লেখা নিয়ে
উৎস গুগল ইমেজেস
চোখ মুখ নাক মেজাজ ইত্যাদি তো আসেই, আমার বিশ্বাস কোটেশনের প্রতি ভালোবাসাও
জন্মসূত্রে আসে। অন্তত আমার তো এসেছে। আমার মায়ের অনেক ডায়রি ছিল। (ডায়রির প্রতি
ভালোবাসাও আমার পাওয়া উত্তরাধিকারের লিস্টে পড়বে) একটা গানের, (যেটা থেকে আমি সা
রে গা মা, ভৈরব রাগের আরোহণ অবরোহণ আর ‘আলো আমার আলো’ গানটা শিখেছিলাম) একটা
কবিতার (বাকি ডায়রিগুলো যেমন চাইলেই নেড়েচেড়ে দেখা যেত এটা তেমন যেত না। স্কুলের
শেষদিকে পৌঁছলে মা মাঝে মাঝে ডায়রি নামিয়ে নিজেই দুয়েকটা কবিতা পড়ে শোনাতেন আর শোনার
পর আমি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলে খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করতেন।) আর একটা কোটেশনের।
এই তিন নম্বর ডায়রিটা ছিল আমার ফেভারিট। সবুজ মলাট, লম্বায়চওড়ায় পথের পাঁচালী
বইটার সমান। ভেতরে নীল রঙের কালি পেনে (পেনটা নির্ঘাত রাইটার, কালিটা নির্ঘাত
সুলেখা।) অসামান্য হাতের লেখায় সারি সারি প্রোভার্ব আর কোটেশন।
Our sweetest songs are those that tell of
saddest thought.
When wealth is lost, nothing is lost; when
health is lost, something is lost; when character is lost, all is lost.
If winter comes, can spring be far behind?
আমি যখন থেকে মাকে দেখছি ততদিনে মায়ের কোটেশন সংগ্রহের অভ্যেস চলে গেছে।
কিন্তু ছোট্ট করে বলা কাজের কথার প্রতি ভালোবাসাটা যে রয়ে গেছে সেটা দক্ষিণেশ্বর
গেলে বোঝা যেত। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে আমরা এতবার গেছি যে গোটা বেড়ানোটা একটা নিয়মের
মতো হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে জুতো রাখার বাঁধা দোকান, সেই দোকান থেকেই শালপাতা আর
কঞ্চি দিয়ে বানানো তেকোণা টুকরিতে কুটকুটে মিষ্টি কড়াপাকের প্যাঁড়া কিনে সোজা মন্দির,
পাণ্ডাকর্তৃক টুকরি ছিনতাই, সেকেন্ডের মধ্যে আধখানা ন্যাতানো জবাসহ টুকরি ফেরৎ এবং
প্রায় হ্যাট হ্যাট শব্দ সহযোগে আমাদের অর্ধচন্দ্র প্রয়োগ। তাড়া খেয়ে আমরা নাটমন্দিরে
নেমে আসতাম। গানটান চলতে থাকলে খানিকক্ষণ বসা হত। এই নাটমন্দিরেই আমি এক
ভদ্রমহিলার ভর হতে দেখেছিলাম। সিঁদুরে মাখামাখি কপাল ভীষণ জোরে জোরে লাল মেঝেতে
ঠুকতে ঠুকতে দুর্বোধ্য শব্দ করছেন। পিঠভর্তি কালো চুল ছড়িয়ে রয়েছে। চারদিকে সবাই
খুব ইমপ্রেসড মুখ করে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছে। এর পর বারোমন্দির। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছ’টা মন্দির
প্রদক্ষিণ করে নেমে এসে আবার নেক্সট ছয়। এই ফাঁকে শিবের বারোটা নাম আরেকবার ঝালিয়ে
