একটি বর্ষার সন্ধ্যে


কেমন কাটলো আপনাদের মাতৃদিবস? যারা মায়ের কাছাকাছি ছিলেন তাঁরা একসাথে কোয়ালিটি টাইম খরচ করলেন কি? যারা দূরেদূরে রইলেন তাঁরা মাকে দূরভাষে উইশ করলেন কি? নাকি আপনি এসব হলমার্ক-হুজুগে বিশ্বাস করেন না, আপনার কাছে প্রত্যেকটা দিনই মায়ের দিন?

যাই হোক, আপনি যে দলেই পড়ুন না কেন, আজকের দিনটা আপনার এবং আপনার মায়ের ভালো কেটেছে আশা করি। আমার কথা যদি জানতে চান, তাহলে বলবো এবছরের মাদার’স ডে আমার এত ভালো কেটেছে যে যখন আমি বুড়িথুত্থুড়ি হয়ে যাবো, মাথার বাকি ক’গাছা চুলও সাদা হয়ে যাবে, সাধের দাঁতের পাটি থেকে দু-একখানা দাঁত আলগা হয়ে খুলে পড়ে যাবে, চোখের মাইনাস পাওয়ার পালটি খেয়ে প্লাস হয়ে যাবে, তখনও আমার আজকের দিনটার কথা পরিষ্কার মনে পড়বে।

অথচ দিনটা আর পাঁচটা দিনের মতই শুরু হয়েছিল জানেন। মানে আর পাঁচটা মাদার’স ডে-র মতো। আমি সকালে উঠে রীতিমত হাতাহাতি করে মায়ের হাত থেকে চায়ের সসপ্যান আর ছাঁকনি কেড়ে নিয়ে মা’কে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়ালাম। মা ভয়ানক কাঁচুমাচু মুখ করে, বারংবার “এসবের কোন মানে হয় সোনা” বলতে বলতে সেগুলো খেলেন। তারপর আমরা বাবাকে ফোন করলাম, ছোটমামা মাকে ফোন করল, মা আমার চিজ সসেজ স্ট্র্যাটা আর সানি সাইড আপ-এর যোগ্য প্রত্যুত্তর দেবেন বলে কোমর বেঁধে রান্নাঘরে ঢুকে ম্যাজিশিয়ানের মতো মিনিটের মধ্যে উচ্ছেবেগুন, মুসুর ডাল, আলু পটলের তরকারি, রুই মাছের কালিয়া আর আমের চাটনি নামিয়ে ফেললেন। আমার যদিও ব্রেকফাস্টই হজম হয়নি তখনও, তবু খেটেখুটে সেগুলো সব খেতে হল। একটা লোক এত কষ্ট করে রেঁধেছে, খাবোনা তো বলা যায়না বলুন?

খেয়েদেয়ে উঠে, জোয়ান মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে আমরা ‘চিলড্রেন অফ হেভেন’ দেখলাম। মা আঁচল দিয়ে ঘনঘন চোখ মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন, “উফ কী বই-ই না বানিয়েছে।”

তারপর কার্বোহাইড্রেটের ওভারডোজে যেই না একটু চোখ লেগে এসেছে, অমনি এক ঘুমে দুপুর কাবার। সে ঘুম একেবারে ভাঙলো যখন, রান্নাঘর থেকে মায়ের চায়ের কাপে চামচ নাড়ার ঠুং ঠুং আর জানালার বাইরে থেকে গমগমে মেঘের গর্জন একসাথে কানে এলো।

চা নিয়ে জানালার পাশে পৌঁছতে না পৌঁছতে ঝড় শুরু হয়ে গেল। সে কী ঝড় বাসরে। দলে দলে কালো মেঘ আকাশ ছেয়ে এসে বিকেলের শেষ আলোটুকু চেটেপুটে সাফ করে ফেললো। চোখ ধাঁধিয়ে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো এদিক ওদিক, মাপমতো সময়ের গ্যাপ দিয়ে কড়কড় করে বাজ পড়তে লাগলো। আমাদের প্রতিবেশি তাঁর প্রাইজ পাওয়া কুকুরকে এক্সারসাইজ করাতে বেরিয়েছিলেন, তাঁদেরকে ছুটে ছুটে ফেরত আসতে দেখলাম। ততক্ষণে রাস্তার দুধারের গাছেদের মাথায় প্রবল আন্দোলন শুরু হয়েছে, পাতা ঝরে কালো কুচকুচে রাস্তাটা, রাস্তার পাশে দাঁড় করানো গাড়ির ছাদগুলো, নিমেষে হলদে সবুজ লালচে হয়ে গেল। ঝরা পাতায় ঘূর্ণি তুলে শোঁ শোঁ আওয়াজ করে রাগি হাওয়া এলোমেলো ছুটতে লাগলো এদিক সেদিক। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে বলতে লাগলাম, “ইস যেন বৃষ্টি নামে, যেন বৃষ্টি নামে...” মায়েরও খুব ইচ্ছে বৃষ্টি নামুক, কিন্তু আমাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে আশাভঙ্গের জন্য প্রস্তুত রাখার গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁধে, কাজেই তিনি উল্টো সুর গাইতে লাগলেন। বললেন, “ধুর হাওয়ায় সব মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাবে দেখবি, বৃষ্টির ব-ও হবে না।”

