না চাহিলে যারে পাওয়া যায়



সেদিন চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলতে খুলতেই কীরকম একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কেমন একটা খালি খালি ভাব। কী যেন নেই কী যেন নেই।  ডান কবজির একটা মসৃণ মোচড়ে তালাটা খুলে ঘরে পা দিয়েই মনে হল, “ওহ ব্যাপারটা এত সোজা? তাহলে রোজ এত ধস্তাধস্তি লাগে কেন?”

লাগে কারণ রোজ আমার ডানকাঁধে একটা ব্যাগ, বাঁ কাঁধে একটা সাত পাউন্ডের ল্যাপটপ ব্যাগ, বাঁ হাত থেকে ঝুলন্ত পলিথিনের প্যাকেটে হয় দুধ, নয় পাউরুটি, নয় কোক জিরোর বোতল আর ডান বগলে একটা কাগজ ঠাসা ফাটোফাটো ফোল্ডার থাকে। সেই ফোল্ডার যথাস্থানে রেখে, কনুই দিয়ে খসে পড়া ব্যাগ ক্রমাগত পেছনদিকে ঠেলতে ঠেলতে, বিশ্বসংসারের গুষ্টির তুষ্টি করতে করতে আমি ঘটরঘটর করে তালার ভেতর চাবি ঘোরাতে থাকি। বার সাতেক লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পর আট বারের বার অবশেষে তালা খোলে। প্রত্যেকদিনের ব্যর্থপ্রয়াসের সাক্ষ্য হিসেবে চকচকে তালার গায়ে অজস্র আঁচড়ের দাগ জমেছে। বাড়ি ছাড়ার সময় অর্ধেক ডিপোজিট আমার ওখানে বেরিয়ে যাবে নির্ঘাত।

সেদিন ব্যাপারটা অত সহজে মিটে যাওয়ায় সন্দেহ হল। অল্পবয়সি পাঠকরা চোখ ঘোরাবেন জানি, এতে সন্দেহের কী আছে? আছে আছে। একটা বয়সের পর বিনা ঝঞ্ঝাটে কিছু হওয়ার মানে অতি পরিষ্কার। হয় ব্যাপারটা হয়নি, নয় কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।

অফ কোর্স। ফোল্ডারটা বগলে নেই।

বয়স হওয়ার আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে কিছুতেই না ঘাবড়ানো। চোখের চালশে যত বাড়ে, মেঘভর্তি আকাশে রূপোলী রেখা খুঁজে বার করার প্রতিভাও পাল্লা দিয়ে তত বাড়ে। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে হাতের বাকি বোঝা নামিয়ে জুতো খুলতে লাগলাম। হতাশ ভাবে মনে করার চেষ্টা করলাম কোথায় ফেলেছি ফোল্ডারটা। ট্রেনে? নাকি দোকানে চেক আউট করার সময় কাউন্টারে নামিয়ে রেখেছিলাম? মনে পড়ল না। যাকগে মরুকগে। ভারি তো একগাদা অং বং চং পেপার। ল্যাপটপটাও তো যেতে পারত? সব সেভ করা আছে। আবার প্রিন্ট আউট নিয়ে নেবখ’ন। আরও কয়েকটা রেনফরেস্ট ধ্বংস হবে এই যা। আর ফোল্ডারটা। সেমিনার থেকে বিনাপয়সায় জোগাড় করে এনেছিলাম বেশ। সেটা গেল।

অনেক চেষ্টা করেও রেনফরেস্টের জন্য অপরাধবোধ জন্মাতে পারলাম না আমি মনের ভেতর। বরং ফোল্ডারটার জন্য একটু একটু মনকেমন করতে লাগল।

যাই হোক। মনকেমন ঝেড়ে ফেলে অবান্তরে আপনাদের সাথে গল্পটল্প করে, মায়ের হাতের রান্নাটান্না খেয়ে, ঘুমিয়েটুমিয়ে ফ্রেশ হয়ে পরের দিন অফিস গেলাম। ঝাড়া হাত পায়ে। একটা বোঝা কমে যেতে বেশ ভালো লাগছিল জানেন। মনে হচ্ছিল এরকম করে সব জিনিস নিজে থেকেই দুমদাম হারিয়ে গেলে তখন আর আমার কিছু করারই থাকবে না। বাধ্য হয়েই হিমালয়ে গিয়ে ধ্যানে বসতে হবে। বাঁচা যাবে।