নেওয়া হত। এর পর রোদে তেতে থাকা চাতাল কোনওমতে লাফিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে মদনমোহনের মন্দির,
মন্দির থেকে বেরিয়ে আবার লাফাতে লাফাতে রামকৃষ্ণের ঘর।
আমার ধারণা গোটা মন্দিরে এইটাই ছিল মায়ের প্রধান আকর্ষণ। রামকৃষ্ণের ঘর নয়,
ঘরের বাইরের দেওয়ালে টাঙানো একটা বোর্ডে লেখা কয়েকটা লাইন। মানুষের জীবনে কী কী জিনিস
আদরের, বর্জনের, সম্মানের, সংশোধনের – সে সবের লিস্ট। প্রতিবার রামকৃষ্ণের ঘরে
ঢোকার আগে বোর্ডটা খুব মন দিয়ে পড়েন মা। প্রতিবারই লিস্ট মিলিয়ে আরেকটু ভালো হওয়ার
সংকল্প নেন মনে মনে। প্রতিবারই দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে ঘুরে এসে আমাকে ফোন করে
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঠাট্টাইয়ার্কি করে ফেলেই গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলেন, “ইস্, ভুল
হয়ে গেল। লেখা ছিল রঙ্গরস চাপল্য বর্জনীয়। এই শেষ, আর আমি তোর সঙ্গে রঙ্গরস করব না সোনা,
কেমন?” প্রতিবারই আমি মাকে সান্ত্বনা দিই যে ওই নিয়মগুলো পৃথিবীর বাকি সবার সঙ্গে
মেনে চলার জন্য, মামেয়ের জন্য নয়।
আমার কোটেশনের ডায়রি নেই। কিন্তু শখটা আছে। জে এন ইউ-তে গোদাবরী হোস্টেলের
ঘরের ইট বার করা (প্লাস্টার চটে ইট বেরিয়ে পড়েছে সে রকম ভাববেন না, ওটাই ডিজাইন।)
দেওয়ালে শোলার বোর্ড লাল রঙের কাগজে মুড়ে আমার জীবনের প্রথম সফট বোর্ড টাঙিয়ে
দিয়েছিল আমার প্রথম রুমমেট, আজকাল যাকে ইনসপিরেশন বোর্ডও বলে। সে বোর্ডে আমি
চন্দ্রবিন্দুর গ্রুপ ফোটো আর আমার পছন্দের কয়েকটা কোটেশন সেঁটে রেখেছিলাম। বেশিরভাগ
কোটেশনই ভুলে গেছি, খালি একটা ছাড়া। Attached detachment, detached attachment. খুব সম্ভবত এডওয়ার্ড সইদের কথা। এডওয়ার্ড সইদ যে মস্ত একজন লোক সেটা ছাড়া
তখন কিছু জানতাম না (এখনও জানি না) কিন্তু তাঁর এই কথাটি আমার দারুণ পছন্দ হয়েছিল।
এখনও পছন্দের।
আমার অনেক সহকর্মীর টেবিলে ইনসপিরেশন বোর্ড আছে। সেখানে রকমারি কোটেশন পড়তে
পাই। Keep calm and carry on-এর বাজার তেজী। সেদিন দেখলাম একজন দেওয়ালে সেঁটেছে Work is worship, Economics is God. আমার এখন আর ইনসপিরেশন
বোর্ডটোর্ড নেই, কিন্তু মাথার ভেতর কিছু কোটেশন সর্বদা ঘুরঘুর করে। যখন যেটা ভাবনার
অগ্রভাগ দখল করে তখন সেটাকে চোখের সামনে রাখার ব্যবস্থা করি। বিশ্বশুদ্ধু সবার
চোখের সামনে নয়, শুধু আমার চোখের সামনে। যেমন ইদানীং আমার অফিস এবং বাড়ির
কম্পিউটার দুটোরই ব্যাকগ্রাউন্ডে জ্বলজ্বল করছে অ্যানি ডিলার্ডের কোটেশন। How we spend our days is,
of course, how we spend our lives.
