বিয়ের সাজ
আমার এক পরিচিত মহিলা
সবাইকে তাঁর বিয়ের ছবি দেখাতে দেখাতে খুব গর্বিত মুখে বলেছিলেন, “আমাকে দেখে আমার
দিদির পাঁচবছরের মেয়ে তো বলছিল, ‘মা মা দেখো, ছোটমাসিকে ঠিক জগদ্ধাত্তি ঠাকুরের
মতো দেখতে লাগছে।’”
খুঁত ধরতে চাইলে ওপরের
কথাটার অনেকরকম খুঁত ধরা যায়। এক, নিজের মুখেই নিজের চেহারার প্রশংসা করা। ফিল্মস্টারেরা করলে
তাও বুঝি, কিন্তু আমার আপনার মতো দুপায়ে হেঁটে বেড়ানো সাধারণ লোক? স্রেফ পাগলামি।
কিন্তু নিজের ঢাক নিজে পেটানোর থেকেও অদ্ভুত কথা হচ্ছে এইটা ভাবা, যে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের মতো দেখতে লাগাটা একটা ভয়ানক ভালো ব্যাপার।
কিন্তু নিজের ঢাক নিজে পেটানোর থেকেও অদ্ভুত কথা হচ্ছে এইটা ভাবা, যে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের মতো দেখতে লাগাটা একটা ভয়ানক ভালো ব্যাপার।
কেনই বা কেউ সুস্থ
মস্তিষ্কে নিজেকে এরকম সাজাতে চাইবে?
আমাদের দলে ‘সাজা’
ব্যাপারটা একটা বেশ উত্তপ্ত আলোচনার বিষয়। লোকে কতটা নিজের জন্য সাজে কতটা পরের জন্য,
সাজার পেছনে কতখানি নিজেকে সুন্দর দেখানোর নিষ্পাপ ইচ্ছে কাজ করে আর কতটাই বা
নিজেকে নিয়ে অতৃপ্তি, এই নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেঁচামেচি চালাতে পারি।
কিন্তু আজ অত গভীরে যাওয়ার
দরকার নেই। আজ শুধু দেখতে ভালোলাগা খারাপলাগা নিয়েই কথা হোক।
আমার বাবা চরমপন্থী মানুষ।
জীবনের বাকি ক্ষেত্রেও, সাজের ক্ষেত্রেও। বাবার মতে পরিচ্ছন্নতার বেশি সাজা মানেই
নিজেকে খারাপ দেখতে লাগানোর রাস্তা পরিষ্কার করা। না সাজলে সবথেকে বেশি সুন্দর
দেখতে লাগে, একটু সাজলে একটু খারাপ দেখতে লাগে, আর খুব বেশি সাজলে খুব বেশি খারাপ
দেখতে লাগে। অনেকটা এই রকম।
আমি আবার অতটা নিষ্ঠুর হতে
পারি না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে লোকে সাজে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে রং মাখে, চুল
ফাঁপায়, অতখানি পরিশ্রম একেবারে জলে যাবে এমনটা কি হতে পারে? মনে হয় না। বিশেষত
সবাই যখন জানেই সৌন্দর্যের সংজ্ঞাগুলো ঠিক কী কী। ফর্সা রং, টুকটুকে ঠোঁট, আপেলরঙা
গাল, ঢেউ তোলা পেশি, উথালপাথাল চুল। এইবার লিস্টে টিক দিয়ে দিয়ে টপাটপ সেজে নিলেই
হয়ে গেল। শক্ত কাজ তো কিছু নয়।
কিন্তু তাই বলে গলায় ফুলের
মালা আর গালে চন্দনের কলকা? মাথায় চোঙা টোপর আর সি-থ্রু ধুতি? গলা থেকে পেট
পর্যন্ত থাকেথাকে নেমে আসা সোনার হার আর শুঁড়তোলা নাগরা চটি? বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ
হাঁটু পর্যন্ত লম্বা জরিচুমকি বসানো একখানা ঘোমটা আর ধাক্কাপাড়ের বাবু ধুতি?
এই সাজে কাউকে কি ভালো
দেখতে লেগেছে কোনওদিন? লাগা কি সম্ভব? যদি লাগতই তাহলে কি সবাই পুজোর সময় কিংবা
মুখেভাতের নেমন্তন্নে এইরকম সেজেগুজেই যেত না?
