সিমপ্টম্
সকালবেলা ঘুম ভেঙেই
যদি টের পান ঢোঁক গিলতে পারছেন না, কানের ভেতর আগুনে সেঁকা লোহার শলাকা বিঁধছে,
মাথার ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ি পিটছে আর পাশ ফিরতে গেলে মনে হচ্ছে যেন দশটা হাতি
সারারাত আপনার শরীরের ওপর লক-অ্যান্ড-কি খেলে বেড়িয়েছে, তাহলে আপনার কেমন লাগে?
আমার আনন্দ আর বাধা
মানে না। আসছে আসছে জ্বর আসছে! ওরে তোরা কে কোথায় আছিস উলু দে, শঙ্খ বাজা...
জ্বর আমার ফেভারিট
অসুখ। অনেকেই অবশ্য জ্বরকে তার ন্যায্য সম্মান দিতে চায় না, বলে, “ধুর ওটা আবার
অসুখ নাকি, ওটা তো অসুখের সিমপ্টম্।” আমি তাদের কথায় দমি না। বলি, “তাই বুঝি?
জ্বর তাহলে আমার ফেভারিট সিমপ্টম্।”
জ্বর হল মায়ের অফিস
কামাই করার সিমপ্টম্। জ্বর হলে মা সারাদিন আমার পাশে বসে থাকবে, আর
ঘণ্টায় ঘণ্টায় গম্ভীর মুখে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপবে। মাপা হয়ে গেল ঝাঁকিয়ে
ঝাঁকিয়ে পারা নামাবে। মায়ের হাতের একশোখানা চুড়ি একে অপরের গায়ে ঠোক্কর খেয়ে
ঠুনঠুন আওয়াজ তুলবে। অনেকদিন পর্যন্ত আমি ভাবতাম ওই আওয়াজটা
থার্মোমিটারের ভেতর হয়। পিসি মাঝে মাঝে জ্বর মাপতে আসত, মেপে মায়ের মতোই ঝাঁকিয়ে
ঝাঁকিয়ে পারা নামাত। কাঁথার ভেতর শুয়ে শুয়ে আমার কী টেনশন হত! আমি বলতাম, “হয়নি,
আরও ঝাঁকাও।” পিসি বলত, “হয়েছে হয়েছে।” আমি বলতাম, “কই আওয়াজ হল না তো?”
থার্মোমিটার ঠিক করে ঝাঁকিয়ে আমার টেনশন কমানোর বদলে পিসি লুটোপুটি খেয়ে হাসত।
এখন মাও নেই, পিসিও
নেই। কিডনির রোগে ভুগে পিসি মরে গেছে বারো বছরের বেশি হয়ে গেল। মানুষ মরে গেলে লোকে
তার কথা ভুলে যায় এ কথা যারা বলে মিথ্যে বলে। পিসির কথা আমার এখনও মনে পড়ে। রোজ
মনে পড়ে। জ্বর হলে তো আরও বেশি করে মনে পড়ে। জ্বর আমার কাছে পিসির কথা আরও বেশি
করে মনে পড়ার সিমপ্টম্।
মা এখন আর অফিস যান
না। যখনই ফোন করি শুনি হয় গল্পের বই পড়ছেন না হয় দাদাগিরি দেখছেন। মায়ের বদলে
আমাকে এখন রোজ অফিস যেতে হয়। জ্বর হল আমার অফিস কামাই করার সিমপ্টম্। গিল্ট-ফ্রি কামাই। গরম জলের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বস্কে
মেল লিখি। লাস্ট লাইনে “থ্যাংকস্ ফর আন্ডারস্ট্যান্ডিং” লিখে সেন্ড করে আনন্দে
মাথার ভেতর ডিগবাজি খাই।
জ্বর হল নিজেকেই
নিজে সবরকমের নিয়ম ভাঙার অনুমতি দেওয়ার সিমপ্টম্। দাঁত মেজে এসে আবার লেপের ভেতর
ঢোকা। গল্পের বই মুখে করে সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি
খাওয়া। পড়ার বই নিয়ে গড়াগড়ি খেলেও কেউ বকবে না, কিন্তু রোগা শরীরে অত রিস্ক নেওয়া
উচিত না।
জ্বর হল টু-ডু
লিস্টে ঢ্যাঁড়া মেরে গোটা একটা দিন মাটি করার কঠোর সাধনায় ব্রতী হওয়ার সিমপ্টম্।
সারা পৃথিবী যখন হইহই করে কর্মযোগের পথে ছুটে চলবে, তখন মোক্ষের আশায় জল ঢেলে আমি
সারাদিন শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ব। তেতো মুখে কিছুই রুচবে না, কাজেই রান্নাঘরে ঢুকে
‘ফ্রম স্ক্র্যাচ’ খাবারদাবার রেঁধে সময় নষ্ট করব না। জ্বর না ছাড়া পর্যন্ত
