অফিস শিফটিং
আমাদের অফিস বাড়ি বদলাচ্ছে। কেন বদলাচ্ছে, দরকার ছিল কি না, বর্তমান লোকেশনের তুলনায় নতুন লোকেশনের তুল্যমূল্যতা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কোনও বিষয়ে যদি মতামত স্ট্রং হয় অথচ সেই মতামতে পরিণতির প্রভাবিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা না থাকে তবে সে মতামত জাহির করা বেকার।
তার থেকে বরং আমার যা করণীয় সেটাই করি। বাক্সপ্যাঁটরা বাঁধি আর কালোর মধ্যে ভালো খুঁজে সান্ত্বনা পাই। দ্বিতীয়টা করতে খুব যে অসুবিধে হচ্ছে তেমন নয়। গ্লাস সর্বদা হাফ ফুল দেখার বদভ্যেস চিরকালই ছিল। অনেক সময় এমনও ঘটেছে, গ্লাস একেবারে ঠনঠনে, আমি চোখ সরু করে, ঘাড় বেঁকিয়ে, চশমা মুছে তাতে ফোঁটা দুয়েক জল আবিষ্কার করেছি।
প্রথমেই মনে হল এই সুযোগে ডেস্কে জমে ওঠা জঞ্জাল সাফ করা যাবে। স্বেচ্ছায় এবং দায়ে পড়ে নেওয়া প্রিন্ট আউট, হাবিজাবি আমন্ত্রণপত্র, সেমিনার কর্মসূচী পাইকারি দরে রিসাইকেল বিনে পাঠালাম। তিনটে স্টেপলার, দু’খানা পাঞ্চিং মেশিন, তিনটে প্রোজেক্টের তেরোখানা নোটবুক, পনেরোটা নীলকালো রেনল্ডস পেন, বাইশটা অজন্তা পেনসিল - বিদায় হল। কার্টনে সেলোটেপ সাঁটতে এসে ভাইসাবেরা ভুরু কুঁচকোলেন। বস? দুই হাত তুলে দিলাম। বস।
সব বদলই নতুন করে শুরু করার আশা জাগায়। নতুন অফিসের নতুন ডেস্কে ফুল মিনিমালিজম অনুশীলন করব। দরকারের থেকে বেশি একটি বোর্ডপিনকেও অ্যালাউ করব না। কনফারেন্স থেকে কুড়োনো পেনসিলের পাহাড় জমাব না। একটাই নোটবুক রাখব। একটা নোটবুক, একটা পেন, তিনটে গাছ, একটা কুন্তলা। নতুন কুন্তলা। যে আজের কাজ কাল করব বলে তুলে রাখে না। টোস্ট খেতে গিয়ে গোটা ডেস্কে গুঁড়ো ছড়ায় না।
তবে সব তো আর চাইলেই ফেলে দেওয়া যায় না। কিছু জিনিস সঙ্গে নিতেই হয়, আপাত অদরকারি হলেও। আমার সহকর্মীরা আমার থেকে ঢের বেশি ভদ্রলোক, বিনোদন বা কর্মসূত্রে যেখানেই গেছে ছোটখাট উপহার নিয়ে ফিরেছে। ভিয়েতনামি ছোট্ট টোকা, শ্রীলংকার কাঠের হাতি, ভুটানের মন্ত্র লেখা সিল্কের ঝালর। সেগুলো ফেলে দেওয়ার মতো কানকাটা হতে পারিনি এখনও, নিয়েছি। গাছেদের তো নিয়েছিই। এই অফিসের উদার জানালা দিয়ে আসা জলহাওয়ায় তারা লকলকিয়ে বাড়ছিল, নতুন অফিসের জলহাওয়া তাদের সুট করলে হয়।
আর নিয়েছি ডেস্কের দেওয়ালে সাঁটা জীবনের মহামন্ত্রখানি। ডান ইজ বেটার দ্যান পারফেক্ট। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছে। একজনের ফেয়ারওয়েল হচ্ছিল, আনুষ্ঠানিক অংশটুকু ফুরোনোর পর সবাই কেকটেক খাচ্ছিল তখন কার একটা কী প্রশ্নের উত্তরে শুনি সে বলছে, “আরও অনেক কিছুর সঙ্গে মাই টেক ফ্রম দিস অফিস ইজ ‘ডান ইজ বেটার দ্যান পারফেক্ট।’”
বলে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকাল।
