কফি শপ ৩ঃ শু
সকালে হাত আকাশে তুলে কফি শপে ঢুকি। গুড মর্নিং ম্যাম, ক্যায়সে হো ম্যাম-এর উত্তরে হাই হ্যালো করি। খোঁজ নিই,রাতে কার কেমন ঘুম হয়েছিল, ব্রেকফাস্ট মে কেয়া থা, আসার পথে হেলমেট পরেছিল কি না। নেক্সট দশ ঘণ্টা ধরে দোকানে যারা ঢোকে ও বেরোয়, সবার সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা বলি।
এবং এত অ্যাগ্রেসিভলি ব্যাপারটা প্র্যাকটিস করি যে অর্চিষ্মানের ধারণা আমি ব্লু টোকাইতে যাওয়া শুরু করার পর কিছু লোক আতংকে ব্লু টোকাই ত্যাগ দিয়েছে
তা কেন? ওর মতো পাবলিকও আছে। যারা আমার এই অ্যাগ্রেসিভ বন্ধুত্বপূর্ণতা রুথলেসলি রিজেক্ট করেছে। ঠোঁট টিপে সরে গেছে। আমিও, অফ কোর্স, তাদের আর বিরক্ত করিনি। আমি গায়ে পড়া। উন্মাদ নই।
অর্চিষ্মান বলেছে, গুড। দেয়ার ইজ স্টিল হোপ ফর হিউম্যানিটি।
অর্চিষ্মানও শনিরবি আমার সঙ্গে কফি শপে যায়। কাজ করে, কান খোঁচায়, হাই তোলে। কানে গান গুঁজে ফোনের দিকে হাসি হাসি মুখে বসে থাকে। আমাকে যারা রোজ হাই বলে, ওকে হাই বলতে এলে ঠোঁট টিপে হেসে আবার ফোনের দিকে তাকায়।
বলে, কী বলব কুন্তলা?
কেন? বলবে, আঃ কী গরম, উঃ কী ঠাণ্ডা, সি আর পার্কে কী পলিউশন, লালকেল্লায় কী বোমাবাজি, হংকং-এ কী অগ্নিকাণ্ড? কথা বলারও দরকার নেই, চনমনে হাত নাড়লেও তো হয়।
অর্চিষ্মান মুখ ছ্যাতরায়। যত্তসব অ্যামেরিকান শান্তিপুরী। কার্বাংকল অন মিনিংফুল হিউম্যান কানেকশন।
*
বিচিত্র লোকের সঙ্গে বিচিত্র গল্প। দীর্ঘদিন ধরে করতে করতে বৈচিত্র্যেরও প্যাটার্ন তৈরি হয়। শু-এর সঙ্গে বাইরের বারান্দায় কথা হয়। এই মার্কেটে আট দশ বছর ধরে কফি খেতে আসছে শু। অনেক হাওয়া বইতে দেখেছে।
বল তো কোন দোকানের কফি সবথেকে ভালো?
বুক চেতাই। কেন? আপনা ব্লু টোকাই?
শু নাকচ করে। ব্লু টোকাইকে দশে ছয় দশমিক পঁচাত্তর দেওয়া যেতে পারে ম্যাক্স। পারফেক্ট টেন ছিল একটা দোকান। বন্ধ হয়ে গেছে। যতদিন খোলা ছিল শু সেখানেই যেত কফি খেতে। শু-এর সঙ্গে আরও লোক যেত, কফি খেত, কিন্তু সে কফির মাহাত্ম্য শু-এর মতো কেউ বুঝত না।
মাহাত্ম্য বোঝা সবার কম্ম নয়। সি আর পার্কে তো কবে থেকে লাট খাচ্ছ, বল দেখি কোন দোকানের মিষ্টি সব থেকে ভালো? শু সিগারেট টানে।
লাফিয়ে হারমিওনি হই। আমি জানি আমি জানি চোরাবালি কতখানি... অবশ্য আমি কেন, এই উত্তরটা সবাই জানে। কমলা।
কমলা অ্যাবাভ অ্যাভারেজ। বেস্ট না।
রোকো রোকো। আর একটা অ্যাটেম্পট প্লিজ। অ্যারিস্টোক্র্যাট।
উঁহু।
অন্নপুর্ণা? সন্দেশ? ভি আই পি সুইটস? সুইট বেংগল? স্লাইস অফ বেংগল? ইয়াম্মি কলকাতা?
