উনিশ কুড়ি



ডিসেম্বর এসে গেল!

বিস্ময়চিহ্ন দিলাম যদিও বিস্ময় জাগার কথা নয়। বিস্ময় তখনই জাগতে পারত যদি জুনের পর একলাফে ডিসেম্বর এসে যেত, কিংবা জুলাইয়ের পর সোজা পরের বছর মার্চ। তা তো হয়নি। প্রতিটি সেকেন্ড প্রতিটি মিনিট প্রতিটি দিন গুনেগেঁথে জুনের পর জুলাই অগস্ট সেপ্টেম্বর অক্টোবর নভেম্বরের প্রতিটি উইকেন্ড পার করে অবশেষে ডিসেম্বরে এসে পৌঁছেছি। 

পৌঁছে গালে হাত দিয়ে বলছি, ভাবা যায়? ডিসেম্বর এসে গেল?

ঠাণ্ডাও এসেছে ভালোমতোই। রুম হিটার, লেপকম্বল ঝেড়েঝুড়ে নামানো হয়েছে। চা খাওয়ার থেকে চায়ের কাপের ওম প্রিয়তর হয়ে উঠছে। আমার চেনা অনেকেরই ঠাণ্ডা লাগছে আবার অনেকের লাগছে না। তাঁরা বলছেন, ধুর ধুর এ আবার ঠাণ্ডা হল। ঠাণ্ডা পড়ত গিয়ে… বলে কে জানে কোন স্বর্ণালী শীতের স্মৃতিতে মুখ হাঁড়ি করছেন।

ডিসেম্বর যখন এসেই গেল, তখন ডিসেম্বরে যা যা করার করে ফেলা যাক। পিছু ফিরি, সামনের জন্য কষে কোমর বাঁধি। আগের বছরের রেজলিউশনের লেপকাঁথাগুলো ঝেড়েমুছে রোদ্দুরে দিয়ে দেখি কতখানি আস্ত রয়েছে আর কতখানি পোকায় কেটেছে।

এ বছরের শুরুতে আমার ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার ছিল ফিনিশ। আমি যদিও শুরু করা কাজ শেষ করব, মাঝপথে ফেলে রেখে লাফ দিয়ে নতুন কিছু শুরু করব না, তারপর সেটা আধখ্যাঁচড়া ফেলে রেখে আরেকটা চকচকে কিছু পেছনে ছুটব না এত সব মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শব্দটি বেছেছিলাম, বছরের শেষে সেটা নতুন মানে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

আজন্ম যে জীবনটা আমি নিজের বলে জেনে এসেছিলাম, দু’হাজার উনিশে তা শেষ হয়েছে।

আবার শুরুও হয়েছে। অন্যরকম, নতুন একটা জীবন। সেই নতুন জীবনটায় এমন খাপে খাপ ফিট করে গেলাম কী করে ভেবে এখনও মাঝে মাঝে অবাক হচ্ছি, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে  বিস্ময়ের মাত্রা কমছে। বুঝছি, যতদিন না আমি শেষ হচ্ছি ততদিন কিছু শেষ হওয়া মানে অন্য কিছু শুরু হওয়া। আমার বেঁচে থাকার জন্য আমার, কেবল আমার, প্রাণটুকু ছাড়া আর কিছুই অপরিহার্য নয়। 

শুরু যখন করতেই হবে, তখন সেটা স্বেচ্ছায় করাই ভালো। তাই আমার সামনের বছরের শব্দঃ শুরু। 

এ ছাড়া এ বছরে বলার মতো কিছু ঘটেনি। অন্যান্য বছরের মতোই বুড়ো হয়েছি, বেড়াতে গেছি, বই পড়েছি। যত পড়ব ভেবে রেখেছিলাম তার থেকে বেশিই পড়েছি। এ বছরের পড়া বই নিয়ে একটা পোস্ট লেখার ইচ্ছে আছে, কিন্তু নেক্সট কুড়িপঁচিশ দিনে আরও কয়েকটা বই পড়ে ফেলার উচ্চাশা আছে, কাজেই সে পোস্ট মাসের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতেও আসতে পারে। 

