১৫-২১ সেপ্টেম্বর


স্পোকেন ইংলিশ শুনলেই যেমন বলে দিতে পারি কে বাংলা মিডিয়াম কে ইংরিজি মিডিয়াম কে সাউথ পয়েন্ট, বাংলা লেখা পড়লেই ধরে ফেলতে পারি কে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। আয়নায় নিজেকে দেখার মতো সহজ আর নির্ভুল। আমরা একটা লোককে তার নাম পর্যন্ত দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি না। হয় কবিগুরু, নয় গুরুদেব, নয় ছন্দের জাদুকর, নয় বাংলার বাঘ। সুকুমার রায় এতদিন ফুরফুরে ঘুরছিলেন, এ সপ্তাহে অন্ততঃ পাঁচজনকে বলতে শুনলাম/লিখতে দেখলাম প্রফেট সুকুমার রায়। একজন আবার লিখেছেন প্রফেট তাতা।

মেয়েরা হুলিয়ে মিছিলে নেমেছে (হুলিয়ে বাদ দিলে আমার আপত্তি নেই) লিখতে আমাদের নার্ভাস লাগে। পাছে ব্যাপারটার ঐতিহাসিকত্ব চোট খায়। আমাদের লিখতে হয় শতশত পাখি খাঁচা খুলে রাতের আকাশে ডানা মেলে উড়ছে।

*****

এ সপ্তাহে জীবনে প্রথম চিয়া সিডস খেলাম। মন দড়ি ছিঁড়ে কে জানে কোন মাঠে দৌড়চ্ছে, শরীরটাকেই মন্দির বানিয়ে পুজোফুজো করে টাইমপাস করব। ইন্টারনেটে লিখেছিল পনেরো মিনিট ভিজিয়ে রাখলেই চিয়া ফুলে উঠবে, উঠল না। হতে পারে ব্লিংকিটের কুড়ি টাকা প্যাকেটের চিয়া হদ্দবাসি কিংবা জলের দোষ। পনেরো মিনিটে এক্স্যাক্টলি যেমন কে তেমন রয়ে গেল। আধঘণ্টা পরে সামান্য মুটোল নাকি কল্পনা করলাম জানি না, ধুস বলে জলে গুলে লেবু চিপে খেয়ে নিলাম।

আমি খেয়ে নিলাম, অর্চিষ্মান ভুরু কুঁচকে গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকল। এটা কী কুন্তলা? বললাম, তোমার দৈনিক প্রয়োজনের চোদ্দ পারসেন্ট ক্যালসিয়াম, বারো পারসেন্ট আয়রন, তেইশ পারসেন্ট ম্যাগনেশিয়াম, চৌত্রিশ পারসেন্ট ম্যাঙ্গানিজ, কুড়ি পারসেন্ট ফসফরাস, আঠাশ পারসেন্ট সেলেনিয়াম, বারো পারসেন্ট জিংক। চিয়া সিডস আর অলসো আ গুড সোর্স অফ ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডস, ফাইবার, প্রোটিন অ্যান্ড অ্যান্টিঅক্সি...

নির্মলের সঙ্গে যোগাযোগ কোরো, ইনশিওরেন্সটিওরেন্স ও-ই হ্যান্ডল করে। এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে ফেলল অর্চিষ্মান।

*****

ডাক্তারখানাতেও গেলাম। মরণবাঁচন কিছু না, ওই মন্দির ঝাঁটপাট দিয়ে রাখা। এই ইস্যুতে ডাক্তার দেখাতে গেছি শুনলে বাবা মুচকি হাসতেন, দাদু বাকরুদ্ধ হতেন, দাদুর বাবা (যে রকম শুনেছি )  বলতেন, সংসারে নারী নায়ক হলে এ-ই হয়। দেশবন্ধু সমিতির ডাক্তারখানা, সেমি-দাতব্য, ছোট ছোট খোপে ডাক্তারবাবুরা বসেন, বারান্দায় সারি দিয়ে বসে পাড়াশুদ্ধু লোক কার কী গোপন রোগ হয়েছে কান খাড়া করে শোনে।

একটা বাচ্চা মেয়ে ভেতরে ছিল। কোন স্কুল কোন ক্লাস ক' ভাইবোনের পর ডাক্তারবাবুর কী একটা প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটা বলল হ্যা। ডাক্তারবাবু বললেন হ্যা নয় হ্যাঁ, শব্দটায় চন্দ্রবিন্দু আছে। অর্চিষ্মান বলল, এই ডাক্তারকে তোমার এত কেন পছন্দ বোঝা গেল। আমিও বুঝে গেলাম ও অলরেডি অপছন্দ করতে শুরু করেছে।

একই কারণে এঁকে দেখাতেই বছরখানেক না দেড়েক আগে একা এসেছিলাম। ডাক্তারবাবু বললেন, বউকে যেটা বলেছিলাম সেটা করলেই পারতে, দু'শো কুড়ি টাকা বেঁচে যেত। মুখ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, না না ঘোড়ার মুখ থেকেই ডিরেক্টলি শোনা ভালো, সামলে নিলাম। রূপক কম রাখার সিদ্ধান্ত সব জায়গাতেই অ্যাপ্লাই করা দরকার।

আমাকে যা বলেছিলেন অর্চিষ্মানকেও তাই বললেন। ওষুধ দিচ্ছি কিন্তু তোমরা আসলে সবাই মরবে স্ট্রেসে। বাঁচতে চাও তো সকালে উঠে কপালভাতি আর হলাসন (এক্স্যাক্টলি এই নামগুলো বলেননি, "স্পেসিফিসিটি"-র খাতিরে লিখছি) শুরু করো। যোগব্যায়াম করতে গেলে অর্চিষ্মানের হাই ওঠে, বলল দৌড়লে হবে না? ডাক্তারবাবু বললেন, দৌড়িয়ে শুধু হার্ডওয়্যার সারবে, সফটওয়্যার সারাতে হলে কপালভাতি ইজ দা ওয়ে টু গো।

*****

ব্রেকফাস্টে কোরিয়ান খাওয়া হবে। আমার কোরিয়ান খাবার ভালো লাগে না। অ্যাকচুয়ালি, আমার কোরিয়ান খাবার খুব খারাপ লাগে। কিমবাপ থেকে বিবিমবাপ থেকে জিগে থেকে জাপচে - সব মিষ্টি। সৌরভ স্টোরস থেকে কোরিয়ান ফায়ার নুডলস কিনে এনে ফাঁকা ঘরে একা একা নিজের সঙ্গে নিজে ঝাল খাওয়ার চ্যালেঞ্জ লড়ি - সে ঝালেরও তলে তলে মিষ্টিই বয়।

