কালোকোট
“বোঁজুঁ মাদাম”
সম্ভাষণকারীর চেহারা
না দেখে, শুধু গলা শুনেই আমি বুঝতে পেরে গেলাম, ইনি যিনিই হোন না কেন, এঁর
উদ্দেশ্য সাধু হতে পারে না।
ফ্রেঞ্চ আমি কিছুই
শিখিনি, কিন্তু টোন-ডিফনেস যাকে বলে সেটা এতদিনে কেটে গেছে। শব্দের তাল, লয়, মীড়, পর্দা
ইত্যাদি শুনে শত্রুমিত্রর তফাত করতে পারি। BHV-র তিনতলার কিচেন
সেকশনের সেলস্মহিলাটির অবোধ্য বিড়বিড়ানি শুনেই বুঝে গেছিলাম যে উনি আমার মিত্রতা
চান না। অবশ্য উনিও আমাকে দেখে বুঝে গেছিলেন যে আমি প্যারিসের ম্যাপ আঁকা
টেবিলম্যাট কিনব না, খালি দেখছি। জিনিসপত্র না কিনে খালি দেখলে অনেক সেলস্পার্সন
ভয়ানক রাগ করেন এটা আগেও দেখেছি। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। তবে মাঝে মাঝে
মনে হয়, ক্রুদ্ধ বিদেশী বিড়বিড়ানির উত্তরে আমি বাংলায় দু’লাইন বিড়বিড় করলে
অন্যপক্ষের মুখটা কেমন হয় দেখি। রাগের বিড়বিড়ানি হতে হবে তার কোনও মানে নেই। নিচু
স্বরে দু’বার “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার...” বললেও হবে। কাজে করিনি
এখনও, সাহসে কুলোয়নি, তবে করে দেখার ইচ্ছে আছে। করলে আপনাদের বলব।
আবার আমাদের ভেন্ডিং মেশিনের সামনে সেদিন একটা কনভারসেশন হচ্ছিল, মূলত একতরফা।
উল্টোদিকের ভদ্রলোক খুব উত্তেজিত হয়ে হাত-পা নেড়ে কী বলছিলেন, আমি কিচ্ছু বুঝতে
পারছিলাম না। কেবল মাথা নেড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু উনি যে আমার ওপর রেগে নেই সেটা বেশ
বোঝা যাচ্ছিল। তারপর আমাদের দ্বাররক্ষক ভদ্রলোক এসে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন।
অন্য ভদ্রলোকটি ভেন্ডিং মেশিন অফিসে কাজ করেন, নির্দিষ্ট সময় বাদে বাদে এসে বাছাই
করা অস্বাস্থ্যকর খাবারদাবার মেশিনে পুরে দিয়ে যান। সেদিন উনি সবে মেশিন বোঝাই করে
দরজায় তালা মেরেছেন, আর আমি অমনি কয়েনের থলি নিয়ে এসে মেশিনের ওপর হামলে পড়েছি।
ভদ্রলোক আমাকে অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, কোকাকোলা ইত্যাদি এখনও ঠাণ্ডা
হয়নি, কাজেই আমি যেন ঘণ্টাদুয়েক ঘুরে এসে আবার ট্রাই করি।
কী ভালো লোক বলুন দেখি।
যাই হোক, যে কথা হচ্ছিল। সেদিন অফিস যাওয়ার পথে আমি সবে একটা মেট্রো থেকে নেমে
ঊর্ধ্বশ্বাসে আরেকটা মেট্রো ধরব বলে ছুটছি, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন
শিরদাঁড়া-জমানো, ঘাড়ের-চুল-খাড়া-করানো কণ্ঠে বলে উঠলেন, “বোঁজুঁ মাদাম।”
থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে দেখি, কালোকোট। ডান হাতে একটা স্ক্যানার-জাতীয় যন্ত্র
নিয়ে, বাঁ হাত চিত করে পেতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। গোলগোল দু’চোখের ভঙ্গি অনেকটা, “পালাবে
কোথায় বাছাধন?”
