জোসেফাইন



সেদিন একটি বাচ্চা মেয়ের সাথে আলাপ হল। বাচ্চা মানে ৩০ ছুঁতে তার এখনো অনেকটা দেরি আছে। বেশ ভালো লাগল আলাপ করে। হাসিখুশি, ঝরঝরে। আজ থেকে বছর ছয়েক আগে আমি যেখানে ছিলাম এই মেয়েটিও জীবনের ঠিক সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে এখন। সামনে বেশ অনেক কিছু হবে হবে। আনকোরা নতুন অনেক কিছু। নতুন জায়গা, নতুন লোকজন, জিভ গোল্লা পাকিয়ে “র” আর “আ”-এর জায়গায় “অ্যা” বলতে শেখা ধরলে প্রায় নতুন একটা ভাষা। টিন্ডার ঝোল আর লাউকির ঘ্যাঁট থেকে একলাফে ওয়েন্ডিস-এর তেলচিটে মিনি চিজবার্গার। দুটো কিনলে একটা ফ্রি। ক্লাস-ফেরতা দুই রোগা বন্ধুর লাঞ্চ সারার জন্য পারফেক্ট।

আলাপ-টালাপ করে বাড়ি ফেরার সময় সব কথা আবার মনে পড়ে গেল। জানতাম এটা হবে। আজকাল ট্রিগার দেখলে চিনতে পারি। কোর্সওয়ার্কের যমযন্ত্রণা, মাসতিনেক পরে শীতের এক পড়ন্ত সন্ধ্যেয় জীবনে প্রথমবার হঠাৎ হোমসিকনেসের আক্রমণব্যাপারটা আমার কাছে এতো নতুন ছিল যে আমি প্রথমে ওটাকে হোমসিকনেস বলে চিনতেই পারিনি-ভাবছি ঠাকুমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে বুঝি। মরা প্রেমের গোড়ায় অক্লান্ত জল ঢেলে যাওয়ার পর্বতপ্রমাণ নির্বুদ্ধিতা। কিছুতেই স্বীকার না করতে চাওয়া যে Out of sight, out of mind কথাটা পৃথিবীতে টিকে আছে আমার জীবৎকালের থেকে অনেক অনেক বেশি দিন।

মনে পড়াকে এজন্য আমার এত ভয়। মাথার মধ্যে একগাদা তিক্ত স্মৃতির প্যারেড। ভুলতে চাওয়া দৃশ্যের ক্রমাগত হাঁটাহাঁটি। একটার পর একটা। থামাতে চেয়ে লাভ নেই। যতক্ষণ না মাথার ভেতরটা অন্য কোন জঞ্জাল দিয়ে ভর্তি করতে পারছি, সব-ভোলানো ইন্টারনেটের হাতে নিজেকে সঁপে দিচ্ছি ততক্ষণ মুক্তি নেই।

কিন্তু সেদিন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। মনখারাপ করা দৃশ্যগুলো পেরোতে পেরোতে আমি শেষপর্যন্ত এমন একটা দৃশ্যে এসে থামলাম যেটার মাইলখানেকের মধ্যে দুঃখের ছায়ামাত্র নেই। ফার্স্ট কোয়ার্টারের শেষ পরীক্ষাটা ঘণ্টাখানেক আগে শেষ হয়েছে। ফেরার পথে বিজনেস লাইব্রেরি থেকে বই তুলে এনেছি। তোলা ব্যাপারটা অবশ্য শুনতে যতটা সহজ লাগছে ততটা সহজে হয়নি। গত দু'সপ্তাহ প্রাণের দায়ে রাতজাগার ফাঁকে ফাঁকে নিজেকে লাইব্রেরিতে গল্পের বইয়ের রিকোয়েস্ট পাঠানোর অনুমতি দিয়েছিলাম শুধু। সে রিকোয়েস্ট জমতে জমতে ১৫টা বইয়ের ঊর্ধ্বসীমা ছুঁয়েছে। লাইব্রেরিয়ান দয়া করে একটা বিরাট সাদারঙের পলিথিনের প্যাকেটে বইগুলো পুরে দিয়েছেন। হাতের আঙুলগুলোর যেখানটায় প্যাকেটের হ্যান্ডেলটা ছুঁয়ে ছিল, সেখানে একটা লাল দগদগে লাইন হয়ে গেছে। চুলকোচ্ছে ভয়ানক। বইগুলো বার করে টেবিলের ওপর থাক করে রেখেছি কিন্তু তার বেশি কিছু করতে অ্যালাউ করিনি নিজেকে। দমবন্ধ করে দ্রুত হাতে জামাকাপড় বদলাচ্ছি, ছাড়া জামা হ্যাঙারে ঝোলাচ্ছি, ব্যাগ থেকে বইপত্র বার করে শেলফে গুছিয়ে রাখছি, টি মেকারে জল ভরে অন করছি। ঘরের মাঝখানে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি আর কী কী কাজ বাকি রয়ে গেল যা আমাকে মাঝপথে বই ছেড়ে উঠতে বাধ্য করতে পারে।