অর্চিষ্মানের কোরিয়ান খাবার ভালো লাগে। আমার কোরিয়ান খাবার খারাপ লাগে কিন্তু অর্চিষ্মানকে ভালো লাগে কাজেই আমিও কোরিয়ানই খাব। জোম্যাটো খুলে পাড়ার কাছাকাছি যত কোরিয়ান দোকানের নাম জোরে জোরে রিডিং পড়লাম, অর্চিষ্মান সবক'টা বাতিল করল। বলল, শোনো না, কোরিয়ানটায় যাই চল।

বুঝে ফেললাম। যে ভাবে সারাদিন একে অপরের 'ইয়েটা কই গেল, এখানেই তো রেখেছিলাম' বুঝে ফেলি। লাজপতনগরের কোরিয়ান কালচারাল সেন্টারের কথা বলছে। সরকারি বাড়ির দোতলায় রেস্টোর‍্যান্ট। থালাবাটি দেওয়ার আগে টেবিলে কাগজ পেতে দিয়ে যায়, কাগজের নিচে বাঁ কোণে সূক্ষ্ম ফন্টে রেস্টোর‍্যান্টের নাম লেখা থাকে। ডালগ্রাক। নিচের লাইনে নামের মানে। বাসনকোসনের শব্দ। প্রতিবার পড়ি আর ভাবি বাসনকোসনের কোন শব্দ? টুংটাং? ঠনঠন? নাকি চার বছর আগে মেজাজ খারাপ করে রান্নাঘরে ঢুকলে যে শব্দটা হত? ভাবনাটা পাঁচ সেকেন্ড মতো থাকে। তারপর হয় অর্চিষ্মান কিছু একটা বলে নয় আমি কিছু একটা বলি। খাওয়াদাওয়া হয়, বাড়ি ফেরা হয়। তিনমাস বা ওইরকমই একটা ইন্টারভ্যালের পর আবার কোরিয়ান খেতে যাই, আবার টেবিল বেছে বসি, আবার থালাবাটি দেওয়ার আগে টেবিলে কাগজ পেতে দিয়ে যায় আর কাগজের নিচে বাঁ কোণে সূক্ষ্ম ফন্টে লেখা থাকে ডালগ্রাক। নিচের লাইনে - বাসনকোসনের শব্দ। ভাবি টুংটাং? ঠনঠন? ঝনঝন? পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় কেউ কিছু একটা বলে। অন্য ভাবনা ঢোকে, ওই ভাবনাটা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। ক্লিন এক্সিট।

ডালগ্রাকের একটা স্টেট ভবন স্টেট ভবন ফিলিং আছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মিনিম্যালিস্টিক সাজ। সবাই আমার মতো ইংরিজি বলে। গলির দিকের বড় বড় জানালা দিয়ে আসা ইন্ডিরেক্ট সূর্যালোকে প্রশস্ত হল ভেসে যায়। রাস্তার দিকের জানালাগুলোতে মোটা ব্লাইন্ডস। তসর রঙের ওপর লাল নীল সবুজ সরুসরু লাইন সমকোণে সাজানো। তাকিয়ে থেমে থেমে দশ গুণলে এ ডি এইচ ডি শান্ত হয়। তিনটে ছবি তুলেছিলাম। প্রত্যেকটার কোণেই অর্চিষ্মান বসে টুইটার পড়ছে কাজেই দেখানো যাবে না।

কোরিয়ান কালচারাল সেন্টার অর্চিষ্মানের সেকেন্ড ফেভারিট কোরিয়ান খাবার জায়গা। আমাদের দুজনেরই ফার্স্ট ফেভারিট মজনু কা টিলা-র বিখ্যাত বুসান। বুসান গিয়ে, খেয়ে, ফিরে আসা - প্রায় ডে ট্রিপ। আমার সেটাই পছন্দের কারণ। কালচারাল সেন্টারে সব চেয়ারটেবিল, বুসানে কাঠের নিচু টেবিলের চারপাশে বসার ব্যবস্থা। সিলিং থেকে কালো চিমনি সাইফাই-হরর সিনেমায় এলিয়েন ভিলেনের মুখোশের মতো ঝোলে। এসির সঙ্গে ফ্যান চললে অল্প অল্প দোলে। বাকি সবার মতো অর্চিষ্মানও বুসানে গিয়ে পর্ক বেলি বার-বি-কিউ অর্ডার করে। একজন এসে সাইডে ফুয়েল সিলিন্ডার গোঁজা সিংগল বার্নার পোর্টেবল স্টোভ টেবিলে বসিয়ে নব ঘুরিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। তখন প্লেট থেকে কাঁচা পর্কের স্ট্রিপ চিমটে দিয়ে তুলে স্টিলের স্টোভটপে রান্না করতে হয়। নিজে না খেলেও প্রত্যেকবারই ওস্তাদি করে চিমটে দিয়ে অর্চিষ্মানের পর্ক স্ট্রিপ উল্টেপাল্টে দিই। খাব না বলে কি খেলবও না? ইউটিউব দেখে "স্মোকি ফ্লেভার" কাকে বলে জানার পর থেকে অর্চিষ্মান গোল করে কাটা কাঁচা পেঁয়াজ, গোটা গোটা রসুনের কোয়া তপ্ত তাওয়ায় সেঁকে নেয়। পর্ক থেকে বেরোনো ফ্যাট স্টোভটপের ঢাল বেয়ে কোণের ফুটো দিয়ে স্ট্র্যাটেজিক্যালি বসানো বাটিতে পড়ে। রান্না হয়ে গেলে, কাঁটাচামচ চপস্টিকের পাশে রাখা কাঁচি দিয়ে পর্কবেলি টুকরো করে লেটুসপাতায় রেখে, পেঁয়াজ রসুন আরও নানারকম বাটাবুটি যোগ করে গোটা ব্যাপারটা এলোমেলো পানের মতো মুড়ে মুখে পুরে দিতে হয়।

