আ মরি রাষ্ট্রভাষা


আজ ব্লগ থেকে ব্লগে ঘুরতে ঘুরতে আমার জে এন ইউ-র এক সহপাঠী কঙ্কণার ব্লগের খোঁজ পেয়ে গেলাম। সহপাঠী হলেও ওর সঙ্গে আলাপ আমার কখনওই হাই হ্যালোর বেশি এগোয়নি। কঙ্কণা ছিল   গুয়াহাটির মেয়ে। ঝকঝকে, মজাদার, অসম্ভব জনপ্রিয়।

কঙ্কণার একটা পোস্টে দেখলাম ও অসমিয়াদের আনাড়ি হিন্দি বলা নিয়ে ভীষণ মজার কিছু গল্প বলেছে। সেগুলো পড়ে ফাঁকা ঘরে বসে হাসতে হাসতে আমারও বাঙালিদের হিন্দি বলা নিয়ে কয়েকটা গল্প মনে পড়ে গেল।

গুচ্ছ গুচ্ছ হিন্দি সিনেমা সিরিয়াল দেখার পরেও বাঙালিদের হিন্দি কী করে এত খারাপ হয়, সেটা আমার কাছে একটা রহস্য। মানছি লিঙ্গবৈষম্যের দিক থেকে দেখলে হিন্দি ভাষাটা ঠিক সরল নয়। কোন যুক্তিতে রেলগাড়ি, চলন্ত অবস্থায় মহিলা আর থেমে থাকলে পুরুষ; অথবা খিড়কি খুলতি হ্যায় না খুলতা হ্যায়, এবং যেটাই হোক না কেন অন্যটা কেন হবে না, এই সব তর্ক নিয়ে বসলে রাত ভোর হয়ে যেতে পারে।

জে এন ইউ-তে ফার্স্ট সেমেস্টারে আমাদের সবার হিন্দিই কমবেশি হাস্যকর ছিল, কিন্তু শাশ্বতরটা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। একদিন বাস থেকে নামতে গিয়ে শাশ্বত খুব বিপদে পড়ে গেল। দরজার সামনে ভিড় করে একগাদা লোক দাঁড়িয়ে আছে যাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা সামনের স্টপে নামবে না। শাশ্বত একে ভদ্র তায় নিজের হিন্দি নিয়ে সেনসিটিভ, কাজেই চেঁচামেচি করে লোক সরাবে তারও উপায় নেই। শাশ্বত অপ্রিয় কাজটা সঙ্গীকে দিয়ে করানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সঙ্গী ততক্ষণে বুঝে গেছে যে শাশ্বতকে দিয়ে হিন্দি বলানোর এবং সে হিন্দি শুনে হাসার এর থেকে ভালো সুযোগ আসবে না। কাজেই সে শাশ্বতর হাজার অনুরোধে কর্ণপাত না করে উদাস মুখে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল।

শাশ্বত দেখল আর উপায় নেই। বাস এদিকে ততক্ষণে স্টপে দাঁড়িয়ে গেছে। মরিয়া হয়ে শাশ্বত, “এক্সকিউজ মি এক্সকিউজ মি, শোরিয়ে শোরিয়ে (বাঙালিরা যে উচ্চারণে সর/সরও/সরুন বলে সেই উচ্চারণে) নামনা হ্যায়” বলে ভিড়কে গুঁতোনোর অক্ষম চেষ্টা করতে লাগল।

সঙ্গের বন্ধুটির তখনও সাধ মেটেনি। সে শাশ্বতকে খোঁচা মেরে বলল, “কী করছিস, হিন্দিতে বল।” শাশ্বত চেঁচিয়ে উঠল, “ কী হল দাদা, সরিয়ে সরিয়ে (সরকাইলো খাটিয়া গানে যে উচ্চারণে স বলা হয়েছে সেই উচ্চারণে) নামনা হ্যায়।”

বাঙালিদের খারাপ হিন্দির থেকেও আমার বেশি অবাক লাগে ওই খারাপ হিন্দিটা বাঙালি কী অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে সেটা দেখে। আমরা বোধহয় ভাবি, ভাষাদুটো তো আসলে একই। সংস্কৃত থেকেই এসেছে যখন, কতই বা আর আলাদা হবে? খালি আমাদের শব্দগুলো ‘ও’ দিয়ে শেষ হয় আর ওদের গুলো ‘অ’ দিয়ে। আমরা ‘শ’ বলি, ওরা ‘স’ বলে। ব্যস্‌, এইবার ও-এর জায়গায় অ আর শ-এর জায়গা স বসিয়ে বাঙালি বীরবিক্রমে দিগ্বিজয়ে বেরোয়।

