সিঙাড়া শরবৎ
ছোট, আঁটো, পাতলা খোলস এবং পুরের ঘেঁষাঘেঁষি - আমার মতে এই হল ভালো সিঙাড়ার সংজ্ঞা। ভেতরের পুর নিয়ে আমি খুব একটা পিউরিট্যান নই। তাই বলে আবার ম্যাগির পুর ভরা সামোসার অ্যাপোক্যালিপসকে সমর্থন করি না। এখানে স্ট্রিক্টলি, আ সাম ইজ ইনফেরিয়র দ্যান ইটস পার্টস। শিঙাড়াতে আলু থাকতে হবে। তারপর ফুলকপিই থাকুক, কি বাদাম, কি কিসমিস, উনিশ আর বিশ। যব তক রহেগা সিঙাড়া মে আলু,তব তক … আর কবিত্বতে কুলোচ্ছে না… আমার অসুবিধে নেই।
আমাদের বাঙালি পাড়ায় সিঙাড়া পাওয়া যায়, কিন্তু তারাও কেমন যেন পাশের পাড়ার জ্ঞাতির দেখাদিখি ষণ্ডা হয়ে ওঠাটাই মোক্ষ বলে ধরে নিয়েছে। ইয়া মোটা খোলস, কামড় দিলে পত্রপাঠ পুর ছেড়ে আলগা হয়ে আসে। সিঙাড়া খাচ্ছি মনে হয় না। ঠিক যেমন বাংলায় কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের বক্তৃতা শুনতে শুনতে আচমকা “এই রচনা/সৃষ্টির যা কিছু শ্রেয়, সব যায় অমুকের প্রতি” কানে গেলে বাংলা শুনছি মনে হয় না, তেমন। আর আলুর পুর একেবারে মশলাদার ভর্তা হয়ে গেছে। ও জিনিস খেলে স্বাদের থেকে অম্বলটাই বড় হয়ে উঠে চোখে পড়ে। তাই খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
সে তুলনায় সরবতের ভালোমন্দ বিষয়ে আমি অতটাও গোঁয়ার নই। সে বাবদে ভালো বলতে পারবে অর্চিষ্মান। আমার সন্দেহ, চিবোনোর কষ্টটুকুও করতে হয় না বলেই সরবতের ওপর ওর এই একচোখোমি। তবে শরবতপ্রীতি জেনেটিক হতে পারে। নাকতলার মা আর মিমির মধ্যে শলাপরামর্শ হয়েছিল, মা চাকরি পেলে কী ভাবে উদযাপন করা হবে। দুজনে মিলে এই গ্র্যান্ড সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে শরবত খাওয়া হবে এন্তার, প্রাণভরে।
চাকরি পাওয়ার পর আমার মা কী খেতে চাইতেন? নিশ্চয় রসগোল্লা । মাকে কত আবোলতাবোল রেস্টোর্যান্টে গিয়ে হ্যানা স্যান্ডউইচ ত্যানা স্যান্ডউইচ, ক্যাপুচিনো মোকা খাইয়েছি, প্রথম চুমুক দিতে না দিতে মা, “কী ভালো রে সোনা” বলে বুড়ো আঙুল আর তর্জনী ছোঁয়ানো মুদ্রাসহযোগে প্রশংসায় ফেটে পড়েছেন, কিন্তু মার্বেলটপ টেবিল কাঠের চেয়ারে বসিয়ে স্টিলের থালায় এসে পড়া গরম গরম রসগোল্লা, যটা ইচ্ছে ত’টা খাও মা বলে কখনও খাওয়াইনি।
অনেকদিন পর মনের মতো সিঙাড়া, শরবত খেতে গিয়ে এত কথা মনে পড়ল। পুরোনো সিঙাড়া খাওয়ার স্মৃতিও। আর স্মৃতি তো আলাদা আলাদা হয়ে আসে না, সিঙাড়ার সঙ্গে সিঙাড়া খাওয়ার সময়টা, কার সঙ্গে বসে খাচ্ছিলাম, খেতে খেতে কী রসিকতা হচ্ছিল, সবই মনে পড়ে। সিঙাড়ার একটা ভালো ব্যাপার আবিষ্কার করলাম, খুব মনখারাপে কেউ সিঙাড়া খায় না। বা মনখারাপ থাকলেও ভালো হয়ে যায়। তাই সিঙাড়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কোনও স্মৃতিই দুঃখের নয়। সিঙাড়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সব সময়ই সূসময়।
তা বলে আমি যে সুসময় দুঃসময় খুব চিনতে পারি তা নয়। আমার নিজের জীবনের সুসময় দুঃসময় আমি নিজে চিনতে পারিনি সত্যি বলতে কী। একেক সময় মনে হয়েছিল কী কষ্টে আছি, পরে দেখেছি, জীবনটা আসলে দিব্যি অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে চালিয়ে গেছি। আবার একেকসময় মনে হয়েছিল আর কী চাই, এখন বুঝতে পারি আরও অনেক কিছু চাওয়া এবং পাওয়া উচিত ছিল ওই সময়ে। নিজের জীবনের সুসময় না চিনতে পারলেও, অন্যদের চিনতে পারি। কলেজ স্ট্রিটে সেদিন যারা তাড়া তাড়া ফর্ম নিয়ে ভুরু কুঁচকে দৌড়চ্ছিল, ফোনে ঝগড়া করছিল, এমনকি কাঁদছিলও, ওই মুহূর্তে যদি দাঁড় করিয়ে জানতে চাইতাম, কেমন চলছে?
