দোল ২০১৩


বাড়িতে ঘুম থেকে উঠতে যে কী ভালো লাগে। চোখ খুলেই মনে হয়, মাথার ভেতরটা এত শান্ত কী করে? আর ঘাড়ের কাছে শিরদাঁড়াটায় দিবারাত্র যে গিঁটগুলো বেঁধে থাকে সেগুলোই বা কোথায় গেল? তারপর এক সেকেন্ড পরেই যখন বাঁদিকে জানালার শিকের ওপারের পেঁপেগাছটা আর আমার মুখের ঠিক ওপরে সিলিংফ্যানের আলতো হাওয়ায় দুলতে থাকা নীল রঙের মশারির ছাদ চোখে পড়ে তখন সব পরিষ্কার হয়ে যায়।  

ও হরি, আমি তো বাড়িতে।

আজ সকাল থেকে আমি কিচ্ছু করিনি। কিচ্ছু না মানে কিচ্ছু না। খালি এই বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওই বিছানায় গা ঢেলেছি, কিশোর ভারতী মুড়ে রেখে টিভি খুলেছি, টিভি বন্ধ করে বয়াম খুলে মুঠো ভরে নিমকি নিয়েছি, একটা একটা করে নিমকি মুখে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে “সেকি এই অবেলায় ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছো কেন গো?” বলে ঠাকুমার কাঁচাঘুম ভাঙিয়ে আবোলতাবোল বকেছি। এরই মাঝে একবার বুচিদিদিদের বাড়িতে পাড়াবেড়াতে গিয়েছিলাম। গিয়ে জেঠুজেঠির পায়ে আর বুচিদিদির গালে আবীর দিয়ে, একটা জলভরা সন্দেশ খেয়ে, জেঠির গাছে ফোটা একটা ধপধপে গন্ধরাজ তুলে নিয়ে এসেছি। ফুলটা এখন আমার পাশেই রাখা আছে। নেতিয়ে গেছে, কিন্তু এখনও সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে ফুলটা থেকে।

আমাদের বাড়িটাকে আমার খুব ভালো লাগে। কারণ আমার বাবা মা আর ঠাকুমা ছাড়া পৃথিবীতে একমাত্র এই বাড়িটাই আমাকে সবথেকে ভালো করে চেনে। বাড়ির পাঁচিল দেওয়াল রান্নাঘর কুয়োতলা ছাদ। আমিও বাড়িটাকে ভীষণ ভালো করে চিনি। এই বাড়ির বাগানে যে গাছগুলো আছে সেগুলোর প্রত্যেকটার বয়স আমি হাতে গুনে বলে দিতে পারি। কোনও কোনওটা আমার থেকেও বুড়ো আবার কোনওটা একেবারে পুঁচকে, সেদিনের। যেমন বেলফুলের গাছটা। মা আগের বছর নিজের জন্মদিনে পুঁতেছিলেন। পুরো একটি বছর মটকা মেরে পড়ে থাকার পর অবশেষে এই বসন্তে তার মাথায় দুটি সাদা কুঁড়ি উঁকি মেরেছে।

দোল খেলা হয় না অনেকদিন। একটা বয়সের পর খেলার ইচ্ছেটা চলে যায় বোধহয়। শেষে এমন হয় যে অন্যকে হুটোপাটি করে খেলতে দেখলেও বিরক্ত লাগে। ক’বছর হল দেখছি আমাদের পাড়ায় একটা বাচ্চাদের দল গজিয়েছে। তারা গরমের ছুটিতে ফাংশান করে, ডিসেম্বরের ছুটিতে ব্যাডমিন্টন খেলে আর আই পি এলের সময় পেছনের জমিটায় বল পেটায়। সে বল অবশ্য জমিতে কম, আমাদের ছাদেই বেশি থাকে। ক্ষণেক্ষণে মিহিগলায়, “জেঠি আমাদের বলটা নেব গো?” শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে মা এখন ছাদের দরজা খুলেই রাখেন, যার যখন পেছনের পাঁচিল টপকে ঘরের ভেতর দিয়ে কাদাপায়ে দৌড়ে ছাদে গিয়ে বল নামিয়ে আনে।