ভেবেছিলাম খুব লুকিয়ে রেখেছি, এখন জানছি অনেকেই দেখেছে এবং অনেকেরই পছন্দও হয়েছে মন্ত্রটা।
অফিস শিফটিং-এর আর একটা সুবিধে আমি ভেবে ভেবে বার করেছি। এই শিফটিং-এ প্রতিবেশী ওলটপালট হবে। যে ডানপাশে ছিল সে চলে যাবে ওপরের তলায়, বাঁ পাশের লোক নিচের তলায়, যার সঙ্গে এতদিন চোরেকামারে দেখা নেই ছিল সে চলে আসবে উল্টোদিকে। পার্সপেক্টিভ বদলাতে হবে। বাধ্য হয়েই।
তবে নতুন সবই কি আর ভালো হবে? পুরনো ভালোও যাবে অনেক কিছু এবং একেবারেই যাবে।
ক্ষতির তালিকার একেবারে ওপরে থাকবেন আন্টিজী। কত দমবন্ধ করা মুহূর্তে, মাথা জ্বলে যাওয়া মুহূর্তে, বুক ধড়ফড় করা মুহূর্তে, চুলোয় যাক মুহূর্তে চায়ের জোগান দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। প্যান্ট্রির রোজকার ডাল রুটি তরকারিও যাবে। প্রতিদিন আমার পুষ্টির জোগান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে মোগলাই না চাউমিন না কাঠি রোল না চিপোটলে না মাঞ্চুরিয়ান, এই সব কঠিং সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। ছেড়ে চলে যাওয়ার একটা অদ্ভুত ব্যাপার আগেও দেখেছি, এখনও দেখছি, যারা গেলে আমার কোনও ক্ষতি নেই, বরং থাকতে যারা আমার অনেক ক্ষতি করেছে, তাদের ছেড়ে যাওয়াও ক্ষতির মতো ঠেকে। আমাদের অফিসের পায়রাগুলো যেমন। এই ক’বছর মোটে পাত্তা দেয়নি, দুজনের পথ কাটাকাটি হলে সর্বদা আমাকেই থামতে হয়েছে, তারা বুক ফুলিয়ে হেঁটে চলে গেছে নিজেদের গন্তব্যে, এমনকি আমার জামাকাপড়ও নষ্ট করেছে বেশ ক’বার, সেই সব বদমাশ বদমেজাজি পায়রাগুলোর জন্যও মন খারাপ বোধ করছি। যাওয়ার আগে সবাইকে হাতে আঁকা গ্রিটিংস কার্ড দিয়ে যাওয়ার মতো মনখারাপ।
মনখারাপ হচ্ছে অফিসে আসার রাস্তাটার জন্যও। চেনা রাস্তায় চেনা সিগন্যাল, চেনা সিগন্যালে চেনা ধূপওয়ালী, চেনা বুলেভার্ডে চেনা গরু, চেনা কুকুর, ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া আবার ফিরে এসে বসা চেনা পায়রা। চেনা রুটের চেনা ড্রাইভার, চেনা পুল-সঙ্গী, তাদের তুলতে-নামাতে দিল্লির চেনা হয়ে ওঠা পাড়া। নাম দেখেই কত লোককে চিনে ফেলি আজকাল। ভাইসাবকে বলি, যদিও লোকেশন এই দেখাচ্ছে আপনি আরেকটু এগিয়ে নিন, বলতে না বলতে ফোন এসে যায়, আপ থোড়াসা আগে আ যাইয়ে। কারও নাম দেখেই আঁতকে উঠি, ইনি কোনওদিনই পাঁচ মিনিট না দাঁড় করিয়ে আসেন না। কারও নাম দেখলে হাঁফ ছাড়ি। ইনি অতি কনসিডারেট। গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকেন।
তাঁদের সঙ্গে আর দেখা হবে না।
কিন্তু সব থেকে বেশি ক্ষতি কী যদি জানতে চান তাহলে বলব, আমার আর অর্চিষ্মানের যাত্রাপথ আলাদা হয়ে যাওয়া। যুদ্ধে যাওয়ার পথটুকুতে একজন পছন্দের লোককে সঙ্গী পাওয়ার শান্তিটুকুও গেল।
notun office bari theke koddur ?
