মায়ার কানে কিচ্ছু ঢুকছিল না। একটা . . . উঁহু, পাঁচটা। নাঃ, গোটা দশেক তো মিনিমাম। দশটা সবুজ গঙ্গাফড়িং যদি একসঙ্গে পাখা মেলে ওড়াউড়ি করে তাহলে যে রকম হবে, মায়ার বুকের ভেতরটায় ঠিক সেইরকম হচ্ছিল।

এতদিন ওর বন্ধুরা সবাই বলেছে প্রেম কাকে বলে সে নাকি বোঝানো যায় না। কেউ পারেনি, পারে না, পারবেও না কোনওদিন। সেই বৃষ্টির দুপুরে বাঁ চোখের কোণে কাঁচের ওপারে কলকলানো কলকাতা আর ডান চোখের কোণে সারি সারি সিলিংছোঁয়া বই নিয়ে, হাত পা নেড়ে খলবল করে কথা বলে চলা তীর্থশংকর বসুমল্লিকের উল্টোদিকে বসে মায়া ওর বন্ধুদের উদ্দেশ্যে মনে মনে মুখ বেঁকিয়েছিল। কে বলেছে প্রেমের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না? খুব যায়। প্রেম মানে আর কিছুই না, প্রেম মানে চোখের মণির ভেতর উশকোখুশকো চুলওয়ালা রোগা, নরম, হাসিঝলমল একটা মুখ, আর বুকের ভেতর দশ-দশটা ফড়ফড়ানো কলাপাতা রঙের গঙ্গাফড়িং।

*****

ওষুধ কাজে দিল না। ডক্টর চৌধুরী ওষুধের মাত্রা ও সংখ্যা দুইই বাড়ানোর পরেও। হুহু করে কমল শুধু মায়ার ওজন। ধেবড়ে যাওয়া কাজলের মতো কালি জমল চোখের কোটরে। শেষটায় এমন হল রাতে ঘুমোতে যেতে ভয় করত মায়ার। ঘুমন্ত তীর্থর পাশে শুয়ে চোখ টানটান করে খুলে রাখত মায়া। মনে মনে গানের খাতার পাতা উল্টে উল্টে একের পর এক গান গেয়ে যেত। নিঃশব্দে, ঠোঁট নেড়ে। কোথায় যেন পড়েছিল, মানুষ না খেয়ে যতদিন বাঁচে তার থেকে ঢের কম দিন বাঁচে না ঘুমিয়ে। শত প্রতিরোধ উপেক্ষা করে, স্রেফ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মায়ার শরীর অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ত, আর সঙ্গে সঙ্গে মায়ার মগজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত অন্ধকার।

একদিন সকালে উঠে মায়া আবিষ্কার করল, অন্ধকারটা ওর স্বপ্নের ভেতর আটকা পড়ে নেই আর। বিশ্রী, কালো, গলিত লাভার মতো উপচে পড়েছে ওর জাগ্রত জীবনটুকুর মধ্যেও। ছুঁয়ে দিয়েছে ওর বাড়িঘরদোর, অফিস, সংসার, এমনকি তীর্থকেও। কতদিন বাদে তীর্থর মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল মায়া। শিউরে উঠল। এ কে? এই কি মায়ার তীর্থ? দেবতার মতো সে উজ্জ্বল তরুণ, যার পাশে পাশে পার্ক স্ট্রিটের বৃষ্টিভেজা বাতাসে উড়েছিল মায়া, সে কোথায়? অন্ধকারটা সে তীর্থকে চুরি করে নিয়ে গেছে মায়ার কাছ থেকে। তার জায়গায় রেখে গেছে ঘোলাটে চোখের, নুয়ে পড়া কাঁধের একটা ক্লান্ত মানুষকে। যার রাতের ঘুম প্রতিদিন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মৃত্যুচিৎকারে।

নিজের ওষুধের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারলেন না প্রলয় চৌধুরীও। ছুটি নিয়ে ওদের কোথাও ঘুরে আসার পরামর্শ দিলেন। শহরের স্ট্রেস থেকে যথাসম্ভব দূরে, নির্জন কোনও জায়গা। মায়ার অফিসে ছুটি নেওয়া হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগেই, স্ত্রীর স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে আপৎকালীন বিরাম জোগাড় করে আনল তীর্থ।

*****

বাংলোর বাগানে দাঁড়িয়ে দিগন্তে নন্দাদেবীর চুড়োর দিকে তাকিয়ে ছিল মায়া। জানুয়ারির দুপুরের স্বচ্ছ, ঝকঝকে রোদ চারদিকের বরফে হীরের মতো ঠিকরোচ্ছে। দীর্ঘ প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সে আলো যতখানি পারে বুকের ভেতর টেনে নিচ্ছিল ও। ট্র্যাফিক পুলিশের মতো হাত নেড়ে নেড়ে আলোর স্রোতকে হুকুম দিচ্ছিল, এদিকে যাও, ওদিকে যাও। মগজের প্রতিটি গলিঘুঁজি, কানের লতির পেছন, চোখের কোটর – কিচ্ছুটি যেন বাদ না পড়ে। শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে কদর্য অন্ধকারের সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলতে চাইছিল মায়া।