অবিশ্বাস্য হলেও অবশেষে সত্যি সত্যি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল। যখন আর কোন কাজ পড়ে নেই, আর কিছুকে মনোযোগ দেওয়ার নেই, ফোনটাও হাতের কাছে এনে রেখেছি যাতে বাজলে তুলে কেটে দিতে সুবিধে হয়। গদিআঁটা বেঁটে চেয়ারটা খসখসে সবুজ কার্পেটের ওপর দিয়ে ঘষটে ঘষটে জানালার পাশে নিয়ে গেলাম। ঘরের সবেধন একফালি জানালা। জানালার নিচে সরু বারান্দার মতো একটুখানি জায়গা বেরিয়ে এসেছে, সেখানে চায়ের কাপটা রেখে, পা মুড়ে গুটিসুটি হয়ে চেয়ারের ভেতর নিজেকে ঠেসেঠুসে গুঁজে দিয়ে টেবিলে রাখা সবথেকে ওপরের বইটা টেনে নিয়ে প্রথম পাতাটা খুললাম।

দ্য ডটার অফ টাইম। জোসেফাইন টে। আগাথা ক্রিস্টির সমসাময়িক একজন স্কটিশ, মূলত গোয়েন্দাগল্প লেখিকা। যদিও বেঁচেছেন ক্রিস্টির তুলনায় অনেক কম দিন। তাঁর গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর গ্র্যান্টও পরিচিতিতে পোয়্যারো কিংবা মার্পলের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেননি। কিন্তু জোসেফাইনের লেখার মধ্যে আমার সেই ছ’বছর আগের বিকেলটাকে স্মরণীয় করে রাখার মতো জাদু পর্যাপ্ত ছিল। ইন্সপেক্টর গ্র্যান্টের মধ্যে সেই বিরল গুণ ছিল যেটা আমি সব গোয়েন্দাগল্পের নায়কের মধ্যে খুঁজি এবং বেশির ভাগ সময়েই পাইনা। জোসেফাইনের ভাষায় “ফ্লেয়ার”। শুকনো যুক্তি নয়, ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ভেজা মাটিতে অসতর্ক খুনির রেখে যাওয়া বুটের ছাপের ওপর ভরসা নয়, ম্যাজিক দেখানোর মতো একটা থেকে আরেকটা ক্লু-তে লাফিয়ে লাফিয়ে সমাধানে পৌঁছে গিয়ে অসহায় পাঠককে ধাঁধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নয়---অপরাধ এবং অপরাধী সম্পর্কে একটা সক্রিয় ষষ্ঠেন্দ্রিয়। গোলমাল ঘটার আগেই গোলমালের গন্ধ পাওয়া। একটা বেফাঁস কথা, একটা বেখাপ্পা চাউনি—মাথার ভেতর গুছিয়ে রেখে দিতে পারা। দরকার মতো বার করে এনে দুয়ে দুয়ে চারে পৌছনো। যে ব্যাপারটাকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড “উইমেন’স ইনট্যুইশন” বলে হাত নেড়ে উড়িয়ে দেয়। সেই ব্যাপারটা।

কী আনন্দে যে কেটেছিল বিকেলটা। এত আনন্দে যে ছ’ছটা বছর পরেও, যে ছটা বছরে কম করেও ছেষট্টিরকম দুর্ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে (ভালো ঘটনাও ঘটেছে, কিন্তু সেগুলো মনে নেই অফ কোর্স) সেই ঘটনাবহুল ছটা বছরের সবকটা মুহূর্তকে হারিয়ে দিয়ে ওই একটা বিকেল আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। না ডাকতেই। একরাশ ভালোলাগা সঙ্গে নিয়ে।

