সময়ের গতি



উৎস গুগল ইমেজেস

অক্টোবর এসে গেল। আমি ব্যাপারটাকে অগ্রাহ্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। তারিখ লিখতে গিয়ে মাসের জায়গায় ক্রমাগতনয়বসিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু গোটা একটা সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর লজ্জার মাথা খেয়ে সে ভুল ঠিক করতেই হল। দুহাজার পনেরো ফুরোতে চলল। আর কয়েকদিন পরেই সেই ভয়ানক কাজটা করতে হবে। আগের বছরের শেষে নেওয়া রেসলিউশনগুলো মিলিয়ে দেখতে হবে, সেগুলো আমি রক্ষা করতে পেরেছি কি না। ব্যর্থ হলে কতখানি হয়েছি। সে কথা ভাবলেই বিশ্রী লাগছে।

আর একটা সন্দেহও হচ্ছে। এই বছরটা কি অন্যায় রকম তাড়াতাড়ি কাটল? দুহাজার চোদ্দটাও তাড়াতাড়ি কেটেছিল, কিন্তু দুহাজার পনেরোটা জাস্ট . . . ইন ফ্যাক্ট, এখন ভেবে দেখছি, দুহাজার তেরোটা দুহাজার চোদ্দর থেকেও ধীরে কেটেছিল। তার মানে দুহাজার ষোলোটা দুহাজার পনেরোর থেকেও দ্রুত কাটবে। আর দুহাজার সতেরোটাকে তো তার মানে চোখেই দেখতে পাব না! দুহাজার আঠেরোর কথা ভাবতে গিয়ে আমার মাথা ভোঁভোঁ করতে লাগল। আমি ভাবনায় ক্ষান্ত দিয়ে সংগীত বাংলায় কী হচ্ছে সেই দেখতে গেলাম।

কিন্তু ভাবনাটা মাথায় গেঁথে রইল। দোষটা কি সময়ের না আমার? আমি যত বুড়ো হচ্ছি তত কি সময় জোরে দৌড়চ্ছে? সেও কি সম্ভব?  

অ্যাকচুয়ালি সম্ভব। তিনশো পঁয়ষট্টি দিন নিয়ে ভাবতে বসলে ধাঁধা লাগে, কিন্তু সময়ের ব্যাপ্তিটা কমিয়ে নিলে ব্যাপারটা আর অত অদ্ভুত ঠেকে না। যেমন ধরুন চল্লিশ মিনিট। এই মুহূর্তে চল্লিশ মিনিটে কী হয়? জল গরম হয় না। একটা পেপারের লিটারেচর রিভিউ ঠিক করে পড়ে ওঠা যায় না, অবান্তরের আগে থেকে স্থির করে রাখা বিষয়ে দুশো চল্লিশটা শব্দ টাইপ করে ওঠা যায় না, মন ভরে ইউটিউব পর্যন্ত দেখে ওঠা যায় না, মনে হয় আরও কুড়ি মিনিট (এবং তার পর আরও দেড় ঘণ্টা) বেড়ালছানার ভিডিও না দেখলে আরামটা পুরো হবে না।

এবার স্কুলের চল্লিশ মিনিটের সঙ্গে একে তুলনা করুন। একটা গোটা পিরিয়ড। দিদিভাই এসে, আগের দিনের পড়া ধরে, কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে, নতুন পড়া পড়িয়ে, হোমওয়ার্ক দিয়ে দিলেন। বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার পায়ে ব্যথা হয়ে গেল, হাত কান থেকে নামতে নামতে প্রায় চিবুকে চলে এল, তবু ঘণ্টা পড়ার নাম নেই।

আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের চল্লিশ মিনিট আর আজকের চল্লিশ মিনিটকে যদি কেউ সমান বলে চালাতে চায় তবে তার থেকে বড় চিটিংবাজ ভূভারতে নেই। সেদিনের চল্লিশ মিনিটটা আজকের চল্লিশ মিনিটের থেকে অন্তত চল্লিশ গুণ বড়।