ঘণ্টাখানেক হল আউলি পৌঁছেছে ওরা। তীর্থর এক আত্মীয়র অনেককালের পুরোনো একটা গ্রীষ্মনিবাস ছিল আউলিতে, সেখানে এসে উঠেছে। মায়া মনে মনে গুনল। তিন বছর আগে হানিমুনে যাওয়ার জায়গা খুঁজে বার করতে যখন আকাশপাতালমর্ত্য এক করে ফেলছিল ওরা, কিচ্ছু পছন্দ হচ্ছিল না, তখন এই বাড়িটার কথা প্রথম শুনেছিল মায়া। দিদিমণি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ রে পিকলু, সেই যে শিমলা না কোথায় কুমুদিদিদের সেই বাংলোটা ছিল, সেখানে যা না? কুমুদিদি ওদের ওই খোট্টা দারোয়ানটাকে লিখে দেবে, তোদের কিচ্ছু অসুবিধে হবে না।’ ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়ের অংক অবশেষে মিলে যাওয়ার উত্তেজনা নিয়ে দিদিমণি তাকিয়েছিলেন মায়ার দিকে। ‘যাবি মায়া? দারুণ ভালো লাগবে দেখিস। আমরা অনেক বছর আগে একবার গিয়েছিলাম। মিমিটুবলুর বাবা এসে বলল – অবশ্য মিমিটুবলু তখন কোথায় – যাবে নাকি? আমিও লাফ দিয়ে বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে রেডি। সে গাড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠছে তো উঠছেই, কোথায় বাংলো কোথায় কী। তারপর পাহাড়ের একেবারে টঙে চড়ে গাড়িওয়ালা বলল, ‘আ গয়া মাইজি।’

‘বাংলোয় ঢুকে অভ্যেসমতো হাতেপায়ে জল দিতে গেছি, ঠাণ্ডা জলে ছ্যাঁকা লেগে গেল। আগুনের ছ্যাঁকার থেকে সে জ্বালা কিচ্ছু কম নয় আমি বলছি তোকে মায়া। নোংরা পায়েই তাড়াতাড়ি খাটে উঠে কম্বলমুড়ি দিয়ে বসলাম। তার একটু পরেই ব্যাপারটা শুরু হল।’

গল্প বলার শখটা তীর্থ কার থেকে পেয়েছে আন্দাজ করতে পারছিল মায়া।

‘কী শুরু হল দিদিমণি?’

‘বরফ পড়া! মিমিটুবলুর বাবা জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ ‘শিগগিরি এস, দেখে যাও’ বলে ভয়ানক ডাকাডাকি লাগাল। গিয়ে দেখি আকাশ থেকে শিমূলতুলোর মতো সাদা সাদা কী সব ঝরছে। আমি তো হাঁ। বললাম, নিউমোনিয়া ব্রংকাইটিস কিচ্ছু বুঝি না, আমি বাইরে চললাম। বলে বাড়িতে পরব বলে আনা চটি পায়ে গলিয়ে দরজা খুলে সোজা বাগানে। কী অপূর্ব দৃশ্য কী বলব তোকে মায়া, চাঁদের আলো, বরফ, পর্বত। নেহাত কবিতা লিখতে পারি না তাই।’

কবিতা লিখতে না পারার দুঃখে দিদিমণি এতদিন বাদে নতুন করে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন।

‘সেই রাতে মিমিটুবলুর বাবাকে কী বলেছিলাম আমার এখনও মনে আছে।’

‘কী বলেছিলে?’

‘বলেছিলাম, স্বর্গের নন্দনকানন যতই সুন্দর হোক না কেন, যতই ব্রহ্মাবিষ্ণু উর্বশীমেনকারা সে বাগান আলো করে রাখুন না কেন, এক্ষুনি, এই মুহূর্তের কুমুদিদিদের বাগানের থেকে বেশি সুন্দর তা হতেই পারে না।'

‘বাড়ির ভেতরটাও খুব মজার, জানিস মায়া। সত্যিকারের ফায়ারপ্লেসে সত্যিকারের আগুন জ্বলতে প্রথম আমি দেখেছিলাম ওই বাড়িতেই। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন সন্ধ্যে ছ’টার পর বিজলিবাতি জ্বলত না। চাকর এসে কাঠ সাজিয়ে আগুন জ্বেলে দিয়ে যেত, ছাদ থেকে ঝোলা ঝাড়লণ্ঠনের মোমবাতিতে আগুন দিয়ে যেত, তার আলোতে যা করার কর। ডাইনিং টেবিলে ইয়া লম্বা লম্বা মোমবাতির আলোয় বসে খেতে হত। দারওয়ানের হাতের মুরগির ঝোল আর মোটা মোটা খসখসে আটার রুটি। অমৃত।’

দিদিমণি তীর্থর দিকে ফিরলেন।

‘যা না রে পিকলু, দেখে আয় বাড়িটা এখনও সে রকমই আছে কি না। কুমুদিদি খুব খুশি হবে। আমি ফোনে বলে দিচ্ছি তোরা শিমলা যাচ্ছিস। খাওয়াদাওয়ার চিন্তা নেই, খোট্টা দারওয়ানটাই সব সামলে নেবে।’

ট্র্যাভেল এজেন্সির ব্রশিওর উল্টোতে উল্টোতে তীর্থ বলেছিল, ‘আঃ দিদিমণি, খোট্টা খোট্টা কোর না তো। আর শিমলা কেন হতে যাবে। পাহাড় মানেই বুঝি শিমলা? কুমুদিদাদের বাড়ি আউলিতে।’

মায়ার আপত্তি ছিল না, বিশেষ করে হিমালয়কে ব্যাকড্রপে রেখে বরফঝরা জ্যোৎস্নারাতে হাওয়াইচটি পরে বাগানে ঘোরাঘুরির আইডিয়াটা ওর দারুণ মনে ধরেছিল, কিন্তু তীর্থর ইচ্ছে ছিল না। বলেছিল, ‘শুনলে তো কুমুদিদাদের বাড়ির ছিরি। হানিমুনের বদলে ওখানে হরর সিনেমার শুটিং জমবে বেশি। আর তাছাড়া দিদিমণিরা সেই কবে গেছে, এখন সে বাড়ি শিওর ভেঙেভুঙে হাওয়া।’
      
