নিজের বাড়ি



খুশবন্ত সিং-এর বাতলানো হ্যাপিনেসের কয়েকটা টোটকা ফরওয়ার্ডের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে আমার ইনবক্সে এসে পৌঁছেছিল। সে সময়টায় আমি কোনো কারণে আনহ্যাপি ছিলাম নিশ্চয় কারণ ডিলিট করার বদলে ফরওয়ার্ডটা খুলে পড়েছিলাম। তার আর কিছুই মনে নেই, কেবল বুদ্ধদেবের অষ্টাঙ্গমার্গের মত খুশবন্তজিও হ্যাপিনেসের আটখানা টোটকা দিয়েছিলেন মনে আছে। সে আটখানার মধ্যেও গোটা ছয়েক বেমালুম ভুলে গেছি, দুখানা কীকরে যেন মনে থেকে গেছে। ওই দুটোই বিশেষ করে মনে ধরেছিল বলে বোধহয়।

ছবি গুগল ইমেজেস থেকে

প্রথম টোটকাটা হচ্ছে, সিংজি বলছেন---আনন্দে যদি থাকতে হয় তবে কাউকে বাড়ি বয়ে এসে আড্ডা মারতে অ্যালাউ করবে না। কথাটা যে কতখানি সত্যি সেটা বলে বোঝানো মুশকিল। তবে ব্যাপারটা শুনে শেখা অসম্ভব, শিখতে হলে ঠেকেই শিখতে হবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে, অতিথি ওঠবার নাম করছেন না, আইপিএল থেকে তৃণমূল...জেনারেল নলেজের ডালে ডালে হুপহাপ লাফালাফি করে বেড়াচ্ছেন। এদিকে আপনার রোজগেরে গিন্নি প্রায় মিস হয় হয়। প্রাণঘাতী পরিস্থিতি। তার থেকে একাবোকা বাড়িতে বসে থাকা অনেক ভালো। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল। আর যদি একা থাকতে আপনার একেবারে কান্না পেয়ে যায়, দুটো লোকের মুখ দেখতে না পেলে দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তাহলে আমি যেটা করি সেটা করতে পারেন। লোকের বাড়ি গিয়ে আড্ডা মারা।

খুশবন্তের দ্বিতীয় টোটকা ছিল---নিজের বাড়ি। হোস্টেল, গ্র্যাজুয়েট ডর্ম, ভাড়া, ইজারা, সাব-ইজারা এসব সিঁড়ি কেবল ভাঙতে হয় বলে ভাঙা। মোক্ষ হচ্ছে সেই আদিঅকৃত্রিম অ্যামেরিকান ড্রিম, নিজস্ব একখানা মাথা গোঁজার ঠিকানা। সে ঠিকানায় হার্ডউডের বদলে কার্পেট পাতা থাকুক ক্ষতি নেই, বাগানভরা আম জাম কাঁঠালের বদলে রান্নাঘরের খুপচি জানালায় না হয় মানিপ্ল্যান্টই দোলাব, মাসে মাসে বাড়িভাড়ার বদলে মর্টগেজ গুনতেও রাজি আছি, যদি মালিকানার খোপে বজ্জাত বাড়িওয়ালার বদলে নিজের নামটা দেখতে পাই।

আমার নিজের বাড়ির শোক হঠাৎ উথলে উঠেছে কারণ লিজ রিনিউ করার সময় এসে গেল প্রায়। সেদিন মেলবক্সের তলা থেকে বাড়িভাড়া বাড়ানোর নোটিশও কুড়িয়ে এনেছি। অপ্রত্যাশিত কিছু নয়, তবু জানি এমাসের বাড়িভাড়ার চেকটা লিখতে গিয়ে গা করকর করবে।

ব্যাপারটা আরও খারাপ হয়েছে মা থাকার জন্য। নিজের বাড়িতে থেকে থেকে স্বভাব এমন খারাপ হয়েছে এঁদের যে কী বলব। নোটিশটা আসা থেকে মাঝে মাঝেই চলতে ফিরতে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠছেন মা, “ভাড়াবাড়ির পেছনে এতগুলো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, কবে নিজের কিছু একটা হবে...” আমি শেষে আর না থাকতে পেরে ঝাঁঝিয়ে উঠতে হেসে জিভ কেটে বললেন, “কী করব বল, রিফিউজি বাবার মেয়ে তো। নিজস্ব একখান বাসার জন্যে বিলাপটা রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে।”

এই কথাটা অবশ্য কিছু ভুল বলেননি মা। একহাতে একটা ট্রাঙ্ক আর অন্যহাতে একখানা বউ আর আটখানা ছেলেমেয়ে নিয়ে শেয়ালদা স্টেশনে এসে নামার পর থেকে আমার মাতামহ সিনেমার মতো একটা জীবন কাটিয়েছিলেন। আপনাদের অনেকের দাদুদিদার জীবনের মতোই। নতুন রোজগারের ব্যবস্থা করে, ছেলেমেয়েদের সব্বাইকে পর্যাপ্ত পড়িয়ে, নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছিলেন। আমার মামারা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে থাকতেন, কিন্তু দাদুর লক্ষ্য অর্জুনের মতো অবিচল ছিল চিরদিন। চাকরি সবাই পায়, কিন্তু সবার নিজের বাড়ি হয়না। জীবন দিয়ে সে কথা বুঝেছিলেন দাদু।