এ বছর অনেক নতুন জিনিস জেনেছি। পুঁই শাকের যে বীজ হয় আর সে বীজ যে রান্না করে খাওয়া যায় এই বছরেই জানা হল। তাও শেষের দিকে এসে। আমার না-জানা দিয়ে অবশ্য সবজির বিরলত্ব প্রমাণ হবে না। আলু পটল ফুলকপি বাঁধাকপি বাদ দিয়ে এমনিই আমি তরিতরকারি বেশি একটা চিনি না, লাউ চালকুমড়োয় রেগুলার গুলোই, রং দেখে লাল শাক আর ভালোবাসা দিয়ে কলমি শাক চিনি। চিনি না বলে অবশ্য লজ্জা পাই না; মহাপুরুষরা তো বলেই গেছেন, যাবত বাঁচা তাবত শেখা। নতুন জিনিস দেখলেই প্রশ্ন করি, এটা কী, ওটা কী। না নিলেও, না খেলেও। জানতে তো দোষ নেই। অনেকে নিজের অজ্ঞানতা প্রকাশে ভয় পান; ট্যালা খদ্দের বুঝে দোকানি যদি বেশি দাম নেন। আমার এক ভাই এই ভয়ে ভুগত। একদিন তার ভেটকি খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে আর সে বাজারে গেছে। এদিকে সে ভেটকি চেনে না। আমি হলে সোজা জানতে চাইতাম, এই যে এত মাছ শুইয়ে রেখেছেন এর মধ্যে ভেটকি কোনটা? ভাই আমার মতো বোকা নয়। সে নাকি মুখটা জোর করে মাছের দিক থেকে ঘুরিয়ে রেখে বলেছিল, কী দাদা, ভেটকি নেই? তখন দাদা, কেন থাকবে না, ওই তো, বলে আঙুল দিয়ে ভেটকি পয়েন্ট আউট করেছিলেন। তখন ভাই আকাশ থেকে পড়ে বলেছিল, এহ হে, দেখেছেন একেবারে চোখের সামনেই আছে অথচ দেখতে পাইনি। তা কত করে দিচ্ছেন?

আমি আর বললাম না যে এ সব টিপস অ্যান্ড ট্রিকস আমাদের ডাকাতদাদার সঙ্গে চলবে না। আপনি ভারতীয় শাকসবজির চলন্তু এনসাইক্লোপিডিয়া হন কি ট্যালারাম সর্দার, ওঁর যদি ঠকানোর ইচ্ছে হয় তো ঠকাবেন। কম আর বেশি। এতদিন ঠকে ঠকে আমরা এখন বুঝতে পারি কোনদিন কম ঠকলাম কোনদিন বেশি। যেদিন উনি বেশি বেশি ধনেপাতা কাঁচালংকা ফ্রি দেন সেদিন বুঝি দাঁও মেরেছেন, আর যেদিন গুটিকয়েক শুঁটকো লংকা ছুঁড়ে ব্যাগে ফেলেন, সেদিন বুঝি দাদা হাত কামড়াচ্ছেন। 

কাল কচুপাতার মতো লম্বা লম্বা ডাঁটির মাথায় পাতা দেখে জিজ্ঞাসা করলাম এটা কী? (কচুপাতা চিনি, কাজেই কচুপাতা যে নয় সেটা শিওর ছিলাম) ডাকাতদাদার স্যাঙাৎ, আরে এটা তো শীষ পালং। দারুণ খেতে। বলেই দু'খানা ডাঁটি তুলে আমার ব্যাগে চালান করলেন। আমি বললাম, আচ্ছা, তাহলে দিয়ে দিন। গীতাদি সকালবেলা এসে ফ্রিজ খুলে খুব খুশি হলেন। আবার দুঃখও পেলেন। 

সঙ্গে একটু কুমড়ো আনোনি? আর একটুখানি বেগুন? বললাম পরের দিন আনব’খন। 

গীতাদির খুব দুঃখ আমরা যথেষ্ট খাইদাই না। নালিশ করেন, কী খালি আলু খাও সকালবিকেল। তোমাদের অল্প বয়স (গীতাদির তুলনায়), খাটের ওপর লেপের ভেতর বসে থাকবে, আমি রকম রকম রেঁধে দেব, খাবে। ঝাড়া হাত পা তোমাদের, আরাম করবে না তো কী করবে।