*****

পৃথিবীতে কোন জিনিসটা যে টিঁকবে আর কোনটা যে টিঁকবে না, সে বলা ভারি শক্ত। টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে স্কুল শেষ করার সময় সবাই মিলে সে কী কান্নাকাটি। অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি কান্না। গত বারো বছর যাদের সঙ্গে খেয়েছে বসেছে উঠেছে, দিনের পর দিন তাদের না দেখে থাকার কথা ভাবতেই বুক মুচড়ে কান্না বেরিয়ে আসত মায়ার। সায়ন্তনী ছিল মায়ার বেস্টেস্ট ফ্রেন্ড। ছাড়াছাড়ি হওয়ার সময় স্কুলের পাশের ষ্টেশনারি শপ থেকে একটা হার্টের দুটো টুকরো – খাপে খাপে লাগালেই জুড়ে গিয়ে একটা গোটা হার্ট হয়ে যায় – কিনে, একটা ওকে দিয়েছিল সায়ন্তনী, একটা নিজে রেখেছিল। হার্টের টুকরোটা প্রথমে হারালো, তারপর মাথার ভেতর থেকে সম্পূর্ণ উবে গেল সায়ন্তনী। অনেকদিন বাদে ফেসবুকে সায়ন্তনীকে ফের খুঁজে পেয়ে শুরুটা খুব ফুর্তি হয়েছিল মায়ার, তারপর তার রকমসকম দেখে চোখ কপালে। এর সঙ্গে সারাদিন কী করে অত গুজগুজফুসফুস করত সেটা অনেক ভেবেও কল্পনায় আনতে পারেনি মায়া।

অথচ কুমুদিদার বাড়ি দিব্যি টিঁকে গেছে। কেউ আসে না, কেউ দেখে না, কেউ ভালোবাসে না, সারাজীবন মনে রাখার প্রতিশ্রুতিস্বরূপ কেউ আধখানা হৃদয় ঝুলিয়ে রেখে যায়নি ওর দরজায়, তবু। চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে ঢালু পাহাড়ের কোলে। ওদের যাওয়ার ইচ্ছের কথা শুনে কুমুদিদার ছেলে অমলজেঠু একেবারে লাফিয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ওরে বাবা, ও বাড়ির কথা তোদের মনে আছে? যা যা, শিগগিরি যা। মাসে মাসে যা। সপ্তাহে সপ্তাহে যা। আমি খুবচাঁদকে ফোন করে দিচ্ছি।’

খুবচাঁদের জায়গায় খুবচাঁদের ছেলে লখনচাঁদ মায়াদের অভ্যর্থনা করল। খুবচাঁদের খুব অসুখ, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না, লখনই বাড়ির দেখাশুনো করে। লখনচাঁদকে প্রথম দর্শনেই পছন্দ হল মায়ার। কালোকোলো, গাঁট্টাগোঁট্টা। মুখখানায় বেশ একখানা সমাহিত ভাব। ছড়ানো বাড়িটার একতলা দু’তলা জুড়ে অনেকগুলো ঘর, বেশিরভাগই তালাবন্ধ। লখনচাঁদ ওদের লটবহর নিয়ে সোজা দোতলার মাস্টার বেডরুমে নিয়ে এল। দিদিমণির বর্ণনার সঙ্গে সব হুবহু মিলে যাচ্ছিল। গত পঞ্চাশ বছরে কলকাতা শহর যত এগিয়েছে আউলি তত এগোয়নি বোঝা যাচ্ছে। এখনও সিলিং থেকে ঝুলছে মোমবাতি লাগানো ঝাড়লণ্ঠন, দেওয়ালের গায়ে হাঁ করে রয়েছে ফায়ারপ্লেস। ইলেকট্রিক আলোর চিহ্নমাত্র নেই। ওদের মনের ভাব বুঝে লখন আশ্বাস দিল, সন্ধ্যের আগেই ও ফায়ারপ্লেসে আগুন দিয়ে যাবে।

সুটকেস হাত থেকে নামিয়ে সেলাম করে চলে যেতে গিয়েও থমকালো লখন। ‘রাত মে কেয়া খাইয়েগা, মেমসাব?’

উত্তরটা মায়া ঠিক করে রেখেছিল তিনবছর আগেই। একটুও না ভেবে বলল, ‘রোটি অর চিকেন কারি বানা দোগে? প্লিজ?’
 
*****

খাওয়াদাওয়ার পর সোজা কম্বলের তলায় ঢুকে পড়ল ওরা। ফায়ারপ্লেসে চুড়ো করা কাঠের ঢিপি গনগন করে জ্বলছিল। ফুটফাট আওয়াজ করে ফুলকি ছিটকে উঠছিল মাঝে মাঝে। পোড়া গন্ধটা ভীষণ চেনা লাগছিল মায়ার। অবশেষে মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় ন্যাড়াপোড়ার শেষদিকে আগুনের মধ্যে আলু ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়া হত। আগুন নিভলে আলু বার করে খোসা ছাড়িয়ে তেলনুন দিয়ে মেখে খাওয়া হত পাড়ার সবাই মিলে। এক এক জন এক এক চামচ করে পেত, তবু উৎসাহের সীমা নেই। সেই আলুপোড়ার গন্ধটা অবিকল এইরকম হত।

পর্দা সরানো জানালার ওপাশে জ্যোৎস্নার আলোয় ঝলমল করছিল সারি সারি বরফঢাকা পর্বতের চুড়োগুলো। ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়ে সে দিকে তাকিয়ে ছিল ওরা দু’জনে। ভীষণ ভালো লাগছিল মায়ার। বুকের ভেতর একটা আশা, একটা আশ্বাস দানা বেঁধে উঠছিল। এবার ভালো হয়ে যাবে ও। আর কোনওদিন ওই বীভৎস অন্ধকার মায়ার নাগাল পাবে না। রাতের পর রাত অমানুষিক শীতে আর জমে যাবে না মায়ার শরীর। আগে কেন আসেনি মায়া এখানে? এই অপার্থিব সৌন্দর্যের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেনি? বলেনি, আমাকে ভালো করে দাও হিমালয়, আমার অসুখ সারিয়ে দাও চাঁদের আলো? চোখ উপচে জল এল মায়ার। বোকার মতো কাঁদবে না বলে চোখের পাতা বুজে ফেলল ও। শুনতে পেল, তীর্থ গুনগুন করে গাইছে, অনেকদিন আগে যেমন গাইত।

‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে . . .’

