সোশ্যাল নেটওয়ার্ক


কেমন আছেন? শরীর মন সব ঠিক আছে তো? আমার তো খারাপ থাকার কোনো কারণ নেই, থাকছিও না। মা রাঁধছেন বাড়ছেন, বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়াচ্ছেন, রাতে শোওয়ার আগে নারকেল তেল গরম করে মাথায় মালিশ করে দিচ্ছেন---আমি আধবোজা চোখে পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করছি। মাঝে একবারই একটু গোলযোগের উপক্রম ঘটেছিলো যখন স্নান থেকে বেরিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার ল্যাপটপের ওপরে মা কপালের টিপ সেঁটে রেখেছেন। আচ্ছা করে বকে দিয়েছি। তাতে কাজ দিয়েছে মনে হচ্ছে, এখন আর রাখছেন না।

যাই হোক, এসব ঘরগেরস্থালির তুচ্ছ কথা থাক। বরং একটা অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক। বেজায় কিন্তু কিন্তু ঠেকছে, তাও বলছি আরকি। সাফাই গেয়ে রাখছি আগেই, মৃত্যু ব্যাপারটা ছেলেখেলার নয় আমি জানি, তাই সেটা নিয়ে লঘুচালে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু ঘটনাটা মাথা থেকে তাড়াতে পারছিনা কিছুতেই।

অতি সম্প্রতি জেফ নামের এক ভদ্রলোক জীবনের যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। জেফ বাই-পোলার-ডিসঅর্ডারের রোগী ছিলেন। এছাড়াও প্রবল নিঃসঙ্গতা ছিলো, হতাশা ছিলো। আমি কল্পনাও করতে পারিনা কত কষ্ট হলে লোকে নিজেই নিজেকে মেরে ফেলতে পারে। যতই নাটুকে শুনতে লাগুক না কেন, পৃথিবীটা তো আসলে সুন্দর। কত যন্ত্রণা হলে সে সমস্ত সৌন্দর্য ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায়, আমি জানিনা।

কিন্তু বাকিদের থেকে জেফের মরে যাওয়ার গল্পটা একটু আলাদা, কারণ জেফ তাঁর আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঘোষণা করে গেছেন। তাঁর tumbler অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁর কথাই তুলে দিচ্ছি,  

Don’t worry. This isn’t a suicide note. I left a proper note at the scene of my death. And I’ll spare you that outpouring of sadness and grief here.
I just wanted to say thanks to my friends who may be reading this. I wish I could have done so intimately, one-on-one or whatever, but you do that kind of thing and people get suspicious. So thanks to my friends who put up with me and tried to help. To those who gave up on me: I don’t blame you. I only blame myself.

আমি জেফের যন্ত্রণা কল্পনা করতে পারছিনা, কিন্তু তাঁদের অবস্থাও আমার কল্পনার বাইরে যারা জেফকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ফলো করতেন। যারা তাঁর আত্মীয়, বন্ধু, পরিজন, কিংবা জাস্ট অনলাইন ফ্রেন্ড। যারা মেসেজটা পড়ার পর সারাদিন অফিস কাছারি স্কুল কলেজ করেছেন, লাঞ্চ খেয়েছেন, মিটিং-এ বসেছেন, এবং ক্রমাগত ভেবে গেছেন তাঁদের চেনা একজন লোক একা একা মরে যাচ্ছেন অথচ তাঁরা কিচ্ছু করতে পারছেন না।

আমি তাঁদের হিংসে করছিনা একটুও।

আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আগাম ঘোষণা করে মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। অস্বীকার করবোনা, খবরটা পড়ে প্রথম অনুভূতি যেটা হয়েছিল তার মধ্যে সমবেদনার ভাগটা কমই ছিলো, কিন্তু তারপর মনে পড়ল, কে কখন কেন কী করে তার ব্যাখ্যা কেবলমাত্র সে নিজেই দিতে পারে। কিংবা হয়তো সেও পারে না। ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়াই ভুল।