কেউ রান্না হওয়া পর্কের স্ট্রিপ কাঁচি দিয়ে টুকরো করে পাতায় রাখে, কেউ কাঁচা পর্কের স্ট্রিপ কাঁচি দিয়ে কেটে স্টোভে চাপায়। খুব ইচ্ছে একদিন জানতে চাইব কোন অর্ডারটা ঠিক। আগে কাঁচি না পরে কাঁচি। উত্তরদাতা নিশ্চয় বলবেন, আপকি জ্যায়সি মর্জি, ম্যাম। তখন আমি বলব, ফিরভি, আপ হোতে তো কেয়া করতে? এই করে মিনিটপাঁচেক কনভারসেশনটা চালাব। কনভারসেশন অন্তে অর্চিষ্মানের মুখটা দেখব বলেই।

ঘুপচি ঘরে ঠাসাঠাসি টেবিলের প্রত্যেকটাতে স্টোভ, প্রথমদিন অস্বস্তি হয়েছিল। কেটেও গিয়েছিল। একদিন আমাদের টেবিলের স্টোভ জ্বলতে শুরু করেই নিভে গেল। ছেলেটি দৌড়ে এসে খালি শিশি খুলে নতুন ফুয়েলের শিশি সেট করে নব ঘোরানোমাত্র বুম! আগুন লাফ মেরে চিমনি ছুঁয়ে ফেলল।

সময়ের নিরবচ্ছিন্ন স্রোতে যেন একটা কোপ। একই সঙ্গে সবকিছু ভীষণ দ্রুত, সবকিছু ভীষণ স্লো মোশন। সমবেত আর্তনাদের ছাপিয়ে একলা গলার চিৎকার, আবে বনধ্‌ কর। বাঁ কানের পাশ থেকে দৌড়ে এসে একজন হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে আগুনের ভেতর, নব ঘোরাচ্ছে। আগুন লাফ দেওয়া মাত্র আমি ছিটকে গেছি কিন্তু দুটো ঘটনার মধ্যে ফাঁক এতই কম যে সন্দেহ হচ্ছে, প্রসেসটা ঐচ্ছিক নয়, আমার থেকে আলাদা একটা কিছু, যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখার ঠেকা নিয়েছে, আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। আগুনের দেওয়াল নেমে এসেছে, টেবিলের ওপারে অর্চিষ্মান আবার দৃশ্যমান। ওর সরার জায়গা ছিল না, দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে গেছে। গোটা ব্যাপারটা ঘটেছে তিন সেকেন্ডের মধ্যে। টোটাল ক্ল্যারিটির তিন সেকেন্ড। শরীর মন চেতনা একটি বিন্দুতে জড়ো হওয়ার দুর্লভ তিন সেকেন্ড।

ফেরার পথে মজনু কা টিলার বাজার, কাশ্মিরী গেট পেরিয়ে অটো যখন ওই ব্রিজটা দিয়ে ছুটছে যার বাঁদিকে ফাঁকা মাঠে ধোঁয়া ওঠা কারখানা, ডানদিকে জঙ্গলের ভেতর ইট বার করা ভাঙা গম্বুজ, অর্চিষ্মানকে ঠেললাম। তিনবারের বার সাড়া এল। কী হয়েছে কুন্তলা?

ওই যে তখন দপ করে আগুন জ্বলে উঠল?

হ্যাঁ।

আমি ছিটকে সরে এলাম ?

হ্যাঁ।

তোমার কথা মনে পড়েনি। শুধু নিজেকে বাঁচানোর কথাই মনে হয়েছিল।

গুড। অর্চিষ্মান ফোনে ফেরত গেল। তার মানে এখনও পুরো পাগল হওনি।

বুসান যাওয়ার এনার্জি নেই, সময়ও না, কোরিয়ান কালচারাল সেন্টারেই যাব। সরকারি ব্যাপার, যাব বললেই চলে যাওয়া যায় না। আপনি পয়সা দিয়ে উদ্ধার করবেন বলে দরজা খুলে ওঁরা বসে নেই। কৌতূহলোদ্দীপক সিদ্ধান্তে রবিবার ও বাকি ছুটির দিন বন্ধ। রবিবার ও ছুটির দিন বাদ দিয়ে গিয়েও একদিন বন্ধ পেয়েছিলাম, কারণ জিজ্ঞাসা করাতে ভাইসাব হাত উল্টেছিলেন।

শপথ করেছিলাম জীবনে ফোন না করে আসব না। কোরিয়ান রেকর্ডিং-এ ওয়েলকাম (হোপফুলি) জানানোর পর ইংরিজি রেকর্ডিং-এ বলা হল আওয়ার ওয়ার্কিং আওয়ার্স আর ফ্রম নাইন এ এম টু ফাইভ পি এম, প্লিজ কল লেটার। বলে ফোন কেটে দেওয়া হল।

এটা হল ন'টা বেজে পাঁচে। অর্চিষ্মান বলল, দেখো, অফিসে এখনও কেউ আসেনি বোধহয়। ন'টা তেইশে ফোন করলাম। ওয়ার্কিং আওয়ার এর মধ্যে পালটায়নি, নাইন এ এম টু ফাইভ পি এম-ই রয়েছে বাট স্টিল কল লেটার। অর্চিষ্মান বলল, দেখো হয়তো বাথরুমে গেছে। ন'টা পঁয়তাল্লিশে ফোন কান থেকে নামিয়ে কটমটিয়ে তাকাতে অর্চিষ্মান বলল, বুঝেছি কুন্তলা সবাই ভীষণ খারাপ খালি আমিতুমি ভালো। চল বেরোই।

কিন্তু আমার শপথ?

যে শপথ এত সহজে রাখা যায় সেটা কোনও শপথই না।

ক্যালেন্ডারে কোন মাস জানি না, আজকালকার দিল্লির সকাল ফিলস লাইক আশ্বিনের শারদপ্রাত। অগাস্টের শেষেও যে বুকধুকপুকুনি থাকে যে গরমটা আসলে যায়নি, দরজার কোণে দাঁড়িয়ে হাসি চাপছে, অন্ধকার ঘরে ঢুকলেই ধাপ্পা! চেঁচিয়ে লাফিয়ে পড়বে, সেটা আর নেই। এ বছরের মতো মুক্তি।

বললাম, পুজো আসার আগের সময়টা কী সুন্দর না? অর্চিষ্মান বলল, হ্যাঁ এসে গেলেই শেষ হয়ে যাবে। বিচ্ছিরি। বললাম, আজকাল হাওয়ার টেম্পারেচার ঠিক যেমনটা দরকার তেমন। অর্চিষ্মান বলল, হ্যাঁ, কিন্তু একমাস পরেই দরকারের থেকে বেশি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। জঘন্য।