সব রকমের কোটেশনের মধ্যে আমার সবথেকে প্রিয় (গদ্য)লেখাসংক্রান্ত কোটেশন। তার
একটা কারণ লেখালিখি সংক্রান্ত কথাবার্তা পড়তে, শুনতে আমার ভালো লাগে। লিখতে যত
ভালো লাগে তার থেকেও বেশি। লেখার পরিশ্রমটাও হয় না, আবার বেশ অনুপ্রেরণাও জোটে। যখন পড়ি নিল গেমন বলেছেন, “Start telling the stories that only
you can tell, because there’ll always be better writers than you and there’ll
always be smarter writers than you. There will always be people who are much
better at doing this or doing that — but you are the only you.” তখন
তাঁকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। রে ব্র্যাডবেরি যখন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন, “Just
write every day of your life. Read intensely. Then see what happens.” তখন রক্ত গরম হয়ে ওঠে। মনে হয় সত্যি সত্যি দেখিই না কী হয়।
বলাই বাহুল্য, দেখা হয় না। কারণ কোটেশন ভালোলাগা মন্দলাগার সঙ্গে সে কোটেশন
জীবনে প্রয়োগ করার কোনও সম্পর্ক নেই। যে কোনও বিনাপয়সার উপদেশের ধর্মই তাই। দেখা
শোনা পড়া যত আরামের, কাজে করা ততটাই কঠিন।
তা বলে সব লেখাসংক্রান্ত কোটেশনই যে আমার মনে ধরে তেমন নয়। আমি নিজে যা মনে মনে বিশ্বাস করি, যেটাকে ঠিক বলে জানি, সেই কথাটাই গুরু গোছের কেউ
সাজিয়েগুছিয়ে বললে ভালো লাগে। লেখালিখির উপদেশসংক্রান্ত কোটেশনের ক্ষেত্রেও সেটা
সত্যি। আবার অনেক সময় ঠিক উল্টো ব্যাপারটাও হয়। উক্তির থেকে বক্তা বড় হয়ে ওঠেন। হয়তো
বিষয়টা নিয়ে আমি আগে ভাবিইনি, কিন্তু যেহেতু আমার প্রিয় মানুষ বলেছেন, অমনি আমার
মনে ধরে যায়। সেদিন কোথায় একটা পড়লাম সত্যজিৎ রায় বলেছেন যে সারাজীবন তিনি একটিই মোক্ষের
সাধনা করে এসেছেন। “ইকনমি অফ এক্সপ্রেশন”। ঠিক করেছি, পারি না পারি, আমিও তাই করব।
সবসময় আবার মনে ধরা কোটেশনও যে প্রয়োগ করে উঠতে পারি তেমন নয়। কে যেন
বলেছিলেন, ব্র্যাকেটের (আমরা বলি ব্র্যাকেট, ওরা বলে প্যারেনথেসিস) ভেতর যে কথা
লিখতে হয়, সেটা আসলে লেখার কোনও দরকারই নেই। আমি বক্তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত এবং
বেশিরভাগ সময়েই এটা মেনে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু কখনও কখনও যে করিও না, সেটার
প্রমাণ আজকের পোস্ট।
অনেকসময় লেখকদের বলা, লেখাসংক্রান্ত কোটেশনই
জীবনের ক্ষেত্রেও লাগসই হয়ে যায়। উমবার্তো একো যখন বলেন, "Do not play the solitary genius", তখন মনে হয়
শুধু লেখক নয়, অলেখকদের ক্ষেত্রেও নিষেধটা সমানভাবে প্রযোজ্য। মায়া অ্যাঞ্জেলো যখন
বলেন, “You can only become truly accomplished at
something you love. Don’t make money your goal. Instead pursue the things you
love doing and then do them so well that people can’t take their eyes off of
you.” বোঝাই যায় তিনি তখন শুধু
লেখার কথা বলছেন না, নাচ, গান, ক্রিকেট, জ্যোতিষচর্চা, সবের
ক্ষেত্রেই তাঁর টোটকা কাজে দেবে। এই গোত্রের আরও একটা চমৎকার উদাহরণ হল রালফ
ওয়াল্ডো এমারসনের উক্তি। “Finish each day before you
begin the next, and interpose a solid wall of sleep between the two.”
তবে লেখালিখিসংক্রান্ত কোটেশনের মধ্যে আমার সবথেকে প্রিয় সেগুলো যেগুলোতে
লেখার খুঁটিনাটি নিয়ে উপদেশ দেওয়া থাকে। যেগুলোর মানা না-মানা হাতেকলমে পরীক্ষা
করা সম্ভব। এই রকম কোটেশনের মধ্যে যতিচিহ্নসংক্রান্ত কোটেশন পেলে আমি খুব মন দিয়ে
পড়ি। কারণ ওটা আমার ভয়ানক দুর্বল জায়গা। হাইফেন, ড্যাশ, কোলনের কথা ছেড়েই দিলাম, কোথায়
যে কমা দেব আর কোথায় যে দেব না, সেটাই আমার কাছে এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার হয়নি। কিন্তু
কার্ট ভনেগাটের উক্তি, “Do not use semicolons. They are transvestite hermaphrodites representing
absolutely nothing. All they do is show you've been to college.”