উঁহু।
টেবিলের কোণা চেপে বলি, রসরাজ?
শু হাসে। এই দোকানটা চার নম্বরে।
ওহ্, আগে বলবে তো। লোকনাথ।
*
লোকনাথ নিয়ে দুটো গল্পের ডিটুর করে নিই। প্রথমটায় অর্চিষ্মান আছে। এক শনি না রবিবার, অর্চিষ্মান বাড়িতে, আমি ব্লু টোকাইতে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে সাধাসাধি করে এসেছি, "একটু পরে ইচ্ছে হলে চলে এসো প্লিজ," এসে থেকে পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর খুঁচিয়ে, দুপুর নাগাদ ক্ষান্ত দিয়ে বেড়ালের ভিডিও পাঠাতে শুরু করেছি। বেলা চারটে নাগাদ, পঁয়ষট্টিটা মেসেজ ডেলিভারড, রেড অ্যান্ড নট রিপ্লায়েড হওয়ার পর পিং এল।
কখন বাড়ি আসবে কুন্তলা? অবশ্য আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, যখন ইচ্ছে এসো।
অর্চিষ্মানের পিং আর এক্সট্রা হট ডবল এসপ্রেসো একই সঙ্গে ডেলিভারি হল। বরের পাত্তা পাওয়ার উল্লাসে সেই ডবল শট একবারে গলায় ঢেলে বেরিয়ে পড়লাম। জিভের ডগা থেকে খাদ্যনালীর গোড়া দপদপাতে লাগল। বেরোনোর আগে "কী নিয়ে যাব?" লিখেছিলাম, সেও ডেলিভারড অ্যান্ড রেড হয়ে পড়ে থাকল। মাঝে মাঝে মনে হয় অর্চিষ্মান আমাকে লেখার পরই ফোনটা নিজের থেকে যতদূরে সম্ভব ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এ ছাড়া এই ইমিডিয়েট দীর্ঘ নীরবতার আর কোনও ব্যাখ্যা হতে পারে না।
মাথা খাটালাম। অর্চিষ্মানের কী কী ভালো লাগতে পারে। জুসের দোকানসংলগ্ন এক হাত বাই দেড় হাত চাতালে এক অতি ভদ্র বাচ্চা ছেলে মোমোর স্ট্যান্ড লাগিয়েছে - অলরেডি সুপার হিট। অর্চিষ্মান আর প্রসেনজিতের জন্য চিকেন, আমার জন্য ভেজ মোমো প্যাক করালাম। পাশের ঠেলার মাথায় বম্বে বড়া পাও (অথেনটিক)-এর বোর্ড বারো মাস ঝোলে, ভাইসাব দু'মাস বাদে বাদে একবার দেখা দেন। সেদিন দেখি দিয়েছেন। সেই অসপিশাস অকেশনের মর্যাদা দিতে বড়া পাও নিলাম। প্লেন না, আমুল বাটারে ভাজা।
লোকনাথের কাউন্টারে নেট ঢাকা সদ্যভাজা সিঙাড়ার ঢিপি। পুরনো তেল আর ভাজা ময়দার গন্ধে গোটা চার নম্বর মার্কেট ম ম। প্রসেনজিৎ আর অর্চিষ্মানের জন্য দুটো নিলাম। সিঙাড়া আমি ত্যাগ দিয়েছি, মাঝে মাঝে অর্চিষ্মানের জোরাজুরিতে ওর থেকে এক কামড় খাই, ব্যস।
অর্চিষ্মানের জিভ অন্নপূর্ণার সিঙাড়ায় অভ্যস্ত। লোকনাথের সিঙাড়া স্বাদে, সাইজে, স্পিরিটে অন্নপূর্ণার সিঙাড়ার একশো আশি ডিগ্রি। কামড় দিয়েই অর্চিষ্মান বলল, এটা কোন দোকানের?
লোকনাথ।
অর্চিষ্মান তাকিয়ে থাকল।
বললাম, চার নম্বরের মিষ্টির দোকানটা।
চার মানে দাঁতের ডাক্তারের উল্টোদিকে?
ওটা তিন। চার কালীবাড়ির উল্টোদিকে।
অর্চিষ্মান সিঙাড়ায় মন দিল। আমি জানি ওর মাথায় কী চলছে।
ওই দোকানটার নাম লোকনাথ তুমি জানতে না তো?