অফিসে গিয়ে মনের আনন্দে কাজে ফাঁকি দিচ্ছি এমন সময় ফোনটা এল। অচেনা নম্বর। এমনিতে আমি অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলে তুলি না। অম্লানবদনে কেটে দিই। কিন্তু ইদানিং আমার বস নতুন ফোন কিনেছেন যার নম্বরটা আমার সেভ করা নেই। ঝুঁকি নেওয়াটা বোকামো হয়ে যাবে।

হ্যালো বলার পর ওদিকের গলাটা কানে আসা মাত্র আফসোস হল। বস নন। অনভ্যস্ত ইংরিজিতে কেউ আমার বিদঘুটে নামটা উচ্চারণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। গলায় যথাসম্ভব বিরক্তি ঢেলে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি বলছি। আমার নতুন ক্রেডিট কার্ড চাই না, ইন্টারনেটের প্ল্যান আপগ্রেডিং চাই না, আপাতত ধর্মান্তরিত হওয়ারও প্রয়োজন বোধ করছি না, এছাড়া যদি কিছু বলার থাকে ঝটপট বলে কাটুন তো মশাই। আমার বলে কিনা গলা পর্যন্ত কাজ...

বোঝা গেল ভদ্রমহিলা আমার ফোল্ডারটা ট্রেনের কামরায় খুঁজে পেয়েছেন। ফেরত দিতে চান।

কোন মানে হয়? অচেনা লোকে যদি এভাবে দায়িত্ব নিয়ে আমার হিমালয়ে যাওয়া মাটি করে, আমার কিছু করার আছে?

ভাবছিলাম একবার বলি যে ও ফোল্ডার আমার লাগবে না। আপনি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাকে খেলতে দিয়ে দেবেন। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে বললাম না। উল্টে ভয়ানক উৎসাহ দেখিয়ে বলতে হল, হ্যাঁ হ্যাঁ ভাগ্যিস। কোথায় কবে দেখা করতে চান বলুন, না না আপনার যেখানে সুবিধে...

ফোনটা রাখা মাত্র মনে হল, নম্বরটা পেল কোথায়? নির্ঘাত ফোল্ডারটা খুলে হাঁটকেছে। মনটা তেতো হয়ে গেল।

তারপর বার তিনেক দেখা করার দিন, বার পাঁচেক দেখা করার জায়গা, বার সাতেক দেখা করার সময় বদলে, শহরের অন্য প্রান্তে উজিয়ে গিয়ে কী করে ফোল্ডারটা ফেরত নিয়ে এলাম সেকথা মনে পড়লেও আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, লিখতে বলবেন না দয়া করে।

তবে ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ হয়ে ভারি ভালো লাগল। টিপিক্যাল মা মা চেহারা। চোখ বন্ধ করা হাসি হেসে ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বললেন, ওঁর মেয়েও ঠিক এরকম একটা ফোল্ডার নিয়ে অফিস যায় কিনা তাই উনি দেখেই বুঝেছেন দরকারি জিনিস। হ্যান্ডশেক করে বললেন, ভালো করে খাওয়াদাওয়া করতে। এত রোগা বলেই নাকি কিছু মনে থাকে না, যেখানে সেখানে জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলি। বাড়িতে এসে মাকে সেকথা বলতে মা গম্ভীর মুখে বললেন, “নিজের মায়ের কথা তো কানে ঢোকে না, পরের মায়ের কথায় যদি কাজ দেয় দেখ।”

ফোল্ডারটা খুলে দেখলাম একেবারে ওপরে টিকিটের প্রিন্টআউটটা রাখা আছে, আর তাতে জ্বলজ্বল করছে আমার কনট্যাক্ট ডিটেলস।

ব্যস গল্প শেষ। এখন সেই ফোল্ডারটা আমার ঠিক সামনে রাখা আছে। জিনিসটা ফেরত পেয়ে বেশ ভালো লাগছে জানেন। পেপারগুলো ফেরত পেয়েও। নতুন প্রিন্টআউট নিতে হল না, রেনফরেস্ট বেঁচে গেল।

*****

আচ্ছা এবার একটা ঘোষণা। আমি একটা ছোট্ট ছুটিতে যাচ্ছি। ওই যে টিকিটের ক্লুটা দিলাম? সামান্য ঘোরাঘুরির ব্যাপার আছে। মাকেও ট্যাঁকে করে নিয়ে যাচ্ছি। কাজেই সোমের বদলে ধীরেসুস্থে মঙ্গলবার ফিরব। বুধও হয়ে যেতে পারে বলা যায় না। এর মধ্যে অবান্তরে সাপ্তাহিকীর ডোজ যেমন পড়ে পড়বে।

