অর্থহীন


গত কিছুদিন ধরে একটা জিনিস টের পাচ্ছি। মোটা বই পড়ার ক্ষমতা আমার ধীরে ধীরে কমে আসছে। ‘মোটা’ কথাটার অবশ্য নিজস্ব কোনও মানে নেই। দেশকালসমাজভেদে ওর মানে বদলে বদলে যায়। দেশে লোকে মোটা বলতে যা বোঝে, অ্যামেরিকায় লোকে তা বোঝে না। আবার অ্যামেরিকার কথা যদি ছেড়েও দিই, পশ্চিমবঙ্গের লোকেরাও উনিশশো সত্তর সালে যেটাকে মোটা বলে ভাবত, সেটার সঙ্গে দুহাজার তেরোর মোটার কোনও মিল নেই। কাজেই শব্দটাকে আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলা দরকার।

মোটা বই বলতে আমি বলছি চারশো পাতার বেশি বইয়ের কথা

বই যদি টেক্সটের হত, তাহলে সত্যি বলছি আমার চিন্তার কোনও কারণ থাকত না। রোগা বা মোটা, কোনওরকম টেক্সটবই পড়ার ক্ষমতাই আমার কোনওদিনই ছিল না। কিন্তু গল্পের বইয়ের ক্ষেত্রেও যে আয়তনটা একটা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেটা এর আগে কখনও অনুভব করিনি।

একটা যুক্তি দিলে অবশ্য অপারগতার দায়টা আমার ঘাড় থেকে নামিয়ে অন্যের ঘাড়ে চালান করে দেওয়া যায়। এখন ভালো বই লেখা হয় না, তাই আমি পড়তে পারি না। কিন্তু পাঁচবছরের শিশুর কাছেও এ যুক্তি চালানো শক্ত হবে। যখন পড়ার ক্ষমতা ছিল, তখন ফাউন্টেনহেড পড়তেও কষ্ট হয়নি। কষ্ট হয়নি বললে ভুল হবে, হয়েছিল খুবই, কিন্তু সে অন্যরকমের কষ্ট। তার সঙ্গে বইটার সাতশো কুড়ি পাতার দৈর্ঘ্যের কোনও সম্পর্ক ছিল না।  

আমার তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, এই মুহূর্তে হাতে এলে আমি ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোজ’ শেষ করে উঠতে পারতাম কি না।

পরিস্থিতি কতদূর ঘোরালো হয়েছে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়? আর সবথেকে বড় চিন্তার কথাটা হচ্ছে, পড়তেই যদি না পারি, লিখব কী করে?

বান্টি হাতের কাছে নেই, কিন্তু থাকলে কী বলত আমি জানি। বলত, “কেন, লিখছ তো। এই যে সকালবিকেল নিয়ম করে পাঁচশো শব্দের প্রকাশ্য ডায়েরি লিখছ, তোমার এই ভয়ানক ইন্টারেস্টিং জীবনটার গল্প ইন্টারনেটে খেলিয়ে ফাঁদছ, জগৎসংসার সম্পর্কে তোমার মহামূল্য মতামত সবাইকে ডেকে ডেকে শোনাচ্ছ? পড়তে না পারাতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না।”

আমি দু’সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলতাম, “এ লেখা কারও মনে থাকবে?”

এতক্ষণে সমস্যাটা বান্টির মগজে ঢুকত। বলত, “সেরেছে। শুধু লিখে রক্ষা নাই আবার মনেও রাখাতে হবে? তাহলে তো বিপদ।”

বিপদই বটে। অবান্তর লিখতে আমার যে খারাপ লাগে না, উল্টে ফুচকা খাওয়ার থেকেও বেশি ভালো লাগে, সেটা নিশ্চয় আপনাদের বলে বোঝাতে হবে না। কিন্তু একে লেখা বলে দাবি করাও ধৃষ্টতা। “ফেসবুকে নেই” বলার সময় এখনও বুকের ভেতর চাপা গর্ব হয়, কিন্তু নিজের মনকে চোখ ঠারিয়ে তো লাভ নেই। অবান্তর, একটু হাতপাখেলানো ফেসবুক ছাড়া আর কি?

