মলিনা


সুরমা, পূর্ণিমা দিয়ে শুরু করে যখন শেষ মেয়েটির নাম মলিনা রাখতে হল তখন তার বয়স আট হতে না হতেই মাসি মলিনাকে খুকিদের বাড়ি নিয়ে এলেন। মলিনার মা মেয়েকে খাবার জোগাতে হিমশিম, আর খুকির মা খুকি, সংসার, অফিস সামলে একশা। মাসি পাশের বাড়ি নিত্যি আসেন দু’বেলা। মলিনার সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হবে।

একটা গোটা সকালও লাগল না, একরত্তি মলিনা খুকিদের সংসারে মিশে গেল। সকালে উঠে ঘুমচোখে মলিনার প্রথম কাজ ছিল গিয়ে খুকির ছোট্ট মশারির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা। ঝুমঝুমিটা চুপিচুপি নাড়ানো, যদি আওয়াজে খুকি চোখ খোলে। চোখ খুললে দুজনেই ফোকলা দাঁতে একে অপরকে দেখে হাসত। খুকির দাঁতের বালাই নেই, আর মলিনার সামনের পাটির দুখানা দুধের দাঁত সেই যে গেছে আর ফেরার নাম করছে না।

খুকির মা ডাক দেণ, মলিনা দৌড়য়। বিস্কিট খাওয়া শেষ হলে চায়ের বাসন নিয়ে কলতলা। রংচটা লাল ফুলছাপ ফ্রকটা বেশ করে গুছিয়ে নিয়ে বসে, সস্তা চুড়ি পরা দুটো ছোট হাত ঘুরিয়েঘুরিয়ে চায়ের কাপ ধোয় মলিনা। কাপ ধোয়, প্লেট ধোয়, দুহাতে বাসন ধরে সাবধানে হাঁটে। বাসন রেখেই আবার ছুট্টে খুকির কাছে। খুকির মা ততক্ষণে ঝিনুকবাটি নিয়ে খুকিকে দুধ খাওয়াতে বসেছেন। খুকি ঠোঁট টিপে বন্ধ করে রাখে, হাত পা ছোঁড়ে, কাঁদে। মলিনা দৌড়ে একটা ছাতা জোগাড় করে আনে। মা খুলে দেন। মলিনা ছাতাটা খুকির মুখের সামনে প্রাণপণ ঘোরায়। খুকি হাঁ করে দেখতে দেখতে বাটি খালি করে ফেলে। মলিনা আর মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসেন। খুকিকে বোকা বানানো এত সোজা।

মায়ের হাতের কাছাকাছি ঘোরে মলিনা। কখন কী দরকার লাগে। রান্নার সময় এই বাটিটা, ওই খুন্তিটা এগিয়ে দেয়। দাদুর চশমা খুঁজে দেয়। ঠাকুমার পুজোর জন্য বাগান থেকে টগরফুল তুলে আনে। ঘোরাঘুরি করে আর কান খাড়া করে রাখে। একসময় অপেক্ষার শেষ। দাদু হুঙ্কার দেন, “মলিনা...” লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে মলিনা। বাজারের ব্যাগ নিয়ে দাদু রিকশায় চড়েন, পাশে পা ঝুলিয়ে মলিনাও। বারান্দায় কারও না কারও কোলে বন্দী খুকির হিংসেমাখা চোখের সামনে টা টা করতে করতে মিলিয়ে যায় মলিনা।

খুকি হাঁটতে শিখলে মলিনার কাজ বাড়ে। বিকেলে সামনের রাস্তায় পায়চারি। একটা ভীষণ ছোট হাত, আরেকটা ছোট হাত ধরে এদিকওদিক যায়। খুকি দুষ্টুমি করে। একদিন খেলতে খেলতে খেলনা ছুঁড়ে মারে মলিনাকে। মা ছুটে এসে খুকিকে চোখ রাঙান। বকেন। কান্নাকাটি। মলিনা চুপ করে থাকে। মুখ কালো করে ঘোরে মায়ের পেছন পেছন। মা জিজ্ঞাসা করেন, “খুব লেগেছে মলিনা?” এতক্ষণে জমে থাকা চোখের জলের নিষ্কৃতি।

-তুমি বকলে কেন ওকে?

তারপর একদিন মাসি আসেন। মলিনার মা মেয়ে ফেরৎ চেয়ে পাঠিয়েছেন। হয়তো বড় দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে, মায়ের কাজে সাহায্য করতে লাগবে মলিনাকে। অথবা মায়ের ইচ্ছে হয়েছে ছোট মেয়েটাকে নিজের কাছে এনে রাখতে। কে জানে। মাসির হাত ধরে মলিনা চলে যায়।

যাওয়ার সময় খুকিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
-আবার আসবি তো মলিনা, দুঃখ কীসের?

কী করে আসবে? এর পরেই তো হইহই করে বড় হয়ে যাবে মলিনা। হয়তো অন্য কারও বাড়িতে কাজে লেগে যাবে, অথবা বিয়েই হয়ে যাবে। তারপর ভিড়ের মধ্যে কোথায় মা, কোথায় খুকি, কোথায় মলিনা। ফোন নম্বর নেই, ইমেল নেই, একটা ঠিকানা পর্যন্ত নেই তো।

মলিনা আমার প্রথম খেলার সঙ্গী। ওর মুখটা পর্যন্ত আমার মনে নেই। সবটাই শোনা। আমি অ্যালবাম খুঁজে দেখেছি। একটাও ছবি নেই মলিনার। কাজেই আমাকে মলিনাকে কল্পনা করে নিতে হয়েছে। একটা ভীষণ ছোট রোগা মেয়ে কলতলায় বসে চায়ের কাপ ধুচ্ছে।

প্রত্যেকবার এই ছবিটা মনে করলে আমার চোখে জল এসে যায়।

Comments

  1. Ki sundar barnona... amio chokher samne dekhte pelam, ar amaro hridoy chhNuye gelo. Erakom khamota sobar thakena. Apni lekha chhaRbenna konodin. :)

    ReplyDelete
  2. amar poRei kanna pacche :( ki likhbo bolo?

    ReplyDelete
  3. Amar o chokhe hol eshe gelo. Asha rakhi Malina ra bhalo thakbe
    Pujoy khub anondo koro

    ReplyDelete

Post a Comment