*****

খাদের ঠিক ধারটায় দাঁড়িয়ে ছিল মায়া। খাদ থেকে ঠাণ্ডা লাভার মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছিল কুয়াশা। মায়াকে আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরছিল। মায়ার শরীর থেকে জোঁকের মতো শুষে নিচ্ছিল উত্তাপ।

সম্মোহিতের মতো খাদের দিকে তাকিয়ে ছিল মায়া। কোথায় যেন পড়েছিল, ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছেটা মানুষের সহজাত। খাদের ধারে যে মানুষ যেতে ভয় পায়, কিংবা সাততলা বাড়ির রেলিংহীন ছাদের ধারে দাঁড়াতে –  সেটা আসলে পড়ে যাওয়ার ভয়ে নয়, সেটা ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছে থেকে নিজেকে বাঁচাতে। অনেক সুখী, তৃপ্ত মানুষের কথা জানা গেছে, যারা উঁচু তীরের নিরাপত্তায় দাঁড়িয়ে নিচে সমুদ্রের ঢেউয়ের আছাড়িপিছাড়ি দেখতে দেখতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঝাঁপ দিয়েছে। নির্ভার পতনের হাতছানি এড়াতে পারেনি। কিংবা হয়তো পাখি হতে চেয়েছে, কে জানে।

মায়া কী চায়? ওই কুয়াশার সমুদ্রের তলায় কোন রহস্য লুকোনো আছে মায়ার অপেক্ষায়? ভাবতে ভাবতে মায়া এক পা এগোতে যাবে, ঠিক এই সময় মায়ার ঘাড়ের ভীষণ কাছে একটা নিঃশ্বাস পড়ল। বরফের মতো ঠাণ্ডা সে নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠল মায়ার সারা শরীর।

মায়া চমকে ফিরে তাকাল। কেউ নেই। চোখের ওপর শুধু পুরু ধূসর কুয়াশার পর্দা। কিন্তু মায়া জানে পর্দার ওপারেই আছে একটা মুখ। আজ যার হাত থেকে মায়ার মুক্তি নেই।

দুটো হাত ছিটকে বেরিয়ে এল কুয়াশার ভেতর থেকে। মায়া চিৎকার করে ওঠার আগেই সাঁড়াশির মতো চেপে বসল মায়ার গলায়। মায়া নিজের দু’হাত দিয়ে গলায় চেপে বসা হাতদুটো আলগা করার চেষ্টা করল, সর্বশক্তি দিয়ে বুকের ভেতর ফুলে ওঠা চিৎকারটাকে গলার বাইরে বার করার চেষ্টা করল। হাতদুটো মায়াকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল খাদের একেবারে কিনারায়। আর দেরি নেই। এবার শুধু নিমেষের অপেক্ষা। আর কয়েক সেকেন্ড বাদে কুয়াশার সমুদ্রের রহস্য স্পষ্ট হয়ে যাবে মায়ার কাছে।

কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা মুখ। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মায়ার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। পাখির মতো কুয়াশায় গা ভাসিয়ে দিল মায়া। টের পেল ওর বুকের ভেতর অনেকদিন আগের, ভীষণ চেনা একটা বৃষ্টি নেমেছে।      

*****

রক্তজল করা একটা চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল তীর্থর। একরাশ অন্ধকারের মধ্যে চোখ খুলল ও। এক সেকেন্ডের জন্য কিচ্ছু মনে করতে পারল না। এটা কোথায়, কার বিছানায় শুয়ে আছে ও? এত অন্ধকারই বা কেন? আবার সেই বীভৎস চিৎকার। একেবারে কাছ থেকে এসেছে চিৎকারটা। আঁতকে উঠে ঘাড় ফেরাল তীর্থ। ওর ঠিক পাশে শুয়ে আছে একটা ছায়ামূর্তি। ছায়াটা পাগলের মতো ছটফট করছে, দুমড়োচ্ছে মুচড়োচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে বসল তীর্থ। ছায়াটার হাত ছিটকে এসে লাগল তীর্থর গায়ে। কম্বলের আড়াল সরে গেছে, ছায়াটা উঠে বসার চেষ্টা করছে।

তীর্থ একমুহূর্ত না ভেবে ছায়াটার বুকের ওপর চেপে বসল। ছায়াটা ক্রমাগত চিৎকার করছে। তীর্থর কান ফেটে যাচ্ছিল জান্তব চিৎকারে। তীর্থ গলা টিপে ধরল ছায়াটার। ওর শরীরের তলায় ছায়া দুলে উঠল, ছিটকে ফেলে দিতে চাইল ওকে বুকের ওপর থেকে। তীর্থ সর্বশক্তি প্রয়োগ করল।

অন্ধকারটা পাতলা হয়ে এল হঠাৎ। কোথা থেকে একটা ফিকে আলো আসছে। সেই আলোতে প্রথমবার ছায়ার মুখটা দেখতে পেল তীর্থ। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য প্রকাণ্ড হাঁ করা একটা বীভৎস মুখ। কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা একজোড়া ভয়ার্ত চোখ। সোজা তাকিয়ে আছে তীর্থর দিকে।