কিন্তু মায়ের সাবধানতা মিথ্যে করে আর সাধ সত্যি করে বৃষ্টি নামলো। হ্যাঁ, যেরকম হা রে রে রে করে ঝড় এসেছিলো, সে তুলনায় বৃষ্টিটা নেহাতই নিড়বিড়ে এলো বটে, কিন্তু যেমনই হোক বৃষ্টি তো? ততক্ষণে ঘরের ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে, কিন্তু তবু আমরা লাইট জ্বালালাম না। সেই আঁধার ঘরের ছায়ায় বসে মা গান ধরলেন। একের পর এক বর্ষার গান। ‘উতল ধারা বাদল ঝরে’ শেষ হতে ‘শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা’ শেষ হতে ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে’। তারপর ‘নিশীথরাতের বাদলধারা’। আমিও গলা লাগালাম। ছোটবেলার মতো। বাইরে স্ট্রিটল্যাম্পের হলদে আলোর গা বেয়ে সরু সরু বৃষ্টির ধারা স্পষ্ট হয়ে ঝরতে লাগলো।

এর থেকে ভালো মাদার’স ডে আর হতে পারতো বলুন? মা প্লাস বৃষ্টি প্লাস গান, আমার সবকটা ফেভারিট জিনিসের একসাথে সঙ্গলাভ কি সোজা কথা? ত্র্যহস্পর্শ যাকে বলে।

অবশ্য আমাদের ডিনারে মালয়েশিয়ান খেতে যাওয়ার প্ল্যানটা কাটাতে হলো। বদলে মা গরমগরম পরোটা ভাজলেন, অল্প করে মাখামাখা আলুর তরকারি বানালেন, ফ্রিজে আগের দিনের রান্না কচি পাঁঠার মাংস ছিল খানিকটা, সেইসব জোড়াতালি দিয়ে মা মেয়ে কোনমতে চালিয়ে নিলাম।

একটু আধটু কম্প্রোমাইজ জীবনে চলার পথে না করলে কি চলে, বলুন?

‘Caught in the rain’ a cinemagraph by Jamie Beck and Kevin Burg. [For some background read this article on The Atlantic.]
ছবিঃ Caught in The Rain by Jamie Beck.

Comments

  1. Replies
    1. থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ শম্পা।

      Delete
  2. Replies
    1. আরে ভগ্নিপতি মশাই যে, কী খবর?

      Delete
  3. asadharon katiechho.... :) kokhono sujog pele tomar gan shonar ichhe roilo...

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওকে গোবেচারা, সেই কথাই রইলো তাহলে। দেখা হলে বেশ চেঁচামেচি করে গানবাজনা করা যাবে'খন।

      Delete
  4. wow.. ki osadharon mother's day celebrate korechho to! amar to porte porte hingshe hoye gelo :(. aha jemon brishti, temni gaan, temni khawa dawa! :-D. sob theke anonder to amar mone holo ma er cha e bikeler ghum banga ta :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ আত্রেয়ী কেউ চা করে ঘুম ভাঙাচ্ছে, এই ব্যাপারটা আমার জীবনে এই মুহূর্তে সবথেকে বড় লাক্সারি। তার ওপর 'কেউ'টা যদি মা হন, তাহলে তো আর কথাই নেই।

      Delete
  5. oooofff!!!! Ki byapok golpo...kon part ta sobtheke bhalo bujhte parlam na- Mothers' Day te ma'r sange thaka, na jhhor-brishti ta, na khaoya doaya gulo!!
    Seattle e 9 months brishti porleo ekdin o "bojro bidyut sohokare" brishti hotey dekhlam na. Sob somoyei sei jhir jhir kore pore jaate chhata khulbo ki khulbo na bhabte bhabtei manushe half bhije jaye...jachhetai!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটাই তো রিয়া, সেদিন এতগুলো ভালো জিনিস একসাথে ঘটলো...অবিশ্বাস্য। শুধু ওই বৃষ্টির গল্প শুনে (আর কফি) আমার তো খুব সিয়াটল যাওয়ার ইচ্ছে। এখানে তো টিপটিপ ঝমঝম কোনরকমই হয়না। জঘন্য।

      Delete
  6. darun katiyecho din ta!!! ishh kottodin erokom sondhye asena amar kachhe....khub nostalgic hoye porlam..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালো কাটিয়েছি কিনা বলো স্বাগতা? আসবে আসবে, তোমারও আসবে। সবুর করো, মেওয়া ফলবে।

      Delete
  7. khub bhalo likhechho post ta.. kolkatay ekhon prochondo, kat-fata, ghemo gorom... chatok pakhir moto haan kore achhi brishtir jonyo. tate tomar ei post, ar chhobita dekhe mon bhore gelo... tate abar porotar sathe kochi patha... aha aha..

    ReplyDelete
    Replies
    1. সোহিনী, পরোটা আর পাঁঠার জুটিটা সত্যি সত্যি মেড ইন হেভেন।

      Delete
  8. bah, Baba kintu pore hingshe korbe

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা বং মম, বাবা এতদিনে হিংসে করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা মা মেয়ে কনসিডারেট। একসাথে থাকলেই বাবাকে ফোন করি। বাবাও ঘন ঘন করে আই পি এল-এর খবর দেয়।

      Delete
  9. Kuntala, tumi Seattle e thako?
    Ar, bhisahon shundor post. " কিন্তু আমাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে আশাভঙ্গের জন্য প্রস্তুত রাখার গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁধে..." :) Bhari bhalo.

    Debika

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ধন্যবাদ দেবিকা। না গো আমি সিয়াটলে থাকিনা। কিন্তু যাওয়ার খুব ইচ্ছে।

      Delete
  10. Bhison Bhison bhalo laglo ei post ta pore. Thank you tomar experience gulo share korar jonno. Emon bhalo lekha porei to amader life er blanks gulo bhore othe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. রাকা, তোমরা যে অবান্তর পড়, আর পড়ে ভালো লাগলে সে কথা আমাকে জানাও, তাতে যে আমার এই বদখত জীবনটা কতখানি ভরে ওঠে যদি জানতে। পুরোটাই আমার লাভ বিশ্বাস কর। তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুব খুশি হলাম।

      Delete

Post a Comment