ছোটবেলায় আপনার বাবামা, গুরুজনেরা কী বলে ভয় দেখাতেন? খেতে না চাইলে, ঘুমোতে
না চাইলে, পড়তে বসতে না চাইলে? জেনেরিক ‘জুজু’ বললে হবে না। দেশকালসমাজভেদে জুজুও
ভিন্ন ভিন্ন হয়। ইভানভ আর মাশকা নামের শিশুদের যেমন দুষ্টু নেকড়ের ভয় দেখানো হয়,
স্তেফান আর উরসুলাদের যেমন চিনির জানালা, ক্যান্ডির ছাদ আর জিঞ্জারব্রেডের
দেওয়ালওয়ালা বাড়িতে থাকা পাজি ডাইনিবুড়ির ভয় দেখানো হয়, রেললাইনের পাড়ায় থাকা
ছানাপোনাদের দৌরাত্ম্য থামাতে গেলে বাবামায়েরা তেমন একটিবার খালি বলেন, “ওই, ওই
কালোকোট এল বলে...দাঁড়া তো...”
আর অমনি যেন সাপের মাথায় ঝপ করে একবালতি ধুলো পড়ে।
রিষড়ার মতো রেললাইন-সর্বস্ব মফস্বল শহরের নাজেহাল বাবামায়েদের কাছে “কালোকোট”
সবথেকে এফেক্টিভ জুজু ছিল। আরেকজন জুজুও ছিলেন, তাঁরও কেরামতি একরকম
রেললাইন-কেন্দ্রিকই ছিল---তিনি হচ্ছেন লেবুগুণ্ডা। মালগাড়ি-ভাঙা থেকে ফুরসৎ পেলে
তিনি অনেকসময় স্টেশনের বাজারে আলুপটল কিনতে আসতেন শুনেছি। বাবা রাতে বাড়ি ফিরে
সিঁড়ির তলায় সাইকেল রাখতে রাখতে মা’কে বলতেন, “আরে আজ দেখি বাজারে গোটাদশেক বাইকে
সাঙ্গোপাঙ্গ চাপিয়ে লেবু এসেছে। আমি সবে বাজার শেষ করে টাকা দিচ্ছি আর আমার পেছন থেকে
একটা চ্যালা গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করছে, “অ্যায়, পালংশাক কত করে রে?”’
আমার বাবামা অবশ্য কখনও লেবুগুণ্ডার ভয় দেখিয়ে পড়তে বসাননি আমাকে। লেবুর প্রতি
তাঁদের মনোভাবটা ভয়ের থেকে করুণার বেশি ছিল। কাগজে ছয়ের পাতায় মাঝে মাঝে লেবুর
কীর্তি ফলাও করে ছাপা হত, সে খবর পড়ে এই-সেদিন-রেলের-মাঠে-হাফপ্যান্ট-পরে-খেলে-বেড়ানো-লেবুর
পরিণতি নিয়ে বাবাকে সখেদে মাথা নাড়তে দেখেছি।
কাজেই আমাদের জুজু ছিল কালোকোট। শুধু ছানাপোনা নয়, কালোকোটের প্রতি বিতৃষ্ণার
ভাবটা ছেলেবুড়োনির্বিশেষে সকলের মধ্যেই দেখা যেত। ট্রেন স্টেশনে ঢোকা মাত্র কামরার
ভেতর থেকে সহমর্মী সহযাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত যাত্রীদের উদ্দেশ্যে,
“সামলে, সামলে, গাড়িতে কালোকোট আছে” ইত্যাদি সাবধানবাণী হাঁকতেন। অনেকে আবার
চেঁচাত, “মামা আছে, মামা!” প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত যাত্রীরা, যাঁরা এতক্ষণ মিনিটে
তিনবার করে ঘড়ি দেখছিলেন আর একটা ট্রেনও টাইমে আসে না কেন সেই নিয়ে রেলমন্ত্রীর
মুণ্ডুপাত করছিলেন, তাঁদের মধ্যে হঠাৎই অসম্ভব উদাসীনতা লক্ষ্য করা যেত। ভাবটা
অনেকটা, এটায় বড্ড ভিড়, পরের ট্রেনটাতেই না হয় যাওয়া যাবে। প্ল্যাটফর্মশুদ্ধু লোক
যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকত, ট্রেন এসে লোক নামিয়ে, খান দু-তিনেক লোক তুলে, ভোঁ
বাজিয়ে হেলেদুলে চলে যেত। একবার রটনা শুনেছিলাম, কয়েকজন ডেলিপ্যাসেঞ্জার নাকি
এমনিই বানিয়ে বানিয়ে কালোকোটের ধুয়ো তুলতেন, যাতে কেউ না ওঠে আর তাঁরা ফাঁকা কামরায়
আরাম করে তাস পেটাতে পেটাতে যেতে পারেন। তবে সত্যিমিত্যে জানি না।
আমি নিজে কখনও কালোকোটের পাল্লায় পড়িনি। মানে যে রকম পাল্লায় পড়লে বিপদ, সে
রকম পাল্লায় পড়িনি। মাঝে মাঝে হাওড়া দিয়ে বেরনোর সময় লাইন দিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে
থাকতেন, আমি মান্থলি বার করে দেখালে ব্যাজার মুখ আরও ব্যাজার করে পথ ছেড়ে দিতেন।
তবে আমার চেনা অনেকেই কালোকোটের পাল্লায় পড়েছে। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে
অদিতিসাহানাদের সঙ্গে ক্যাঁচরম্যাচর করতে করতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছি, এমন সময় দেখি
একজন খুব চেনা দেখতে ভদ্রমহিলা হাতপা নেড়ে এক কালোকোটকে কী সব বোঝানোর চেষ্টা
করছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, চেনা মানে ভীষণই চেনা। আমার বাড়িতেই থাকেন, দিবারাত্র
আমাকে বকেনঝকেন। গুটিগুটি এগিয়ে গিয়ে শুনি আমার মা প্রাণপণে কালোকোটকে বোঝানোর
চেষ্টা করছেন যে তাঁর মান্থলি টিকিট এই সবে মাত্র ফুরিয়েছে, তিনি খুবই লজ্জিত যে
তিনি সেটা খেয়াল করতে পারেননি ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সব শুনে কালোকোট বঙ্কিম হেসে
বলছেন, “সবাই ওইরকমই বলে।” মা মুখ লাল করে বলছেন, “আমি বলছি না।”
অবশ্য কালোকোটকে আর পাঁচটা জুজুর সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। বাকি জুজুদের
সঙ্গে কালোকোটের তফাৎটা হচ্ছে এই জায়গায় যে কালোকোটের ভয়ের এলিমেন্ট হচ্ছে কোটটা,
কোটের ভেতরের মানুষটা না। সেরকম মানুষ আমাদের পাড়াতেই দু’জন ছিলেন। একজনের নাম
ভোম্বল রায়, আরেকজনের নাম শেখর সরকার। আমাদের পাড়ায় ওই দুটি লোকের থেকে নিরীহ লোক
অর্ডার দিলেও আর খুঁজে বার করা যাবে কি না সন্দেহ। অথচ ওঁরাই যখন রোজ সকালে কালো
কোট চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেন, পাড়ার কুকুরবেড়ালগুলো পর্যন্ত ল্যাজ গুটিয়ে ঝোপে
লুকোত।
ভোম্বলবাবুর সঙ্গে আমার বাবার বেশ খাতির ছিল। অফ কোর্স, কোটহীন ভোম্বলবাবুর
সঙ্গে। কোটপরা ভোম্বলবাবু পাড়ায় ছিলেন নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন। কোটহীন ভোম্বলবাবুর গান,
বাগান নানারকমের শখ ছিল। আমার বাবার বাগানে ঝোঁক নেই কিন্তু গানে আবার সাংঘাতিক। গহরজান
আর গুলাম আলি দেওয়ানেওয়া করতে করতে দুজনের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল বেশ। মাঝে মাঝে
রবিবার সকালে কোটহীন ভোম্বলবাবু আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। চাবিস্কুট খেতে খেতে
গল্প গান ছাড়িয়ে এদিকওদিক ডালপালা মেলত। সেরকম এক রবিবারে ভোম্বলবাবু তাঁর
কর্মজীবনের ইতিকথা বলছিলেন। কী করে দ্বারভাঙ্গা থেকে কলেজ শেষ করে এসে রেলের
পরীক্ষা দিয়ে এই টিটি*-র চাকরি পেয়েছিলেন তিনি, সে গল্প। আমরা প্রথমটায় চুপ করে কাঠ
হয়ে বসেছিলাম, বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করছিলাম না, কিন্তু ভোম্বলবাবুর মুড এসে
গিয়েছিল। তিনি বলছিলেন, “বৌদি, এই লাইনে থেকে যে কতরকমের মানুষ দেখলাম, জানলাম-চিনলাম,
ভাবতে পারবেন না।” ক্রমশ গল্পের তোড়ে আড় ভেঙে গেল। আমরাও চেয়ারের কানায় এগিয়ে বসে
নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলাম।
“আচ্ছা, এই যে শোনা যায় টিটি-রা লোকের মুখ দেখেই ধরে ফেলতে পারে কে টিকিট
কেটেছে আর কে কাটেনি, সত্যি? নাকি মিথ?”