আলোটা বাড়ছে। ছায়াটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছায়াটা আর ছটফট করছে না। ছায়াটার দৃষ্টি নরম হয়ে আসছে। তীর্থ হাত সরাল না। তীর্থর হাতের নিচে একটা জীবন্ত, উষ্ণ শরীরের দপদপানি নিস্তেজ হতে হতে মিলিয়ে গেল। ছায়াটা এখন একেবারে নিথর। তীর্থর দিকে অপলক চেয়ে থাকা দুটো চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল শুধু।

*****

মস্ত কালো লোহার গেটটা এখন আর পুরো খোলা হয় না। ঘোড়াগাড়ি ঢুকবার মাপে বানানো হয়েছিল, এখন সকালে একবার সাইকেল চালিয়ে পেপারওয়ালা ঢোকে। তার ঢুকতে যতখানি জায়গা লাগে ততখানি ফাঁক করে একটা পাল্লা খুলে রাখা আছে। দরজা দিয়ে ঢুকে একটা পাথর বিছোনো রাস্তা, রাস্তার দু’পাশে জঙ্গল। সাপখোপের ভয় ভুলে সে জঙ্গলের ভেতর ঢুকলে এখনও দেখতে পাওয়া যাবে ফোয়ারার ধ্বংসাবশেষ। নাকচোখভাঙা বিষণ্ণ পরী। রাস্তা ধরে সোজা হাঁটলে একটা গাড়িবারান্দা আসবে। বারান্দার ওপারে একটা বিরাট ইমারত। তার গা থেকে কচি বটের চারা নাক বার করে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে।

গাড়িবারান্দা থেকে ভাঙাচোরা সিঁড়ি উঠে গেছে বাড়ির মূল অংশে। সেখানে এখন আর কেউ থাকে না। থাকা যায় না বলেই থাকে না। যেখানটা এখনও থাকার যোগ্য আছে, বাড়ির পেছনদিকটা, সেখানে কয়েকঘর পরিবার বাস করে। তাদের সঙ্গে এ বাড়ির কোনও নাড়ির টান নেই। দুর্ভোগের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে কে জানে কোন চুলো থেকে তারা এসে তরী ভিড়িয়েছে এ বাড়িতে।

গাড়িবারান্দা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই একটা প্রকাণ্ড হলঘর। আজকালকার মাপের দোতলার সমান উঁচু সিলিং, ঘরের মাঝখান থেকে পেঁচিয়ে উঠে গেছে চওড়া সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে একটা জায়গায় ধুলো সরালে এখনও বেরিয়ে পড়বে চারটে গোল দাগ। মেঝের বাকি অংশের মার্বেলের থেকে সে গোলগুলোর রং বেশ খানিকটা ফিকে। ওখানেই বোধহয় দাঁড়িয়ে থাকত স্টেনওয়ে কোম্পানির চকচকে, কৃষ্ণকালো গ্র্যান্ড পিয়ানো। সব জমিদার বাড়িতেই যেমন থাকত। থাকাটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু না। এই বাড়ির লোকেরা এককালে জমিদারই ছিলেন তো। ওই তো দেওয়ালে তাঁদের ছবি টাঙানো আছে। রংজ্বলা, ছেঁড়াখোঁড়া ক্যানভাস থেকে এখনও, এতদিন পরেও ফুটে বেরোচ্ছে দাপট। সিঁড়িতে ওঠার মুখে প্রথম ছবিতে যিনি মরা বাঘের মাথার ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বদ্রিশংকর বসুমল্লিক। অগুন্তি বাঘ শিকার করেছিলেন তিনি। দেশে, বিদেশে। অন্য শিকারেও অরুচি ছিল না। লাটসাহেবের জন্য ডাকা পার্টির বিরিয়ানিতে নুন কম হয়েছিল – বাকিরা কেউ ধরতেই পারেনি, কিন্তু বদ্রিশংকরের চোখে ধুলো দেওয়া সহজ ছিল না। লখনৌ থেকে আনা রাঁধুনির কপালের ঠিক মাঝখানে বন্দুক রেখে ঘোড়া টিপেছিলেন তিনি। রক্ত ছিটকে লেগেছিল তাঁর সারা মুখে, কিন্তু চোখের পলক পড়েনি।

সিঁড়ির পরের ছবিতে সিংহের থাবার মতো পায়াওয়ালা চেয়ারে যিনি বসে আছেন তিনি আদিত্যশংকর, বদ্রিশংকরের ছেলে। চেয়ারের হাতলে বসে আছেন কুসুমবালা। আদিত্যশংকরের তিন নম্বর স্ত্রী। স্ত্রীকে চোখের মণির মতো ভালোবাসতেন আদিত্যশংকর, আর তাই একদিন ইংরিজি শেখানোর জন্য রাখা তরুণ সাহেব গৃহশিক্ষকের সঙ্গে হাসতে দেখে দুজনকে দুটি গুলিতে শেষ করে দিতে হাত কাঁপেনি তাঁর। আদিত্যশংকরের পাশের ছবি তাঁর যোগ্য পুত্র রুদ্রশংকরের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন লাগে, তখন ইনি অক্সফোর্ডের ছাত্র। রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনে রক্তে আগুন ধরে গিয়েছিল তাঁর। কর্তৃপক্ষকে গিয়ে ধরে পড়েন, তাঁকে যুদ্ধে যেতে দেওয়ার জন্য। কর্তৃপক্ষ এ ধরণের অসাধারণ অনুরোধ পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু অনুরোধকারীও যে ঠিক আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো নন, সে তাঁদের চোখ এড়ায়নি। যুদ্ধে গিয়ে মনের সুখে জার্মান শিকার করেছিলেন রুদ্রশংকর। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরার পর অনেকদিন বন্ধুদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় তাঁকে আফসোস করতে শোনা যেত, নিজের হাতে মারা অন্তত একটা জার্মানের মাথা যদি তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাঁচিয়ে আনতে পারতেন, তাহলে সেই মুণ্ডুর ওপর পা রেখে একটা পোর্ট্রেট আঁকানো যেত। পোর্ট্রেটটা তিনি টাঙাতেন বদ্রিশংকরের বাঘের মাথায় পা রাখা ছবির ঠিক পাশে।