সেই দলের লোকজন আজ দশটা বাজতে না বাজতেই এমন হা রে রে রে করে রঙের বালতি আর পিচকিরি আর বেলুন নিয়ে মাঠে নামল যেন দেশে সদ্য স্বরাজ ঘোষণা হয়েছে। যত না খেলা, চিৎকার তার থেকে বেশি। কানের পর্দা ফাটার উপক্রম। আমি সবে গজগজ করে বলেছি, “দেখো না এই রং তুলতে কী হাল হয়” মা অমনি দয়ার অবতার হয়ে বলে উঠলেন, “আহা, বেরসিকের মতো কথা বলিস না তো সোনা। ওদেরই তো এখন চেঁচাবার বয়স। ওরা চেঁচাবে না তো কারা চেঁচাবে? তুই?”

আমি সব সইতে পারি, কিন্তু আমার রসবোধ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে মনে বড় ব্যথা পাই।

তাই একটু পরে যখন মা নিজেই ছাদ ফাটিয়ে, “এ কী এ কী?” বলে চিৎকার করে উঠলেন আর আমি দৌড়ে গিয়ে মায়ের চিৎকারের কারণটা আবিষ্কার করলাম, তখন আমার হাসতে হাসতে পেট চেপে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না।

মা বাজ পড়া গাছের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর প্রিয় বাচ্চার দল আমাদের সদ্য রং করা নীল বর্ডার দেওয়া সাদা ধপধপে পাঁচিল তাক করে একের পর একে হলুদ সবুজ গোলাপি রঙের বেলুন ছুঁড়ে টিপ প্র্যাকটিস করে চলেছে।

তারপর ঝাড়া একঘণ্টা ধরে মায়ের গজগজানি চলল। ল্যাজকাটা বাঁদর, বদমাশের ধাড়ি, ভবিষ্যতের লেবুগুন্ডা্‌, এইসব বাছাবাছা বিশেষণ ধরে মা দুষ্কৃতীদের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে লাগলেন।

আমি বললাম, “আহা মা, দোলই তো খেলেছে, আর তো কোনও দোষ করেনি। আর এটাই তো দোল খেলার বয়স। ওরা খেলবে না তো কারা খেলবে? তুমি?”

তারপরেও যে মা আমাকে পাত পেড়ে বসিয়ে এঁচোড়ের তরকারি আর বাটামাছের ঝাল দিয়ে একগাদা ভাত ঠেসেঠুসে খাওয়ালেন, সেটা তাঁরই মহত্ত্ব।

সময় সব ভুলিয়ে দেয়। পাঁচিলের রঙের দুঃখটুঃখ সব। একটু পরে যখন সবার দোল খেলা ফুরিয়ে গেল, পিচের খালি রাস্তাগুলো আর কয়েকটা গরু গায়ে রং মেখে কাত হয়ে পড়ে রইল, তখন আমি আর মা জানালা দরজা বন্ধ করে, ফ্যান তিনে চালিয়ে, পরিষ্কার ঠাণ্ডা সিমেন্টের মেঝেতে বালিশ পেতে শুয়ে পাড়াপড়শি আত্মীয়স্বজনের নিন্দেমন্দ করতে লাগলাম।

আর আমাদের কথাগুলো ফ্যানের হাওয়ায় পাক খেয়ে খেয়ে আমাদের ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আলনার কাপড়ের ভাঁজে, কম্পিউটার টেবিলের নিচে, দরজার কোণে, টুলের তলায়, যেখানে ভগবতীর মায়ের ঝাঁটা পৌঁছোয় না কে জানে কতদিন, সেসব জায়গায় মা-মেয়ের মনের কথাগুলো গিয়ে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসতে লাগল।  

