শনিরবি
হ্যালোউইনের রাত তখনও
পুরো পোহায়নি। আকাশে ঘন কালো মেঘ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা
টি-শার্ট, সোয়েটার, ব্লেজার ফুটো করে হাড়ের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। এমন সময়ে কোন
জায়গায় বেড়াতে যেতে অতি বড় পাগলেও মানা করবে?
গোরস্থান। কিন্তু
আমি যেহেতু পাগল নই আর আমি যেহেতু নিজের ভালো বুঝি না, তাই শুক্রবার (ফ্রান্সে
সেদিন পাবলিক হলিডে ছিল) সকাল হতে না হতে হানা দিয়েছিলাম Père Lachaise গোরস্থানে।
Père Lachaise প্যারিসের সবথেকে
বড় গোরস্থান, Père Lachaise-এর বয়স দু’শোর বেশি,
Père Lachaise-এর প্রথম
বাসিন্দা মোটে পাঁচবছর বয়সের একটি বালিকা। শেষ বাসিন্দার নাম এখনও বলার সময় হয়নি,
কারণ Père Lachaise-তে এখনও নতুন কফিন
ভর্তি নেওয়া চলছে। তবে অ্যাপ্লিকেশনের লাইন প্রচুর, অ্যাডমিশনের নিয়মকানুনও ভয়ানক কড়া।
Père Lachaise দেখতে এইজন্য
যাওয়া কারণ এখানেই শেষ শয্যায় শুয়ে আছেন ভিক্টর হিউগো, বালজাক, প্রুস্ত, অস্কার
ওয়াইল্ড, শপ্যাঁ, জিম মরিসন এবং আরও অনেক খ্যাতনামা লোক। Père Lachaise নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবথেকে বেশি নক্ষত্রখচিত গোরস্থান।
প্যারিসের
এই পাড়াটার নাম হল গিয়ে Le Marais, প্যারিসের বিখ্যাততম শপিং ডিস্ট্রিক্ট, আর এই বাড়িটা হচ্ছে
প্যারিসের বিখ্যাততম ডিপার্টমেন্ট স্টোর, Bazar de
l'Hôtel de Ville, সংক্ষেপে BHV। সাততলা
বাড়ি। বেসমেন্টে DIY। একতলা আর দোতলায় মহিলাদের জামাকাপড় জুতোমোজা
গয়নাগাঁটি। তিনতলায় ডায়রি, জার্নাল, ছবি আঁকার জিনিস, হ্যান্ডমেড পেপার, পেন,
পেনের কালি। চারতলায় রান্নাঘরের বাসনকোসন, হাতাখুন্তি, এসপ্রেসো মেকার, বাহারি
অ্যাপ্রন। পাঁচতলায় ঘর সাজানোর জিনিস, আলো। ছ’তলায় ছোটদের রাজ্যপাট, খেলনা, কমিকস।
সাততলায় বিছানা, বিছানার চাদর, চেয়ার, চেয়ারের গদি, ডাইনিং টেবিল, টেবিলের ঢাকা।
ছেলেরাও বঞ্চিত হননি, বরং তাঁদের জন্য রয়েছে আরেকটা গোটা
তিনতলা বাড়ি, এই বাড়িটার ঠিক পেছনেই।
BHV-র একেবারে নাকের ডগায়, প্যারিসের টাউন হল Hôtel de Ville। সেই
তেরোশ সাতান্ন সাল থেকে এটাই হচ্ছে প্যারিসের মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের ঠিকানা।
আর এই যে অনিন্দ্যসুন্দর চত্বরটা দেখছেন, এর নাম Place de l'Hotel de Ville -
Esplanade de la Libération। ওই ফোয়ারাগুলোর ওধারেই সেন নদী বয়ে চলেছে।
এই জায়গাটা দেখতে যেমন ভালো, তেমনি ইন্টারেস্টিং।
অনেককাল আগে এটা ছিল সেন নদীর তীরে বালি আর নুড়ি মেশানো একটা বিচ মতো, যেখানে কাঠ,
গম আর মদবোঝাই জাহাজেরা এসে নোঙর ফেলত। সকাল থেকে লোকজন কাজের খোঁজে এখানে হত্যে
দিয়ে বসে থাকত। কখন জাহাজ আসবে, কখন জাহাজ থেকে কাঁধে করে মালের বস্তা নামাতে লোক
লাগবে। তাদের ভিড় করে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকার কথা মাথায় রেখে এই জায়গাটার নাম তখন
ছিল Place de Greve, অর্থাৎ কি না, প্লেস অফ “Voluntary stoppage”। আর এই জায়গাটার এই চরিত্রটা থেকেই আমাদের একটা ভীষণ
চেনা শব্দ এসেছে। শব্দটা হচ্ছে Strike। ওয়েবস্টার দ্যাখস-নাড়ি যার মানে বলছে Stop work by ganging up to get a raise.