সুশাসক জমিদার হিসেবে বসুমল্লিকদের সুখ্যাতি ছিল। প্রজাদের তাঁরা বিপদে রক্ষা করতেন, সম্পদেও বঞ্চিত করতেন না। শুধু মাঝে মাঝে রক্তের ক্ষিদে জেগে ওঠা ছাড়া আর কোনওরকম পাগলামির চিহ্ন কখনও দেখা যায়নি বসুমল্লিকদের বংশে।

      

Comments

  1. আপনি মশাই ব্লগ লেখা ছেড়ে সাসপেন্স ফিলিম বানান। কোথায় লাগে হচকিক?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে, ভদ্রলোক কবরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন, তাঁকে যন্ত্রণা দিয়ে আর লাভে আছে সুগত? আপনি কি কলম্বাস থেকে ফিরে গেছেন?

      Delete
  2. এই তো ! বর্ষার দিনে এরকমই কিছু একটা পড়তে চাইছিলাম :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমাদের এখানেও কাগজে 'মনসুন অ্যারাইভিং সুন' হেডলাইন এসে গেছে সোমনাথ, এখন বৃষ্টিটা এলেই হয়।

      Delete
  3. Ore baba re. Chaa thanda hoye giye, gaa faa knata diye ekakkar. Tumi bapu suspense ey focus koro. Daroon famous hoye jabe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই জন্যই তোমাকে আমার এত ভালোলাগে বিম্ববতী। আমি জীবনে আসলে কী হতে চাই সেটা তুমি ধরে ফেলেছ। লেখাটা তোমার কাছে উতরেছে শুনে খুশি হলাম। বাই দ্য ওয়ে, কাল টিভিতে গুশাইনিতে রাজুবাবুর বাংলো দেখাচ্ছিল। দেখেই আমার তোমার কথা মনে হয়েছে।

      Delete
  4. শেষটা দুর্দান্ত, আর গোটাটা অসাধারণ। :)
    আমিও অন্যদের সঙ্গে একমত, সাসপেন্স লেখার একটা সহজাত দক্ষতা আছে আপনার, প্লিজ ওটাকে কাল্‌টিভেট করুন। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইস, আপনি আমার লেখার দক্ষতা দেখেই খুশি হচ্ছেন অরিজিত, আমার সাসপেন্স পড়ার দক্ষতা দেখলে যে কী করতেন তাই ভাবছি। লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। আর আমার প্রিয় দুটো ইংরিজি শব্দ, সাসপেন্স আর কালটিভেট, কমেন্টে গুঁজে দেওয়ার জন্য ডবল খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  5. সাসপেন্স পড়ার দক্ষতায় মনে হয় আপনার আর আমার সেয়ানে-সেয়ানে টক্কর হবে, এইটুকুনি কনফিডেন্স নিজের ওপর আমার আছে। :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা, আসুন কোলাকুলি করি।

      Delete
  6. কী জিনিস নামিয়েছ ডার্লিং, এক্কেবারে লা-জবাব! (আজকের ট্রিভিয়া-আমার ডাকনাম টুবলু)।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, টুবলু।

      Delete
  7. অসাধারণ লাগলো!! আর সত্যি কথা বলতে কি আমার না আর কোনো কথা মনেই আসছে না.. বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি.. দেখি পরে আবার এসে কমেন্ট করে যাব |

    ReplyDelete
    Replies
    1. সর্বনাশ, একেবারে বাকরুদ্ধ! থ্যাংক ইউ, অপরাজিতা।

      Delete
  8. আমি এটুকুই দাবী করতে পারি যে -
    তীর্থ কে দেখে মায়ার বুকের ভেতর দশ
    দশটা গঙ্গা ফরিং যেমন ফর ফরাচ্ছিলো,
    গপ্পোটা পড়ার সময় আমার মনের মধ্যে সে রকম ই
    আটটা উচ্চিংড়ি আর সাতটা গুবড়ে পোকা তিরিংবিরিং আর কুর কুর করছিল.
    -- আত্মদীপ

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা, আপনাকে এত কষ্ট দিয়েছি দেখে খারাপই লাগছে আত্মদীপ। তবু, থ্যাংক ইউ।

      Delete
  9. Amar student der tomar lekha Porte bolechi ,tarao ekhon amar moton tomar ondho bhokto

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা রণিতা, ধন্যবাদ ধন্যবাদ। তোমার স্টুডেন্টদের গুরুভাগ্য ভালো দেখছি।

      Delete
  10. Replies
    1. থ্যাংক ইউ, রুচিরা।

      Delete
  11. Isss.... fatai dichen!!!! Ekkere jare kaun jai romohorshok!!!!