বাঁ হাতে অমর কলোনির ফার্নিচার মার্কেট। এই মার্কেট থেকে আমরা খাট কিনেছি, চেয়ার কিনেছি, কফিটেবিল কিনেছি। এই সব সিরিয়াস সংসারী কাজকর্ম যে আমাদের দ্বারাও হতে পেরেছে, ভেবে অবাক লাগে। এমনও নয় যে আগের বছর কিনেছি, যখন কিনেছি রীতিমতো শিশুই ছিলাম বলতে গেলে। অবশ্য আমার বাবামায়ের আঠাশ বছর বয়সে আমি হয়েছিলাম। ডানদিকে বাবা নাগপালের বিখ্যাত ছোলে ভাটুরের দোকান, ইন্টারনেটের রিভিউতে সবাই পাগলা হয়ে যাচ্ছে, আমার অত কিছুও লাগেনি। চৌমাথার ফলের রসের দোকানে দাঁড়িয়ে একদিন অর্চিষ্মান স্ট্রবেরি মিল্কশেক খেয়েছিল, আমার মিল্কশেক দেখলে শরীর খারাপ করে, আমি পাশে দাঁড়িয়ে আকাশবাতাস দেখছিলাম। বাঁদিকের রাস্তা ধরে গিয়ে ঘুপচি চায়ের দোকানের অসামান্য চা মনে আছে। দিদির মুখটাও ভুলিনি।

কালচারাল সেন্টার এসে গেল। ডানহাতের তর্জনী মধ্যমা পেঁচিয়ে গার্ডভাইসাবকে বললাম, ক্যাফে যানা হ্যায়। ভাইসাব জাবদা রেজিস্টার এগিয়ে দিলেন। এন্ট্রি কর দিজিয়ে। অর্চিষ্মান আমাকে বলল, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ আপনিই করে দিন।

দুজনের জন্য ভেজ কিমবাপ, আমার জন্য স্পাইসি ভেজ নুডলস, অর্চিষ্মানের জন্য বাঁশের কঞ্চিতে পালা করে গাঁথা পর্ক সসেজ আর তকবোকি এল। সসেজে কামড় দিয়ে অর্চিষ্মান বলল, এইবারে কিছু কথা বলতে হল বাপরে।

সোম টু শুক্র অর্চিষ্মান মধ্যপ্রদেশ না হরিয়ানা কোথায় যেন ছিল, সেখানে ওকে অন্যবারের থেকেও বেশি কথা বলতে হয়েছে। পুরোটাই বাধ্যতামূলক নয়, অর্চিষ্মান নিজেও যেচে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছে। যত বলেছে তত নাকি ওর কাছে একাকীত্বের মানে স্পষ্ট হয়েছে।

একাকীত্ব মানে হচ্ছে নোবডি লাইকস মি।

চপস্টিক দিয়ে কিমবাপ তুলে মুখে পুরলাম। অর্চিষ্মান চপস্টিক ম্যানেজ করতে পারে না বলে ওর সঙ্গে খেতে বেরোলে এক্সক্লুসিভলি চপস্টিক ব্যবহার করি। থালার লাস্ট চাউমিনের টুকরো চপস্টিক দিয়ে মুখে পুরে হাসিহাসি তাকাই।

পরপর দুটো কিমবাপ খেয়ে নিলাম। খেল দেখাব বলে নয়, ভাবতে সময় নেব বলে।

আমি ক্রনিক একা। কিন্তু একাকীত্বের তীব্রতম মুহূর্তেও কি কখনও এই দুঃখে বুক ফেটেছে যে হা ঈশ্বর কেন কেউ আমাকে পছন্দ করে না, করলে এ নরকযন্ত্রণা ভুগতে হত না? আমার তো বরং উল্টো অনুতাপ হয়। হে ভগবান, আমি কেন সবাইকে এত অপছন্দ করি, না করলে এখন কাউকে খুঁচিয়ে হ্যাজানো যেত, এই নরকযন্ত্রণা ভুগতে হত না।

টোল ফেলা ছোট্ট সাদা সেরামিকের দানিতে চপস্টিক নামিয়ে রেখে বললাম বললাম, তুমি কি বলতে চাও শাহরুখ খানের কখনও একা লাগে না?

আহা নোবডি লাইকস মি মানে এভরিবডি ডিসলাইকস মি নয়। নোবডি লাইকস মি মানে আমি বলতে চাইছি যে এই যে আমি এত লোকের সঙ্গে এত কথা বলছি, এত লোকে আমার সঙ্গে এত কথা বলছে, এমনিই বলছে। বলার জন্য বলছে। এই জন্য বলছে না যে সকালে উঠে মনে হয়েছে আজ অর্চিষ্মানের সঙ্গে কথা বললে দারুণ আনন্দ হবে। বা অর্চিষ্মানের সঙ্গে কতদিন কথা হয়নি।  সে রকম মনে হলে কথোপকথন অন্যরকম হত। হয়তো একাকীত্বও কমত।

অ। ওটা লাইক নয়, আগ্রহের অভাব। তোমার একা লাগছে কারণ তোমার মনে হচ্ছে নোবডি ইজ ইন্টারেস্টেড ইন ইউ।

কিমবাপ শেষ করে নুডলসে মন দিলাম। নামের আগে স্পাইসি দেখে ভুলে, ভুল করেছি। যে সসে নুডলস চুবিয়ে দিয়েছে, গোচুজাং না কী নাম, স্পাইসি এবং মিষ্টি। আমাদের টকঝাল চানাচুর কেস। মনে পড়ে গেছে কী অর্ডার করা উচিত ছিল। প্যানকেক। ইয়াচেজন। বুসানে, ডালগ্রাক দু'জায়গায় আগে খেয়ে ভালো লেগেছিল। শপথ নিলাম এর পর থেকে কোরিয়ান খেতে গিয়ে প্যানকেক আর কিমবাপই অর্ডার করব। আর কিচ্ছু না। এবং না, এই শপথ আমি ভাঙব না।