পড়ার পর থেকে আমি সেমিকোলনের পাট তুলে দিয়েছি। নিতান্ত ঝামেলায় না পড়লে ব্যবহার
করি না। যতিচিহ্ন সংক্রান্ত আরেকটা যে উপদেশ আমার মনে ধরেছে সেটা হচ্ছেন ফিটজেরাল্ডের
বলা, “Cut out all these exclamation points. An exclamation point is like
laughing at your own jokes.”
স্টিফেন কিং-এর অ্যাডভার্ব বর্জনের উপদেশ আমার আরেকটা প্রিয় কোটেশন। "The road to hell is paved
with adverbs." মিস্টার কিং-এর রাগ সমস্ত রকম অ্যাডভার্বের প্রতিই,
কিন্তু বেশি রাগ যে সব অ্যাডভার্বের ওপর যেগুলো সংলাপের আশেপাশে ব্যবহার হয়। যেমন
ধরা যাক কেউ যদি লেখে, “‘দূর হয়ে যা
আমার চোখের সামনে থেকে’ রেগে আগুন হয়ে বললেন বাবা,” তখন স্টিফেন কিং বলবেন
এখানে “রেগে আগুন” বলার কোনও দরকারই ছিল
না, কারণ সংলাপটা পড়েই বোঝা যাচ্ছে বাবা রেগে গেছেন। যদি না বোঝা যায় বরং সংলাপটা
সারাও, “বললেন” ক্রিয়াপদের আগে একগাদা বিবরণ জুড়ো না।
সবসময় যে এই উপদেশগুলো খুব
কাজে লাগে তা নয়। “ফাদার সেড অ্যাংরিলি” বাক্যে 'অ্যাংরিলি' শব্দটাকে যতটা বাড়তি মনে
হয়, 'রেগে আগুন' শব্দদুটোকে ততটা মনে হয় না। এর কারণ আমাদের কানের দোষ হতে পারে,
বা হয়তো সত্যিই তারা বাড়তি নয়, হয়তো বাক্যে সত্যিই তাদের প্রয়োজন আছে। যতই হোক দুটো
ভাষা তো আলাদা, দুটো ভাষায় লেখার ধাঁচও আলাদা হবে। এক ভাষার নিয়ম আরেক ভাষায়
চালিয়ে দেওয়া হয়তো যায় না।
আর সেখানেই আমার দুঃখ। বাংলা
ভাষায় এ ধরণের নিয়মকানুন বলে দেওয়ার লোকের বড়ই অভাব। ব্যাকরণ বইয়ের অভাব নেই, কিন্তু
যাঁরা প্রচুর লিখেছেন, লিখতে লিখতে বাংলা গদ্যের বাক্যগঠন যাঁদের কাছে
নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের মতো স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, তাঁরা কোথাও লিখে যাননি সে সব বাক্য
লেখার সময় তাঁরা কী কী গুণের পেছনে ছুটেছেন, কী কী অবগুণ প্লেগের মতো পরিহার করেছেন। মাঝেসাঝে কেউ কেউ অবশ্য নিজের অন্যান্য লেখার মাঝে মাঝে
দুয়েকটা টোটকা গুঁজে দিয়েছেন। সম্ভবত পাকদণ্ডীতেই লীলা মজুমদার পরামর্শ দিয়েছিলেন
তেড়ে ইংরিজি সাহিত্য পড়তে, চলতি শব্দের ভাঁড়ার বাড়াতে, আর অনুচ্ছেদের মধ্যে
বাক্যের দৈর্ঘ্যের হেরফের করতে। মানে একটা লম্বার পর একটা বেঁটে বাক্য, একটা
ইতিবাচকের পর একটা প্রশ্নসূচক বাক্য– এই রকম। তাছাড়া ‘বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন’
বলে আনন্দ প্রকাশনীর একটি বই আছে। সেটি মূলত আনন্দবাজার পত্রিকা ব্যবহার বিধি। 'তুলল' লিখব নাকি 'তুললো', 'মন্ত্রী' ঠিক কিন্তু 'মন্ত্রীত্ব' ভুল, এই সব তথ্যের জন্য বইটি
খুবই কাজের। তাছাড়াও “মনে রাখুন, ‘প্রত্যুষ পাঁচ ঘটিকায় তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত
হয়’ না লিখে ‘ভোর পাঁচটায় তিনি মারা যায়’ লিখলে মৃতের প্রতি কোনও অশ্রদ্ধা সূচিত
হয় না।” বা “শার্দূলের গর্জনের
চেয়ে বাঘের হালুম কিছু কম ভয়ঙ্কর নয়।” এই রকম ভালো ভালো উপদেশও বইটিতে আছে।