    Btw sobai lekhikar e eto proshongsa korlen... kebol bangla porte pari bole amar nijeke nijer pith chapre dite ichhe korche...Setai ba kom ki bolun??? :P

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ অর্ণব। ওই বাংলা পড়তে পারার পিঠচাপড়ানিটা আমি সকালবিকেল নিজেকে দিই, কাজেই হাই ফাইভ (অবশ্য সব ভাষার লোকেরাই যে যার ভাষা নিয়ে নিজেদের পিঠ চাপড়ায় বলে আমার ধারণা।)

      Delete
  12. amar ektu confusion hochhe, lajjar matha kheye jiggesh korei pheli.. Tirthar bongshogoto rakter khider byaparta bujhlam kintu Mayar sapne to or kono hat chilo na.. tahole ki Mayar depression ta handle na korte pere o khun ta kore phello, jenebujhei? naki ami kichui bujhini :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রে কাকলি, কনফিউশন রয়েছে মানে গল্পটা হয়নি। যাই হোক, আমি মাথার ভেতর যেটা ভাবছিলাম সেটা বলি। মায়ার ডিপ্রেশন ছিল না। যেটা ছিল সেটা ষষ্ঠেন্দ্রিয়, যা ওকে আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছিল। খুন মায়া হতই, আজ নয়তো কাল, তীর্থর হাতেই হত। ঘটনাচক্রে মায়ার স্বপ্ন দেখা, আপাত-ডিপ্রেশন ইত্যাদি হয়ে মনে হল যেন তীর্থ আর থাকতে না পেরে খুন করেছে, কিন্তু সেটা জাস্ট ঘটনাচক্রই।

      Delete
    2. আমিও ঠিক ষষ্ঠেন্দ্রিয় ব্যাপারটা ঠাহর করতে পারি নি। এবার বুঝলাম।

      Delete
    3. o achha, sixth sense er concept ta mathay asheni! bah, tahole tupi khullam!

      Delete
    4. ওহ .... এবার আবার পড়লাম .. ঠিক ঠিক ...
      গল্পে সে রকম ই ইঙ্গিত.
      আমি ভেবেছিলাম নেহাত ই কাকতালীয় ... তীর্থ থাকতে না পেরেই অবচেতনে বংশের নাম উজ্জল করেছে :p

      Delete
    5. কাকলি, টুপি আপনি খুলবেন কি, ভাগ্যিস প্রশ্নটা করেছিলেন। অনেকেরই ধোঁয়াশা ছিল দেখা যাচ্ছে।

      অনির্বাণ, আত্মদীপ - ধোঁয়াশা কেটেছে জেনে খুশি হলাম।

      Delete
  13. tomar ei golpo ta jokhon pora shuru korechilam tokhon anek-anek din por moner moto kichu porte parchi banglaay ---- erokom akta darun onubhuti toiri hochchilo , jothareeti boraborer obbhyaser moto bhalo legeche bole onnyo kaaj fele gograse pora shuru korlam, uddeshshyo chilo joto taratari hoy pore shesh kora . darun lagchilo porte , bhison romanchokor akta onuubhuti hochchilo anekdin por , kintu janina keno jei muhurte tomar golpe Pallabi chatwal elo --- kemon jeno taal kata shuru holo , tao ashaay book bendhe ami pore jachchilaam , ei bhebe je darun kichu chomok ashte choleche , tarpor anek kichui holo kintu je gotite uttejonar parod chora shuru hoyechilo ta dhore rakhte chaileo aar kichutei sei prottyasha puron holo na . ami asha korechilaam aaro anek beshi gaaye kanta debar moto kichu mochor ---- ja aashole asha korechilaam kintu bujhte parchilaam na mochor ta golper thik kon jaaygata theke ele amar uttejonar parod paharer churoy uthbe , kintu jodio ojana chilo ( setai swabhabik , pathok ki kore janbe lekhoker moner kotha aage theke ) tao eta bujhlaam golpe pallabi chatwal asar por jebhabe obodharito bhabe Dr. Choudhury elen , Mayar jibone ekadhik gongaforing elo Teetrho r aagomoner maddhyome , kumudidar bari elo ebong sobsheshe taar eetihaas --- kirokom jeno khoob chena kono choker gondite baki goltpo ta egiye gelo , je goti te romanchito hoa shuru korechilaam --- sei romancho baki golpo tate aar onubhob korlaam na . amio choto thekei rohossyo romancher bhokto , taai suspense thriller niye ato ghataghati korechi je ekhon prottyasha anek bere giyeche . Tobe aageo bolechi tumi daroon lekho , taai to aar kichu na hok tomar blog porboi porbo mane pori jobe theke pora shuru korechi tomar blog . Aar amar asha amar prottyasha r parod akdin paharer churoy thik uthe jabe tumi amon golpo likhbe .

    ReplyDelete
    Replies
    1. গল্পটা তোমার প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারেনি শুনে দুঃখিত হলাম অনিন্দিতা। আশা রাখি পরের গল্পগুলো পারবে।

      Delete
    2. আমার মনে হয় কুন্তলা, তুমি দুয়েকবার গল্পটা আগাগোড়া পড়। কয়েকটা প্যারাগ্রাফ একটু উপরে নিচে ওলটপালট করে দিলে চেনা ছকটা সহজেই ভেঙ্গে যাবে। উদাহরণ: প্রাক্‌বিবাহ ডেটিং-এর গল্পটা দিয়ে শুরু করতে পারতে। প্রথম থেকে সময়ানুক্রমিক গল্পে এই একটা ফ্ল্যাশ ব্যাক খাপ খায়নি।

      আর বেশ কিছু জায়গা অতিকথন দুষ্ট। ওগুলো ছেঁটে ফ্যালো। উদাহরণ: আগের প্যারাগ্রাফ এর শুরুতে আমরা জেনে গেছি যে মায়া আউলি গেছে। তাই পরে সায়ন্তনির প্রসঙ্গটা বাহুল্য বলে মনে হয়।

      Likhe jao, tomar doulate bangla ta para hoy niyomito.

