শনাক্তকরণের জন্য


কেমন আছেন সবাই? কেমন কাটল আপনাদের উইকএন্ড? আমার আর মায়ের ঝটিকাসফর নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। আমি যখন বক্তৃতা শুনতে শুনতে হাই তুলেছি, মা তখন হোটেলের দুধসাদা বিছানায় দুধসাদা কম্বল মুড়ি দিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন। একদিন বিকেলে জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম। কফি খেয়ে বেরনোর সময় কফির দোকান থেকে মা আমাকে একটা খুব পছন্দসই কফিমাগ কিনে দিলেন। আমি হাজারবার বারণ করলাম কিছুতেই শুনলেন না। বললেন, “আমাকে ওরা রিটায়ারমেন্টের সময় কত কিছু দিল, আমি তোকে কিছু দেব না এটা হয় নাকি?” আমি যখন বললাম যে এটা কোন যুক্তিই হলনা, তখন মা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বললেন, মা হওয়া ব্যাপারটাই নাকি আগাগোড়া অযৌক্তিক।




মা থাকার সুবিধেও যেমন আছে, অসুবিধেও বিস্তর। যেমন ধরুন, বাড়ি ফেরার পর আমার প্ল্যান ছিল ল্যাপটপটা নিয়ে বিছানার ওপর চিৎপাত হয়ে পড়া। স্বাভাবিক লোকে যেমন পড়ে। কিন্তু মা যথারীতি বাগড়া দিলেন। হাত পা ধুতে হল, জামাকাপড় ছাড়তে হল, এমনকি ব্যাগটা পর্যন্ত পুরো আনপ্যাক করে যেখানকার জিনিস সব সেখানে রাখতে হল। এত পরিশ্রম করে যখন অবশেষে বিছানায় গা ঠেকিয়েছি, ল্যাপটপ ছাড়াই, তখন মা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে বললেন, “যাই এইবেলা পায়েসটা রেঁধে ফেলি বরং।”

বাড়ি থেকে খবরের কাগজে মুড়ে সুগন্ধী গুড় বয়ে এনেছেন মা, মেয়েকে পায়েস রেঁধে খাওয়াবেন বলে। এই মাদার’স ডে আর ঘোরাঘুরির চক্করে সে সদিচ্ছা রূপায়ণে ক্রমাগত বাধা পড়ছে।

কাজেই আমাকে বিশ্রামের আশা ত্যাগ দিয়ে উঠে পড়তে হল। আমার জন্যই পায়েস যখন তখন মায়ের সাথে সাথে আমারও একটু হাত পা না নাড়লে ভালো দেখায় না। মা দুধ ঘন করতে বসালেন, আমি খবরের কাগজমোড়া গুড়ের চাক আর নতুন কফিমাগটা নিয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে বসলাম। ঠুকে ঠুকে গুড়ের চাক ভাঙব। সেই ভাঙা গুড় মা পায়েসে দেবেন।

কিন্তু সৎ কাজে শত বাধা। মুড়বি তো মোড় মা গুড় মুড়েছেন আনন্দবাজারের একখানা আস্ত পাতা দিয়ে, কাজেই বাধ্য হয়েই আমাকে গুড় ছেড়ে কাগজে মনোযোগ দিতে হল। দিয়ে দেখি ওরেব্বাস এ যে আমার পুরো কাগজের মধ্যে ফেভারিট পাতা! না না সম্পাদকীয় পাতা না, আপনারা দেখছি আমাকে কিছুই চেনেননি অ্যাদ্দিনে। এটা হচ্ছে ওই পাতাটা যেখানে সবাই জন্মদিন, মৃত্যুদিন, অন্নপ্রাশন, নিরুদ্দেশ, আর এফিডেভিট করে নাম বদলের ঘোষণা ছাপে। জন্মদিনের ঘোষণায় কপালজোড়া কাজলের টিপওয়ালা বাচ্চাদের ছবি দেখে, ছবির তলায় ছোদ্দিদা, ছোদ্দাদু, মাম্মাম, ভালোপিসে, কালোমেসো ইত্যাদি স্বাক্ষর দেখে, “আজ হইতে আমি নিবারণ সাঁতরা হইতে শ্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান নামে ভুবনে খ্যাত হইলাম” এইসব পড়েটড়ে আমি অবশেষে নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত ঘোষণায় এসে উপস্থিত হলাম।