কিন্তু আমি যতদূর জানি
স্টিফেন কিং-এর ‘অন রাইটিং’-এর মতো বই বাংলায় একটাও লেখা হয়নি। লেখাকে কেন্দ্রস্থলে
রেখে একজন লেখকের যে জীবন, সেই জীবনটাকে নিয়ে লেখা বই। সেটার দিনরাত, সেটার
হারজিত। একটা লেখা কী করে তৈরি হয়, কীভাবে কাঠামোটা আসে, কীভাবে তাতে
হাড়মজ্জা রক্তমাংস চাপানো হয়, সেই গল্প নিয়ে লেখা বই। সোজা কথায় বলতে গেলে সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধেক জীবন’-এর থেকেও ‘সেই সময়’ আর ‘প্রথম আলো’ আর
‘আত্মপ্রকাশ’-এর জীবনী আমি পড়তে দারুণ ইচ্ছে করে। একজন লেখক কখন লেখেন, কতক্ষণ
লেখেন, লিখতে লিখতে আটকে গেলে কী করেন। একটা দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গেলে কোন কোন
ইন্দ্রিয়ের কথা মাথায় রাখেন, একটা চরিত্রের কতখানি অনাবৃত করেন, কতখানিই বা পাঠকের
দৃষ্টির আড়ালে রাখেন – এই সব আমার জানতে ইচ্ছে করে। আমার মতো অনেকেরই করে নিশ্চয়।
এত বিখ্যাত লেখকের জীবনী,
আত্মজীবনী লেখা হয়েছে, কেন যে তাঁদের লেখক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা নিয়ে কখনও কিছু
লেখা হয়নি ভগবানই জানেন। কারণ হতে পারে আমরা বোধহয় লেখা, গান, ছবি আঁকা বা
অন্যান্য সৃষ্টিশীল ব্যাপারকে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে দিতে চাই। হেমিংওয়ে বলেছিলেন,
“It’s none of their business that you have to
learn to write. Let them think you were born that way.” জন্মগত
প্রতিভার প্রতি আমাদের যত মুগ্ধতা পরিশ্রমের প্রতি ততই নাককোঁচকানি। সারাবিকেল
আড্ডা মেরে বেশি নম্বর পেলে আমরা দারুণ খুশি হই, কিন্তু আড্ডার লোভ জয় করে সারাবিকেল
বইয়ে মুখ গুঁজে বেশি নম্বর আদায় করলে সেটাকে “গেঁতোমি” বলে উড়িয়ে দিই। পড়াশোনার
মতো দিন আনা দিন খাওয়া ব্যাপার নিয়েই আমাদের এই মনোভাব, সংগীত সাহিত্য ভাস্কর্য
ইত্যাদি সৃষ্টিশীল কাজকর্মের ক্ষেত্রে যে কী হবে সে তো আন্দাজ করাই যায়। তবে এ
মনোভাব চিরকালই ছিল। বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে হিন্দুস্থানি মার্গসংগীতকে পাঠ্যক্রমের
বাঁধনে বেঁধে ফেলায় তাঁকে অনেক হেনস্থা সইতে হয়েছিল। ওস্তাদপণ্ডিতের ঘরে না জন্মে,
স্রেফ নিজের উদ্যোগ ও পরিশ্রমে স্কুলে ভর্তি হয়ে গান গাইতে শিখে যাবে যে কেউ, এ
সম্ভাবনায় ঘরানাদার গাইয়েবাজিয়েরা ভয়ানক রেগে গিয়েছিলেন।
তবে স্বীকার করতে বাধা নেই,
আমার এ মনোভাব একেবারে স্বার্থহীন নয়। প্রতিভার ওপর ভরসা করে থাকলে আমার আর লেখার
কোনও মানেই হয় না। প্রতিভা আমার নেই, থাকলে এই সাড়ে চৌত্রিশ বছরে বেরিয়ে পড়ত। কাজেই
প্রতিভার মুখ চেয়ে বসে থাকলে আমার চলবে না। আমার ভরসা কেবল খাটুনি। ঘষটে ঘষটে
যতটুকু হয়। তাই আমার অ্যান্থনি ট্রলপের কোটেশনটি বড় প্রিয়। "My belief of book writing is much the same as my belief as to
shoemaking. The man who will work the hardest at it, and will work with the
most honest purpose, will work the best."