হয়তো বলত, জঘন্য। দেশ জুড়ে অনাচার, প্রেম টিকছে না, প্রেম টেঁকাতে গেলে পড়া মাথায় উঠছে, নম্বর কম আসছে, পড়তে বসলে কবিতার লাইন ঘাই মারছে মাথায় - জঘন্য খারাপ সময়। মুখে কিছু বলব না, অতটাও বুড়ো হইনি, কিন্তু মনে মনে বলব, উঁহু, এই হচ্ছে তোমার জীবনের সুসময়। মনে পড়বে যখন তখন প্রেমের ওমটাই মনে পড়বে, ঝগড়াটা পড়বে না। টেনশনটা তো মিটেই যাবে, কিন্তু এই যে ভারি ব্যাকপ্যাক নিয়ে খারাপ লিফটকে কাঁচকলা দেখিয়ে দুটো সিঁড়ি টপকে টপকে চারতলায় উঠছ আর নামছ, অসীম শক্তিধর হাঁটুর কথা মনে পড়ে গর্বে বুক ফুলে উঠবে।
অন্ততঃ আমার তাই কামনা।
আসলে সুসময় দুঃসময় সব জড়িয়েমড়িয়ে থাকে। আলাদা করা যায় না। এই মুহূর্তে আমারও তো চিন্তা, টেনশন, শোকতাপ কম নেই, কিন্তু সেদিন দুপুরবেলার রোদ্দুরটাও ছিল, হাতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ফেভারিট লোকের হাতও ছিল, সিঙাড়ার মতো সিঙাড়া আর শরবতের মতো শরবৎ খাওয়ার প্ল্যানও ছিল। আর কত সুসময় চাই।
এই যে সেই স্মৃতিজাগানিয়া সিঙাড়া শরবতের ছবি। ওই যে সিঙাড়াটা প্লেটের ওপর আমি-কিন্তু-কিছু-জানি-না মুখ করে বসে আছে, আমার সংজ্ঞায় পৃথিবীর সার্থক সিঙাড়ার নমুনা। নো ওয়ান ক্যান ইট জাস্ট ওয়ান। তার ওপর আবার সরের নাড়ুটা না নিয়ে থাকা গেল না, না হলে একশো টাকার মধ্যে দুজনের খাওয়া হয়ে যেত। দ্বিতীয় দোকানে ডাব শরবৎ আর কেসর মালাই শরবতের পর মুখের মিষ্টি ভাব কাটানোর জন্য ট্যামারিন্ড সিরাপ নেওয়ার সিদ্ধান্তটাও নিতেই হল।
না সিঙাড়া, না সরের নাড়ু, না ট্যামারিন্ড সিরাপ, কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েই আফসোস করিনি।
আপনাদের কাজ একটাই। বলুন দেখি দোকান দুটোর নাম। একটা হিন্টও দিচ্ছি, জানি লাগবে না - দুটো দোকানের নাম একই ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে শুরু।
Puntiram ar Paramount. Achcha Shingara khaoar somoy age bhage tinte kona kamre khash? Tui e bollam. Oi bolei abhyosto chilum.
ReplyDeleteতুই যদি আমাকে আপনি কিংবা তুমি বলতিস, পাপড়ি, তাহলে আমার মাথা এমন তাজঝিমমাজঝিম হয়ে যেত যে আর উত্তর দেওয়া হত না।
Deleteউত্তর সব ঠিক হয়েছে বলাই বাহুল্য।
Hahaha tajjhim majjhim . Besh khasha bolechish. Haha
Deleteপুঁটিরাম আর প্যারামাউন্ট। এ আবার বলতে হয়?
ReplyDeleteহাহা, ঠিক, ঠিক।
Deleteদূর দেরী হয়ে গেলো, উত্তর সবাই দিয়ে দিয়েছে !