      Delete
    3. ধন্যবাদ চন্দ্রচুড়, আপনার সাজেসশনস মনে রাখব।

      Delete
  14. darun hoeche golpo ta..barsha r din r sathe jomjomat ekebare

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, সঙ্গীতা।

      Delete
  15. Darun Darun !!! ekhaneo ei borshai eirakom galpo ekkebare jome gachhe. purota ek niswase pore phellam. tobe afsosh holo ei lekhatar update asheni amar kachhe tai deri hoe galo ...
    Ekta request roilo... aro eirakom galpo chai. seshta osadharon

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে দেরি কীসের ইচ্ছাডানা? আপনি যে পড়েছেন এটাই যথেষ্ট। আপনার গল্পটা ভালো লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগল। গল্প লিখতে আমার ইচ্ছে করে, কিন্তু কী নিয়ে লিখব সেই ভাবতেই সময় কাবার হয়ে যায়। এই উইকএন্ডে একটা জিনিস করার খুব ইচ্ছে আছে, দেখতে হবে বাজারে গন্ধলেবু উঠেছে কি না।

      Delete
  16. Amar 2 to question aache . Last comment e kotota ki bhalo laglo bolte bolte jigges korte bhule giyechilaam . 1) " Didimoni " oder mane Maya & Teertho r ke hoy ? 2) Teertho ki mayake porikolpito bhabe socheton obosthay khoon korlo ? naki or alter ego ? naki kono aaloukik Shakti oke diye koriye nilo ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনিন্দিতা, দিদিমণি ওদের একজন বয়স্কা আত্মীয়। আর তীর্থ কেন মায়াকে খুন করেছে সেটা ওপরে বলেছি, তুমি পড়ে নিতে পার।

      Delete
  17. ইয়ে, একটা কথা-'Coupe' উচ্চারণটা বোধহয় কুপ নয়, যতদূর জানি কুপে।

    ReplyDelete
  18. অনবদ্য সাসপেন্স। ভাষা এজ ইউজুয়াল তুলনাহীন (আমি আপনার লেখনশৈলির বিরাট ভক্ত)। শেষের চমকটাও ভাল। সব থেকে ভাল বসুমল্লিক পরিবারের রত্নদের কীর্তিকাহিনির বর্ণনা। সব মিলিয়ে বেশ পুদিচ্চেরি ব্যাপার। কিন্তু কয়েকটা কন্সট্রাকটিভ সমালোচনাও সঙ্গে সঙ্গে করে রাখি :-)

    ১। ষষ্ঠেন্দ্রিয়র ব্যাপারটা আমার মাথাতেও ঢোকেনি, কমেন্ট পড়ে বুঝলাম। সেটা আমার মাথার দোষ, বা কল্পনাশক্তির অভাবও হতে পারে। তবে আমি ভেবেছিলাম তীর্থ মায়াকে স্লো পয়জনিং করছে। এ দিকটা একটু ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে। সেটা যে সবসময় খারাপ তা নয়। সব কিছু জলের মত পরিষ্কার যে হতেই হবে তার মানে নেই। তবে ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখবেন।

    ২। সাসপেন্স গল্পে আরেকটু ফোকাস, আরেকটু ঠাসবুনুনি থাকলে বোধহয় ভাল হয়। এ গল্পেও কিছু কিছু ঘটনার বর্ণনা আছে যেগুলো না থাকলে হয়ত কিছু ক্ষতি হতনা।

    সমালোচনা ইন গুড ফেথ। রাগ করবেন না :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে, রাগ করার ব্যাপারই নেই তথাগত। কষ্ট করে পড়েছেন, সেটা নিয়ে ভেবেছেন এবং সুচিন্তিত মতামত রেখেছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ ছাড়া এর প্রতিক্রিয়া আর কোনও কিছুই হতে পারে না।

      আপনার পরামর্শ মনে রাখব। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  19. ei chaloman andhakar aste aste ghire dharche, ei drishyata samprati akta filme dekhlam 'under the skin'.cinemata amar bhalo lage ni,kintu kichu kichu angsho gaye kanta deoar moto... tor lekhata amar khub bhalo legeche...besh bhoyer - tinni

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, তিন্নি।

      Delete
  20. Porlam...Khub bhalo hoyeche...r to kichu bolar dorkar nai...porertar opekhay roilam...
    'machi taranor moto hat nere' -- eta Sirshendu Mukherjee-r Durbin e peyechilam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ধন্যবাদ সৌমেশ।

      Delete
  21. Kuntala Amar proshno gulo keno jegechilo mone se bishoy e aar ektu kholsa Kore bolar dorkaar aache , BTW tomar oporer lekha mane ki oporer comments ? Hain porechi . jaaihok ei long weekend ta ekhankaar swadhinota upolokhkhe bes onnyorokom chutir amaje sobaai moje aache , amrao sei dolei aachi taai 2 din pore ektu somay niye bose guchiye tomake ei byapar ta niye likhbo , ashakori birokto hobena .

    ReplyDelete
    Replies
    1. মোটেও না, অনিন্দিতা। আশা করি তোমার ফোর্থ জুলাই লং উইকএন্ড ভালো কাটুক।

      Delete
  22. tension ta jata just jata,sotyi kothay lage thrlieer filim..kichu bepar,jemon ektu predictable,oi je thakumar sabdhanota ta..aar explanation e ektu golojog..jodio chotogalpo ei rakam e hobe..sesh hoiao hoilo na sesh..

    ReplyDelete
  23. achcha comment gula pore ekta bapar clear holo swopner mane ta..sixth sense..ba ba ..besh besh..baparta age mathay aseni..

    ReplyDelete
    Replies
    1. মাথায় না আসার দোষটা নিতান্তই আমার, আমিই ঠিক করে বোঝাতে পারিনি। আপনি যে পুরোনো পোস্টগুলো পড়ে এত যত্ন করে মন্তব্য লিখছেন সে জন্য অনেক ধন্যবাদ।

      Delete

Post a Comment