ভোম্বলবাবু ক্রিমক্র্যাকারে কামড় দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। ট্রেড সিক্রেট
ফাঁস করতে চান না, এমন ভাব করে। তারপর বললেন, “সে তো মেজদা, অন্যায় করলে মুখে একটা
ছাপ পড়বেই, পড়বে না বলুন? টিকিট কাটছ না মানে সোজা কথায় সরকারের ঘরে সিঁধ কাটছ। সে
পাঁচটাকার সিঁধই হোক কি দশটাকার সিঁধই হোক। চুরি ইজ চুরি।”
চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে ভোম্বলবাবু এবার সেই অমোঘ সত্যিটা উচ্চারণ
করলেন, “এ দেশে সবাই যদি টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ত, তাহলে দেশের সবকটা রেললাইন সোনা
দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া যেত, বুঝলেন বৌদি। খাঁটি সোনা।”
কালোকোট নিয়ে আরেকটা গল্প মনে পড়ছে, যেটা বলে উঠব। না বলে উঠব না কারণ গল্পটা
আমার ভীষণ প্রিয়। গল্পটায় আমার ছোটবেলা আছে, ট্রেন আছে, গান আছে, গানের মাস্টারমশাই
আছেন, আর আছে রাকেশদা। আমি যখন সবে হারমোনিয়ামের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে চিঁহিগলায় “পিয়া
কে নজরিয়া যাদুভরি” গাইতাম তখন রাকেশদা রামকলিতে চৌষট্টিমাত্রার তান অবলীলায়
নামাত। মাস্টারমশাইয়ের স্টার ছাত্র ছিল রাকেশদা। একদিন রবিবার বিকেলে মায়ের হাত
ধরে মাস্টারমশাইয়ে দেড়তলার ঘুপচি ঘরে ঢুকে দেখি হারমোনিয়ামের ওপারে মাস্টারমশাই শিরদাঁড়া টানটান করে ভুরু কুঁচকে বসে আছেন, এপারে রাকেশদা
মুখ কাঁচুমাচু করে বসে আছে, আর হারমোনিয়ামের ওপর গ্যাঁট হয়ে বসে আছে একটা জাম্বো
মিষ্টির প্যাকেট। শ্রীরামপুরের বেস্ট ময়রার মিষ্টি।
রাকেশদা সরকারি চাকরি পেয়েছে। রাকেশদার আর গান গাওয়ার সময় হবে না। রাকেশদার
আজই মাস্টারমশাইয়ের কাছে গান শেখার শেষ দিন।
মাস্টারমশাইয়ের কাছে এ দৃশ্য নতুন নয়। তাঁর হাতে গড়া কত ছাত্রছাত্রীকে যে চাকরি
আর বিয়ের চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে তার লেখাজোখা নেই। রাকেশের আগেও অনেক গেছে, পরেও
অনেক যাবে। মাস্টারমশাইয়ের আর দুঃখ হয় না। মাস্টারমশাই রাকেশদাকে বললেন, “যা পারিস
কর। যে চুলোয় যেতে চাস যা। একটাই কথা, গান গাইতে হবে না, শোনাটা ছাড়িস না। কোনও
কথা শুনিসনি কোনওদিন, এই কথাটা শুনিস।”
তারপর মাসছয়েক কেটে গেছে, মাস্টারমশাই কলকাতা গিয়েছিলেন কী একটা কাজে, কাজ
সারতে সারতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। হাওড়া স্টেশনে যখন ঢুকলেন তখন মাস্টারমশাইয়ের
দেহে মনে আর একটুও শক্তি অবশিষ্ট নেই। পাঁচে একটা বর্ধমান দিয়েছে। মাস্টারমশাই
সোজা সেটায় উঠে একটা খালি সিট দেখে বসে, দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে ফেললেন।
ভরসন্ধ্যের ট্রেনটা যখন কয়েকটা সিট খালি থাকতেই ছেড়ে দিল, তখনই মাস্টারমশাইয়ের
সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হল না। সন্দেহটা মাস্টারমশাইয়ের হল যখন লিলুয়া,
বেলুড় হুশহুশ করে জানালার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, বালি আসব আসব করছে এদিকে ট্রেনের
গতি কমার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তখন। পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করে মাস্টারমশাই
জানলেন, ট্রেনটা গ্যালপিং, ফার্স্ট স্টপ চন্দননগর।
আবার দেওয়ালে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে ফেলা ছাড়া মাস্টারমশাইয়ের আর কিছু করার ছিল
না।
রেললাইনের লোকদের মাথার ভেতর অ্যালার্ম লাগানো থাকে। শ্রীরামপুর ঢোকার আগে
মাস্টারমশাইয়ের চটকা ভেঙে গেল। গাড়ি থামল না, প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেল, আর
ঠিক তক্ষুনি মাস্টারমশাই দেখলেন কামরার ওইপ্রান্ত থেকে দুটি পুলিশকে দুদিকে নিয়ে
এক কালোকোট এগিয়ে আসছেন। মাস্টারমশাইয়ের কাছে আসতে এখনও দেরি আছে, কিন্তু চন্দননগর
আসার আগেই যে এসে পড়বেন সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মাস্টারমশাইয়ের পকেটে টিকিট আছে
একটা, শ্রীরামপুর পর্যন্ত।
কপালের দু’পাশে দপদপ করতে থাকা শিরাদুটো টিপে মাস্টারমশাই মুখ নিচু করে বসে
রইলেন।
টিটি মাস্টারমশাইয়ের খোপে ঢুকে পড়েছে, কামরাজোড়া নিস্তব্ধতা, জানালার বাইরে
নিকষকালো অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ট্রেনটা প্রাণপণে ছুটছে। যথেষ্ট জোরে ছুটছে না বলাই
বাহুল্য কারণ চন্দননগর আসেনি এখনও।
টিটি মাস্টারমশাইয়ের ডানদিকের লোকটার সামনে হাত পাতল, টিকিট পাঞ্চ করল। টিটির হাত
মাস্টারমশাইয়ের নাকের তলা দিয়ে চলে গিয়ে বাঁদিকের লোকটার সামনে থামল। মাস্টারমশাইয়ের
হৃদপিণ্ডে তখন জাকির হুসেন ঝাঁপতাল ঝালায় তুলেছেন। কী হচ্ছে কিছু বোঝার আগেই টিটি
সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের চ্যানেল ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
চন্দননগরে নেমে মাস্টারমশাই সবে ওভারব্রিজ টপকে ডাউন প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার
উপক্রম করছেন, এমন সময় পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “একটু দেখে ট্রেনে উঠবেন তো
মাস্টারমশাই, বাড়ি ফিরতে কত দেরি হয়ে গেল।
কাকিমা কত ভাবছেন বলুন তো।”
চেনা গলা। চেনা স্কেল। চেনা উচ্চারণ। চেনা দম ছাড়া। মাস্টারমশাই বোঁ করে পেছন ঘুরতেই
রাকেশদা একগাল হেসে মাস্টারমশাইয়ের পায়ে উপুড় হয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়ালে পর মাস্টারমশাই
মুখের হাঁ বন্ধ করে তাঁর কালোকোট পরা প্রাক্তন ছাত্রের কান মুলে, চুল ঘেঁটে, পিঠ
চাপড়ে বলতে লাগলেন, “হতভাগা ছেলে, তোর ভয়ে আমি এতক্ষণ কেঁচো হয়ে ছিলাম! অলপ্পেয়ে,
অলম্বুষ!”