আমারও কি এ রকম মনে হয়? নোবডি ইজ ইন্টারেস্টেড ইন মি? মনে হওয়ার কিছু নেই কারণ আমি জানি নোবডি ইজ ইন্টারেস্টেড ইন মি। কিন্তু তাতে দুঃখই বা পাই কী করে, আমিও তো কারও প্রতি ইন্টারেস্টেড নই। খুব ঘোরতর একা লাগার মুহূর্তে ভেবেছি যে তিনজনের সঙ্গে এই মুহূর্তে কথা বলতে পারি তাদের কারও সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই কি না। চাই না। তারা আমার যত পছন্দের হোকই না কেন, তাদের সঙ্গে যতই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারি না কেন, জাস্ট কথা বলাই হবে। ওপর ওপর ফাঁক ভরবে। যে রিয়েল আনন্দ, রিয়েল দুঃখ, রিয়েল শোক, রিয়েল ভয় সারাদিন ভেতরে ফুলেফেঁপে উঠছে তাদের এককণাও দাঁতের ফাঁক দিয়ে বার করা যাবে না।

অর্চিষ্মান বলল, সে সব বলবে বলেই লোকে থেরাপিস্ট ধরে।

থেরাপিস্ট ধরে, গুরু ধরে, মূর্তি ধরে। যে সব কথা কাউকে বলা যায় না তা বিশ্বাস করে এঁদের বলা যায়। আমার চেনা টপ তিনজন পেটপাতলা লোকের মধ্যে যিনি টপমোস্ট তিনি পাশ করা থেরাপিস্ট। কাজেই কোনও থেরাপিস্টের যদি আমার সিক্রেট মনখারাপ সারিয়ে পয়সা রোজগারের আশা থাকে তিনি সে আশা ত্যাগ দিতে পারেন। আমার চেনা কেউ গুরু নন। অচেনা গুরুকে বিশ্বাস করার মতো কাছাখোলা এখনও হতে পারিনি। আর মূর্তিকে? ওয়েল, নট ইয়েট। অবস্থা আরেকটু ঢিলে হোক।

*****

প্রসেনজিৎ এল। কচুবাটা হবে। বিয়ের প্রায় পাঁচবছর পর একদিন সয়াবিনের তরকারি মুখে পুরে, কী ভালো রেঁধেছে, বলে অর্চিষ্মান থমকে গিয়েছিল। তোমাকে বিয়ে করে আমার কী অবস্থা দেখো কুন্তলা, সয়াবিনও ভালো লাগছে। সেই প্রথম ওর মুখেচোখে আফসোস দেখেছিলাম। রিয়েল আফসোস। আজকাল অর্চিষ্মান ভর্তাবিলাসী হয়ে উঠেছে। আমার সঙ্গে বিয়ে, পরপর বাংলাদেশ প্রোজেক্ট মিলিয়েটিলিয়েই হবে। ফোন করে বলে, ওহ্‌ কুন্তলা, যা একখানা রসুনভর্তা খেলাম না। রসুনভর্তা, কুমড়োভর্তা, বরবটিভর্তা। অনেকদিন ধরে বলছিল একদিন কচুবাটা হোক, রাজুর কাছে উপযুক্ত ভ্যারাইটির কচু পাওয়া যাচ্ছিল না। রাজু প্রসেনজিতের জামাইবাবু। একদিন বিকেলে,প্রসেনজিৎ এসে বলল, কচু এসেছে। বলেই বলল, সকালে এসেছিল এখন আছে কি না জানি না। মারকাটারি মার্কেটিং। আমি বললাম, সে কী এখন কী হবে? প্রসেনজিৎ বারান্দার গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে ওপরদিকে চেঁচিয়ে বলল, রাজু, বউদির জন্য একটা কচু রেখে দিস। রাজু ওপর থেকে চেঁচিয়ে জানালো যে রাখা আছে, প্রসেনজিৎ এখনই গিয়ে নিয়ে আসতে পারে। প্রসেনজিৎ দৌড়ে গেল। অর্ধেক আই ব্লক শুনল আমরা আজ কচু খাব।

আমি অন্য কথা ভাবছিলাম। প্রসেনজিৎ আমাদের বাড়িতে প্রায় পাঁচ বছর ধরে আসছে। সাড়ে চার বছর ধরে শিওর ছিলাম ও আমাকে দিদি বলে ডাকে। কেন ছিলাম জানি না। সম্বোধনের প্রয়োজন তো পড়ে না বিশেষ। কিন্তু গত ছ'মাসে অন্ততঃ ছ'বার প্রসেনজিৎ আমাকে এক্সপ্লিসিটলি বউদি বলে ডাকল বা উল্লেখ করল। অর্চিষ্মান যে এ বাড়িতে ওর প্রাইমারি রিলেশন হয়ে উঠছে সেটা ভালো লাগল না।

কষে রসুন শুকনোলংকা পুড়িয়ে, আমাদের ননস্টপ হাঁচিয়ে, কচু বেটে রেখে গেল প্রসেনজিৎ। গরম ভাতে মেখে খেতে খেতে আরামে মাথা নেড়ে অর্চিষ্মান বলল, দিনকে দিন বাঙাল হয়ে যাচ্ছি। খুঁটিয়ে দেখলাম। গলায়, চোখেমুখে, অতটা আফসোস ধরা পড়ল না। সময়ে আফসোসও অভ্যেস হয়ে যায়।

*****

কচুবাটা শেষ, কচুবাটার মজাও। এদিকে রাত এখনও বাকি। অর্চিষ্মান শনিরবির জন্য এসেছে, সোমবার চলে যাবে। এই আটচল্লিশ ঘণ্টা মজায় মজায় ছেয়ে ফেলতে হবে। বুকমাইশো-তে একটা সিনেমার নামেই মার্ডার দেখাচ্ছে, সেটার টিকিটই কাটা হল। বাকিংহ্যাম মার্ডারস। ইংল্যান্ডের পটভূমিকাতে খুনখারাপি, সাম্প্রদায়িক টেনশন, বিখ্যাত শেফ রণবীর ব্রারের বড় পর্দায় দ্বিতীয় আত্মপ্রকাশ। ভালো লাগবে না ধরে নিয়ে গেছিলাম বলে বেশি ভালো লাগল? হতে পারে। অবজেকটিভ ভালোও আছে। বোরিং জায়গাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে বা বানানোই হয়নি। বিরক্ত হতে শুরু করার আগেই সিনেমা শেষ। পাশে তিন যুবতী এসে বসাতে আতংকিত হয়েছিলাম, সারা সিনেমা কথা বলবে, হাসবে, পনেরো সেকেন্ড পর পর ফোন দেখবে, নীল আলো চোখে ধাক্কা মারবে। চুপ করতে বললে সোজা চোখে চোখ রাখবে যাতে স্পষ্ট লেখা থাকবে আন্টি, গো অ্যান্ড মাল্টিপ্লাই ইয়োরসেলফ। তেমন কিছুই হয়নি। সিগারেটের বিরুদ্ধে সতর্কীকরণ চলাকালীন ফোন এসেছিল, পাশের সিটের মেয়েটা ফিসফিসিয়ে, শুরু হো রহা হ্যায়, বাদ মে বাত কর রহি হুঁ, বলে ফোন কেটে দিল। আমি মুগ্ধ এবং চমৎকৃত। মেয়ে উন্নতি করুক।