আর এটা হওয়াও কি সম্ভব যে আত্মহত্যা ব্যাপারটার মধ্যেই একটা ঘোষণার ছায়া লুকিয়ে থাকে? সব অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মরে গিয়ে প্রতিবাদ রেখে যাওয়া? যাদের প্রচন্ড রাগ, তারা মেরে মরে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কিন্ডারগার্টেন ক্লাসে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে তারপর নিজের মাথায় শেষ গুলিটা পুঁতে দেয়। বাকিরা বন্ধ দরজার ভেতর নিজের নিষ্প্রাণ দেহ ঝুলিয়ে রেখে দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়ে যায়।

তাহলে আমার পক্ষে জেফের tumbler-এ আত্মহত্যার ঘোষণাটা ব্যাখ্যা করা সহজ হয়। যারা ১৪০ কিংবা তার সামান্য বেশি কিছু শব্দে তাঁর সাথে সকালসন্ধ্যে ওপর ওপর হাই হ্যালো করেছেন, গভীরে গভীরে তাঁর অসুখ কতদূর চারিয়েছে তার বিন্দুমাত্র খবর না রেখেই, তাঁদের জেফ শেষমেষ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন যে তিনি ভালো নেই। মেসেজটা পড়ে তাঁরা সারাদিন যে মনঃকষ্টটা ভোগ করেছেন, সেটাই হয়তো তাঁদের শাস্তি। জেফকে সাহায্য করতে না পারার।

বলাই বাহুল্য, জেফের শেষ পোস্টটায় কমেন্টের মেলা বসে গেছে। এতদিনে যার লেখায় টেনেটুনে চার পাঁচটা কমেন্ট পড়তোনা, শেষ চেক করা পর্যন্ত সেখানে এখন একানব্বইটা কমেন্টস। অপচয় আর কাকে বলে।

Comments

  1. সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঘোষণা করে আত্মহত্যা করা!!! সত্যি ক্ষমতার প্রয়োজন। ওঁর আত্মবিশ্বাস কে salute জানালাম... আমার কিন্তু ওঁকে একটিবারের জন্যেও কমজোরি মনে হচ্ছে না। শুনলে হয়তো অবাক হবে আমি ওঁকে সমর্থন-ও করতে পারছি...

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুব সাধারণ একটা লেখা, বিশেষ জুতের নয়... দেখতে পারো:
      http://kothatobolarjonyei.blogspot.in/2011/08/blog-post_30.html

      Delete
    2. সংহিতা, লেখাটা ভালো। লেখাটার নিচের কমেন্টগুলোও ইন্টারেস্টিং। আমার ধারণা, আত্মহত্যা ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে প্রবল নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়। ডিভোর্স এরকম আরেকটা বিষয় যেটা খুব গভীরে আঘাত করে দেখেছি। তার ফলে যেটা হয়, বিষয়গুলো নিয়ে সকলেরই খুব জোরালো মতামত থাকে, আর সাইড নেওয়ানেওয়ির ব্যাপার এসে যায়।

      তোমার মতামত সম্পর্কে বলি, আমি সমর্থন হয়তো করছি না। কিন্তু সেটার কারণ আমার চরিত্র, যার সাথে আত্মহত্যা ব্যাপারটা জাস্ট যায় না। জেফের যা মনে হয়েছে, উনি সেটা করেছেন। সেটা দুঃখের হয়েছে, এটুকুই বলতে পারি।

      Delete
  2. আমিও কমজোরি ভাবছিনা একটুও| আর কষ্টও হচ্ছেনা| বরং একটা অদ্ভুত শ্রদ্ধা জাগছে|

    ReplyDelete
    Replies
    1. অভিষেক, ইন্টারেস্টিং। আমার সেরকম কিছু মনে হয়নি। তবে সেটা বোধহয় চরিত্রের ভেদে।

      Delete
  3. Bhoyaboho. Ar kichui na. Bhadrolok definitely komjori, karon komjori na hole keu suicide kore na. Ami suicide jinish ta ke konodin i support kori na, ajo korchi na. Ami mone kori manush jokhon eka thakte thakte depression er sesh limit e pouche jaye tokhoni erokom kore. Tai kharap lage je ekta manush ke jibito thakte dite keu ekjon o sahajyo korlo na? Etai bhoyabaho.