চেকার সাহেবের হেনস্থা দেখে সঙ্গের পুলিশদুটো খুব দাঁত বার করে হাসতে লাগল।
*****
বান্টি বলে এইটাই আমার দোষ। গল্প একজায়গায় শুরু করে কমপ্লিটলি অন্য জায়গায়
গিয়ে থামি। গল্পটা শুরু হয়েছিল শত্রুভাবাপন্ন “বোঁজুঁ মাদাম” সম্ভাষণ এবং তারপর
ফ্রেঞ্চ কালোকোটের সঙ্গে মোলাকাত দিয়ে। সে মোলাকাতের পরিণতি জানতে যাঁরা এখনও
উৎসুক তাঁদের জন্য বলি, আমার পকেটে টিকিট ছিল, বার করে সেটা দেখাতেই কালোকোট গোমড়া
মুখে “মেহ্সি” বলে নতুন শিকারের সন্ধানে হাঁটা দিয়েছিলেন। আমিও টিকিট ফের জিনসের পকেটে পুরে, মনে মনে
বেশ করে কালোকোটকে মুখ ভেংচে, নিজের রাস্তা ধরেছিলাম।
*আসল কথাটা টিটিইঃ ট্রেন ট্র্যাভেলিং টিকেট এক্সামিনার। কিন্তু তখন আমি মূর্খ ছিলাম, অতশত
জানতাম না। সকলেই টিটি বলত, আমিও শুনে শুনে টিটি বলতাম। ছোটবেলার অসম্মান করব না
বলে ঠিক কথাটা এখন জানা সত্ত্বেও গোটা লেখাটায় ‘টিটি’ লিখলাম। আশা করি আপনারা কিছু মনে
করবেন না।
Daroon daroon. Kalocoat der amar khub bhalo laage. Khub chhotobelay (amar tokhon 5/6 bochhor boyesh) ami ekbaar TT ke biye korbo bole bayna dhorechhilam. Amar dharona chhilo TT jodi amar bor hoy tahole ami binipaisay hilli dilli kore berate parbo.
ReplyDeleteDurpallar trainey bangali TT ra amar favourite. Sedin Kolkata Rajdhani te ek kalocoat eshe, pasher uttor bharotiyo lokta ke waiting list howa sotweo khub kore boke, amar songe pujor somoy pabda ar rui machher rate niye goppo kore, oboleelakrome chole galo. Ticket dekhteo chailo na!
হাহাহা বিম্ববতী, কী ভালো বায়না। তোমার বাড়ির লোকের তখনকার মুখগুলো আমার দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। বাঙালি টিকিট চেকারদের পার্শিয়ালিটি জগৎবিখ্যাত। আমার বাবার এক পরিচিত চেকার (বলতে গিয়ে টের পেলাম, আমার বাবার একাধিক টিকিটচেকারের সঙ্গে পরিচিতি আছে, কী সাংঘাতিক!) একবার, ওই রাজধানীতেই, আমার পরিচয় আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। আর যায় কোথায়, তারপর আধঘণ্টা পরপর নিজে এসে, লোক পাঠিয়ে, "অসুবিধে হচ্ছে না তো? খিদে পাচ্ছে না তো?" এই সব হচ্ছিল। সে যে কী বিপদ কী বলব। উপরি ঝামেলা, সহযাত্রীরা রেগে কোলাব্যাঙ হয়ে যাচ্ছিলেন।
Deleteধ্যেত, টিটিই কে টিটি ছাড়া কেউ কোনদিন কিছু বলেছে?