ততক্ষণে মা বুঝে গেছেন আমার ভরসায় থাকলে সেদিন আর তাঁর পায়েস রাঁধা হচ্ছেনা, তাই তিনি নিজেই এসে গুড় ভাঙতে শুরু করেছেন। কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে আমি মাকে নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত ঘোষণাগুলো জোরে জোরে রিডিং পড়ে শোনাতে লাগলাম।

-“আমার কাকা, উচ্চতা ৫ ফুট, রোগা, কালো, ডান চোখ ট্যারা, অমুক দিন হইতে নিখোঁজ...” এদের নির্ঘাত শরিকি ঝগড়া ছিল মা, গায়ের ঝাল ঝেড়ে লিখে দিয়েছে।

মা উত্তর না দিয়ে গুড় ভাঙতে থাকেন।

-ওরে বাবা মা এইটা শোনো। “অমুক গ্রামের শ্রী তমুক, তোতলা, টাকমাথা, গালে কাটা দাগ...” কী সাঙ্ঘাতিক!

ব্যাপারস্যাপার দেখে আমি রীতিমত উত্তেজিত হয়ে পড়ি। সেই সঙ্গে একটা সন্দেহ মনে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে।

-আচ্ছা মা, আমি হারিয়ে গেলে তোমরা কী লিখে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে?

-আহ সোনা, সর্বক্ষণ তোমার এই বোকা বোকা রসিকতাগুলো অসহ্য।

-আরে হাইপোথেটিক্যালি বলছি তো। বলনা মা? নির্ঘাত লিখবে বেঁটে, নাকথ্যাবড়া, গালভর্তি ব্রণর দাগ, কেলেকুষ্টি...

-আহা কেলেকুষ্টি কেন, লিখব উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।

-ওই একই হল, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মানেই সবাই জানে কেলেকুষ্টি।

আমার সম্ভাব্য নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত ঘোষণার দুর্দশা কল্পনা করে আমি মুহ্যমান হয়ে বসে থাকি। সেই দুঃখেই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে আমার। কীসের দুঃখে লোকে নিরুদ্দেশে যায় সে রহস্যটা এতদিনে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

আমার অবস্থা দেখে মা আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। বলেন, শনাক্তকরণের জন্য নাকি ওইরকমই লিখতে হয়। সুডৌল চিবুক, পটলচেরা চোখ, বাঁশির মতো নাক এসব লিখে বিজ্ঞাপন দিলে আর নাকি কাউকে খুঁজে পেতে হত না কখনো। সৌন্দর্য ব্যাপারটা বিরল হতে পারে, কিন্তু ভিড়ের মাঝে আলাদা হয়ে থাকে মানুষের যত খুঁত আর খামতি। আমাদের যার যেখানটা টোলখাওয়া, বাঁকাচোরা, ছাতাপড়া---সেইসব জায়গাগুলোই নাকি আমাদের সবথেকে বড় পরিচয়। যে জায়গাগুলো মসৃণ, নিয়মিত ধুয়েমুছে পালিশ করে চকচকে করে রাখা, সেগুলো নয়।

কোনো যুক্তি আছে? তাহলে আর বিউটিপার্লারে গিয়ে একগাদা টাকা গচ্চা দিয়ে লাভ কী? দরকারের সময় যদি চকচকে ত্বক কোনো কাজেই না লাগল? আপনারাই বলুন?

এত শক্ত শক্ত কথা ভাবতে গিয়ে আমার কীরকম ঘুম এসে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখি সারাবাড়ি পায়েসের সুগন্ধে ম ম করছে। টেবিলে বসে পা দোলাতে দোলাতে বাটিভর্তি পায়েস খেতে খেতে আপনাদের কথা, বিশেষ করে যারা মায়ের হাতের পায়েস খেতে পাচ্ছেন না, তাঁদের কথা খুব মনে পড়ছিল জানেন। সত্যি বলছি। অন গড ফাদার মাদার।

Comments

  1. mayer ador unparalleled... etar songe jogoter ar kichhur kono comparison hoyna.. ei sukh tumi joto pao totoi u r blessed bole janbe. onader je keno kichhute alshemi ashena, eta kintu ekta rohosyo..