তুমি কেন জানতে তাতে আমি বেশি ইন্ট্রিগড। এই সব হাবিজাবি তথ্যে ব্রেন জ্যাম করে রাখ বলেই...
বলেই যে কী অর্চিষ্মান ভাঙল না, আমার খোঁচানোর প্রশ্নই নেই।
একটা লোক কত কম মনোযোগ খরচ করে জীবনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে পারে, অর্চিষ্মানকে না দেখলে জানতাম না। এমন নয় যে খারাপলাগা জিনিসে মনোযোগ দিচ্ছে না। আমাদের আরামের পিন্যাকল, পাশাপাশি শুয়ে বাজে বাংলা সিনেমা দেখাতেও অর্চিষ্মান জিরো মনোযোগী। আধঘণ্টা পর পর সিনেমা পজ করে চা নিতে ওঠে। কী হল একটু বলে দাও। ও নাকি তাকিয়েই ছিল, কী হয়েছে দেখেনি।
তাকিয়ে থাকা কিন্তু না দেখা, চুপ করে থাকা কিন্তু না শোনা, মাথা নাড়া কিন্তু একটি বর্ণ না বোঝা, সর্বোপরি বোঝার চেষ্টাই না করার জন্য অ্যাপোলোজেটিক নয় অর্চিষ্মান। বাকিদের দেখা, শোনা এবং বোঝার চেষ্টাই বরং অর্চিষ্মানের ভেতর বিপুল বিস্ময়ের জন্ম দেয়।
আমি বলি, কারণ সেটাই নর্ম্যাল, অর্চিষ্মান। সামনে একটা কিছু চললে মন দিয়ে দেখা, বললে অ্যাটেনশন দিয়ে শোনা।
অ্যাটেনশন দেওয়ার মতো কিছু কি চলছে তোমার আশেপাশে, কুন্তলা? কিছু কি বলছে কেউ?
সাড়ে পনেরো বছর আগে আমাকেও বিন্দুমাত্র অ্যাটেনশন না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। অ্যাটেনশন না পাওয়া আমার নতুন অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু অর্চিষ্মানকে দেখে মনে হয়েছিল এর অ্যাটেনশন পেলে আমার আখেরে লাভ। কাজেই সে অ্যাটেনশন আদায় করতে আমি প্রচুর পাঁপড় বেলেছি, ওগো দেখ গো দেখ গো আমি এখানে, এই যে হ্যাঁ হ্যাঁ আর একটু নিচের দিকে তাকাও বলে লাফিয়েছি ঝাঁপিয়েছি।
আই রিগ্রেট নাথিং।
*
লোকনাথ সংক্রান্ত প্রথম গল্পে অর্চিষ্মানের থাকা সংক্রান্ত ডিসক্লেমারের দরকার ছিল না। কারণ দ্বিতীয় গল্পেও অর্চিষ্মান আছে। গল্প মানে ঘটনা। ঘটেছে কয়েক সপ্তাহ আগেই।
অর্চিষ্মান সেদিনও বাড়িতে ছিল, আমি ব্লু টোকাইতে দিনভর কাটিয়ে পাঁচটা নাগাদ, গত আটঘন্টায় পাঠানো সাতষট্টিটা মাল্টিমিডিয়া মেসেজের একটাতে অর্চিষ্মানের লাইক পেয়ে বুলেটের বেগে ব্লু টোকাই থেকে বেরিয়েছিলাম। মাঝপথে লোকনাথে থেমে সিঙাড়া নিলাম। সিঙাড়ার পাশে মোটা মোটা পাটিসাপটার ঢিপি। অর্চিষ্মান সিঙাড়া এক্সপেক্ট করেছিল, কাজেই ওটা ছুঁড়ে ফেলে "দেখি দেখি এটা কী" বলে পাটিসাপটার ওপর টুট পড়ল। যতক্ষণ দরজার হুকে চাবি ঝোলালাম, জুতো বাক্সে ঢোকালাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই একটা শেষ করে ফেলল।
ভালো?
গোলাপের গন্ধটা কম হলে আরও ভালো হত।
হ্যাঁঃ?