একসময় ভাবতাম অবান্তর আমার গা-গরম করার এক্সারসাইজ। মাঝপুকুরে ঝপাং করে লাফ দিয়ে পড়বার আগে বটের ঝুরি ধরে খানিকক্ষণের দোল খাওয়া। কিন্তু বেশ ক’বছর ধরে দোল খেতে খেতে বুঝতে পারছি, পুকুরের জল ভয়ানক ঠাণ্ডা আর গভীর। ফস্‌ করে ঝাঁপাব বললেই ঝাঁপানো যায় না। ঝাঁপ দেওয়াটা বেশ শক্ত কাজ। তার জন্য দোল খেতে জানাটাই যথেষ্ট নয়, সাঁতার দিতে জানতে হবে।

“তবে শেখো

“তাহলে তো ঝুরি ছেড়ে নামতে হবে।”

“তবে নামো।”

যেন নামো বললেই নামা যায়। যেন মানুষের খুশিঅখুশি, ইচ্ছেঅনিচ্ছে বলে কিছু থাকতে নেই।

তবু চিন্তাটা থেকেই যায়। পাঁচশো শব্দের পোস্ট থেকে পাঁচশো পাতার উপন্যাস থেকে পাঁচ কোটির বায়নার রাস্তাটা নাকবরাবর কি না, সে নিয়ে সন্দেহ ঘন থেকে ঘনতর হয়।

ওদিকে আবার মনে রাখার মতো কিছু করার ইচ্ছেটাও বুকের ভেতর থেকে নড়ে না।

মা আমার ব্লগ লেখাটা মোটেই ভালো চোখে দেখেন না। একে ব্লগ, তায় তার মূল সুর ঠাট্টার। এর থেকে বেশি অনিত্যের সাধনা কি আর কিছু হতে পারে? তবু আমি চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে মায়ের দ্বারস্থ হই। গোলাপি বালতি ওপচানো সার্ফ এক্সেলের দুধসাদা ফেনায় নীল মোজা ডোবাতে ডোবাতে মা স্বভাবসিদ্ধ সাবলীলতায় আমার সমস্ত দোনামনা কাটিয়ে দেন।

“একটা পোস্ট লিখতে তোমার কত সময় লাগে?”

“দুই থেকে তিন ঘণ্টা। মাঝে মাঝে চার। কোনও কোনওটায় সারাদিন।”

সময়নষ্টের বহর শুনে মায়ের হাত কেঁপে ওঠে। বালতি থেকে খানিকটা ফেনা চলকে মেঝেতে পড়ে যায়। চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে মা জিজ্ঞাসা করেন, “একটা মনে রাখার মতো উপন্যাস লিখতে কত সময় লাগে বলে তোমার ধারণা, সোনা?”

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে নিজেই উত্তরটা দিয়ে দেন। বলেন, “পাঁচবছর থেকে সারাজীবন পর্যন্ত লাগতে পারে। তার পরেও সেটা ভুস করে সময়ের সমুদ্রে ডুবে যেতে পারে, আধখানা ঢেউও না তুলে।

...আর তোমার দু’ঘণ্টার ব্লগপোস্ট সময়ের বুকে কতখানি আঁচড় কাটবে বলে তোমার মনে হয়?”

