হোমসিকনেস
ইন্দোনেশিয়ান
কনসুলেট থেকে খবর এনেছে ফাউজি, প্যারিসের সেরা নাসি গোরেং কোথায় পাওয়া যায়। মেট্রো
থেকে নেমে সে দোকানের দিকে হাঁটছি, দেখি ফুটপাথের ওপর মস্ত হোটেল, মাথার ওপর লেখা
লে মেরিডিয়ান। অমনি দিল্লির কথা মনে পড়ে গিয়ে মনটা দুঃখ দুঃখ হয়ে গেল।
ফাউজি আগেও এসেছে এ
দোকানে। দোকানি যে রকম হেসে ওকে অভ্যর্থনা করলেন তাতে বুঝলাম সপ্তাহের এ মাথা ও
মাথায় এসে ফাউজি দোকানের ব্যবসা ফুলিয়েফাঁপিয়ে তুলেছে। ফাউজির অর্ডারও দেখলাম
উনি জানেন। ওর জন্য এল এক বড় প্লেট নাসি গোরেং, আমার জন্য এক বাটি চিংড়ির সুপ। আর আমরা
কেউই অর্ডার না করা সত্ত্বেও এল একটা ছোট বাটি। বাটি ভর্তি কুচি করে কাটা গোটাদশেক
লাল লংকা, বীজ মেমব্রেন ইত্যাদি আরও যা যা ইউটিউবের সাহেব শেফরা ঝালের ভয়ে কেটে
ফেলে দেন, সেই সব শুদ্ধু।
এতদিন ধরে প্রবাসে
দোকান খুলে বসে আছেন, ভদ্রলোক ঠিক জানেন দেশের লোকের মন কীসে ওঠে। সূক্ষ্মতায় নয়।
ফ্রেঞ্চফুডের সূক্ষ্মতার দেমাক সাংঘাতিক। অনেক ফ্রেঞ্চ রান্নার রেসিপিতে শুনেছি
সরাসরি রান্নায় দেওয়ার বদলে রান্না চলাকালীন এক কোয়া রসুন ছেঁচে বাটিতে করে
রান্নাঘরের কোণে রেখে দেওয়ার নির্দেশ থাকে। তাতেই যা কাজ হওয়ার হয়ে যায়। তবে সে
রসুনের সুবাসওয়ালা খাবারের রসাস্বাদন করতে হলে খাইয়ের প্যালেটও ফরাসি হতে হবে।
আমাদের প্রাচ্যদেশের প্যালেটে অত সূক্ষ্মতা পোষাবে না। আমাদের জিভের সুখের জন্য
লাগবে ফিশসসের বোঁটকা গন্ধ, থাই বার্ডচিলির মোক্ষম কামড়, কাসুন্দির
নাম-ভুলিয়ে-দেওয়া ঝাঁজ। ডিজোঁ মাস্টার্ড তার কাছে শিশু।
আমরা দুজনেই খানকয়েক
চামচ লংকাকুচি যে যার খাবারে মিশিয়ে নিলাম। কোনও দরকার ছিল না, পুরোটাই
সাইকোলজিক্যাল। মন দিয়ে খাচ্ছিলাম, কেউই বেশি কথা বলছিলাম না। দোকানের বাইরে
রাস্তায় ঝলমলে আলো জ্বলে উঠেছিল। এমন সময় হঠাৎ ফাউজি বলল, “আর মোটে দেড়মাস, খেয়াল
আছে?” আমি বললাম, “মনে নেই আবার? রোজ সকালে উঠে নিজেকে সেটাই তো মনে করাই। আর মোটে দেড়মাস, তারপরই বাড়ি।” ঝালের চোটে চোখে চলে আসা জলের পর্দা ফাঁক করে আমার মুখে
হাসি ফুটল।
ফাউজি আকাশ থেকে
পড়ল, “ইউ ওয়ান্ট টু গো ব্যাক?”