খেয়ে দেখো।
ঠিকই। পাছে নর্ম্যাল পাটিসাপটায় লোকের মন না ভরে, ঠেসে গোলাপের সেন্ট মেরেছে।
*
অ্যামেরিকা'স নেক্সট টপ মডেল বলে টিভিতেএক সময় একটা অদ্ভুত প্রতিযোগিতা হত। সে অদ্ভুত প্রতিযোগিতায় সিজনে সিজনে অদ্ভুত প্রতিযোগীরা নাম দিতেন এবং অদ্ভুত লোকেরা বিচারকের আসন আলোকিত করতেন। সেই সব অদ্ভুত জাজদের মধ্যেও যিনি সবথেকে বেশি অদ্ভুত, একবার এক প্রতিযোগীকে তিরস্কার করছিলেন। ওই প্রেক্ষাপটে তিরস্কার যে লাইনে হয়ে থাকে - কুচ্ছিত বা মোটা বা বেঁটে - সে সব না, তাঁর তিরস্কারের বেসিস ছিল, "ইউ ডু নট লুক এক্সপেনসিভ।"
আমি মফঃস্বলি বাংলা বালিকা বিদ্যালয়, লুক বলতে ততদিন থ্যাবড়া টিকলো, কুতকুতে পটলচেরা দুধেআলতা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বুঝে এসেছি। এক্সপেনসিভ যে একটা লুক সেটা আমার ওই প্রথম জানা। আমার এবং আমার চোদ্দপুরুষের।
সে চোদ্দ বছর আগের কথা। তার পরের চোদ্দ বছরে ক্রমশঃ এক্সপেনসিভকে আসল লুক হয়ে উঠতে দেখলাম। আসল লুক, আসল টেস্ট, আসল এন্টারটেনমেন্ট। বিরিয়ানির প্লেট সামনে নিয়ে মাংস তুলে ক্যামেরার সামনে ঝুলিয়ে ধরে বলছে, সাইজ দেখেছ মামা? পার পিস মিনিমাম দেড়শো গ্রাম। বাড়িতে মায়ের কড়াইয়ের মধ্যে ক্যামেরা নিয়ে প্রায় ঢুকে গিয়ে বলছে, ওয়াও, বাবা আজ কিং-সাইজ চিংড়ি নিয়ে এসেছে বাজার থেকে, তাই না মা? চিংড়ির কিং-সাইজ আর একবার আন্ডারলাইন্ড হচ্ছে মা থালা নিয়ে হাসি হাসি মুখে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোনোর সময়, আবার একবার খাওয়ার সময়।
ছ'পিস মোমোর সঙ্গে দু'প্যাকেট ঝাল লাল, দু'প্ কেচাপ, দু'প্যাকেট মেয়োনিজ ইজুক্যালটু ছ'প্যাকেট চাটনি। তবেই না আশি টাকা দাম "ওয়র্থ ইট।"
এক্সপেনসিভ নিজ মহিমায় আবির্ভূত হয়েছে আর সেই এক্সপেন্স জাস্টিফাই করার জন্য আশ্চর্য সব স্ট্র্যাটেজির আশ্চর্য লুপ তৈরি হয়েছে। পাটিসাপটায় গোলাপের আতর, বাটির বদলে ডাবের খোলায় খাবার পরিবেশন। অচিরেই নারকেল নাড়ুতে কিসমিস গুঁজে রুপোর তবক সেঁটে বিক্রি করবে।
ডিসক্লেমারঃ এই প্রসঙ্গে আরও অনেক কথা মাথায় আসছে, কিন্তু সে সব কথা জট ছাড়িয়ে লেখার সময় বা স্ট্যামিনা কোনওটাই এই মুহূর্তে নেই। আপাততঃ আধখেঁচড়া লিখে ক্ষান্ত দিচ্ছি। পরে কোনও পোস্টে দেখা যাবে।
*
শু যখন বলল, সি আর পার্কের সেরা মিষ্টি চার নম্বরের কোনও একটা মিষ্টির দোকানে পাওয়া যায়, আমি বললাম, লোকনাথ। আর যদি লোকনাথ না হয় তাহলে তারাশঙ্কর।
লোকেশন চিনতে হবে না, তারাশঙ্কর কী সেটাও যদি অর্চিষ্মান বলতে পারে জীবনের মতো শকুন্তলা হয়ে যাব।
শু জানাল, কোনওটাই নয়।
টেবিলে টিস্যু ছুঁড়ে হাত তুললাম। তোমার প্রশ্নটা হয় ট্রিক কোশ্চেন নয় আমার চশমা বদলানোর টাইম হয়েছে।
শু হাসল। আহা তা কেন, সবাই তো সমান চোখকান খোলা রেখে জীবনের পথে হাঁটে না। চিনিয়ে দিলেই চিনতে পারবে। কালীবাড়ি ডানদিকে রেখে সোজা হাঁটছ? বাঁদিকে চার নম্বর মার্কেট? মার্কেটে ঢুকলে? ঢুকেই ডাইনে টার্ন নাও।
নিলাম।
মুদির দোকান? ডানদিকে ডিমফিম রাখা?
