শিশুর সাতকাহন



যখন কলেজে পড়তাম তখন বাচ্চা দেখলে নাক কুঁচকোতাম। শুধু আমি না, আমার সব বন্ধুই কুঁচকোতো, কারণ কুঁচকোনোটাই ফ্যাশনেবল ছিল। আর যেসব বড়রা বাচ্চা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গাল টিপে আদর করতেন আর উলিবুলি ভাষায় কথোপকথন শুরু করতেন, তাঁদের দেখলে চোখ ঘুরিয়ে বলতাম, “এরা কারা বস?”

কিন্তু তখন আমি রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাস করতাম না, বিউটি পার্লারে যাওয়াটাকে প্রাইম ক্রাইম হিসেবে গণ্য করতাম, কেউ সানন্দা পড়ে শুনলে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতাম, আর বিশ্বাস করতাম “প্লেটোনিক” নামে পৃথিবীতে সত্যি সত্যি একরকমের প্রেম হয়।

কাজেই তখনকার ‘আমি’কে বেশি পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই।

এখনকার আমি আর সে আমি নেই। বাচ্চা দেখলে শুধু যে আদর করতে ইচ্ছে করে তাই না, মাঝে মাঝে মনের ভেতরটা হু হু পর্যন্ত করে, কেন সুস্মিতা সেনের মতো সাহসী হলাম না। হলে বেশ স্টেপ জাম্প করে একটা ছোট্ট ফ্রক পরা, মাথার দুপাশে টেনে দুটো ঝুঁটি বাঁধা, গালফোলা আধো আধো কথা বলা জ্যান্ত পুতুলকে বাড়িতে এনে বন্দী করে রাখা যেত।

হাফপ্যান্ট পরা বাটিছাঁট পুতুল হলেও আপত্তি নেই। গালটা যথেষ্ট ফোলা হলেই চলবে শুধু। যেরকম গালে চুমু খেতে গেলে নাকটাক সব ডুবে যায়, সেরকম।

কিন্তু দেখাই যাচ্ছে সাহস নেই। নেই যখন কী আর করা। আমি এখন তাই কদাচিৎ ভিডিও চ্যাটে বুচিদিদির মেয়ের সাথে খেলা করে আর রাস্তায় লোকের বাচ্চাদের লুকিয়ে চুরিয়ে দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই।

এই রে, লুকিয়ে চুরিয়ে দেখি বলে আবার কিছু সন্দেহ করে বসবেন না যেন। এখানে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, অন্যের বাচ্চা রাস্তায় ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেলে “আহা” বলে তুলতে গেলেও পুলিশ ধরে। বাড়িতে এসে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক চালায়, আপনার ধান্দাটা কী সেটা তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। এদিকে আমরা ১২২ কোটির দেশের লোক, আমাদের বাচ্চারও অভাব নেই, বাচ্চার গাল টেপার কিংবা শাসন করার লোকেরও না। বাচ্চা হওয়ারও দরকার নেই, বয়সে ছোট আর লম্বায় বেঁটে হলেই চলবে। একবার একজন আপাদমস্তক অপরিচিত ভদ্রলোক আমার স্কুটির পিছু নিয়ে--উনি নিজেও বাইক চালাচ্ছিলেন--বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে এসে মাকে নালিশ করেছিলেন, “আপনার মেয়ে কিন্তু খুবই রেকলেস চালায়।” ব্যস। মা ভদ্রলোককে প্রায় হাতেপায়ে ধরে ঘরে এনে, চা খাইয়ে, “কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো” বলেটলে, আজকালকার প্রজন্মের গুছিয়ে নিন্দেমন্দ করেছিলেন। আর আমাকে পরের একসপ্তাহ স্কুটির বদলে রিকশা চাপতে হয়েছিল। সবথেকে খারাপ যেটা হয়েছিল, যেটুকু রেকলেসনেসের বীজ বপন হচ্ছিল সেটার শিকড়সুদ্ধু উৎপাটন হয়ে গিয়েছিল।


গুগল ইমেজেস থেকে

আজকালকার টিনএজারদের এভাবে হ্যান্ডেল করার সাহস হবে কারোর? ঘাড়ে কটা মাথা?