কেউ বলতে পারেন তা তো হবেই। এখনকার চল্লিশ মিনিটের হিসেব হচ্ছে ইউটিউব দেখা দিয়ে আর তখনকার চল্লিশ মিনিটের হিসেব হচ্ছে কান ধরে বেঞ্চের অপর দাঁড়িয়ে থাকা দিয়ে। একটা চরম আরাম, অন্যটা চূড়ান্ত অপমান। সেই অপমানের চল্লিশ মিনিট তো দীর্ঘ মনে হবেই।মনে নেই সেই যে আইনস্টাইন বলে গেছেন”, তিনি ফস করে আস্তিন থেকে সেই তত্ত্বটি বার করবেন, যা দিয়ে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করা যায়, নোলানের সব সিনেমার মানে বোঝা যায়। রিলেটিভিটি।

কিন্তু আপনি সেটা মানতে রাজি হলে আপনার দোষ। কারণ আপনি জানেন এ ক্ষেত্রে রিলেটিভিটির কোনও দোহাই নেই। এখনকার ইউটিউব দেখার সময়ও যত জোরে ছুটছে, অর্চিষ্মানের সঙ্গে অটো চেপে শহরে চষে ফেলার সন্ধ্যেগুলোও যত দ্রুত কাটছে, ফাঁকিবাজির বছরগুলো, ফাঁকি দিচ্ছি সে জেনে  ঘাড়ের কাছে শক্ত গিঁট পাকিয়ে বসে থাকা বছরগুলোও ততখানিই হু হু করে কাটছে। এর সঙ্গে সুখদুঃখ ভালো লাগা খারাপ লাগার কোনও সম্পর্ক নেই। সত্যিটা হচ্ছে আগে সময় আস্তে কাটত, এখন দ্রুত কাটে। আগে সন্ধ্যেয় পড়তে বসার সময়টা অনন্ত মনে হত, এখন বই খুলে বসব বসব ভাবতে ভাবতেই দিন কাবার।

এক কথায় আমরা শিকার হচ্ছি ফরওয়ার্ড টেলিস্কোপিং-এর। টেলিস্কোপের মধ্য দিয়ে জিনিস দেখার মত করে সময়কে দেখার নামই হচ্ছে টেলিস্কোপিং। The term telescoping comes from the idea that time seems to shrink toward the present in the way that the distance to objects seems to shrink when they are viewed through a telescope. সাধারণত দূরবীন দিয়ে দূরের জিনিস কাছে দেখা যায়, কিন্তু সময়ের ক্ষেত্রে কখনও সখনও এর উল্টোটাও ঘটে। অর্থাৎ দূরের সময় যেমন কাছের মনে হতে পারে তেমনই কাছের সময়ও দূরের মনে হতে পারে। তবে দ্বিতীয় অর্থাৎ ব্যাকওয়ার্ড টেলিস্কোপিং-এর উদাহরণ বিরল। অনেক সময় এই সেদিনের কোনও ঘটনাকেও অনেক সময় দূরের মনে হয়, প্রথম প্রেমিকের মুখ শেষবার দেখার সনতারিখ দিব্যি মনে করতে পারলেও তার মুখটা ঝাপসা হয়ে যায়।

তবে এ জিনিস বিরল। আকছার যেটা ঘটে সেটা উল্টো ঘটনাটা, ফরওয়ার্ড টেলিস্কোপিং। অনেক দূরের ঘটনা মনে হয় এই সেদিনের। ক্যালেন্ডার বলছে আড়াই বছর কেটে গেছে অথচ আমার মগজ বলছে এই তো গত সপ্তাহের ব্যাপার। গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়ায় প্যান্ডেলের রঙিন কাপড় উড়ছে, আমি ভয়ানক রকম সাজগোজ করে সিংহাসনে চড়ে বসে আছি, অর্চিষ্মানের গাড়ি জি টি রোডের জ্যামে আটকে আছে, ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ফাইল হাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটাহাঁটি করতে করতে বলছেন, “আমার আরও চারটে বিয়ে আছে, হে ভগবান, কী করে হবে সে সব…”

এই রকম যে ঘটে তার কারণ সময়ের জোরে ছোটা। আমি যত বুড়ো হচ্ছি সময় তত জোরে ছুটছে। আপনি যত বুড়ো হচ্ছেন সময় তত জোরে ছুটছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফরাসী দার্শনিক পল জাঁনে যখন বুড়ো হচ্ছিলেন তখনও সময় জোরে ছুটছিল।