ReplyDeleteগুগল ম্যাপ অনুযায়ী চার দশমিক ছয় কিলোমিটার। এই অফিসের দশ কিমির তুলনায় অনেকটাই কম।
Delete"Done is better than perfect" - amar moto born perfectionist-er pokhhe ei montro-ta atmikoron kora besh asubidha hoyeche, kintu theke sikhte sikhte bujhechi eta sab samoy mathay na rakhle jibon-er ardhek porikkha te fail :/
ReplyDeleteStudent thakar samoy gorbo chilo kothin Maths test-e hoyto 100 te 80 answer kore asbo, kintu sei 80 te examiner lal pen lagate parben na :) Ar ei professional life-e kaj korte korte bujhechi anek samoy-ei deadline-er madhey ekta Ho-jo-bo-ro-lo uponyas likhe dileo khub khoti nei, kintu deadline miss korle jake Hindi te bole 'Satyanash' :D
Ar ei office shifting-er lekha ta to jothariti bhalo laglo, arekta khub kajer katha mone poriye dilo "The only constant in life is change" :)
আমার আবার উল্টো সমস্যা। যতখানিই করি বা যতটুকু, পারফেক্ট কখনওই হয় না। আর পারফেক্ট যখন হবেই না তখন যেমন তেমন করে শেষ করা ছাড়া গতি নেই। চেঞ্জের ব্যাপারে ঠিকই বলেছেন। মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
DeleteLekhata pore Sumon-er ekta gan mone pore gyalo -
ReplyDeleteChena dukkho chena sukh
chena chena hashi mukh
chena alo, chena andhokar...
aar kichu bolbo na, khub bhalo laglo lekhata. :)
থ্যাংক ইউ, অরিজিত।
Deletekuntala, bohudin pore elam. bar exam er pora korte korte matha kharap hoye jachhey. pora bade ar somosto kichhu korte ichhey korchhey. sei poriprekkhite tomar lekha ta osombhob bhalo laglo.
ReplyDeleteপরীক্ষা শেষের অনেক অভিনন্দন, চুপকথা। খুব আনন্দ কর।
Deletesesh hoyni go. July 30-31 e porikkha. apatoto chakri chhere diye porashuna korchhi ar August er din gunchhi
Deleteআচ্ছা। এটা বেশ সাহসের কাজ করেছ কিন্তু। ভেরি ইমপ্রেসড।
Deleteআমাদের অফিস সল্টলেক থেকে যখন বানতলায় শিফ্ট হলো, পুরোনো চায়ের দোকানের মালিক টিঙ্কুদা আমাদের ফ্রীতে লাড্ডু খাওয়ালো। আবার যখন ফেরত আসার সময় হলো দুবছর পর, নতুন বিল্ডিং এর সামনের চায়ের ঠেকের মালিক শম্ভু চা খাওয়ালো ফ্রীতে।
ReplyDeleteপরদিন টিঙ্কু পুরোনো আত্মীয়র মতো কুশল জিজ্ঞাসা করলো। ছেলেমেয়ে হয়েছে কিনা জানতে চাইলো, নতুন বাইক কিনেছে দেখালো, চুল পেকে গেছে বলে দুঃখ করলো।
কয়েক মাস পর আমাদের দলের একজন বানতলায় কোনো দরকারে গেছিলো, বললো শম্ভু নাকি একদম একই ভাবে আমাদের সবার খোঁজ খবর নিয়েছে।
চা যে খাওয়ায় আর যে খায়, এই দুজনের সম্পর্কের গভীরতা শুধু তারাই জানে।
Delete