বাঁদিকে ফ্রিজে লিমকাফিমকা।
রাইট। মাঝখান দিয়ে হাঁটছ?
হাঁটছি।
লোকনাথ পেরোলে?
পেরোলাম।
মোমোর দোকান? রোল চাউমিনও বানায় বোধহয়।
ওটা সীমার বন্ধুর দোকান। প্রসেনজিৎ দেশে যাওয়ার সময় সীমা আমাদের রান্নাবান্না ঝাড়পোঁছ করেছিল। সীমা সুন্দর কথা বলে। প্রসেনজিৎ নিচের ভাড়াটের পরকীয়া নিয়ে খাপছাড়া খাপছাড়া খবর দিয়েছিল, অর্চিষ্মান শুনে বলেছিল, ধুস, গল্পটার মাথামুণ্ডু দাঁড়াচ্ছে না। কাল প্রসেনজিৎ এলে এই এই ইস্যুগুলো - বলে তিনটে বুলেট পয়েন্ট দিল - ক্ল্যারিফাই করে দিতে বলবে। সম্পাদকের কাছে শব্দসীমার ক্ল্যারিফিকিশন চাইতে আমার হাতপা কাঁপে, প্রসেনজিতের কাছে প্রতিবেশীর পরকীয়া ক্ল্যারিফাই করার সাহস আমি জোগাড় করতে পারিনি। সীমা এসে একেবারে টাইমলাইন ধরে ধরে পুরো ব্যাপারটার এমন ক্লিয়ার ছবি এঁকে দিল যে অর্চিষ্মানও আমার পিঠ চাপড়ে দিল। গুড জব, কুন্তলা।
সীমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হত। সীমার ফেভারিট বিষয় ওর মেয়ে। ল পড়ে। মায়ের প্রতি মায়ায় টইটম্বুর। অর্চিষ্মান একদিন ওপরে এসে বলল গেটের সামনে নাকি সীমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, হাই হ্যালো-র পর সীমা অর্চিষ্মানকে বলেছে দাঁড়ান দাদা, আমার মেয়েকে দেখবেন। মেয়ের খোঁজে অর্চিষ্মান এদিকওদিক তাকাতে সীমা বলল, মেয়ে মাঠে জগিং করছে। সীমা আর অর্চিষ্মানের দেখা হয়েছে মেলাগ্রাউন্ডের সাইড গেটের সামনে, সীমার মেয়ে তখন জাস্ট সেই গেট পার হয়েছে। মেয়ে যতক্ষণ পুরো মাঠ ঘুরে এল অর্চিষ্মান আর সীমা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর সীমা বলল, ওই যে দেখুন আমার মেয়ে।
সন্তানস্নেহ জিনিসটা যে কী অসহনীয় তীব্র, কুন্তলা, ওই মুহূর্তে সীমার মুখটা যদি দেখতে, বলে অর্চিষ্মান চুপ করে গেল।
তীব্র ছাড়ুন, অর্চিষ্মান কোনওরকম আবেগই হ্যান্ডল করতে পারে না। চায়ও না। সেই কারণেই ও নিজের সত্তার বাঙাল-হাফকে অ্যাকনলেজ করে না। বাঙালদের কমপ্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজের ক্ষেত্রগুলো, যেমন রাঁধাবাড়া খাওয়াদাওয়া, স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও।
অত আবেগ হ্যান্ডল করার থেকে সারাজীবন খারাপ খাবার খাব তাও ভালো।
এত যাদের প্যাকনা তাদের কপালেই এমন বাঙাল জোটে। রাঁধাবাড়ার নাম নেই এদিকে আবেগের ভিসুভিয়াস।
*
শু ততক্ষণে মোমোর দোকান পেরিয়ে গেছে। বাঁদিকে কী দেখছ?