    ReplyDelete
    Replies
    1. রিয়া, কী জানি, হয়তো এদের সাহায্য করাও মুশকিল। আমি প্রথমে খুব ভাবছিলাম, টুইটারে একগাদা বন্ধু না পাতিয়ে, সশরীরী বন্ধু থাকলে কাজে দিত, যারা ডিপ্রেশন হলে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। তারপর মনে পড়লো, ভরা সংসারের মধ্যে থেকে ডিপ্রেশনে ভুগে গলায় দড়ি দিতে দেখেছি। ২২ বছর বয়সে প্রেমে দাগা খেয়ে ফ্যান থেকে ঝুলতে দেখেছি। আমার মাথায় ঢোকেনি। কিন্তু তাঁদের নিশ্চয় বেঁচে থাকাই অর্থহীন মনে হয়েছে।

      Delete
    2. Setai... manusher je kotha theke kii hoye jaye onyo der pokkhe bojha hoyto sob somoy sombhob hoy na. Hoyto seriousness ta bujhle tara sahajyo korto. Asholey ki jano, suicide korar somoy manusher ekta temporary insanity eshe jaye.
      Kauke judge kora uchit na, ke ki abasthay ki kore amra kichui bolte parina, unless we are in their shoes. Tobu mone hoy, beche thakar kono reason i ki chhilo na ar??

      Delete
  4. post tar arambho ta dibbi chilo......maa er agomon, bhalo ranna, khawa dawa aar jatno. ei shob "vicariously" enjoy korchi hatat kotha theke ei suicide er bhoyaboho ghotona.
    na!! er cheye tomar ghar gerosther tuccho goppoy bhalo!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে শম্পা, আমারও তাই মত। কিন্তু কী করবো বলো, ঘটনাটা মাথা থেকে বেরচ্ছিলই না। নেক্সট পোস্টটা আবার ব্যাক টু অবান্তরপ্রলাপ। প্রমিস।

      Delete
  5. ইয়ে, মানে, আমার তো ভদ্রলোককে কমজোরি মনে হচ্ছে না, খারাপ কিছু করেছে বলেও মনে হলো না, তবে ওই লেখাটায় অনেকগুলো 'লাইক' পড়েছে দেখলাম... মানে বুঝলাম না...
    শ্রদ্ধা করতে পারছিনা, interesting মনে হয়েছে বলতে পারি... সবারই তো ইচ্ছে করে তার কথা, তার মনের কথা বেশি লোকে জানুক, আলোচনা করুক... কিন্তু সঙ্গে এই ইচ্ছেটাও থাকে যে, সেই গল্পগুলো নিজের কাছেও পৌঁছোক... এক্ষেত্রে সেটা হলো না বলে জেফের প্রতি একটু করুণাই হচ্ছে...

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও বুঝিনি। কমেন্টের পর কমেন্ট জুড়ে, "হায় হায় জেফ, একি করলেন, আমাকে ফোন করলেন না কেন?"...

      Delete
  6. খুব, খুব দুঃখের ঘটনা| তবে আমিও কিন্তু কখনই আত্মহত্যাকে সমর্থন করতে পারিনা| আমার এক ব্লগার বন্ধু গতবছর এই কান্ড করেছে- সে অবশ্য এরকম এনাউন্স করে করেনি, কিন্তু তাও, আমরা তার বন্ধুরা আঁচ পেয়েছিলাম যে এরকম কিছু ঘটতে পারে| আমরা সাহায্য করার চেষ্টাও করেছিলাম - মানে আমি পার্সোনালি না - কিন্তু আমার অন্য বন্ধুরা| কিন্তু ও যেন সাহায্য নিতে চায়নি - ধরেই নিয়েছিল এটা ছাড়া ওর আর কোনো গতি নেই, অন্য রাস্তা থাকতেই পারেনা| জেফের পরিচিতদের জন্য আমার সহানুভূতি রইলো|

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, কী জানি, সাহায্য করা হয়তো যায়না। একই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে কেউ কেউ দাঁত চেপে লড়ে যায়, কেউ কেউ আত্মহত্যা করে। সবই নিয়তি হয়তো শেষপর্যন্ত।

      Delete

Post a Comment