জানি, জানি, সব জানি। কিন্তু কম সময়, কম পরিশ্রমে, ব্লগপোস্ট লেখার থেকে বেশি তাৎক্ষণিক রিটার্ন আর কোথায়? এর মায়া কাটানো কি চাট্টিখানি কথা? কাজেই একটা একটা করে পোস্টের পর পোস্ট জমতে থাকে, বছরের পর বছর কেটে যায়, আর আমার মনে রাখার মতো কিছু করার সাধ দূর থেকে আরও দূরে সরে যেতে থাকে।

তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করি, পাঁচশো শব্দের বেশি আর একটিও শব্দ লেখার ক্ষমতা আমার লোপ পেয়েছে। গল্পের বই পড়ার ক্ষমতার মতো।   

*****

আপনি পারেন এখনও একবইঠায় চারশো পাতার একটা গোটা গল্পের বই শেষ করতে? তাহলে আপনাকে আমি ভীষণ হিংসে করি। 

Comments

  1. একবৈঠায় কথাটা একটু গোলমেলে, কিন্তু আপনি কি বলছেন বুঝতে পারছি। আমার ঠিক এই সমস্যাটাই হয়েছে গত কয়েকবছর ধরে।যদিও এটা খানিকটা লেখকের ওপরেও নির্ভর করে, তাও বলব, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লেখক যেই হন না কেন, ৪০০ পাতার বেশি মোটা বই দেখলে আমি শুরু করার উত্সাহ পাইনা। এই মুহুর্তে হ্যারি পটার এন্ড ডেথলি হ্যালোস পড়ছি অবশ্য আরেকবার, কিন্তু খুব আস্তে আস্তে, শুধু জিম করার সময়ে। এই যে ইনস্ট্যান্ট রিটার্ন এর নেশাটা, এটা বড় সর্বনেশে নেশা, লং টার্ম কাজকর্ম করার মোটিভেশন নষ্ট করে দেয়। আপনি ভাববেননা আপনি একলা এ ব্যাপারে। বাকিদেরও একই অবস্থা। সেইজন্যই লোকে উপন্যাস ছেড়ে ব্লগের দিকে ঝুঁকেছে, আবার ব্লগ ছেড়ে টুইটার আর ফেসবুক ধরেছে। আপনি ৫০০ পাতার উপন্যাস যাদের জন্য লিখবেন, তারা পড়তে রাজি তো?

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thik katha boleche Sugata, shobar i ei oboshta, iPad e ar koto porbe loke. Tumi sobar age tomar Ma-er quotation er ekta boi lekho. Collection of 140 words, Twitter specific, applicable to modern day real life quotation. Hu hu katbe.

      400 pata, ki page size ?

      Delete
    2. "এই যে ইনস্ট্যান্ট রিটার্ন এর নেশাটা, এটা বড় সর্বনেশে নেশা, লং টার্ম কাজকর্ম করার মোটিভেশন নষ্ট করে দেয়।"

      পড়ে স্যাড হয়ে গেলাম। এর থেকে বেশি সত্যি কথা গত সাত দিনে আর শুনিনি।

      বং মম, পেজ সাইজ এই ধরুন, নাইন টেনের জীবনবিজ্ঞান বইয়ের মতো। মাকে টুইটারের মতো করে ১৪০ শব্দের বাণী দিতে বললে, মায়ের চেহারাটা কেমন হবে, শুধু সেইটা দেখার জন্যই প্রস্তাবটা দিয়ে দেখব।

      Delete
    3. এখানে আরো ২-৪ লাইন যোগ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। আমি গত বছর দুয়েক ধরে এই সমস্যাটা লক্ষ্য করছি নিজের মধ্যে। এবং আপনার শুনতে মোটেই ভালো লাগবেনা যদি আমি বলি যে এমনও হয়েছে যে আপনার ব্লগ পোস্ট খুলে "ওরেবাবা বিরাট লেখা" বলে আমি তখনকার মত বন্ধ করে দিয়েছি। সেটা কিন্তু লেখিকা হিসেবে আপনার ব্যর্থতা নয়, পাঠক হিসেবে আমার ব্যর্থতা, কারণ "একাকী গায়কের নহে যে গান, মিলিতে হবে দুই জনে" ইত্যাদি। আমি সত্যি বড় বড় মোটা মোটা বই পড়তে চাই, কিন্তু শুরু করতে ইচ্ছে করেনা। আমি ডিস্ট্র্যাকশন এড়াবার জন্য টুইটার-এ নেই, এমনকি ট্যাবলেট না কিনে ই-বুক রিডার কেনাও এই কারণেই। নিজেকে লং-টার্ম কাজে মনোনিবেশ করতে যেটুকু বাধ্য করা যায় আর কি।