রবিবার সব জমা কাজ শেষ করে ফেলব ভেবেছিলাম, কফিশপে তিনঘণ্টা বসে পনেরো মিনিটের কাজ করে বাকি সময়টা ইউটিউব দেখে ধুত্তেরি বলে ইডলি খেয়ে বাড়ি চলে এলাম। দুপুরে কাজ হল না বলে বিকেলে ফ্রাস্ট্রেশন হল, বিকেলে ফ্রাস্ট্রেশন হল বলে রাতে কাজ হল না। অর্থাৎ আজটাও কালকের মতোই গেল। কালটাও আজকের মতোই যাবে। পরশুটা কালকের মতো। অর্থাৎ কিচ্ছু বদলাবে না। কুন্তলা থেকে যাবে কুন্তলাতেই। আনবেয়ারেবল হেভিনেসে মাথা ধরে থাকবে। কী করব, কেন করব, উত্তর মিলবে না। নতুন কোনও রাস্তা খুলবে না চোখের সামনে। যে রাস্তাগুলো ছিল একে একে বন্ধ হয়ে যাবে।

*****

অর্চিষ্মান সকালে অন্যদিনের থেকে আধঘণ্টা আগে উঠবে বলে বাড়িতে যত ফোন আছে সবেতে অ্যালার্ম দিতে হবে। ও যখন উঠবে তখন আমার ভরদুপুর তবু নাকি রিস্ক নেওয়া যাবে না।

সকালে উঠে অবশ্য ভালোই হল। এক্সট্রা কথা বলার এক্সট্রা সময় পাওয়া গেল। পুনরুজ্জীবিত 'মহানগর' কয়েকটা শহরের হলে রিলিজ করেছে। তিন্নি দেখে মুগ্ধ। লিখেছে, শিগগিরি দেখে আয়। কথা মহানগর-এর দিকে ঘুরল। সিনেমা বলতে আমরা মোটের ওপর গল্প বুঝি কাজেই গল্প নিয়েই কথা হল। সত্যজিৎ রায়ের নিজের লেখা গল্প থেকে সিনেমা আর অন্যের লেখা গল্প থেকে সিনেমা কি আলাদা? এ রকম গল্প কি সত্যজিৎ লিখতেন? মহানগরের গল্পটা কার লেখা? কারওরই মনে পড়ছে না।

অর্চিষ্মান যেদিন বাড়ি ফেরে দোতলা থেকে টাটা করি, বাড়ি না ফিরলে টাটা করতে নিচে যাই। শুরুতে যাওয়াটা তাৎপর্যহীন ছিল, কিন্তু রেগুলার করতে করতে ব্রেনের বাগানে একটা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। একদিন যদি না যাই এবং সেদিনই যদি গোলমাল ঘটে, সকালে যে নিচে নামিনি সেটাই সবার আগে ধাঁই করে মাথায় আসবে। ধরে নেব আমি গেলাম না বলেই গোলমালটা হল। এতদিন "চল যাই তোমাকে টাটা করে আসি" বলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে শিস দিতে দিতে চটি ফটফটিয়ে নামতাম, এখন বাথরুমে গেলে "এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে যাও, এক্ষুনি বেরোচ্ছি" চেঁচিয়ে, ডান পায়ে বাঁ আর বাঁ পায়ে ডান চটি পরে দৌড়োই।

অর্চিষ্মানের অফিসের নাম লেখা গাড়ি মোড় থেকে বাঁদিক নিয়ে অদৃশ্য হল। রোজকার মতো ওই মুহূর্তে আরেকবার হাত নাড়ি। আমি অর্চিষ্মানকে দেখতে পাই না, অর্চিষ্মান আমাকে দেখতে চাইলে দেখতে পাবে। আমি নাইন্টি পারসেন্ট নিশ্চিত অর্চিষ্মান টুইটার দেখছে, বাকি দশ পারসেন্টের মুখ চেয়ে হাত নাড়ি। বাড়ি থেকে অতিথি চলে গেলে মা গেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যতক্ষণ অতিথির পেছন ফিরে তাকিয়ে আমাদের দেখতে পাওয়ার চান্স আছে, ততক্ষণ।

অর্চিষ্মান অদৃশ্য হওয়ার পরেও গেটে দাঁড়িয়ে আকাশবাতাস দেখলাম। প্যান্ডেল প্রায় শেষ। মোড়ে মোড়ে গান, আবৃত্তি, নাচের প্রতিযোগিতার প্রকাণ্ড পোস্টার পড়ে গেছে। একঝলক হাওয়ায় গায়ে কাঁটা দিল। রীতিমত ঠাণ্ডা। গেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই টের পেলাম, মুড ভালো হচ্ছে। চারপাশের আলো শোঁ শোঁ করে আমার ব্রেনের ভেতর ঢুকে পড়ছে। হৃদয়টা প্রসারিত হতে শুরু করেছে, আমি আর কাউকে অপছন্দ করছি না, জাজমেন্ট বানান ভুলে যাচ্ছি। আর কিছুটা আলো ঢুকলেই অচেনা গানের সঙ্গে গুনগুনিয়ে উঠব, কীবোর্ডে আঙুল উসেইন বোল্ট ছুটবে, বিশ্বাস করতে শুরু করব হবে হবে, সব হবে। কী হবে জানি না, হবেই যে নিঃসংশয়।

অর্চিষ্মানের হোয়াটসঅ্যাপ। নরেন্দ্রনাথ মিত্র। ঘরের দিকে ফিরলাম। উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। এ আলো থাকবে না। দু'ঘণ্টা পর বা দোতলায় পৌঁছতে পৌঁছতেই আবার অন্ধকার হয়ে যাবে সব। আমি আমিই থাকব। আবার অপেক্ষা। কখন রোদ ওঠে বা হাওয়া দেয়। ঝমঝম বৃষ্টি নামে বা ফোন আসে। এমন কারও, যাকে আমি একটুও অপছন্দ করি না।

হয় জীবন এ রকমই নয় পেরিমেনোপজ।

Comments

  1. chomotar ... poristhiti gotik a ek jaygay nichu ekta pachil a bose paa dolate dolate porlam bole aro bhalo laglo... badam bhaja thakle aro bhalo hoto.
    Jeeban ekkebare erokom e bote.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও বাদামভাজা নেই তবু আপনার মন্তব্য মন ফুরফুরে করল, শিবেন্দু। থ্যাংক ইউ। পার্শিয়ালি হলেও পুরোটা যে শরীরের ঘাড়ে চাপানো যাবে না, অন্য দলের লোকের কাছ থেকে সে আশ্বাস পাওয়াটাও ইম্পরট্যান্ট।

      Delete
  2. Darun lekhagulo. Tukro diary r moton.