যাই হোক, কী থেকে কী কথায় এসে পড়লাম। বাচ্চাদের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা হচ্ছিল। গোলমেলে কিছু নয়, “ইস আমারও যদি একটা থাকত” গোছের নিরীহ দুর্বলতা। আর সে দুর্বলতা বুক ফুলিয়ে প্রকাশ করার ওপর সামাজিক সেন্সরশিপের কথা। আমি নিশ্চিত পথে একটা মিষ্টি আলাপি বাচ্চা চোখে পড়লে যদি তার আঙুলের ডগাটা ধরে একটু নেড়ে দিতে পারতাম, বা হাত নেড়ে হাই বলতে পারতাম, বা চোখ ট্যারা করে জিভ বার করে তাকে খিলখিলিয়ে হাসাতে পারতাম, তবে আমার এই চোরচোর ভাবটা থাকত না।

যে ভাবটা, খেয়াল করে দেখেছেন নিশ্চয়, বাচ্চাদের একেবারেই থাকেনা। চোখে চোখ পড়ে গেলে কোন বাচ্চাকে চোখ সরিয়ে নিতে দেখেছেন কখনো? কিংবা পার্সোনাল স্পেসের তোয়াক্কা করে ইচ্ছে হলে আপনার মাথার চুল ধরে টানা থেকে বিরত থাকতে? জামাইষষ্ঠী সপ্তাহের মাঝখানে পড়ত যে সব বছর, ভিড়ে ঠাসা লেডিস কামরায় ঘর্মাক্ত মায়ের কোলে চেপে লক্ষ লক্ষ বাচ্চাকে মামাবাড়ি যেতে দেখেছি। তাদের প্রত্যেককে মায়ের কোল থেকে ঝুঁকে পড়ে নরম নরম দুই হাতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সামনের লোককে প্রাণপণ ঠেলতেও দেখেছি। লজ্জিত মা তাড়াতাড়ি বকে উঠে হাত টেনে সরিয়ে দিলে প্রত্যেককে চেঁচিয়ে বলতে শুনেছি, “ওর গা আমার গায়ে লাগছে কেন?”

সত্যিই তো। ঠেলো বাছা, যত পার ঠেলো।

কাল আইসক্রিমের দোকানে একটা মিষ্টি বাচ্চার সাথে দেখা হয়ে গেল। গোলাপি ফ্রক, মাথার দুপাশে কোঁকড়া চুলের দুখানা ঝাঁকড়া ঝুঁটি, তাতে আবার গোলাপি রঙের ডোরা ক্লিপ আঁটা। মা বাবার সাথে আইসক্রিম খেতে এসেছে। আমি তো একবার তাকিয়েই জোর করে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছি। ফ্যাট ফ্রি ভ্যানিলা আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর আমার আইসক্রিম এসে গেল, কিন্তু আমার বন্ধুর ফুল ফ্যাট স্ট্রবেরি মিল্কশেক তখনও রেডি হয়নি কিনা, তাই আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সেটা খেতে শুরু করে দিলাম।

আর অমনি বাচ্চাটার চোখ আমার দিকে পড়ে গেল। ব্যস আর যায় কোথায়। তারপর যতক্ষণ আমি দোকানে রইলাম সে আকুল চোখে আমার আইসক্রিম খাওয়া দেখতে লাগল। বিশ্বচরাচর ভুলে। আমি গোলাপি রঙের চামচে করে আইসক্রিম তুলে মুখের ভেতর পুরছি, চোয়াল নাড়িয়ে সে আইসক্রিম পেটের ভেতর পাঠাচ্ছি, আবার হাত নামিয়ে চামচে করে নেক্সট ইনস্টলমেন্টের আইসক্রিম নিয়ে মুখের কাছে তুলে ধরছি--প্রতিটি স্টেপ সে পলকহীন চোখে পরীক্ষা করতে লাগল। বলতে গেলে আমার সাথে সাথে আইসক্রিমটা খেতেই লাগল প্রায়। মানে চোখে দেখে যতটা খাওয়া যায় আরকি।

আমার কী ইচ্ছে করছিল নিচু হয়ে মেয়েটার গালটা আলতো করে টিপে দিই, কিন্তু অতি কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলাম। বড় হওয়ার বিড়ম্বনা। দোকান থেকে বেরোনোর সময় বন্ধুকে খোঁচা মেরে বাচ্চাটার দিকে দেখাতে তিনি ভয়ানক বিরক্ত হয়ে বললেন, “উফ তোমার এই পরের বাচ্চা নিয়ে আদিখ্যেতা অসহ্য। কোনদিন নিজে মার খাবে, আমাকেও খাওয়াবে।”

দেখুন দেখি। মার খাওয়ার মত কী করা হয়েছে?