দুধ-সিরিয়াল আর চকোলেট বিস্কুট পথ্য করব। বেডসাইড টেবিলে এক বোতল জল রাখা থাকবে। খুনখারাপি
পড়ে গলা শুকোলে যাতে বোতলে চুমুক দিয়ে গলা ভেজাতে পারি।
ছোটবেলায় বেদম জ্বর
হত আমার। দেখ-না-দেখ গা ছ্যাঁকছ্যাঁক, চোখ ছলছল। তারপর একদিন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে
দেখলাম মাথার ভেতর বড়বেলা বসে পা নাচাচ্ছে, ছোটবেলা হাওয়া। যাওয়ার সময় সঙ্গে করে
সে নিয়ে গেছে আমার ঘামরক্ত ঝরিয়ে জমানো টিকিটের বাণ্ডিল আর জ্বরকে। “আমার টিকিট
কোথায় গেল, আমার জ্বর কোথায় গেল” বলে এদিকওদিক হাতড়াচ্ছি, এমন সময় বড়বেলা বলে উঠল,
“ধুর জ্বরের জন্য মনখারাপের কী আছে। ওটা তো অসুখই না, অসুখের সিমপ্টম্। ওর বদলে
এই দেখো তোমার জন্য কত ভালো ভালো অসুখ এনেছি আমি।” এই বলে একটা মোটা প্যাকেট আমার
দিকে এগিয়ে দিল। প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখি সত্যিই প্রাপকের নামের পাশে আমার নাম লেখা।
প্যাকেটের ভেতর সারি সারি ছিপি আঁটা বীজাণুর শিশি শোয়ানো। শিশির গায়ে
সাদা লেবেলে অসুখের নাম লেখা। উচ্চাশা, টেনশন, মায়ের-কথা-না-শোনা, ইন্টারনেট...
টিকিটের বাণ্ডিলটা
আর কোনওদিন খুঁজে পাইনি, তবে গতকালের মতো একএকটা দলছুট দিনে জ্বর এখনও এসে “হাই”
বলে যায়। বড়বেলার অসুখগুলোকে পাড়াছাড়া করে একাই আমার শরীরমন অধিকার করে বসে। সারাটা
দিন জ্বরের সঙ্গে আড্ডা মারতেই খরচ হয়ে যায়, টেনশন করার আর সময়ই পাই না।
যত ভালো দিন, তত
দ্রুত কাটে। এ নিয়ম খণ্ডাবে সাধ্য কার, খোদ আইনস্টাইনের রিলেটিভিটিতে লেখা আছে। আজ
সকালে উঠে দেখছি জ্বরটর কোথাও কিছু নেই, খিদের ছুঁচোরা পেটের ভেতর টিম বানিয়ে
ফুটবল খেলছে, মোবাইলের অ্যালার্ম চিৎকার করে বলছে “তাড়াতাড়ি কর তাড়াতাড়ি কর, বেলা
যে বয়ে গেল, বিশ্বজয়ে বেরোতে লেট হয়ে যাচ্ছে যে...”
কালকের দিনটা অলরেডি
স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ছোটবেলাটাকে আজকাল মাঝে মাঝে যেমন মনে হয়। কিন্তু আমি
জানি ওটা স্বপ্ন নয়, ঘোর সত্যি। বড়বেলার মতোই বাস্তব। আর একটু বাদেই যে বাস্তবে
ঝাঁপ দেব আমি। ঝাঁপ দিতে দিতে ভাবব, কবে আবার জ্বর আসবে দেখা করতে।
Aha. Eka eka bidesh bibhnuiye jwor badhano kharap byapar, se tumi jai bolo. Sabdhane theko bapu!
ReplyDeleteআরে জ্বর বাধানো কি অত সোজা বিম্ববতী, সে রাত পোয়াতে না পোয়াতেই ভেগেছে। এখন আমি আবার যাকে বলে রাইট অ্যাস রেন। তবে আমি সাবধানে থাকব, চিন্তা কোর না।
DeleteSheki! Etodin pore blogging e phirlam ar e ki khobor! Bhalo hoye otho taratari Kuntala. Jwor howa ta emon shundor kore likhecho ... ekmatro tumi e paro. :-)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ শর্মিলা। আমি ঠিক হয়ে গেছি এখন।
DeleteAj nischoi bhalo achho Kuntala :-) . ' জ্বর' er sobcheye anonder byapar holo , ma er office chhuti... etar jonye high five .
ReplyDeleteএকদম ইচ্ছাডানা। মায়ের অফিস কামাই যেন নিজের অফিস কামাইয়ের থেকে ভালো, তাই না?