পল জাঁনে অবশ্য সময়ের জোরে ছোটার ব্যাপারটা চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি সেটার একটা কারণও বার করেছিলেন। সেই কারণ জগতে প্রোপোরশনালিটি থিওরি বলে খ্যাত হয়েছে। খুব সরল করে বললে এই থিওরির মূল কথা হচ্ছে আপনি যত বড় হচ্ছেন, একটা নির্দিষ্ট সময় (সেটা পাঁচ মিনিট বা এক বছর) আপনার গোটা জীবনের তুলনায় তত ছোট হয়ে যাচ্ছে। জাঁনে-র প্রায় সমসাময়িক অ্যামেরিকান দার্শনিক এবং মনস্তত্ত্ববিদ উইলিয়াম জেমস, জাঁনে-র থিওরি সহজসরল করে বলেছেন, "the apparent length of an interval at a given epoch of a man's life is proportional to the total length of the life itself. A child of 10 feels a year as 1/10 of his whole life - a man of 50 as 1/50, the whole life meanwhile apparently preserving a constant length." আপনার যখন এক বছর বয়স তখন এক বছর সময়টা আপনার গোটা জীবন, কাজেই সেটা কত দীর্ঘ মনে হবে কল্পনা করে নিতে পারেন। আপনার যখন চার বছর বয়স তখন এক বছর সময়টা আপনার গোটা জীবনের এক চতুর্থাংশ, আপনার যখন পঁয়ত্রিশ হবে হবে করছে তখন এক বছর সময়টা আপনার গোটা জীবনের পঁয়ত্রিশ ভাগের মাত্র এক ভাগ। সত্তর বছর বয়সী একজন মানুষের ক্ষেত্রে এক বছর সময় তো প্রায় চোখেই দেখা যাবে না। পলক ফেলতে না ফেলতে কেটে যাবে।

মুশকিলটা হচ্ছে আমরা এভাবে প্রতি মুহূর্ত গোটা জীবনের হিসেব নিতে নিতে বাঁচি না। আমরা প্রতিটা মুহূর্তকে পেছনের পঁয়ত্রিশটা বছরের সমষ্টি নিরিখে মাপি না, আমরা মুহূর্ত মাপি মুহূর্তের মতো করেই। কাজেই এই থিওরিতে আজকাল আর বেশি লোক বিশ্বাস করেন না, বিশ্বাসযোগ্য আরও নানান টাইম পারসেপশন থিওরি বাজারে এসে গেছে।

এদের মধ্যে এক জাতের থিওরি শারীরবৃত্তীয় যেখানে মানুষের শরীরকে ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ছোট মানুষদের ঘড়ি নতুন, স্প্রিংটিং গুলো সব টানটান, উৎসাহও বেশি। কাজেই সে ঘড়ি সময়ের থেকেও জোরে ছোটে। যদি ধরে নিই যে সময়ের থেকে পঁচিশ শতাংশ বেশি জোরে ছোটে তাহলে চব্বিশ ঘণ্টার একটা দিনে আসলে সে তিরিশঘণ্টা সময় পার করে ফেলে। অর্থাৎ তার কাছে এক একটা দিন প্রায় তিরিশঘণ্টার। উল্টোদিকে বুড়ো জং ধরা ঘড়ি ক্লান্তিতে অবসাদে স্লো হয়ে যায়। যদি ধরি যে সে সময়ের থেকে পঁচিশ শতাংশ ধীরে চলে তাহলে চব্বিশ ঘণ্টার এক দিনে সে পার করেছে মোটে আঠেরো ঘণ্টা। তার কাছে দিন তো ছোট মনে হবেই।

টাইম পারসেপশনের বায়োলজিক্যাল থিওরিওয়ালাদের মধ্যে একজন ছিলেন অ্যামেরিকান শারীরবিদ হাডসন হগল্যান্ড। উনিশশো তিরিশের শুরুর দিকে এঁর স্ত্রীর একবার ধুম জ্বর এসেছিল। হগল্যান্ড যথাসাধ্য স্ত্রীর সেবাযত্ন করছিলেন, পাশে বসে মাথায় হাত বুলোচ্ছিলেন। কিন্তু কাঁহাতক আর একটানা রোগীর বিছানার পাশে বসে থাকা যায়। হগল্যান্ড মাঝে মাঝে উঠে এদিকসেদিক যাচ্ছিলেন আবার চট করে ফিরেও আসছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী অনুযোগ করতে লাগলেন হগল্যান্ড নাকি তাঁকে ছেড়ে বাড়াবাড়ি রকম বেশিক্ষণের জন্য হাওয়া হয়ে যাচ্ছেন।