Quotations porte amaro khub bhalo lage re... Majhe majhei google khule quotations pori. Kintu as usual , segulo sudhu khub mon diye pori.. apply kora hoi na kaj a.. Tobe majhe majhe Facebook a post kori , ar majhe majhe whatsapp er status banai ogulo ke...
ReplyDeleteHip hip hurray for kakima... Marattok guni re uni...
সর্বনাশ, তোর কথা শুনলে মা অজ্ঞান হয়ে যাবে, ভট্টা। দোষগুণ যাই থাক, সব মা-ই মারাত্মক, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
Deleteকোটেশন স্ট্যাটাস বানানোর পক্ষেই ভালো, ওগুলো মানতে হলেই হয়েছে আরকি।
পড়ে দারুন লাগল। যেমন বিষয়ভাবনা তেমনই লেখা। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের "এ মুভেবল ফিস্ট'-এও বেশ কিছুটা আইডিয়া পাওয়া যায় কিভাবে লেখা উচিত তার ব্যাপারে। তাই না?
ReplyDeleteযায় বুঝি? আমি পড়িনি, পড়ব তা হলে। রেকো দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ, অনিন্দ্য। লেখাটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।
Deleteআমার তো তাই মনে হয়েছে। বইটা যদিও ওঁর নিজের জীবন, তবু আমি যেন "সেই সময়"-এর ধরন পাই। তখনকার প্যারিসের তাবড় তাবড় শিল্পী-সাহিত্যিকের অনায়াস যাতায়াত আছে পাতায় পাতায়। অবশ্যই পড়ুন...
Deleteএই লেখাটায় আমার অনেক কিছু বলার আছে।
ReplyDeleteপ্রথমত, ওই কোটেশনের প্রতি ভালোবাসাটা আমারও আছে ভীষণ রকম। আমার বাবারও ঠিক ঐরকম একটা ডায়রি ছিল, মানে এখনও আছে কোথাও, যেটা ভর্তি ফাউন্টেন পেনে নিল কালিতে লেখা ইংরেজি আর বাংলা কোটেশন। সেটা থেকেই হয়ত আমার স্বভাবটা তৈরী হয়েছিল। আমি গুগল করে করে কোটেশন পড়ি রেগুলার, গুছিয়ে কোনও কিছু লিখতে হলে সেখানে সেগুলো গুঁজে দেওয়ার চেষ্টাও করি। আমার এখানে পড়তে আসার সময়ে আমার স্টেটমেন্ট অফ পারপাস, পরে চাকরির এপ্লিকেশনের সঙ্গে টিচিং ফিলোসফি ইত্যাদি সব জায়গাতেই ভাল ভাল কোটেশন দেওয়া আছে। যখন দেশে সফটওয়্যার-এর কাজ করতাম তখন আমার ইমেল এর নিচে সিগনেচারের সঙ্গে একটা কোটেশন থাকত। তার মধ্যে আমার সবথেকে পছন্দেরটা ছিল, “The greatest pleasure in life is doing what people say you cannot do.” চাকরি ছাড়ার সময়ে অফিসের সবাইকে যে মেলটা পাঠিয়েছিলাম তার ওপরে লেখা ছিল "A ship in harbour is safe, but that is not what ships are built for." ইদানিং ফটোগ্রাফি নিয়ে বেশ কিছু কোটেশন আমার ভীষণ ভালো লাগে, বিশেষত অ্যান্সেল অ্যাডামস-এর। আমার সবথেকে প্রিয়টা হল “The single most important component of a camera is the twelve inches behind it.” বলাই বাহুল্য সব সময়ে সব কোটেশন মেনে চলা যায়না, কারণ তাহলে পি এন পি সি, ইউটিউব আর অ্যাংরি বার্ডস-এর জন্য সময় থাকেনা।
দ্বিতীয়ত, দক্ষিনেশ্বর যাওয়ার বর্ণনাটা এর থেকে ভালো করে লেখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ওই গরম চাতাল লাফিয়ে লাফিয়ে পেরোনোর জায়গাটা মোক্ষম হয়েছে।