    BTW, Korean khabar amader khub pochhonder. Raka South KOrea thakar samay ami koekbar giyechhilam, khub upobhog korechhi. Oder kichhu fried chicken e madhu dey, kintu Bibimbap-Kimbap kintu misti noy. Amader darun lagto. Delhi thakar samay Busan er naam shunechhilam. Noida theke asar effort dite pari na. Onyto jaygatar kotha jantam na. Nahole thik jetam. Kolkatay subidher kichhu nei.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সায়ন। কোরিয়ান খাবার জগতে উচ্চ প্রশংসিত। আমি আপনার সঙ্গে ঝগড়া করছি না একদমই, কিন্তু আমার প্রত্যেকবার কোরিয়ান খাবার মিষ্টি লেগেছে। মিষ্টি মানে কি রসগোল্লা? মিষ্টি মানে মিষ্টিমিষ্টি। যতটুকু খেয়েছি মনে হয়েছে ওঁদের যে বেস সসগুলো, সেগুলো হয় মিষ্টি চাল বাটা/সিরাপ দিয়ে তৈরি হয়, সেটাই আমার অস্বস্তির কারণ। অ্যাকচুয়ালি, আমার চেনা যাঁদের কোরিয়ান খাবার ভালো লাগে তাঁদের ওটাই ভালো লাগে, টক মিষ্টি ঝাল উমামির ব্যালেন্স। তাঁরা বাপির টকমিষ্টি চানাচুরও মারাত্মক পছন্দ করেন। ছানার ডালনা। সব রান্নার শেষে, নিরামিষ হলে তো রক্ষা নেই, ব্যালেন্স করার জন্য একচামচ চিনি দেন।

      ব্যালেন্স ব্যাপারটা আমাকে অ্যাপিল করে না। কাজেই।

      ইয়ার্কি অ্যাপার্ট, আপনার কমেন্ট পড়ে আমি ইন্টারনেটে খুঁজতে গেলাম। যে রকম সন্দেহ করেছিলাম, আমার মতো আরও লোক আছে যাঁদের কোরিয়ান খাবার মিষ্টি লাগে। কেউ বলছে কোরিয়ান খাবারে মিষ্টির পরিমাণ দিনকে দিন বাড়ছে। পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে কোরিয়ান খাবারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এ জিনিস ঘটতে পারে বলছে অনেকে।

      আপনার সঙ্গে যে জায়গাটায় একেবারে একমত হতে রাজি - কোরিয়ায় গিয়ে কোরিয়ান খাবার খেলে হয়তো সম্পূর্ণ অন্য স্বাদ আবিষ্কার করব। বাইরে ইন্ডিয়ান দোকানে ইন্ডিয়ান খাবার খেয়ে ধাঁধা লাগার অভিজ্ঞতা তো আছে।

      বাই দা ওয়ে, অন্নপূর্ণায় মাঝে মাঝে কাঁচালংকা রসগোল্লা করে। আপনি দিল্লি এলে খাওয়াব।

      Delete
    2. কাঁচালংকা রসগোল্লা!!! কি সাংঘাতিক!!

      কলকাতার কিছু ক্যাফেতে কোরিয়ান খাবার পাওয়া যায়, একটায় খেয়ে অন্যগুলোতে না খেয়ে নাকচ দিয়েছি।

      তবে আপনার কোরিয়ান খাবার লাগলেও লাগতে পারে। আমার পিওর ঘটি টেস্ট বার্ড :-D

      Delete
    3. অঅঅ। এইবার কেস ক্লিয়ার।

      সিরিয়াসলি বলছি, অনেক বাঙালবাড়িতেও রান্নায় মিষ্টি দেওয়া হয়, এটা আমি অনেক বড় বয়সে আবিষ্কার করেছি। আমার বাড়িতে একেবারেই দেওয়া হত না। তাই হয়তো আমার ধারণা ছিল যে ব্যাপারটা মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ, সে রকম হয়তো না।

      তাছাড়া আমার ফ্লেভার মিক্স না করার ইস্যুটা বাঙালত্বের থেকেও বাতিকজনিত হওয়ার চান্স বেশি। খাবার থালায় এই পদের সঙ্গে ওই পদ ঠেকে গেলেও প্যানিক হয়, জিভেও সেম কেস।

      "কলকাতার কিছু ক্যাফেতে কোরিয়ান খাবার পাওয়া যায়, একটায় খেয়ে অন্যগুলোতে না খেয়ে নাকচ দিয়েছি।" দিল্লির খাবার অন অ্যাভারেজ কলকাতার থেকে বেটার। খুন করে ফেললেও আমাকে এই মত থেকে কেউ টলাতে পারবে না।

      Delete
  3. প্রদীপ্তSeptember 30, 2024 at 11:02 AM

    মাঝে মাঝে আমি পুরোনো অবান্তর পড়ি। অবান্তরের সাথে আজকের আলাপ নয় কিনা, নিজের লেখা তো নিযে দুবার পড়ে উঠতে পারিনা, অবান্তর পড়লে ওই সময়টা ছুঁয়ে যায়। পনেরো বছরের পোস্টের কমেন্ট বন্ধ রেখেছিলে নিশ্চয়ই চাওনি কেউ কিছু লিখুক তাও লিখলাম।

    এই লেখাটা পড়তে পড়তে মনে হল, তুমি যে উপন্যাসের জব্যে অবেকদিন ধরে ভাবছ। এবার মনে হয় শুরু করে দিতেই পারো।

    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত। নিজের পুরোনো লেখা নিজে পড়তে পারার থেকে শক্ত কাজ পৃথিবীতে আর আছে বলে আমার মনে হয় না।

      Delete
  4. Replies
    1. হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা।