সাধারণ মানুষ হলে হয়তো ঘটনাটাকে অসুস্থ মানুষের ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দিত, কিন্তু হাডসন হগল্যান্ড কি না বিজ্ঞানী আর টাইম পারসেপশনেরবডি টেম্পারেচর থিওরির একজন হর্তাকর্তা বলে খ্যাত হওয়া কি না তাঁরই কপালে নাচছে, তাই তিনি একটা ঘড়ি নিয়ে এসে বসলেন। স্ত্রীকে বললেন সেকেন্ড গুনতে। যা ভেবেছিলেন তাই। স্ত্রী যতক্ষণে ষাট গুনে ফেলেছেন, হগল্যান্ডের ঘড়িতে ততক্ষণে কেটেছে মোটে সাঁইত্রিশ সেকেন্ড। হগল্যান্ড পরীক্ষা চালিয়ে যেতে লাগলেন। স্ত্রী গুনতে লাগলেন, স্ত্রীর জ্বর বাড়তে লাগল। জ্বর যত বাড়ল, গুনতির গতিও তত বাড়ল। অর্থাৎ মিনিটের দৈর্ঘ্য ক্রমশ কমতে লাগল। হগল্যান্ড দাবি করলেন, শরীরের তাপমাত্রা যত বেশি হয়, সময় তত দ্রুত ছুটছে বলে বোধ হয়। অর্থাৎ ঘড়ি যতক্ষণে ষাট সেকেন্ড অতিক্রম করে, ততক্ষণে মনের ঘড়ি ষাটের বেশি সেকেন্ড অতিক্রম করে এবং ফলত একটা দিন বা একটা গোটা বছরকেও স্বাভাবিকের থেকে দীর্ঘ বোধ হয়। শৈশবে আমাদের রক্ত গরম থাকে তাই সময়কে আমরা দীর্ঘ বলে ভুল করি। যত বয়স বাড়ে আমরা ক্রমে ঠাণ্ডা মেরে যাই আর আমাদের দিনও ছোট হতে থাকে।

হগল্যান্ড এবার স্ত্রীকে রেহাই দিয়ে ছাত্রদের ওপর চড়াও হলেন। তাদের মাথায় তপ্ত হেলমেট চাপিয়ে, ঠাণ্ডা জলে চুবিয়ে নিরীক্ষা চলতে লাগল। হগল্যান্ড ছাড়াও আরও অনেক বিজ্ঞানী পরের কয়েক দশক ধরে শরীরের তাপমাত্রা আর সময়ের গতি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে ছিলেন। হগল্যান্ডের স্ত্রী আর ছাত্রদের বদলে তাঁদের নিরীক্ষার শিকার হয়েছিল শত শত ইঁদুর, গিনিপিগ এবং মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ।

টাইম পারসেপশন নিয়ে কাজ চলছে এখনও। হিউস্টনের ল্যাবরেটরিতে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন নিউরোসায়েন্টিস্ট ডেভিড ইগলম্যান ও তাঁর দলবল, ব্রেনের ভেতরকার ঘড়িটার সত্যিটা ধরবেন বলে। কিন্তু ঘড়ি কি শুধু একটা? ইগলম্যান বলছেন, মোটেই না। ব্রেনটাকে প্রায় একটা ঘড়ির মিউজিয়াম ধরে নেওয়া যেতে পারে। খাঁজে খাঁজে বসানো একেকটা ঘড়ি, একেকভাবে সময় রাখছে। কেউ দিনরাতের নিরিখে, কেউ শরীরের পেশির নড়াচড়ার নিরিখে। দুহাজার নয় সালে প্রকাশিতব্রেন টাইমনামের পেপারে দুটি চমৎকার অনুচ্ছেদে ব্রেনের ঘড়িদের গুরুদায়িত্বের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন ইগলম্যান।

At some point, the Mongol military leader Kublai Khan (1215–94) realized that his empire had grown so vast that he would never be able to see what it contained. To remedy this, he commissioned emissaries to travel to the empire's distant reaches and convey back news of what he owned. Since his messengers returned with information from different distances and traveled at different rates (depending on weather, conflicts, and their fitness), the messages arrived at different times. Although no historians have addressed this issue, I imagine that the Great Khan was constantly forced to solve the same problem a human brain has to solve: what events in the empire occurred in which order?