স্টেটমেন্ট অফ পার্পাসে কোটেশন, নাঃ, আপনার কোটেশনপ্রীতির কাছে আমার কোটেশনপ্রীতি হার স্বীকার করছে, সুগত। কোটেশন না মানা প্রসঙ্গটায় বলি, ব্যাপারটা অনেকটা আপনার কোটেশনের ওই জাহাজটার মতো। কোটেশনস আরে নট মেন্ট টু বি ফলোড।
Deleteবাঃ, বেশ অন্যরকম লেখা, খুব ভাল লাগলো। :)
ReplyDeleteধন্যবাদ, অরিজিত।
DeleteAmar ei saptahe-r quote holo "Writing is possibly an art but crime writing is definitely a craft." Aajkal russian lekhok boris akunin ke aviskar korechei. daroon crime fiction set in Tsarist Russia.
ReplyDeleteব - রি - স আ - কু - নি - ন। ব্যস। লিখে নিলাম, শম্পা। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
Deleteক্রাইম রাইটিং-এর ব্যাপারটায় একেবারে একমত। মগজে রীতিমত প্যাঁচ না থাকলে ও জিনিস লেখা সম্ভব নয়।
K...tumi akunin er boi na peleo koi baat nei. aami ek copy kine rekehchhi phor u. dekha holey diya dimu :)
Deleteহাহা, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, শম্পা।
DeleteMost of the computer related problems originate between the keyboard and the chair.
ReplyDeleteআমার কাজ নিয়ে এর চেয়ে ভালো এবং লাগসই কোটেশন হতে পারে না।
বাঃ, বেশ কোটখানি।
Delete"You can not do, what you can not do, whatever you can do , do that better" eita amader lab e jholano thakto... amar supervisor er quote, ek jon ex student metal plate e print kore deoale tangiye rekhechhilo...
ReplyDeleter amar moto alos jate ektu motivated hoi tar jonyo besh kota motivational quote mone kore rakhi... email er tolay jhuliye.. "You may have to fight a battle more than once to win it" Louha Manabir besh kota quote amar pochhonder...ei lekhata pore aro ekbar dekhe nilam..:Papiya
তোমার সুপারভাইসরের বলা কথাটা মনে রাখার মতো, পাপিয়া। থ্যাংক ইউ।
Deleteদারুণ কোটেশনগুলো। আমিও জমাই, তবে মনে মনে। :)
ReplyDeleteকেমন আছো গুরু? মন খারাপটা সারল?
আরে প্রিয়াঙ্কা যে। কেমন আছ? মন খারাপ সারল, আবার হল, আবার সারল। এই চলছে। এরকমই চলবে।
Deletetin patar paper likhtei har kali hoye jachchhe-ta abar boi. Ishhh voyonkor byapar
ReplyDeleteআহা, এ তো গপ্প লেখার কথা হচ্ছে, পেপার লেখার সঙ্গে তার তুলনা হয় না। দুটোর দুরকম কষ্ট, হীরক।
DeleteAmader office e ekta quotes er desk calendar moto diyechhe! One for each day!
ReplyDeleteবাঃ, এটা তো বেশ ভালো ব্যাপার, রুণা।
Deleteপাণ্ডাকর্তৃক টুকরি ছিনতাই... hahaha... dakhineshwar er bornonar kono tulona hobena ... quotation collect er sokh ta chole geche... amar ekhon mojar mojar quote gulo besh bhalo lage...
ReplyDeleteতোরও ও শখ ছিল জেনে আনন্দিত হলাম, ঊর্মি। এটার বোধহয় বয়সের সঙ্গে একটা যোগ আছে।
Delete