জন্মের পর থেকে যত কথা আমি বলেছি, যত অকাজের ভাবনা ভেবেছি, যত বিরহের কবিতা ভেঁজেছি, সে সবকিছু এই বাড়িটার কোথাও না কোথাও জমা হয়ে আছে। বাড়িটা যত্ন করে জমিয়ে রেখেছে। আমি যখন মাঝে মাঝে বাড়িটায় ফিরে আসি, বাড়িটার দিকে ভালো করে তাকাই, আনমনে একটা কিছু হাতে তুলে নাড়িচাড়ি, সেই কথা আর ভাবনা আর দৃশ্যগুলো একলহমায় চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। কাঠের আলনাটার গা থেকে ঝুলছে আঙ্কল চিপসের ফ্যাকাশে ম্যাসকটওয়ালা কি-চেন? অমনি মনে পড়ে যায় সিমলা ট্রিপ। হোটেলের ঘরে বড়দের সঙ্গে বসে ত্রিদেব দেখতে দেখতে চিপস খাচ্ছি আর বুঁদ হয়ে নাসিরুদ্দিন আর সঙ্গীতা বিজলানির নাচ দেখছি। ঠাকুমার ঘরে ঢোকার মুখের চৌকাঠটা? পুজোর নতুন জামা পরে ছুটে ঠাকুমাকে দেখাতে যাচ্ছি, হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছি, চিবুক বেয়ে লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ঠাকুমা “আহা আহা” করে খাট থেকে খচমচিয়ে নামছেন, মা পেছন থেকে হায় হায় করে ছুটে আসছেন।

“গেল গেল, আমার মেয়ের দাঁতের সেটিং জন্মের মতো গেল...”

মা আলতো করে আমার গায়ে চাঁটি মারেন। “ভ্যাট, আমি মোটেই এই সব বলিনি, বাজে কথা বললেই হল?”

আমরা দুজনেই হাসি। মার মুখটা হঠাৎ দুঃখীদুঃখী হয়ে যায়।

-সব ফেলে পর হয়ে যাবি সোনা?

-বস্‌স্‌স্‌...... পর তো সেই কবে থেকে। বাড়ি থেকে দূর করে দিয়েছ তো প্রায় এগারো বছর হতে চলল, মনে নেই? এখন নতুন করে শোক উথলে উঠছে বুঝি?

-সেই। তুই তো আমার সোনাই থাকবি, বল?

-হোল লাইফ। না থাকার অপশন আছে নাকি? তুমি চাইলেই তো হবে না।

মায়ের মুখে আবার হাসি ফোটে।  

-অলরাইট, ভেরি গুড।

-মেম খায় চা বিস্কুট। এবার নিজে ঘুমোও, আমাকেও ঘুমোতে দাও। যত্তসব।

এই ছিল আমার এবছরের দোল। আপনারা কে কেমন করে দোলযাত্রা উদযাপন করলেন? আমার মতো বেরসিক হয়ে বাড়িতে বসে রইলেন, নাকি হোলি হ্যায় চিৎকারে পাড়া কাঁপালেন? আমাকে বলুন। আমি শুনব বলে বসে আছি। 

Comments

  1. markin deshe dol weekend e atoeb ekhono teen din haate achey.
    tomar barir goppo ta pore khub bhalo laglo. aamake je barita shob theke bhalo chinto seti promoter er haate pore ekhon jha~n chok-choke apartment complex hoye gechey...tar baranday
    kaydar grill dhore dnariye bhanga chaad tar katha mone pore :((

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইস, তোমাদের ভাঙা ছাদের কথা শুনে আমারই মনখারাপ লাগছে শম্পা। আর অনেকবছর পর আমাদের ছাদটার কী হবে ভেবে বুক কাঁপছে।

      তোমার হোলি যখন এখনও হয়নি, তাহলে বলে রাখি, হ্যাপি হোলি। খুব আনন্দ কোরো।

      Delete
  2. সময় সব ভুলিয়ে দেয়.....er porer onshotuku osadharon likhechen...apnar kothay er jonno highest five roilo...likhe jan...apnar hobe... :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. বলছেন? যাক বাঁচালেন সৌমেশ। খুব ভালো লাগল আপনার কমেন্ট পড়ে।