ReplyDeleteলেখাটা যথারীতি চমৎকার সিঙারার মতই হয়েছে।
হাহা, থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।
DeleteIsh ki soja proshno..ar ki bhalo topic .. Ami kokhono ei duto jinis porpor khaini.. ekbar try korte hobe..
ReplyDeleteকরিস, ঊর্মি। ভাত ডালের থেকে ঢের ভালো লাঞ্চ।
Deleteনাম দুটো লিখতে এসে দেখি একাধিক লোক লিখে দিয়েছে, দেখে ভারী আনন্দ হলো। কুন্তলা, আমার সাথে তোমার পরিচয় নেই, তবে তোমার লেখা আমি পড়ি।
ReplyDeleteআরে থ্যাংক ইউ, সোমা। পরিচয় হয়ে ভালো লাগল।
Deleteআমি একটা বেরসিকের মতো মন্তব্য করতে চলেছি। এই পুঁটিরামে তো সবাই খেয়েছে, কেউ কখনো আমহার্স্ট স্ট্রিট আর এমজি রোড এর ক্রসিং এর পুঁটিরামে খেয়েছেন কি? রাধাবল্লভীর সাথে সাদা আলুর ঝোল আর সিঙ্গাড়া দুটোই বেশ অন্যরকম আর ভালো।
ReplyDeleteএইবার আমি এমন একটা সত্যি স্বীকার করব যে সবাই আমাকে "বাঙাল! বাঙাল!" বলে ঢিল ছুঁড়বে। আমি কলেজ স্ট্রিটের পুঁটিরামে জীবনে দ্বিতীয়বার (প্রথমবার, কার সঙ্গে আর, মায়ের সঙ্গে) আর প্যারামাউন্টে জীবনে প্রথমবার খেলাম। আমহার্স্ট আর এম জি রোডের ক্রসিঙের পুঁটিরামে খাইনি। পরেরবারে কলকাতার মজা করার লিস্টে লেখা রইল। থ্যাংক ইউ, বৈজয়ন্তী।
DeleteBhalo laglo porte. Comment korte deri hoyate dekhlam sabai dokan gulor naam bole diyechhe. Duto jaigai amar boro priyo. Putiram er khabargulo dekhe mon boro drobo hoye gelo. Anekdin jaoa hoini.
ReplyDeleteAar apnake ebong paribar er sokolke Ingriji noboborsher anek anek subhechchha
আপনার পরিবার আর আপনাকেও হ্যাপি নিউ ইয়ার, সুস্মিতা। পুঁটিরামের খাবার আমার ভালো লেগেছে তবে ডাল তরকারিগুলো সামান্য মিষ্টির দিকে। ওটুকু না থাকলে পারফেক্ট।
DeleteHaan chholar dal ta besh mishti kore kintu amar ota khetei besh bhalo laage.
Deleteঅর্চিষ্মানও আপনার দলে, সুস্মিতা। খুব আহাউহু করে ডাল খাচ্ছিল। আরেক প্লেট নেবে ভাবছিল তারপর সিঙাড়ায় কামড় দিয়ে ঠিক করল ওটাই আরেকটা খাওয়া যাক।
DeleteHappy new year Kuntala! Notun bochor khub bhalo katuk tomader eyi kamona kori.
ReplyDeleteAmi Kolkata haate gune 3 ki 4 baar giyechi ar Putiraam e ekbaar e kheyechi … tobuo ami thik Putiram chinte perechi . Onnota jani na, amar janar kothao noye :-)
হ্যাপি নিউ ইয়ারের অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমাকেও, শর্মিলা। খুব ভালো কাটুক ২০২০।
Deleteএকবার খেলে আমিও পুঁটিরাম চিনতে পারতাম না। অনেকবার খেলেও পারতাম কি না সন্দেহ। কাজেই। দ্বিতীয় দোকানটা প্যারামাউন্ট। পুঁটিরামের কাছেই। পরেরবার কলকাতা গেলে ট্রাই করতে পার।
dutoi darun. :-) - Ichhadana
ReplyDeleteহাই ফাইভ, ইচ্ছাডানা।
Deleteবছরের শেষে কলকাতা গিয়েছিলেন নাকি, কুন্তলা?
ReplyDeleteআমরাও কদিন আগে ফিরলাম, শীতকালের বৃষ্টিতে ভিজে কান-গলা-নাকে ঠান্ডা লাগিয়ে বন্ধ করে। :D
ছবিগুলো খাশা। :)
গেছিলাম, গেছিলাম। আরও যা যা সব মজা করেছি সেই নিয়ে পোস্ট আসছে। ঠাণ্ডালাগা দ্রুত দূরীভূত হোক।
Delete