      Delete
  5. কুন্তলা সাউথ কোরিয়া তে কিছু বছর ছিলাম , কিছু খাবার ভালো লাগতো , বিশেষ করে ইউনিভার্সিটি র canteen এর খাবার গুলো |পোহাং বা সিওল দু জায়গাতেই একই ব্যাপার | দেশে পুনের একটা কোরিয়ান রেস্তোরাঁ তে খেয়ে বলেই এসেছিলাম এরকম করেছে কেন ? তবে দিল্লি তে থাকাকালীন বা বছরে একবার দুবার দিল্লি গেলে মজনু কা টিলার বুসান এই যাই . ক্যালিফর্নিয়া র কোরিয়ান bbq এর এক্সপেরিয়েন্স ও খুব সফিস্টিকেটেড . তবে কুচবিহারে একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে ওনার একটা ফুড ট্রাক আছে উনি কোরিয়াতে প্রায় 12 বছর স্যামসুং এ শেফ হিসেবে কাজ করেছেন | দুর্দান্ত কিমচি , কিমপাপ আর তাকগালবি পার্টি করি ঘরে |
    আর আমিও যোগ ব্যায়াম শুরু করেছি 6 সপ্তাহ হলো অনেক রকম ঝামেলা পাকাচ্ছে শরীর মন | পেরিমেনোপজ আর মাইগ্রেন এর সমস্যা কমেছে কিনা বুঝছিনা কিন্তু কিছু একটা ভালো হচ্ছে |~ সুমনা ~

    ReplyDelete
    Replies
    1. সুমনা, যোগব্যায়ামে ভালোই হয় শুনেছি। কিন্তু ধৈর্য লাগে আর কানে মিকা সিং গুঁজে করা যায় না, যে কারণে আমাদের দ্বারা হয়ে উঠছে না।

      ইন্টারনেটে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, কোরিয়াতেও "সিওল" স্টাইল ফুড নিয়ে নাকবেঁকানো চলে (তুমি হয়তো পোহাং বা সিওলের খাবারের প্রশংসাই করেছ, কিন্তু ক্যান্টিনের খাবার তাই সেগুলো ঘরোয়া কায়দার/বেটার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি)। এক কোরিয়ান মানুষ লিখেছেন, যার বাড়ি সিওলে নয়, তিনি প্রথমবার সিওলের রেস্টোর‍্যান্টের খাবার খেয়ে ঘাবড়ে গেছিলেন কারণ জীবনে এত মিষ্টি খাবার খাননি।

      তবে এগুলো সব সাবরেডিট, সত্যি মিথ্যে জানি না।

      কিমচি আমারও ভালো লাগে, কারণ ওটাতে অনেক জায়গাতেই এখনও চিনি দেয় না। অর্চিষ্মানের প্রিসাইজলি যে কারণে পোষায় না। বেশি ঝাল লাগে। ভালোই, আমার ভাগে ডবল।

      Delete
    2. বেশীর ভাগ দামি রেস্তরাঁ তে তুমি যে সমস্যা বলছো সেগুলো হতো | তবে প্রফেসর পার্টি না দিলে আমরাও সেগুলোতে যেতাম না | ছোটোখাটো তেই খেতাম | আর শশা আর মুলো দিয়ে যে কিমচি হয় ওটা একটু মিষ্টি | তবে আমি শীতকাল এ সব সব্জি আর chinese cabbage দিয়ে কিমচি বানিয়ে রেখে দি . আচারের মতো | তোমার তো ভালো লাগবেই , মিষ্টি একদম না | আমি ঢাকার বাঙাল আমার বর বর্ধমানে দেশ | তবে রান্নায় মিষ্টি আমার ছেলেও খায়না

      Delete
  6. Auntie, go and multiply yourself, eta kokhono shunini, onno onek kichchu shunechchi, kintu eta shunini. Besh laglo. Eita ki apnar nijosso na collected? Valo thakben.

    Saugata

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার কিছুই নিজস্ব না, সৌগত, সবই কালেক্টেড। আসল এক্সপ্রেশনটার ইউফেমিজম খুঁজতে দিতে গুগল বার করে দিল।

      Delete
  7. সাতদিনের সাতটা লেখা একসাথে পড়তে বেশ ভাল লাগল গো , থেরাপিস্ট , কোরিয়ান সবই ইন্টারেস্টিং টপিক। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এবার থেকে এ রকমই লিখব ভেবেছি রে ঊর্মি। পরে দারুণ করে লিখব ভেবে ঘটনা জমিয়ে জমিয়ে কিছু লেখাই হয় না।

      Delete
  8. এই রে, এবার তো বাংলা লিখতে ভয়ই করছে, কী ধরে ফেলবেন কে জানে? ভাগ্যে প্রবাসী ব্যাপারটা গোপন নেই আর।

    আমার পরিচিত এক ভদ্রমহিলা একদিন বললেন, "আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার বুঝিনা। এই দেখ না, আমার ছেলের বৌটা ঠিকঠাক খাবার খায় না, এদিকে ছিয়াশি কিনে খাচ্ছে।" প্রথমে ভেবেছিলাম ছিয়াশি মানে হয়তো কোনও মদ কী গুটকার ব্র্যান্ড হবে, তারপর শুনলাম সকালে ভিজিয়ে খায়। তখন উদ্ধার হল ছিয়াশি মানে চিয়া সিড্স।

    এদিকে পৌলমী আবার চিয়া সিড্স থেকে চিয়া চারার চাষ করেছে। সেগুলোকে নাকি মাইক্রো গ্রিনস বলে। অন্য খাবারের ওপর সেগুলো ছড়িয়ে খেলে নাকি মারাত্মক উপকার। এখনও খাওয়া হয়নি, শুধু ফটো তুলছি। এই বেলা যেখানে যা কমেন্ট করার করে রাখি। খাবার পর কী হবে কে বলতে পারে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. চিয়া সিডসকে ছিয়াশি বানানোটা চমৎকার। চিয়া গাছ জন্মানোর টাইম ল্যাপস ভিডিও দেখেছি, যক্ষীর মাথা ঘিরে জঙ্গলের মতো বেড়ে ওঠে। ব্যাপারটা ফ্যাসিনেটিং এবং স্বল্প ভয়েরও।

      আপনার বাংলা অতি উচ্চমানের, প্রবাসী বা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ - দুইয়ের বদগুণ থেকেই মুক্ত।

      Delete

Post a Comment