      Delete
  3. ah,ki bhalo lekha... :-),amio bolchi tor habe :-)aj amar dui bandhu achamka dupurbela ese amake rang makhie geche,ar tarpor sara barir mejhe,madure,table e,parday,alpo alpo abir lege ache,purota jayni akhono, bhalo kore snan korechi,kintu hat pa akhono laal ,buro boyeshe dol khela :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. তিন্নি, তুই তো আমার মায়ের মতো কথা বলছিস দেখি। বুড়ো আবার কী? পঁচিশের পর সব মনের বয়স, চন্দ্রিল বলেছে।

      ছোটবেলায় আমি যতদিন পারতাম গায়ে লেগে থাকা রং বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। 'কুল ডুড' হওয়ার আশায়। তুইও কি সেরকম করছিস?

      Delete
  4. nah amar o tomar moto obostha. Bari bose laptop khutkhat korei katalam.kono kaam nai...:(

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিষ্কাম দোল খেললে রাখী? ভেরি গুড।

      Delete
  5. Kolkata theke firlam kal. BaRi ta dekhe mon ta kharap hoye gyalo. je janlar pashe boshe Anondomyala aar Enid Blyton pray mukhosto kortam, sei janlar pashe daRiye chokhe ettukhani jol eshe gyalo. ki sundor din gulo chilo, bolo? hoyto ekhono ache...se kotha aro 10 bochor porei bujhbo nirghat :)

    khub khub bhalo likhecho...

    amar dol o oi..poRe poRe ghumono :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওটাই বেস্ট দোল সুমনা।

      বাড়িটা যে এখনও আছে সেটাই তো কত বড় পাওয়া। দেখছ তো পুরোনো বাড়ি সব কী দ্রুততায় অদৃশ্য হচ্ছে।

      Delete
  6. ki bhalo likhecho kuntaladi..ki bhishon bhalo..
    dol ami kokkhono khelina khub bhoy pai, tai ei akta utsab ami ekhane akdom miss korina, tobe tomar lekha pore barite katanor oi dupurta boddo miss korchi..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগছে স্বাগতা। আমি ছোটবেলায় অবশ্য একটুআধটু দোল খেলতাম। নিজের বয়সী বন্ধু বেশি ছিল না তাই গরুর গায়ে রং দিতাম। তবে এখন বুঝেছি ওসবে ওদের কষ্ট হয়, তাই স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে।

      Delete
    2. This comment has been removed by the author.

      Delete
    3. গরুর গায়ে রং দিতাম !! ki sanghatik! garugulo dhnushoto na??? :-)

      Delete
    4. আমি তো বন্ধ গেটের এপারে দাঁড়িয়ে ওপারে গরুর গায়ে রং দিতাম। তাছাড়া মানুষ তো ছেড়েই দিলাম, গরুরাও অনেকদিন হল আমাকে পাত্তা দেওয়া বন্ধ করেছে।

      Delete
  7. darun laglo. internet connection khub kharap obosthai, roj obantor e ashtei parchhina.

    ReplyDelete
    Replies
    1. কোনও ব্যাপার না ইচ্ছাডানা, যখন সব ঠিকঠাক হবে আবার আসবেন।

      Delete
    2. mone hochhe virus ghotito problem chhilo. ashakori apatoto ar problem hobena.

      Delete
  8. খুব মনে ধরল লেখাটা । গন্ধরাজ ফুলে মিল মিল । আমাকে রেঁধে বেড়ে সাহায্য করে যে মেয়েটি সে আমাকে দোলের দিন থেকে প্রায় সন্ধ্যায় একটা দুটো গন্ধরাজ ফুল এনে দিছছে । এত ভাল লাগছে যে কি বলব।।

    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. মিঠু, আমার খুব প্রিয় ফুল গন্ধরাজ। এত আটপৌরে অথচ এমন সুন্দর গন্ধ... আশা করি দোল ভালো কেটেছে।

      Delete

Post a Comment