“ইউ ডোন্ট?” আমার
পতন আরও উঁচু থেকে।
আর বলেই মনে পড়ল,
একসময় আমিও চাইতাম না। ফাউজির বয়সে তো নয়ই। মাত্র বছর চারেক আগের একটা কনভারসেশনের
স্মৃতি ভেসে উঠল। খাঁখাঁ রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটছিল আর গাড়ির ভেতর আলোচনা হচ্ছিল
আমাদের কার কোথায় সেটল করার ইচ্ছে। সবাই হিল্লিদিল্লি নানারকম বলছিল, একা আমি বুক
ফুলিয়ে বলেছিলাম, সেটল করার দরকারটা কী? সারাজীবন এদিকসেদিক ঘুরে ঘুরে বেড়ালেই তো
বেস্ট।
অগুন্তিরকম সিকনেসে
আমি ছোটবেলা থেকে ভুগেছি। জ্বর, মায়োপিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েড, মগজে সেরোটোনিনের
অভাব। কিন্তু যে সিকনেসটি আমাকে কোনওদিন কাবু করতে পারেনি সেটা হচ্ছে হোমসিকনেস। কাবু
না হওয়ার কারণ জেনেটিক্স হতে পারে, আমার বাবামা দুজনের কাউকেই ঠিক ঘরমুখো বলা যায়
না। আবার আরোপিতও হতে পারে। বেশ কচি থাকতেই, যখন কাঁচা ব্রেন নতুন কিছুর দেখা পেলেই
স্পঞ্জের মতো সেটাকে শুষে নিচ্ছিল, রমাপদ চৌধুরীর একটা গল্পে দু’লাইন পড়েছিলাম।
লাইনদুটোর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে যে সবাই কোথাও না কোথাও যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে
বেরোয় রোজ সকালে, সেখানে যেতে পারে না বলে সন্ধ্যেবেলা আবার যেখান থেকে শুরু
করেছিল, সেই বাড়িতে ফিরে আসে। লাইনদুটো পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফেরা ব্যাপারটা
যে কতখানি আন-কুল, সে সত্যিটা নিমেষে চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। সেই মুহূর্ত
থেকে আর কখনও, কোনওদিনও বাড়ি ফিরতে চাইনি আমি।
বা না চাওয়ার ভান
করেছি। কারণ এখন রোজ ঘুম ভেঙে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, বিকেলবেলা টিব্যাগের
গন্ধওয়ালা চায়ে চুমুক দিতে দিতে, রাতে পিঠের তলায় বালিশ গুঁজে টাইপ করতে করতে যে চিন্তাটা
আমার সবখানি চেতনাকে আচ্ছন্ন করে থাকে, সেটা হচ্ছে কবে বাড়ি যাব।
আমার মাইলমাইল লম্বা
অসুখের লিস্টে হোমসিকনেস নবতম সংযোজন। প্রথমটা স্বীকার করতে নিজেই কাছেই খুব লজ্জা
হচ্ছিল, কিন্তু এখন অবস্থাটা এমন পর্যায়ে গেছে যে আর স্বীকার না করে পারা যাচ্ছে
না। চলতে ফিরতে বাড়ির কথা মনে পড়ছে, দিল্লির কথাও। অসুবিধেগুলো ক্রমশ প্রকট হয়ে
উঠছে। বাড়ির সামনে একটাও পার্ক নেই, মর্নিং ওয়াক বন্ধ। অফিস থেকে ফেরার পথে একটাও
ঝালমুড়িওয়ালা নেই, ব্যাগেট খেয়ে আর কদ্দিন বাঁচে লোকে?
মর্নিংওয়াকের ভেনু হিসেবে এই পার্কের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কি মুখের কথা?