তবু লোকে বছরের পর বছর ধরে
বিয়ে করার সময় ওই সাজটা সেজে আসছে। শুধু সাজছে না, সেজে হাসিহাসি মুখে ছবিও তুলছে।
একসেট ছবি বন্ধুবান্ধব, আরেকসেট কাকিপিসি, আরেক সেট অফিসকোলিগদের সঙ্গে। শুধু তুলেই ক্ষান্ত হচ্ছে না,
দিকেদিগন্তরে সে সব ছবি মেল করছে, বারোয়ারি দেওয়াল পেলেই টাঙিয়ে দিচ্ছে। নিজের ওই
চেহারাটা স্থিরচিত্রে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে তার মন ভরছে না, যত্ন করে ভিডিওতে তুলে
রাখছে। তারপর শিকারি বেড়ালের মতো ফাঁদ পেতে বসে থাকছে, রাস্তা দিয়ে চেনা লোক গেলেই
ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের দেখাবে বলে।
রেগেমেগে এত কথা হুড়মুড়িয়ে
বলে হাঁপিয়ে গিয়ে দম নিচ্ছি, বান্টি পা নাচাতেনাচাতে বলল, “ধুস, তুমি কিসুই বোঝনি।
বিয়ের সময় কেউ সুন্দর দেখবে বলে সাজে না।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “বলিস
কী? খারাপ দেখাবে বলে কেউ সাজে নাকি?”
বান্টি বলল, “বিয়ের সময়
ওইরকম সাজার নিয়ম চোখে পড়ার জন্য। বরবউকে ওইরকম পাগলের মতো সাজিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে
রাখে যাতে দূর থেকেই দেখে লোকে টপ করে চিনে ফেলতে পারে। গরমের মধ্যে ভারিভারি
প্রেজেন্ট হাতে ঘেমেনেয়ে বেশি হাঁটাহাঁটি করতে না হয়।”
“তোমাদেরও রাখবে, দেখো না।”
বলে বান্টি দাঁত বার করে পা নাচায়।
আমি একেবারে মুষড়ে পড়ি।
ব্যাপারটা ক্রমেই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বোধ হয়। অলরেডি আমাকে মা সতর্ক করে
রেখেছেন, যেন বিয়ের দিন আমি একটু শান্তশিষ্ট মিতভাষী হয়ে থাকি। অন্যসময়ের মতো ক্ষণেক্ষণে
নিজের পচা রসিকতায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে অর্চিষ্মানের পিঠ চাপড়ে অট্টহাস্য করে না উঠি।
“তাহলে লোকে ভাববে বিয়ের
আনন্দে অর্চনাদির মেয়ে পাগল হয়ে গেছে। সেটা কি ভালো হবে?” মা গম্ভীর গলায় জানতে
চান।
চুপ করে থাকা ছাড়া আর কীই
বা বলার আছে আমার এর উত্তরে? তাই চুপ করে থাকি। যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলেও আমাকে
কিছু কম পাগলের মতো দেখতে লাগবে। তার মধ্যে যদি কেউ এসে জগদ্ধাত্রী-ফাত্রি বলে তা
হলে তো আর কথাই নেই। বান্টির চোখ বাঁচিয়ে আমি মনেমনে একটা ছোট্ট প্রার্থনা সেরে
নিই। আমাকে জগদ্ধাত্রী বললে যেন পাশে বসে থাকা অর্চিষ্মানকেও ‘কাত্তিকঠাকুর’ বলে
কমপ্লিমেন্ট দেয় ঠাকুর।
হোমরাচোমরা মাসি গোছের কেউ
এসে চিবুক ধরে “তোমাকে ঠিক কার্তিকের মতো দেখাচ্ছে” বললে অর্চিষ্মানের মুখটা ঠিক
কীরকম হবে ভেবে আমি নিজেনিজেই টানা দুমিনিট হেসে নিই। বান্টি আছে দেখেও কন্ট্রোল
করতে পারি না। আমাকে একাএকা হাসতে দেখে বান্টি চোখ ঘোরায়। বলে, “কাকিমা ঠিকই ভয়
পেয়েছিলেন, তুমি অলরেডি পাগল হয়ে গেছ।”
*****
সে বান্টি যা খুশি বলুকগে,
ওর কথায় অত পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু যে কথাটা বলার দরকার আছে সেটা হচ্ছে,
কালকের দোল আর নরশুর গুডফ্রাইডে মিলিয়ে বেশ একটা লম্বা ছুটির ব্যবস্থা করা গেছে।