আমি খেয়াল করে দেখেছি বাঙালিদের মধ্যে যে যত খারাপ হিন্দি বলে তার হিন্দি বলার উৎসাহও তত বেশি। যেমন আমার মা। কলকাতাতে রাস্তায় বেরোলে তিনি ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলবেনই। সে চালকের চোদ্দপুরুষ বঙ্গসন্তান হলেও। যত বলি, “মা উনি বাংলা বোঝেন” মা কানেই তোলেন না। “ডাইনে ঘুমিয়ে, বাঁয়ে ঘুমিয়ে, ফাঁকা রাস্তা ছোড়কে ইতনা ভিড়কা রাস্তা কিঁউ লিয়া?” ইত্যাদি বলে যান।

কিছু কিছু পরিস্থিতি আছে যেগুলো সব বাঙালির ভেতর থেকে হিন্দি টেনে বার করে আনে। ম্যাজিকের মতো। আমাদের ছোটবেলার একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল লোডশেডিং। ‘কারেন্ট’ একবার গেলে আর ঘণ্টাতিনেকের আগে ফেরবার নাম করত না। অসহ্য গরমে হাতপাখা আর চার্জ কমে আসা এমারজেন্সি লাইট নিয়ে পাড়াশুদ্ধু লোক ছাদে উঠে বসে মশা মারত আর সরকারের মুণ্ডপাত করত। তারপর যখন হঠাৎ দপ করে রাস্তায়, বাড়ির জানালায় আলো জ্বলে উঠত, ফুল ভলিউমে চালিয়ে রাখা টিভিতে হঠাৎ জনপ্রিয় হিন্দি গান মাঝখান থেকে শুরু হয়ে যেত তখন সারাপাড়া থেকে সরুমোটামিহিখোনা গলায় সম্মিলিত “আ গয়া” চিৎকার উঠত।

এতক্ষণ বিশ্বশুদ্ধু লোকের হিন্দি নিয়ে হাসাহাসি করলাম বলে এ কথা ভাবার কোনও কারণ নেই আমার ও ভাষায় দেখার মতো দখল আছে। মায়ের তুলনায় আমার হিন্দি স্বর্গীয় হতে পারে কিন্তু অনেকের তুলনাতেই সেটা পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়। হিন্দি নিয়ে নাকাল হওয়ার সবথেকে লজ্জার গল্পটা বলে আজকের মতো শেষ করব।

আবার জে এন ইউ, আবার ফার্স্ট সেমেস্টার। বন্ধুবান্ধব তখনও বিশেষ হয়নি, কোনওদিন যে হবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। একাবোকা ক্লাসে যাচ্ছি, লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারছি, ক্যাম্পাসের আদাড়েবাদাড়ে রিং রোডে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ একদিন মেসের ওয়াটার কুলারের গায়ে দেখি পোস্টার সাঁটা---অমুক দিন সন্ধ্যেবেলা নর্মদা হোস্টেলে ডিনারের পর গানবাজনা হবে। শিল্পীরা দেখি সবাই দাস, গোস্বামী, ব্যানার্জি, সেনগুপ্ত। যাদের মধ্যে দুজন আবার আমারই ক্লাসমেট।

নির্দিষ্ট দিনে ডিনারের পর গুটিগুটি নর্মদার দিকে হাঁটা দিলাম। হোস্টেলের গেটে অচেনা মুখের ভিড়। ভয়েভয়ে এগিয়ে গেলাম। প্রতিমুহূর্তে মনে হতে লাগল, ইস্‌ না এলেই হত। যদি সবাই আমাকে দেখে হাসে? হঠাৎ দেখি ভিড়ের একটু আড়ালে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, মুখখানা ভালমানুষ গোছের। আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে আমার ভয়াবহ বাঙালি উচ্চারণে, থেমে থেমে, ভেঙে ভেঙে ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “উয়ো মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম কাঁহা পর হো রহা হ্যায়?”

ছেলেটি একমুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল, “সোজা গিয়ে ডানদিকে।”

কতটা এমব্যারাস্‌ড্‌ হয়েছিলাম আমার নিজেরই এখন মনে নেই। তবে হতভাগা অরিত্র নেক্সট চারবছর একটি বারও আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলেনি, স্থানকালপাত্র নির্বিশেষে দেখা হওয়া মাত্র, “আরে কুন্তলা ম্যাডাম, ক্যায়সে হ্যায়?” বলে জ্বালিয়ে খেয়েছিল, সেটা এখনও হাড়েহাড়ে মনে আছে।


Comments

  1. hahaha.. darun likhecho! by the way ami Delhi Universityr ar tumi JNU theke shune ekta kirokom sisterhood er byapar mone holo. Ar hyan, amake please 'apni' bolo na, jehetu tumi phd korcho ami bhebe nilam je ami tomar theke boyesh e chhoto!

    ReplyDelete
  2. thank you......achchha, ekhon theke 'tumi' bolbo.

    ReplyDelete
  3. Aapni Hindi ta chaaliye jete paaren, besh lagchhe!:-)

    ReplyDelete
  4. osombhob bhalo tomar hassyoros , bhison upobhog korlaam aar khoob haslam .

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ধন্যবাদ।

      Delete

Post a Comment