আপনারা ভালো হয়ে থাকবেন। খুব করে টিভি দেখবেন আর ঘুমোবেন। দেখা হবে। টা টা।

Comments

  1. ishhh... amar bar duyek pocket-mar [thuri bag-mar] hoechhe.. protibar i or bhetorer taka gulor theke purse tar jonyo beshi koshto hoechhe.. tobe amake keu ferot die jaini.. sudhu college er I-card ta ekjon doyalu lok [besh chor chor dekhte] cycle e kore bari boye ferot diye amar mayer bigolito hashi soho 2 to rosogollao snatiye gechhe.

    kothay kothay berale, sei niye agami soptaher abantor nishchoi sorgorom thakbe.. khub anondo koro...

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ বেশ দয়ালু চোর তো? তা রসগোল্লা খাইয়ে ভালোই করেছেন কাকিমা, বেচারা রোদ্দুরে এতখানি সাইকেল চালিয়ে এসেছে।

      আরে কাজের বেড়ান। বেশি আনন্দ হওয়ার চান্স কম। তবে রাস্তায় কী কী হল, কাকে কাকে দেখে হাসি পেল, কাকে কাকে দেখে গাপিত্তি জ্বলে গেল, সেসব নিশ্চয় আরাম করে বসে বলব সোহিনী।

      Delete
  2. Oi chor-chor loktai to pocketmaar chhilo. I-card ta or kaje lagbe na bole ferot diye gechilo. Ar oke to 5 takao deya hoyechilo :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধরা না পড়লে কেউ চোর না রিয়া। দয়ালু ভদ্রলোক, যিনি আই কার্ড ফেরত দিতে এসেছেন।

      Delete
  3. আপনার ব্লগ পড়বার বদভ্যাস হয়ে গেছে বেশ কয়েকদিন হল..সত্যি, কিছু কিছু বদভ্যাস বড়ই উপাদেয়..

    আলাপ করে গেলুম..

    আগেও একবার কমেন্টটি লিখে ডিলিট করেছি, কিছু অপ্রয়োজনীয় টাইপো ছিল..এমনিতে আমি টাইপের ব্যাপারে ভীষণ অসাবধানী, কিন্তু প্রথমবারেই ইম্প্রেশন খারাপ হলে চলে, বলুন?

    আর ধ্যানে বসাকে অমন তুরুশ্চু করবেন না, ও ভারী কঠিন জিনিস.. আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি, বসলেই খানিক পরে আমার খিদে পায়, গা-কুটকুট করে আর ইউটিউব দেখতে ইচ্ছে করে..

    ReplyDelete
    Replies
    1. Sotyi dhyan e bosha khub difficult. Amar phone e facebook check korte ichhe kore, mone hoy - ei re sobai koto ki update kore fello! Ar na holey boddo ghum paye, 5 min o boshte pari na :D :D

      Delete
    2. আরে অমিত, আপনি অবান্তরকে "উপাদেয় বদভ্যেস" বলেছেন, আপনার টাইপো থাকলেও ফার্স্ট ইম্প্রেশন জম্পেশ হত। যদিও একটাও টাইপো নেই এই কমেন্টটাতে।

      ধ্যানে বসলে আমারও নানারকম বিপত্তি সৃষ্টি হয়। নাক কান চুলকোয়, পাশের অ্যাপার্টমেন্টে ঝগড়া বাধে, আরও সব ঝামেলা।

      আলাপ করে খুব ভালো লাগল অমিত। আশা করি অবান্তরের সাথে আপনার বন্ধুত্ব দীর্ঘ আর গভীর হবে।

      রিয়া, একমত একমত।

      Delete
  4. bah. besh anondo kore berao :-). kakimar oi quote ta khub chena laglo :P

    ReplyDelete
    Replies
    1. সব কাকিমাদেরই এক রা কিনা, তাই।

      Delete
  5. Bhalo kore ghure asun... pore galpo shunbo. Apnar kaj nischoi bhalobhabe hobe... beRano safol hobe. Ei je harano folder pelen eta ekta good omen. Happy journey!

    ReplyDelete
    Replies
    1. বলছেন? ভালো হলেই ভালো।

      Delete

Post a Comment