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটাই তো সোহিনী। এই অসম্ভব এনার্জি আসে কোত্থেকে জানিনা। আমি তো এর সিকিভাগ কাজ করার কথা কল্পনা করতে পারিনা। আর মায়ের আদরের কথাটা যেটা বললে সেটা নিখাদ সোনা। মাঝে মাঝে নিজেকে চিমটি কেটে দেখতে হয় সত্যি সত্যি আমাকে কেউ এত ভালোবাসে কিনা।

      Delete
  2. আমাদের বাড়ির পাশের দেওয়ালে একবার নিরুদ্দেশ সম্পর্কে খোঁজখবর চেয়ে একখানি পোস্টার সাঁটা হয়েছিল (কে বা কারা সেঁটেছিল তা আমি জানি না), তাতে যে ছবিটা ছিল সেটা অবিকল আমার মত দেখতে, কেবল একটা কান দেখা যাচ্ছিল না, সম্ভবত: ছিল না..ওই ছবি যারা লাগিয়েছিল তারা আমাকে দেখতে পেলেই যে ধরে নিয়ে যেত সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে!

    তার পর থেকেই নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা থাকলেই আমি ভীষণ মনোযোগী এবং ভীত হয়ে পড়ি, কে জানে বাবা, আমার কথা বলছে না তো?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা অমিত, এটা জম্পেশ হয়েছে। বেঁচে থাকতে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু একেবারে বাড়ির দেওয়ালে এসে নিরুদ্দেশ পোস্টার সাঁটা!

      Delete
  3. কিন্তু টেবিলে বসে কেন খাচ্ছিলি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা এটা ভালো পয়েন্ট আউট করেছ। টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম না আসলে। কিন্তু পা দোলাতে দোলাতে খাওয়ার ব্যাপারটা বোঝাতে গিয়ে টেবিল আমদানি করতে হল। টেবিল ছাড়া আর কিছুতে বসে কি পা দোলান যায়? মাথায় আসছিল না।

      Delete
  4. Amar ma-o gurguriye Emirates chepe pouche geche. Ami ar Arnab airport theke niyeo eshechi :) Byas ar jayi kothay? Ekhon amay raate daant brush korte hoche, 10ta bajlei shunte hoche, "jao Ria shuye poro, kal college, na na, office ache", sob "niyom mene" gari chalachi kina khoj hochhe, bhor pet breakfast kheye berote hochhe ar hardwood floor e ichhe kore slip korchilam dekhe baron kora hoyeche, shunini (oboshyoi) tokhon baba ke phone e bola hoyeche "Ria ekdom katha shunche na"!!! Bhabo abastha!! Tobe Arnab er ananda. Or ei 3yrs e prothom jamaishoshthi holo, luchi ar sobuj aam-sondesh diye :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহহহ কাকিমা এসে গেছেন! কী মজা কী মজা। কাকিমার সাথে খুব আনন্দ করে নাও রিয়া। অর্ণবের প্রথম জামাইষষ্ঠীতে আমার বিলেটেড অভিনন্দন রইল। হাহা, কথা শুনছে না-টা মায়েদের সিস্টেমে ঢুকে গেছে রিয়া, ওটা এই বয়সে আর সারানো শক্ত। তুমি এ'কদিন কথা শুনেই চল বরং।

      Delete
  5. আহা গুড় দিয়ে পায়েস কতদিন খাইনি| আপনাদের ওহায়োর থেকে আমার বাড়িতে এক বন্ধু ও তার স্ত্রী এসে লং উইকেন্ড কাটিয়ে গেল| বলাই বাহুল্য নেমন্তন্ন করে গেছে, আমি যেন সুযোগ সুবিধে হলেই সিনসিনাটি যাই ইত্যাদি| গেলে আপনার বাড়িতে একবার ঘুরে আসব ভাবছি - আপনি আমাদের ডাকলে যা যা করবেন বলে লোভ দেখাচ্ছেন রোজ, আর সামলানো যাচ্ছেনা|

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিশ্চয় নিশ্চয়। নেমন্তন্ন করা রইল।

      Delete
  6. ami mon diye pori patro chai patri chai...amar hevy lage...doh koli te dui tol bisishto nij bari,bhogini bibahita..mosti ta lage hotat sadhu banglar use ta dekhe..keh soh chah.....erokom aro..aro mosti lage obituary dekhte..mane bhul bujho na..amar mone hoy kemon jeno lok dekhano bapar ache...ei bapar tate..no offense btw..opinion entirely mine

    ReplyDelete

Post a Comment