Your brain, after all, is encased in darkness and silence in the vault of the skull. Its only contact with the outside world is via the electrical signals exiting and entering along the super-highways of nerve bundles. Because different types of sensory information (hearing, seeing, touch, and so on) are processed at different speeds by different neural architectures, your brain faces an enormous challenge: what is the best story that can be constructed about the outside world?

কিন্তু এত সব থিওরির মধ্যে আমার নিজের সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে যে থিওরিটা সেটা নতুন কিছু নয়। পল জাঁনের আনুপাতিক তত্ত্বের কথা সহজ করে বলেছিলেন যে সাহেব মনস্তত্ত্ববিদ উইলিয়াম হেনরি, তিনি জাঁনের প্রায় সমসাময়িক সময়েই বলেছিলেন পারসেপচুয়্যাল থিওরির কথা। এতে বলে সময় আমাদের কাছে কত দীর্ঘ বা কত হ্রস্ব প্রতিভাত হবে সেটা নির্ভর করে সেই সময়ে আমরা কতখানি তথ্যের মুখোমুখি হচ্ছি তার ওপর। তথ্য বলতে এখানে খবর বোঝানো হচ্ছে না, অভিজ্ঞতার কথা বলা হচ্ছে। ছোটদের কাছে সময় লম্বা বলে মনে হয় কারণ তারা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্যের মুখোমুখি হয়। হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা, প্রথম কানমলা খাওয়ার অনুভূতি, প্রথম বন্ধুর প্রতি অনুরাগ বা ঈর্ষার বোধ - সবই টাটকা, আনকোরা। সে সব তথ্যকে জায়গা দেওয়ার জন্য সময় নিজেকে টানতে টানতে বড় করতে থাকে। বা অন্যভাবে বললে এই প্রতিটি নতুন অনুভূতিকে বুঝতে তাকে থামতে হয়।  সে জায়গায় আমাদের কথা ভাবুন। জীবনে যা শেখার, যা জানার ছিল সব জানা হয়ে গেছে, নতুন বলতে খালি সকালবিকেল স্টার আনন্দের ব্রেকিং নিউজ। দুদিন শুনলে তারও প্যাটার্ন মুখস্থ হয়ে যাবে। প্রতিটি দিনই আগের দিনের চর্বিতচর্বণ। আমরাও বোরের হদ্দ, আমাদের সময়ের বোধও তাই। সেই চর্বিতচর্বণের মধ্যে দিয়ে সে হুড়মুড়িয়ে দৌড় লাগিয়েছে, বলছে, নতুন কিছু যদি পাস তো ডেকে দেখাস, না হলে এই আমি চললাম।

এ থিওরিটা ভালো লাগার কারণ হচ্ছে এখানে সর্বশক্তিমান শুধু সময় নয়, শুধু সেই আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ছোটাবে না, চাইলে আমিও তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমি যদি এখনও প্রতিটি দিনকে নতুন ভাবে দেখি, রোজ ডিফেন্স কলোনির মোড়ে যখন অটোটা দাঁড়ায়, নির্বিকার বসে না থেকে চোখ মেলে চারদিক তাকাই,  রোজ একটা নতুন কিছু আবিষ্কার করি, একটা ছোট চারাগাছ, নিচু হয়ে শাটারের তালা খোলা মুখটা, বাবা, কী চোখা নাক ভদ্রলোকের, আর সেই দেখে আমার নিজের নাক নিয়ে ভুলে যাওয়া দুঃখটা যদি আবার নতুন করে চাগাড় দিয়ে ওঠে, তাহলেই ওই সময়টার ঘাড় ধরিয়ে কাজে লাগিয়ে নেওয়া যায়। সেটাকে বাধ্য করা যায় আস্তে ছুটতে। এ ভাবে একটা গোটা দিনের দৈর্ঘ্য অল্প অল্প করে বাড়ানো যায়, দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর, বছর থেকে গোটা জীবন। প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি মনোযোগ বাড়িয়ে, বলা যায় না, আমি হয়তো আমার আয়ুটাই বাড়িয়ে ফেলতে পারি।