দাদুর গল্পের শেষটা আন্দাজ করার জন্য কোন প্রাইজ নেই। দাদু ভাড়াবাড়িতে মারা গেছিলেন। তার চার বছর পর ধুমধাম করে গৃহপ্রবেশ করে কসবার এখনকার বাড়িতে ঢুকেছিলেন মামারা।

যাই হোক। দাদুর গল্পটা লেজুড় হিসেবে এল, কিন্তু আজকের মূল প্রসঙ্গটা হল যে আমার বাড়িভাড়া বাড়ছে। আর সেই দুঃখে আমি আধমরা হয়ে আছি। দিনকয়েক পর এই দুঃখটা অন্য দুঃখ দিয়ে চাপা পড়ে যাবে জানি, কিন্তু যতক্ষণ না পড়ে ততক্ষণ আমি ঘ্যানঘ্যান করলে বিরক্ত হবেন না প্লিজ। 

Child's Drawing house
ছবি গুগল ইমেজেস থেকে

Comments

  1. বাড়িভাড়ার ব্যাপারটা একদম মিলে গেছে দেখছি...
    বাড়িভাড়া গুনতে আমারো এখন মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর বোলো না সংহিতা। বাবার বাড়িতে থাকার যে কী মজা, সেটা নিজের বাড়ি (ভাড়া) না হলে টের পেতাম না।

      Delete
  2. এই বছরখানেক আগে পর্যন্ত কলকেতা থেকে যাতায়াত-দূরত্বে নিজ-বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও নেহাত কুঁড়েমি করে ভাড়াবাড়িতে থাকতাম! কি বাড়াবাড়ি বলুন তো? আমার ভাড়াবাড়ির ঠিক আড়াআড়ি যে আরেকটি ভাড়াবাড়ি সেখানে একটি হোটেলের রান্নাঘর ছিল, সকাল দুপুর বিকেল হাতা-খুন্তি নাড়ানাড়ির আওয়াজে আর নানাবিধ সুখাদ্যের সৌরভে মনোবেদনায় নাড়ির ছাড়াছাড়ি অবস্থা.. বছরশেষে বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়ার সংকেত দেওয়ায় তেনার সঙ্গে আড়ি করে তাড়াতাড়ি বাপের বাড়ি ফিরে এসেছি!

    ReplyDelete
    Replies
    1. সর্বনাশ করেছেন। এর সাথে পাল্লা দেওয়া আমার কর্ম নয়, তাই আমি 'ড়' বাদ দিয়েই লিখছি। আপনার ভাড়াবাড়ির পরিণতি জেনে দুঃখিত হলাম। তবে চুঁচুড়া থেকে কলকাতা যাতায়াত করা তো এমন কিছু শক্ত ব্যাপার না। বাড়ির ভাত খেয়ে ফিজিক্সের মোষ তাড়াতে পারাই তো ভালো। ভালোই হয়েছে ভাড়াবাড়ির পাট চুকেছে।

      Delete
    2. হক কথা হক কথা!

      Delete
  3. Amader biyer por 1yr amra apartment e thaktam rent kore. Tarpor dujonei realize korlam je bari bharar pechone otogulo taka dhele konodin keu borolok hoyni. (Mane eta katha'r katha, "borolok" hoyar bishesh ichhe amader nei, jayi hok) to mot katha holo bari bhara deyar theke mortgage deya better. Ote taka ta ektu beshi lagleo, asset ta toiri hoy. To sesh mesh bari ta kinei fellam!
    Besh bhaloi lagey. Jokhon closing holo tokhon sobe dry wall gulo legeche. Tarpor proti weekend e amra dekhte jetam kotodur egolo. Seta ekta darun feeling. Plan kore kore protyekta deyal er rong choose kora, furniture choose kora, segulo assemble kora, decoration kine ana, yard e gachh pota...byapok feeling eta :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আন্দাজ করা যায় রিয়া। একদম নিজের একটা জিনিস, প্রায় হাতে করে বানান...ভালো লাগাই স্বাভাবিক।

      Delete
  4. tobe deshe (dadu'r amoler) nijer bari aar amerikay nijer bari'r madhe ekta bishaal tafat achey.

    dadu'r bari satyi nijer bari, tobe ekhaner kena bari ashole bank er. mane bank is your bariwala or bariwali.

    aar american dream boley emon shundor bhabe byapar ta ke "sell" korechey je oi gorthe sabai porbei porbei....tumio porbe jani tao upodesh dilam....amakeo anek diyechilo... bola bahulya labh hoyni... :(((

    ReplyDelete
    Replies
    1. Shampa, tofat ta odesh-edesh er noy, somoyer. Ekhono kolkatay bari korte gele bari ta bank eri hobe. Loan neya manei to bank er haate barir chabi :P

      Delete
    2. হুম, এটা একটা কথা বটে।

      Delete

Post a Comment