Deletetora jwar hoyeche !!ki kharap ....kintu lekhata to durdanto ...:)
ReplyDeleteহয়েছিল। এখন শরীর আবার ফুরফুরে। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম তিন্নি।
Delete"গেট ওয়েল সুন" বা তাড়াতাড়ি সেরে উঠুন গোছের কিছু একটা বলাই হয়ত রীতি, কিন্তু আপনার লেখা পড়ার পর সেটা বলতে ঠিক ভরসা পাচ্ছিনা। বরং "আনন্দে থাকুন" সেই শুভেচ্ছা জানালাম।
ReplyDeleteহাহা, থাকব থাকব। থ্যাংক ইউ সুগত।
Deleteবাব্বাঃ, জ্বরে এত মজা ! তাহলে ভরসা করে বলতেই হয় আজ দুদিন ধরে আমি বেশ জ্বরে ভুগছি। কিন্তু মজা? ওটা বোধহয় ছেলেবেলায় ফেলে এসেছি। এই মজাটা সেই সোনারঙা দিনগুলিরই অনুসঙ্গ। তোমার লেখা পড়ে বোঝা যাচ্ছে তুমি এগিয়ে গেলেও সেই দিনগুলি তোমার পিছু ছাড়েনি। প্রার্থনা করি, জ্বরেও আনন্দ কুড়িয়ে নেবার খেলাটা যেন কখনও তোমার সঙ্গ না ছাড়ে।
ReplyDeleteএ মা, জ্বরে ভুগছেন নাকি মালবিকা? ষাট ষাট। ভালো হয়ে উঠুন তাড়াতাড়ি। উঠে চিড়িয়াখানায় রোদে পিকনিক করতে যান, এই কামনা করি।
Deleteওগো, তুমি তো আমার কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া দিদি মনে হচ্ছে গো! ছোটবেলায় জ্বর হলে আমিও সারাদিন গল্পের বই নিয়ে বিছানায় লুটোপুটি দিতাম। সঙ্গে বাড়তি পাওনা হল মা একটু বেশি বেশি যত্ন করবে, বাবা মাঝে মাঝে মাথা টিপে দেবে। বড়বেলায় জ্বরটা আসেই না প্রায়। এলেও সেই একই, হালকা ভাত-ডাল-আলুভাজা খেয়ে গল্পের বই আর ঘুম। দ্যাট রিমাইন্ডস মি, অনেকদিন জ্বর হয়নি :P
ReplyDeleteএবার আমি একটু একটু রেগে যাচ্ছি। লোকজন আমার একমাত্র কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া দিদিতে ভাগ বসাচ্ছে!
Deleteহাহা সুগত, আরে রাগের কী আছে, হয়ত আমি আপনি আর প্রিয়াঙ্কা হারিয়ে যাওয়া ট্রিপলেট, সেটা আরও কত ইন্টারেস্টিং বলুন দেখি।
Deleteপ্রিয়াঙ্কা, তোমার কমেন্টের উত্তরে যদি লিখি, "বালাই ষাট, কামনা করি অবিলম্বে তোমার জ্বর আসুক (বেশি না, অল্প করে)" তাহলে সবাই আমাকে গণপিটুনি দেবে। কাজেই সে কথা আর বলছি না। যাই হোক, তোমার মন্তব্য পড়ে হঠাৎ আলুভাজা-ক্রেভিং হচ্ছে। জঘন্য ব্যাপার।
arre dada, ragben na please! kuntala di kromosho sarbojoneen didi hoye jachhe, seta bhalo na kharap se nijei bichaar koruk :P
Deleteসর্বজনীন দিদি-টা একটা মারাত্মক ব্যাপার প্রিয়াঙ্কা। ব্যাপারটার ভালোমন্দ বিচার করা সত্যি কষ্ট।
DeleteChoto belay Ma r chuti niye barite boshe thakatai bodh hoy jor er sabtheke bhalo oshudh mone hoy ekhon.Baddo dukkho holo bhai apnar lekhata pore...nijer choto belar jor er dingulo bhebe mon ta baro dukhkhu bilashi hoye jachche.
ReplyDeleteকথাকলি, আরে দুঃখের কী আছে। ছোট থাকলে তো ছোটবেলার মর্ম কোনওদিনও উপলব্ধি করতেই পারতাম না। ভাগ্যিস বড় হয়েছি। সেই কথা ভেবে দুঃখ ভুলে আনন্দে লাফান।
DeleteApnar reply dekhe dukhkho bhullam kina janina ...tobe ajantei mukh thrke ekta "hehe"beriye galo:D
ReplyDeleteভেরি গুড।
Delete