*****

পল জাঁনে-র প্রোপোরশনালিটি থিওরির একটা চমৎকার দৃশ্যরূপ দিয়েছেন ডিজাইনার ম্যাক্সিমিলিয়ান কিনার। দেখতে ইচ্ছে হলে এইখানে ক্লিক করতে পারেন।





কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ 
http://www.newyorker.com/magazine/2011/04/25/the-possibilian
https://edge.org/conversation/brain-time
http://news.bbc.co.uk/2/hi/uk_news/magazine/6926500.stm
http://plato.stanford.edu/entries/time-experience/


Comments

  1. Darun laglo pore Kuntala. Sesher er link ta khub mojar

    ReplyDelete
  2. Replies
    1. তুমি যে কতদিন বাঁচবে, রাহুল। পরশু অফিস যেতে যেতে অর্চিষ্মানকে জিজ্ঞাসা করছিলাম তোমার কথা। তুমি দিল্লি কবে আসছ? আমাদের কতগুলো জরুরি সিনেমা দেখা মিস হয়ে যাচ্ছে তো।

      Delete
  3. eibar shanti, ar buro hobo na. onobodyo bishoy nirbachon. abantar shudhu prolaap e boke na :P

    ReplyDelete
  4. punoshcho: share na kore thakte parlam na

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, হীরক।

      Delete
  5. Shesher theory ar take proyog er idea dutoi bhalo.
    Amar mone hoy oi oti simple theory tai thik - je samaytuku amra enjoy korchhi, seta mone hoy khub tatatari kete gelo. Ke jeno bolechhilo na - premikar sathe 2ghonta o 2 min mone hoy..etc. Ekhon proshno uthbe tahole borobelay ki kore keno eto hurmur kore time kete jay? Amra to enjoy korchhi na. Amar mone hoy - na, amra actually khub enjoy korchhi. Ofc er chap, deshe bidesher khobore bishad, ei sab e achhhe, kintu bhitore bhitore jar joto boyes barchhe se toto jeeban namak recipe te moje jachchhe, mangsho ranna r moto, rondhre rondhre sab masla dhuke jachche olpo beshi aanch a. Er ekmatra byatikrom genuine depression hole, 40 bochhorer seta eleo tokhon mone hobe din katte chaichhe na. Ei ar ki.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটা হতে পারে, শিবেন্দু। হয়তো আমরা এই দিনগুলো ভীষণ এনজয় করছি, কিন্তু অকৃতজ্ঞ বলে সেটা স্বীকার করতে চাইছি না। আপনার মন্তব্য পড়ে ভালো লাগল।

      Delete
  6. "প্রজাপতি সে তো বরষ না গণে নিমেষ গণিয়া বাঁচে,
    সময় তাহার যথেষ্ট তাই আছে।" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    অবশ্য সুকুমার রায়ের হ য ব র ল এর বুদ্ধি আরো ভালো; চল্লিশ হলেই বয়স উল্টে দাও।
    _ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাহ, কী চমৎকার লাইনখানা। ধন্যবাদ গৌতম। চল্লিশ হলে বয়স উল্টে দেওয়ার খেলাটা আমি কবে থেকে শেখার চেষ্টা করছি, কিছুতেই শিখে উঠতে পারছি না, এদিকে চল্লিশ ঘনিয়ে আসছে।

      Delete
  7. Kuntala-debi, apni surely you are joking, Mr. Feynman. porechen ? Sekhane Hogland er experiment ta niye Feynman er kichu interesting experiment ache.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, তাই বুঝি ঘনাদা? এই বইটা অনেকদিন আগে খাপছাড়া ভাবে পড়েছিলাম। হাতের কাছেই কোথাও আছে নির্ঘাত। বার করে আরেকবার পড়ার সময় হয়েছে মনে হচ্ছে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  8. Daruuuun lekhata!! Ar sesher linktar kono tulona nei. Tobe linkta dekhe ektu bhoy bhoy-o kore :(
    Ho Jo Bo Ro Lo-r sei buror jayga satyikarer prithibite nei!

    ReplyDelete
    Replies
    1. লিংকটা দেখে আমারও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল সায়ন। আপনার লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete

Post a Comment