ReplyDeleteআমি ছোটবেলা থেকে টিটিদের পছন্দই করতাম, কারণ আমার ট্রেনে চড়া বলতে ছিল এলাহাবাদ থেকে কলকাতা আসা, আর সেখানে আমাদের রিজার্ভ করা সিটে প্রায়ই অন্য লোক বসে থাকত, যাদের টিটি এসে বকেঝকে নামাত। বড় হয়ে ট্রেনে চাপ্তাম যখন, তখন টিটি না ধরলে মনে হত টিকিটের পয়সাটা জলে গেল।
তবে আমায় টিটি সত্যিসত্যি ধরেছে ৩ বার। একবার আমি নতুন কলেজে ঢোকার পর হুগলী ঘাট থেকে শেয়ালদা যাব, সব ডেলি প্যাসেঞ্জারদের দেখাদেখি একটা এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম, এমনি টিকিট কেটেই। নামার পর সব এদিক-ওদিক সরে পড়ল, নাকি মান্থলিতে ওটা এলাউড জানিনা, ধরা পড়লাম আমি। সোজা ফাইন। আরেকবার হায়দ্রাবাদ থেকে মুম্বাই যাব, আমার বন্ধুর আর আমার টিকিট একসাথে, কিন্তু ও নামবে শেষ স্টেশনে, আমি তার কয়েকটা স্টপ আগে। মুশকিল হল, দুজন্কার টিকিট একসাথে কাটা, তাই টিকিট একটাই। ঝামেলা হতে পারে আন্দাজ করে আমি একটা জেরক্স করে নিয়ে গেছিলাম টিকিটটা, কিন্তু ট্রেনের টিটি কিছুতেই সেটায় কোনো সই-সাবুদ করলেননা। কাজেই যা হওয়ার তাই হল।আমি নেমে জেরক্স দেখালাম, আর ফাইন খেলাম। আমার বন্ধু টিকিট নিয়ে লাস্ট স্টেশনে গেল নিশ্চিন্তে। শেষবার এদেশে, আমার মান্থলি ফুরিয়ে গেছিল। আমার মান্থলিটা মেলে এসে বাড়িতে পড়ে ছিল, ১ তারিখ ব্যাগে ভরতে ভুলে গেছিলাম। এখানে কালোকোটেরা আবার নিলশার্ট। যাই হোক, তিনি আমায় বললেন কোর্টে গিয়ে জজকে মান্থলিটা দেখিও, ফাইন লাগবেনা। সত্যি তাই হল।
আপনার মাস্টার মশাইয়ের গল্পটা ভারী ভালো। আপনার নিজের গুলোও।
টিকিট কাটলাম অথচ টিটি ধরল না, এটা একটা রিয়েল আফসোস। তাও আমি প্রতিদিন টিকিট কাটতাম, কাটি, কাটবও---কারণ এ নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহই নেই যে যেদিন আমি টিকিট কাটব না, সেদিনই চেকার আমাকে ধরবে। ধরবেই। কেউ আটকাতে পারবে না।
Deleteবন্ধুর মুখ চেয়ে ফাইন খেলেন? স্যাড।
ato bhalo laglo pore ...darun hoyeche lekhata :) amio akbar bombay te local train e fine diechi ,train theke nemei ticket ta kuchikuchi kore chinre fellam,tarpore berobar mukhe tt dhare 250 taka fine nilen ..:( :(
ReplyDeleteএইটা জাস্ট ব্যাড লাক, তিন্নি। তোর তৎকালীন মনের অবস্থাটা আমার ভাবতেও খারাপ লাগছে।
Deleteকালোকোট নিয়ে একটা সাংঘাতিক গপ্প শোনাই। আমরা তখন কলেজে পড়ি টড়ি আর কি। আমার এক তুতো বন্ধু, মানে বন্ধুর বন্ধু আর কি -- অণুজিত। যাদবপুরে পড়াশোনা করে। রাজনীতিতে প্রবল উৎসাহ। তার বক্তব্য ছিল রেল একটা পরিষেবা, যেটা রাস্ট্র তার প্রতিটি মানুষকে দিতে বাধ্য - বিনামূল্যে!
ReplyDeleteএইরকম দাবি নিয়ে সে প্রতিদিন ব্যারাকপুর থেকে শিয়ালদা স্টেশন হয়ে সাউথ লাইনের ট্রেন ধরে যাদবপুরে গিয়ে অবতীর্ণ হত - বলা বাহুল্য টিকিট না কেটে। অবশেষে একদিন ঘটনাটা ঘটেই গেল। এক কালোকোট তাকে গ্রেপ্তার করল।
- টিকিট?