তারাশংকর।
তারাশংকরের আগে।
অ্যাপোলো।
আহা, অ্যাপোলোর পরে।
আমার জীবনের প্রথম রুমমেট ছিল পূর্ণা। ঢাকাইয়া। জটিল কিছু ভাবতে হলে দুই হাতে মাথা চেপে চোখ বুজে বলত, দারা, এহন ব্রেনে Saaপ দিতে লাগব।
আমিও ব্রেনে Saaপ দিলাম। মগজ জুড়ে ধোঁয়া পাক খাচ্ছে। অল্প অল্প কাটছে। অবশেষে একটা বোর্ডহীন খুপরি। ভেতরে আলো জ্বলছে কি না শিওর নই, জ্বললেও একটা টিউবের বেশি না। তাও চিড়িক চিড়িক করছে। খালি ক্যাবিনেটের ওপর সিঙাড়া রেডি হয়ে ভাজার অপেক্ষায়। মনে পড়ছে, প্রতিদিন এদের অপেক্ষারতই দেখি, ভাজা হচ্ছে বা ভাজা হয়ে সাজিয়ে রাখা আছে দেখিনি কখনও। খুপরির সামনে ম্যানহোলের ঢাকনাচাপা আবর্জনার ওপর ভনভন মাছি।
চোখ খুললাম। সে দোকান তো আর নেই। বছর পাঁচেক আগে শেষ দেখেছিলাম বোধহয়।
থাকবে কী করে। ব্যবসাবুদ্ধি নেই। টিকতে পারল না। ওই দোকানের কাঁচাগোল্লা একবার খেলে, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি তোমাকে, সি আর পার্ক কেন, পৃথিবীর আর কোনও কাঁচাগোল্লা মুখে তুলতে পারতে না।যতদিন ছিল ওটাই ছিল সি আর পার্কের বেস্ট মিষ্টির দোকান। হিডেন জেম।
*
আমার সন্দেহ, শু-এর সংজ্ঞায় যা-ই জেম, তা-ই হিডেন। যতক্ষণ হিডেন, ততক্ষণই জেম। হিডেনত্ব হারালেই জেমত্ব গন।
পপুলারিটি ও কোয়ালিটির ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্কে শু-এর মতো অটল বিশ্বাস আর কারও দেখিনি। অনেকে লুকিয়ে লুকিয়ে এ বিশ্বাস পোষণ করেন জানি। কারণ 'পপুলার মানেই বাজে' হচ্ছে যথার্থে আনপপুলার ওপিনিয়ন। চন্দ্রিল ভট্টাচার্যকে বোধহয় একবার আনইকুইভোক্যালি বলতে শুনেছিলাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, পপুলার মানেই বাজে। অবশ্য চন্দ্রিলকে কোট করার ঝামেলা হচ্ছে, উনি কখন ডিবেট মোডে আছেন বোঝা মুশকিল। ভালো তার্কিকরা সভার পক্ষেও কনভিন্সিং, বিপক্ষেও। আসলে কী বিশ্বাস করেন কে জানে। টি এস এলিয়ট, ডিবেট করতেন কি না জানি না, করতেন না ধরে নিয়ে তাঁকেই কোট করি। "When a great work is diluted for the masses, nothing remains but the dilute."
তবে এলিয়ট এবং চন্দ্রিল দুজনেই পপুলার, কাজেই এর থেকে কী ডিডিউস করার আপনি করে নিন।
আমার মত? আমার মত হচ্ছে এই বিষয়ে মত প্রকাশ করাটাই সময় ও এনার্জির অপচয়। এ পক্ষ বলবে চেতন ভগত ও পক্ষ বলবে হেমিংওয়ে, এ পক্ষ বলবে হানি সিং ও পক্ষ বলবে কিশোরকুমার, এ পক্ষ বলবে বেদের মেয়ে জোসনা ও পক্ষ বলবে সোনার কেল্লা। এর অন্ত নেই।
একমাত্র একটা আনহিডেন ব্যতিক্রমকেই জেম বলে ঘোষণা করতে রাজি হয়েছে শু। ব্যতিক্রমটা পাঁচ মাইল দূর থেকে আন্দাজ করা যায়, আপনারা কেন পারছেন না আমি জানি না।
*
রবীন্দ্রনাথ। লোকটা যে কী করে গেছে ভাবা যায় না। মানুষের এমন একটা ইমোশন নেই যা নিয়ে লোকটা লিখে যায়নি। এই কাঁকড়ার জাতে না জন্মালে লোকটা এতদিনে কোথায় পৌঁছে যেত।
(চলবে)
Comments
Post a Comment