তাই গল্পটা সাতকাহন করে আপনাদের কাছে বললাম। আপনারা ঝাঁঝিয়ে উঠবেন না এই আশায়।  

Comments

  1. এটাকে কাকতালীয় বলবেন না টেলিপ্যাথি বলবেন জানিনা, আজকেই আপনি এটা লিখলেন, আর আজকেই আমি অমৃতার এক বছরের ছেলেকে ঘন্টা তিনেক সামলে, স্ট্রলার নিয়ে ক্যাম্পাসময় ঘুরে বেড়িয়ে অচেনা লোকের কাছে "আইডিয়াল ড্যাড" খেতাব পেলাম | তবে দিনকাল নেহাতই খারাপ | এই তো সেদিন এক জায়গায় পড়লাম বাবা মায়েদের তাদের বাচ্চাদের সকার গেম এর ছবি তুলতে দেওয়া হচ্ছেনা কারণ সেই ছবিতে অন্য বাচ্ছাদেরও তো ছবি উঠে যাবে... যদি এই বাবা মায়ের কোনো বদ মতলব থাকে? যদি অন্য বাচ্চার বাবা মা স্যু করেন? থাক বাবা তার চেয়ে ফটো তোলাই বারণ করে দেওয়া ভাল - নাই বা থাকলো ছোটবেলাকার কোনো স্মৃতি !

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাংলায় বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো বলে একটা কথা আছে না? এ হচ্ছে সেই ব্যাপার। লোককে ছবি তুলতে দিচ্ছে না, এদিকে দেখুনগে নিজের ব্লগে বাচ্চার ফটোশপ করা ছবি ছেপে ছত্রাকার।

      স্মৃতি, হ্যান্ডিক্যামে তুলে রাখছে বোধহয়। কমেন্টারি সুদ্ধু।

      Delete
  2. Amar profile-er chhobita dekho!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওলে বাবালে! এ তো ভীষণ সিরিয়াস এবং ব্যস্ত লোক মনে হচ্ছে। ইনি কে? তোমার ছানা?

      Delete
  3. Hyan! 7mash bayes! tumi er kachhakachhi thakle, tomake takie haste baddho korbe! se tumi jatoi cheshta karo je kichhutei takabe na etc...
    Bus stand, restaurant, museum jekhanei hok, karo sathe eye contact holei holo, ek gaal hese hese bondhutto kore ase!

    ReplyDelete
  4. oh jah bolecho. amaro eromi iche kore, bacha dekhlei ektu gulu-gulu kore ador kore dite :D. tomar step jump er idea ta osadharon! but sahosh nai :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. গুলু গুলু করে আদর করাই উচিত আত্রেয়ী, যারা করে না তাদেরই যাকে বলে--বেশি বেশি।

      Delete
  5. Ami oboshyo ekhono bachha der dekhe "ulibuli" kore ador kori na. Tobe amar bhalo lage oder khubi, especially ektu kole neyar moto size er jara, mane sodyojato noy ar ki. Amar ek bhaijhi ar ek bonjhi ache, tader naam Pushi ar Bhollu. Poshaki naam Rishika ar Srinika. Pushi ajkal totapakhir moto katha bole. Phone korechilam or birthday te, tokhon amay bollo, "ami jokhon cake katchilam tomra ele na keno?" Bhadromohila'r boyesh 3. Tini kodin agey Arnab ke phone e bolechen, "Pisho, tumi bohudin Hiya'r (mane Bhollu'r) bari ashoni bole to tomar sange dekha hoyni."
    Bhollu'r boyesh 1.5 years. Oi bhadromohila bodhoy jonmer porer din thekei katha bolchen. Problem ta sudhu ei je onar katha amra bujhi na. Ekhon besh bodhogomyo hochhe jodio. Tini abar ajkal phone e ho-la-la, ho-la-la kore gaan o shonachen. Jonmo theke didi or kaner kache Rabindrasangeet geyeche onek, ho-la-la holo sei gaan shonar phol. Ei na holey generation gap??

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা রিয়া, তোমার ভাইঝি বোনঝিরা তো মোটামুটি একাই/দোকাই আসর জমিয়ে রাখেন মনে হচ্ছে। খুব ছোট বাচ্চা আমারও কোলে নিতে ভয় লাগে। আর তাছাড়া, শুনতে খুব খারাপ লাগলেও বলছি, এন্টারটেনমেন্টও কম। কটরকটর করে কথা বললে তবে না মজা?

      আহা আজকার রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুরুতে উ-লা-লা গায় তো। দেখলে না পাবলো প্যাট্রোন্যাভিশ কীরকম ঝ্যাং ঝ্যাং করে পুরানো সেই দিনের কথা গাইলো?

      Delete

Post a Comment