সবথেকে কান্না পায়
শনিরবিগুলো এলে। ম্যাপ হাতে নিয়ে নতুন শহরের কোণাঘুঁজি এক্সপ্লোর করে বেড়ানো দারুণ
ভালো ব্যাপার। কিন্তু তার থেকেও ভালো হচ্ছে বাড়ির সামনে থেকে অটো ধরে শোঁ করে হলে
গিয়ে সিনেমা দেখে, পপকর্ন দিয়ে লাঞ্চ সেরে, মলের ছাদের রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে
কুলফি জেলাতো খেতে খেতে আড্ডা মারা। নভেম্বরের উইকএন্ডের দুপুরগুলোয় মতো কী রকম গলাসোনার
মতো রোদ্দুর ওঠে দিল্লিতে, যারা না দেখেছে তারা তো জানে না।
হয়তো মনখারাপটা ওই
আড্ডাটার জন্যই। ইটকাঠলোহাসুরকি দিয়ে বানানো হোমের থেকেও হোমের ভেতরের রক্তমাংসের
সঙ্গীর পিছুটান বেশি। লোকজন অবশ্য আগের বাড়িতেও ছিল, কিন্তু সে বাড়িটা ঠিক আমার
ছিল না। সে বাড়িতে তাদের নিয়মকানুন চলত। সে বাড়িতে রাত্তিরে ম্যাগি খেয়ে শুয়ে পড়ার
প্রস্তাব দিলে লোকে এমন ভাব করত যেন পৃথিবী ধ্বংসের আর বেশি বাকি নেই। আমার দিল্লির
বাড়িতে ডিনারে ম্যাগি খেতে খেতে টিভি দেখাটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিনটে প্রিভিলেজের
মধ্যে বিবেচিত হয়। অনেক সময় সে ম্যাগি আমাকে রাঁধতেও হয় না।
অবিশ্বাস্য কিন্তু
সত্যি, এই গোটা বাড়িটায় একা হাতপা ছড়িয়ে নিজের মতো থাকার থেকে দিল্লির দু’কামরার
ফ্ল্যাট আরেকটা প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকার আরাম অনেক বেশি। সে
আরামের জন্য আমার এবার সিরিয়াসলি মনখারাপ হচ্ছে।
বাড়ি ফেরার ইচ্ছে থাকাটা যদি আনকুল হয় তাহলে মশাই আমার আর কুল হয়ে কাজ নেই। যতই লন্ডন প্যারিস নিউ ইয়র্ক করে বেড়াই, সেটা ওই কয়েকদিনই ভালো লাগে। তারপর আবার সেই বাড়ির জন্য মনকেমন করাটা শুরু হয়। আর বাড়ির সঙ্গে যদি কোনও ভালবাসার মানুষকেও ফেলে এসে থাকি তাহলে তো কথাই নেই। আর সেটল করার দরকার প্রসঙ্গে বলি, আর কোনো কারণ থাক বা না থাক, আমি কুঁড়ে মানুষ, মালপত্র বিছানাবালিশ টেবিল চেয়ার বই বাসন নিয়ে বাড়ি পাল্টানোর কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে। তাই সে ঘটনাটা যত কম ঘটে ততই মঙ্গল। বিশেষ করে একটা বয়েসের পরে তো বটেই।
ReplyDeleteতবে ফাউজিকে জাজ না করেই বলছি, কেউ বাড়ি ফিরতে চায় কিনা সেটা অনেকটাই নির্ভর করে তার বাড়ির, এবং তার দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি অবস্থার ওপর। এই ধরুন আমি কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়াশুনো করে দেশে ফিরতে চাই কারণ আমি জানি যে দেশেও আমার এই কাজ করার সুযোগ আছে। আমার এক নেপালি বন্ধুও এখানেই আমার সঙ্গে পি এইচ ডি করেছে, কিন্তু সে জানে নেপালে তার কাজের খুব একটা সুযোগ নেই, তাই তাকে কোনও বাইরের দেশেই সেটল করতে হবে, আর নাহলে দেশে ফিরে গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য কোনো কাজ করতে হবে। তাই সে ফিরতে চায়না।
আমার ধারণা বয়স একটা বড় ফ্যাক্টর সুগত। ফাউজিও আমার বয়সে পৌঁছলে বাড়ি যেতে চাইবে বলেই আমার বিশ্বাস।
Deleteachha ei baki der maashi, dilli'r "প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সঙ্গে" paris e thaka jayna?
ReplyDeleteসেটাই তো মুশকিল শম্পা। অচেনা প্রাপ্তবয়স্ক, অপ্রাপ্তবয়স্ক কারওর সঙ্গেই থাকার ইচ্ছে বা সাহস কোনওটাই আর বাকি নেই। সপ্তাহে দুদিন ডিনার কিংবা লাঞ্চ ঠিক আছে, কিন্তু তার থেকে বেশি গা-ঘষাঘষির কথা ভাবলেই শিউরে উঠি। তবে সেটা হয়তো ভুলই, লোকের সঙ্গে থাকতে পারলে হয়তো ভালোই হত।
Deletearre na na, aami tomake অচেনা প্রাপ্তবয়স্ক r katha bolchi na. bolchi je delhi'r চেনা প্রাপ্তবয়স্ক ke paris e ana jayna ?