আমি সেই ছুটিতে কলকাতা যাচ্ছি। প্রাক্বিবাহ প্রিপারেশনের জন্য। মা হাতে লিস্ট
নিয়ে হাঁ করে পথ চেয়ে বসে আছেন, এয়ারপোর্ট থেকেই পাকড়াও করে এদিকওদিক ছোটাছুটি
শুরু করে দেবেন। আমাকে পাগল সাজানোর সমস্ত ব্যবস্থা পাকা না করতে পারলে মায়ের আর
তর সইছে না।
বুঝতেই পারছেন, এই ছোটাছুটির
মধ্যে আমি অবান্তরে আসতেও পারি আবার নাও পারি। আসলে তো কথা হবেই, না আসতে পারলেও
আপনারা অবান্তরকে ভুলে যাবেন না। মাঝেমাঝে এসে দেখেশুনে রাখবেন।
আর আপনারা সবাই খুব আনন্দ করে
দোল খেলবেন। নিজে ভালো করে বাঁদুরে রং মাখবেন, চেনাশোনা কারও ওপর গায়ের ঝাল থাকলে বাঁদুরে
রং দিয়ে আচ্ছা করে সে ব্যাটার দাঁত মেজে দেবেন। আমি ফিরে এসে সে গল্প শুনব।
টা টা।
লিস্ট বানাতে ভুলো না ।
ReplyDeleteমিঠু
খেপেছ মিঠু? লিস্ট ছাড়া জগৎ অন্ধকার।
Deletearre chandaner saj darun jinish,gale na hok ,kapale dile motei kharap lage na ;-) ;-)....
ReplyDeleteবউয়ের কপালে তো? না সে লাগে না বটে, কিন্তু বাকি সবার কপালে খুব অদ্ভুত লাগে।
Deletenha..apnar lekha sabdhan e port hobe dekchi.. :D
ReplyDeleteসেকি সৌমেশ, কেন?
Delete'অন্যসময়ের মতো ক্ষণেক্ষণে নিজের পচা রসিকতায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে অর্চিষ্মানের পিঠ চাপড়ে অট্টহাস্য করে না উঠি'
ReplyDeleteeta kolpona kore-e amar dat kopati beria jachhe..
puro lekhata ekdom bumper holi special hoyeche!
থ্যাংক ইউ সৌমেশ।
Deletekake jagodhatri fatri lagey jani na...tobe tomake sheje guje singhashone boshle "cute aar sweet" lagbe shei byapare aamra
ReplyDeletenischit :)
হ্যাঁ হ্যাঁ, এই সব বলেই লোকে গাছে তোলে, তারপর সুড়ুৎ করে মইটা টেনে নেয়। ওসব আমার জানা আছে শম্পা।
Deleteআপনাকে জগদ্ধাত্রী আর অর্চিষ্মানকে কাত্তিকঠাকুর? সে আপনারা যা ভালো বোঝেন... কিন্তু শাস্ত্রমতে জগদ্ধাত্রী কাত্তিকঠাকুরের মা।
ReplyDeleteexactly. amio etai bhabchilam, but bolte sahos pachhilam na.
Deletecomment ta pore akkhan ram-bishom khelam
Deleteউফ, কী ভীষণ প্যাঁচালো মন লোকজনের। আমি একটু রসিকতা করার চেষ্টা করছিলাম, অমনি সবাই এসে শাস্ত্র আউড়ে আমাকে বিপদে ফেলতে লেগেছে।
Deleteshey bolte gele tow kartik er biyeii hobar katha noy...aboshho dakshin bharatiyo goppe kartik er biye hoyechilo....edike "dokkhni" style e biye korte gele menu ta "idli sambar roshom" rakhte hobe :((
ReplyDeleteতুমিও মাঠে নেমেছ দেখছি শম্পা। রসম নিয়ে অত মুখ ভ্যাচকানোর কিছু নেই, টকটক ঝালঝাল দিব্যি খেতে। আজকেই আমি মাকে বানিয়ে খাওয়াব ভেবেছিলাম, এদিকে দেখছি বাড়িতে আদা নেই। কাজের সময় একটা কিছু যদি হাতের কাছে পাওয়া যায়। জঘন্য।
Deletebiye te sabai ke nemontoono kore tarpor dakkhini khabar khawale mushkil achey :(
ReplyDeletejai hok menu ta pore janio....mane biye shere tere tarpor!
totokhon "suspense" thak.
ইয়েস ইয়েস, সাসপেনস।।
Delete