      আপনার ব্লগ পোস্ট লিখতে কত সময় লাগে জেনে অবাক হয়ে গেলাম। নো ওয়ান্ডার আপনার লেখা এত ভালো। আমি দুয়েকটা ব্যতিক্রম বাদে কোনদিন দু ঘন্টার বেশি দিয়েছি বলে মনে পড়েনা। এখন সেটুকুও দিতে পারছিনা বলে লেখা কমিয়ে দিয়েছি।

      Delete
    4. না সে সময় লাগাটা অপটুতার লক্ষণও হতে পারে। আমি অনেক বেটার ব্লগারদের কথা জানি, যাঁরা আধঘণ্টায় পোস্ট লেখেন বলে দাবি করেছেন।

      Delete
  2. kakimar barnonata asadharon....:-D :D ......onar sange alaper iccheta kromei bere choleche.... amar mone hoy na kono dini tor 500 shabder beshi lekhar khamata lop pabe ..ota akdom baje katha...kintu prathamei uponyash keno?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, আমার মা আমার থেকে একশোগুণ বেশি ইন্টারেস্টিং।

      Delete
  3. shunechi sunil ganguly "shei samay" niye praye 20-25 bochor bhabna chinta korechilen, tarpor likhte about 5-6 bochar legechilo. aar rushdie "midnight's children" likhte 12 bochor lagiyechilen! kaajei :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. তবেই বোঝো শম্পা।

      Delete
  4. আমি 'ইনহেরিটেন্স সিরিজ' আজ রাত্রে শেষ করব, আড়াই হাজার পাতা। কাজেই আমি এখনও লড়ছি। আর আমার বয়সও বেশি, কাজেই আমি ঘ্যাম নিতেই পারি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিশ্চয়। কুডোস।

      Delete
  5. jobe theke computer beshirokom bhabe life e esheche tobe theke ektu ektu kore geche, ekhon to eksnge 2-3 te boi nie ekbaar eta ekbaar oita kore kore pori, aar onek boi maajhpothe tyaag o kori, ja ta obostha .... shob kichur blame chapai PhD life er tension ke :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা পরমা, সে ভালোই কর। সব দায় একা নিতে হলেই হয়েছিল আরকি।

      Delete
  6. ei post pore ki je shanti pelam, bhabtam amari bodhoi sudhu dhoiryo lop peyechhe. tobe eta sottii ekta samosya. tobe ei samosya amar onek age suru haoa sotteo ami kintu Harry Potter er sob series sesh korte perechhi ei ja santona.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও শান্তি পাচ্ছি। আরও কারও কারও আমার মতোই দুরবস্থা দেখে। হ্যারি পটার জিন্দাবাদ, বলুন ইচ্ছাডানা?

      Delete
  7. আমার ধারণা - তুই একটু জোর করে পড়া শুরু কর্‌। প্রথম ক'দিন অসুবিধে হবে, তারপর আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে যাবে। তবে প্রথমেই গম্ভীর কিছু দিয়ে শুরু করিস্‌না - হয় হাসির কিছু বা থ্রিলর পড়্‌।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওকে, তাই করব। কিছু একটা না করলে চলবে না।

      Delete
  8. apnar lekhata pore kano janina mone holo apni bodhoy khub taratari akta uponyas lekha shuru korben:)..amar mone howata jano sotti hoy :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ধুর, ওরকম লিখব লিখছি করে বছরের পর বছর কেটেছে। আরও অনেক বছর কাটবে।

      Delete

Post a Comment