- নেই।
- ফাইন দিতে হবে।
- দেবনা।
অতঃপর অণুজিতের ফ্যান্টাসটিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা কালোকোটকে জানানো হল। মানতেই হবে কালোকোট সত্যিকারের ভদ্রলোক, সমস্ত কথা তিনি মন দিয়ে শুনেছিলেন! সব শুনে কালোকোটের বোধ হয় খুব মায়া হয়েছিল এই দু দিনের ছোকরার ওপর। খানিক হিতোপদেশ দিয়ে তিনি জিগাইলেন --
- এখন যাবে কোথায়?
- যাদবপুর।
- ছেড়ে দিচ্ছি তোমাকে, কিন্তু টিকিট টা কেটে নিও।
- টাকা নেই (বস্তুত তার কাছে টাকা ছিলনা!)
ভদ্রলোক খুব খানিক মাথা নেড়ে এ-কার-পাল্লায়-পড়েছি এরকম ভাব করে ১০টা টাকা অণুজিতের হাতে দিয়ে বললেন 'যাও, টিকিটটা কেটে নিও।' অতঃপর আমাদের নায়ক বীরদর্পে বেরিয়ে এসে সাউথ লাইনের দিকে এগোতে গিয়েও হঠাত থমকে দাঁড়াল। তারপর খানিক কিসব ভেবে আবার ফিরে গেল সেই কালোকোটের কাছে। টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, 'কাকু, টাকাটা আপনি রাখুন। ভেবে দেখলাম টিকিট আমি কাটবনা। কাটলে সেটা আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিরোধিতা করা হবে', বলে টাকাটা হতভম্ব কালোকোটের হাতে গুঁজে দিয়ে অণুজিত সরে পড়ল।
প্রোজ্জ্বল, ভোম্বলবাবু তাঁর কেরিয়ারলব্ধ যে কটা উপলব্ধির কথা বলেছিলেন আমাদের সেদিন, তার মধ্যে এ কথাটাও ছিল। যে অল্পবয়স্ক ছেলেরা টিকিট কাটবে না, কিছুতেই না, মরে গেলেও না। কেউ রাজনৈতিক বিশ্বাসের ছুতোয়, কেউ বাহাদুরি দেখিয়ে, কেউ জাস্ট এমনিই। তেল আর জলের মতোই, ট্রেনের টিকিট আর যৌবন (ছেলেদের, মেয়েদের যৌবনেও অত সাহস হয় না) মিশ খায় না।
Deleteআপনার গল্পটা খুবই ভালো। অণুজিত খুবই ইন্টারেস্টিং চরিত্র মনে হচ্ছে।
মেয়েদের যৌবনেও অত সাহস হয় না - shahosh er bepar na choice r bepar ?
ReplyDeleteআমার ধারণা সাহস।
DeleteI thought TTE meant Travelling Ticket Examiner. Can you please find out which is correct?
ReplyDeleteTravelling Ticket Examiner is correct. Thank you for letting me know. I really appreciate it.
Deleteখুব প্রাসঙ্গিক হয়তো নয়, তবে এইটে দেখতে পারেন- এরকম সুযোগ থাকলে আমার যে কি সুবিধেটাই হত!
ReplyDeletehttp://youtu.be/ojo9M1cPSPI
হাহা, সিরিয়াস্লি ভালো। থ্যাংক ইউ সুনন্দ।
DeleteEkta oprasongik prosno hotat mathay elo. Paris e ki ekhon হ্যাদ্দেহোয়া paoa jay? Jodi jay, tahole setar taste ki Delhi-r হ্যাদ্দেহোয়া-r moton? By the way, ei prosno ta mone haoar por ami abar khunje khunje purono blog ta bar korlam, banglay "হ্যাদ্দেহোয়া" word ta copy korbo bole.. :)
ReplyDelete-Aparajita
অপরাজিতা, আরে আমি খোঁজ করিনি হ্যাদ্দেহোয়ার। কেন যেন ইচ্ছে করেনি। তবে চোখেও যে পড়েনি সেটা ঠিক। পড়লে কিনব।
Delete