এই জিনিসটাও জানলাম, এ বছরে নয় অবশ্য। হারানো ক্রেডিট কার্ডের খোঁজে পোস্টঅফিস ব্যাংক এক করে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরলে নিচের কাকিমা জানালা থেকে মুখ বার করে জিজ্ঞাসা করবেন, সিনেমা দেখে ফেরা হল বুঝি? আবার হয়তো যাচ্ছি গ্যাসের দোকানে তাগাদা দিতে, ওপরের কাকিমা হেঁকে বলবেন, আজ কী খেতে যাওয়া হচ্ছে, দোসা না চাউমিন? 

যেন খাওয়া আর সিনেমা দেখা ছাড়া আমাদের আর কোনও কাজ নেই। আমাদের দেখলে সম্ভবতঃ তাই মনে হয়, অবান্তরের পাতাতেও সেই রকমই একটা আভাস ফুটে বেরোয়, সে আঁচ আমি পেয়েছি।আমাদের এইরকম অকর্মার ঢেঁকি ইমেজ দেখে রাগ হতে পারত, কিন্তু হয় না। কারণ, এক, ইমেজটা সত্যি। দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, কর্মবীর হওয়া, অন্তত আমার জীবনের সার্থকতার শর্ত যে নয় সেটা এ বছর নয়, গত বেশ কয়েক বছরে জেনে গেছি। বরং এই যে ফুরফুরিয়ে ভেসে যাচ্ছি, আমার জীবনের এই ছবিটাই যদি লোকের চোখে ভেসে থাকে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবে না। কারণ ওটাই আমার অ্যাসপিরেশন।

সামনের বছর এ বছরের থেকেও নির্ভার জীবনযাপন করব। বই পড়া, শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাওয়া, প্রতিক্রিয়া আরও কমিয়ে আনা, এ সব গতে বাঁধা রেজলিউশনের পাশাপাশি ওটাই আমার দু’হাজার কুড়ির রেজলিউশন।


Comments

  1. সামনের বছর এ বছরের থেকেও নির্ভার জীবনযাপন করব। বই পড়া, শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাওয়া, প্রতিক্রিয়া আরও কমিয়ে আনা, এ সব গতে বাঁধা রেজলিউশনের পাশাপাশি ওটাই আমার দু’হাজার কুড়ির রেজলিউশন।

    High Five! :) :)

    দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, কর্মবীর হওয়া, অন্তত আমার জীবনের সার্থকতার শর্ত যে নয় সেটা এ বছর নয়, গত বেশ কয়েক বছরে জেনে গেছি। বরং এই যে ফুরফুরিয়ে ভেসে যাচ্ছি, আমার জীবনের এই ছবিটাই যদি লোকের চোখে ভেসে থাকে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবে না। কারণ ওটাই আমার অ্যাসপিরেশন।

    Highest Five!!! :) :) :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আমার তরফ থেকেও যথাক্রমে হাই এবং হায়েস্ট ফাইভ, অরিজিত।

      Delete
  2. Resolutions er jonno shubhokamona.. Darun weather to akhon!

    ReplyDelete
    Replies
    1. দুর্দান্ত ওয়েদার, রণদীপ। আমি তোমার আগের কমেন্টে তোমাকে ভুল নামে ডেকে ফেলেছিলাম, আশা করি রাগ করোনি।

      Delete
  3. Arre na na.. Haddehoya, Gâteau des rois sob ek byapar..

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আদ্যিকালের কথা মনে করিয়ে দিলে যে।

      Delete
  4. চমৎকার রেজোলিউশন। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।

      Delete
  5. Baah khub bhalo resolution.... aami eto gochhano noi.... tai aamar kono resolution nei....bhalo thakun... anek shubhokamona aapnar resolution er jonyo

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুস্মিতা। আমারও রেজলিউশনহীন থাকতে পারলে ভালোই লাগত, কিন্তু অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে।

      Delete

Post a Comment