বাড়ি ফিরে সার্চ ইঞ্জিনে জোসেফাইন টে লিখে সার্চ করতেই বেরিয়ে পড়ল। আটখানা উপন্যাস। আমি আর সময় নষ্ট করিনি। আপাতত নাওয়াখাওয়া বাদ দিলে বাকি সময়টুকু জোসেফাইনে সমর্পণ করেছি। মায়ের ভাষায় “গাঁজায় দম দিয়েছি”। কিন্তু মা জানেন না। গাঁজায় দম দেওয়া নয়, সামান্য গোয়েন্দাগল্প মুখে করে বসে থাকাও নয়। এ হচ্ছে তিলে তিলে সুখের স্মৃতি তৈরি করা। যাতে আজ থেকে ছয়, ষোল, ছাব্বিশ বছর পরে ফিরে তাকালেও এই মুহূর্তগুলোকে বাকি সব মুহূর্তের থেকে বেশি স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যায়।


Comments

  1. দিলি তো, উসকে? এবার কিনিয়ে ছাড়বি মনে হচ্ছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কিনলে The Daughter of Time টা কিনো। আফসোস হবেনা বলেই মনে হয়।

      Delete
  2. amar bf(jani na, sheshmesh tar bf theke bor e promotion hobe kina) aj e delhi gache, chakri korte..amio vabchi ebar gutiguti bidesh pari debo..porsu theke mood off..tar opor tomar lekhar first 3te para pore vya vya kore kadlam kichukhon.. :(
    jai hok..ei bhodromohilar nam ami ei prothom sunlam..search kore dekhbo ekkhuni..goendagolpo er cheye valo kichu prithibi te ar hoy na bodhoy.. :)

    ReplyDelete
  3. arey tumi google searchbox lagiyecho! thanku thanku.. :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. কুহেলি, আহারে। মন খারাপ করো না। মুড ভালো হয়ে যাক তাড়াতাড়ি এই কামনা করি। যা বলেছ, গোয়েন্দাগল্প রকস।

      ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

      Delete
  4. tey niye kono katha hobe na...simply terrific. btw, madhulika liddle namok ekjon ke abiskar korlam. golpo gulo set in mughal court..shekhanei murder aar detective holen nobleman muzaffar jung...besh lagchey "the englishman's cameo) porte. Charles Finch kemon laglo?

    ReplyDelete
    Replies
    1. শম্পা, টে সত্যি টেরিফিক। চার্লস ফিঞ্চের বিউটিফুল ব্লু ডেথ খুব ভালো লেগেছিল, সেপ্টেম্বর সোসাইটি...সো সো। মধুলিকা লিডলের খোঁজে থাকব তাহলে।

      Delete
    2. aamar charles finch er shob kota boi er madhe BBdeath tai khub bhalo legechilo. anya gulo kintu just choley...temon kichu na. recently ian rankin porte arambho korechhi, inspector rebus ke besh lagchey.

      Delete
  5. PoRini. Ebar poRe dekhte hochchhe tahole!

    ReplyDelete
    Replies
    1. পড়ে ফেলুন। পস্তাবেন না।

      Delete
  6. tomar smriti ta amar first year er akta sondhyer smritir songe hubohu akrokom...oboshyo first quarter sesh noy, ami akta pati first midterm sesh hotei ei udjapon ti korechilam; Te noy, songi chhilen Agatha nijei: Then there were none; ar chair e bose golper boi amar bhaloi lagena, tai posture ta chilo aramer leper tolay adhshoa..baki sob ditto...aaaaak :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা স্বাগতা তোমার সুখটা আমি কল্পনা করতে পারছি। কী স্মরণীয় সন্ধ্যে বল দেখি? এরকম সন্ধ্যে জীবনে বেশি আসবেনা স্বাগতা (যদিও আমি মনেপ্রাণে চাই আসুক, কিন্তু সত্যিটা তুমিও জান, তাই তো?) ওটার স্মৃতিটাকে বুকের মধ্যে জাপটে রেখে দাও।

      Delete
  7. jodi na kiney porar ichhey hoy: http://gutenberg.net.au/crime-mystery.html

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ধন্যবাদ ধন্যবাদ। আপনি তো খনি খুলে দিলেন পুরো। বাকিরা সবাই Caco Mukho-কে ধন্যবাদ জানাও।

      Delete

Post a Comment