Deleteওহ্ সরি, আমি তোমার কমেন্টটা ভুল বুঝেছি শম্পা। সে হলে তো ভালোই হত, কিন্তু ভিসার ঝামেলা হয়ে গেল কি না। কাজেই সে আশায় গুড়ে বালি।
DeleteEki. Tumi ekla now. Home/ je kono jaygar jonyo sickness ekta universal jinish. Uncool bole kon kharap lok? Amar toh dillitey thekei kolkatar jonyo monkamon kore. Abar kolkata phire gele dillir jonyo. Abar benares gele dilli/kolkatar jonyo. Abar benares er baire gele benares er jonyo.
ReplyDeleteTarpor majhe majhe Manali, McLeodgunj, Tarkarli, Shantiniketan...eisbo jaygar jonyo-o monkamon kore.
Amar jeebonta khali "greener grass" er jonyo monkharapey kete galo mairi.
তোমার কমেন্ট পড়ে মন ভালো হয়ে গেল বিম্ববতী। এইভাবে ভেবে দেখিনি কখনও ব্যাপারটা। সত্যিই তো, অনেকরকম জায়গার জন্য মনখারাপ করাটাই তো স্বাভাবিক। থ্যাংক ইউ। তোমার সেকেন্ড প্যারাগ্রাফে বলা চারটে জায়গার মধ্যে দুটো জায়গায় যাইনি, যেতে হবে।
Deleteeki sunchi? tumi r ekla thakay allergy? tobe tumi thik e bolecho boyes ekta boro factor. ekla haat paa choriye thaka ta bodh hoy beshidin bhalo lagena.
ReplyDeleteভাবো একবার রাখী? আমি নিজে যখন টের পেলাম প্রথম ব্যাপারটা, নিজেকে চিমটি কেটে দেখব কিনা ভাবছিলাম।
DeleteApnar হোমসিকনেস porte porte ai 'friendsickness' dekchilam..khub bhalo laglo videota -- http://www.youtube.com/watch?v=gHGDN9-oFJE&feature=share
ReplyDeleteবাহ, খাসা শব্দ বানিয়েছেন তো। ভিডিওটার জন্য থ্যাংক ইউ সৌমেশ।
Deleteহাঃ হাঃ হাঃ, এত ওড়াউড়ি, নাচানাচি, লম্ফঝম্পর পর মেয়ের এবার মাটির কথা মনে পড়েছে। তবে চিন্তাং মা কুরু, দড়ি তো খুঁটিছাড়া হয়নি। তাই দীর্ঘ পরবাসের পর হোম, মনে হয় একটু বেশিই সুইট লাগবে। ফিরে আসার মুহূর্তের জন্য আগাম অভিনন্দন।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ মালবিকা।
Deleteমনের কথাটা বলতে শিখে গেছ দেখছি। আমিও তোমার মত এই সিকনেস থেকে উর্ধ্বে ছিলাম আগে, নিজেকে ভবঘুরে ভাবতে ব্যাপক লাগত। আজকাল দেখছি (ঘর-বাড়ি নয়), কলকাতার জন্যে মনটা কীরকম যেন একটা হয়ে যাচ্ছে, হাফ বয়েল্ড ডিমের কুসুমের মত। বয়স হয়ে যাচ্ছে মনে হ্য়, জানো।
ReplyDeleteবাহ, দারুণ সিমিলি দিলে তো প্রিয়াংকা। মনে রাখব। বয়স যত হচ্ছে বুঝতে পারছি, বয়সকে ইগনোর করা কতটা শক্ত।
DeleteAmi ajke Jakarta e boshe Nasi Goreng khelam. Goto 2 mash dhore Indonesian/Pizza/Burger kheye kheye mukhe ghor oruchi. Ami porshu baRi jabo :D tai ei post ta ekdom hi five post!
ReplyDeleteAar ami Dec e Delhi jachhi. besh onekdin er jonno. Tomar Shohor asakori amar o bhalo lagbe. Pouche janio, dyakha korbo :)
বাহ, দারুন ব্যাপার তো সুমনা, জাকার্তায় বসে নাসি গোরেং? নিশ্চয় জানাব।
DeleteTomar prothom post porechhilam eka thako keno sei prosonge. Takhoni bhebechhilam er ek piece bie hok, tarpor baddho hoye ekla jodi thakte hoi takhon bujhbe doka thakte kato beshee bhalo lage!!! Aj sei din esechhe!
ReplyDeleteহাহা রুচিরা, ঠিকই বলেছ।
Delete