তারপর
তো বন্দরটন্দর উঠে গেল। Place
de Greve নাম বদলে হয়ে গেল Place de l'Hotel de Ville। পাবলিক শাস্তিপ্রদানের ব্যাপারস্যাপার সব এখানেই
সারা হত। শিরচ্ছেদ, জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি। পৃথিবীর প্রথম গিলোটিনে
মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল এই চত্বরেই। নিকোলাস নামের এক ছিঁচকে চোরকে চাপানো
হয়েছিল সেদিন গিলোটিনে। সে সময় এই সব প্রকাশ্য শাস্তিদান দেখতে রথের মেলার মতো ভিড়
হত। শোনা যায়, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা ইত্যাদির তুলনায় অসম্ভব দ্রুততায় পুরো
ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাওয়ায় লোকের আমোদে কম পড়ে এবং তারা গিলোটিনের বিরুদ্ধে নিজেদের
ক্ষোভ জানায়।
এখন
অবশ্য সে সব স্মৃতি। এখন এই জায়গাটায় বিকেলবেলা ছোট মেয়েরা বাবার কাঁধে চেপে খেলা
দেখতে আসে।
এখন প্যারিসের চেহারা ঠিক এইরকম। সারাদিন বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা আর হাওয়া আর
কাঁপুনি। এই ওয়েদারে কারও রান্না করতে ইচ্ছে করে? সারাদিন গ্যালন গ্যালন চা খাই,
তাতেই পেট ভরে যায়। গত দু’দিনে মাত্র একবার গ্যাস জ্বালিয়েছি। এই নিচের রান্নাটা
করতে।
ইনপুট
আউটপুট
chobigulo khub sundar :) :)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ।
Delete' নক্ষত্রখচিত গোরস্থান' - darun. Khabarer input output dutoi besh laglo. :-) ar store o khubi lobhonio .
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা।
Deleteআবার সেই দারুণ উপভোগ্য চিত্তাকর্ষক ইতিহাসঘেঁষা ধারাবর্ণনা। তোমার লেখার এই দিকটা প্রশংসা দাবি করে।
ReplyDeleteবেড়াবার জন্য, বিশেষ করে মন খারাপ সারাতে, গোরস্থান বেশ ভাল জায়গা, নয় কি? বিশেষ করে এইরকম নক্ষত্রখচিত হলে। আরো আছে। তুমি হয়তো মন ভার করে কোন একটা সমাধির উপর বসে আছ চমৎকার বলে একটা সিনেমায় শাহ্রুখের মত। এমন সময় ভূত নাসিরুদ্দিনের মত কেউ যদি তোমায় এসে হ্যাল্লো বলে?
সেটা হলে অবশ্য কেলেঙ্কারি হত মালবিকা। ভূতের সঙ্গে হাইহ্যালো করার আমার কোনও ইচ্ছেই নেই, তা সে জিম মরিসনের ভূত হলেও না।
Deleteছবি লেখা সবই খুব সুন্দর, সে তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই। স্মৃতি জিনিসটা খুব অদ্ভুত, জানেন? আপনার ওই বাজার না হোটেল না ডেভিল কি দোকানটার ছবি দেখে আমার আরেকটা প্যারিসের দোকানের ছবি মনে পড়ে গেল, আমার বাবার তোলা। সেটাও বিরাট। নামটা খানিকক্ষণ ব্রেনের মধ্যে হাতড়ে রাজ্যের জঞ্জাল ঘেঁটে বের করে এনে ঝেড়ে-ঝুড়ে দেখি : Printemps. আপনি গেছেন কি সেখানে?
ReplyDeleteউঁহু যাইনি তো। সময় পেলে যাব।
Delete