তিনটে বই
Drive Your Plow Over The Bones/ Olga Tokarczuk
“I’ve long since become unused to discussing humanity as a whole. Humanity as a whole is too stable a system, nothing upsets it.
প্রাইজ ব্যাপারটার অনেক অসুবিধে আছে। কারা প্রাইজ পায়, কেন পায়, কারা প্রাইজ দেয়, কেন দেয়, এ সব কঠিং প্রশ্ন। প্রাইজ পাওয়া দিয়ে ভালোমন্দ বিচার কতখানি নিশ্ছিদ্র সে নিয়ে সকলেই সংশয়ে ভোগে। কত লোক গারবেজ লিখে প্রাইজ পেয়ে গেল, কত লোক স্রেফ অনুবাদ হল না বলে নোবেল পেল না - এ বিষয়ে উচ্চকিত চর্চা সর্বত্রই চলে।
কিন্তু প্রাইজের অনেক উপকারিতাও আছে। এই যেমন ওলগা তোকারজুক ২০১৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে আমি তাঁর নাম জানতাম না। তিনি নোবেল পেলেন বলেই আমি তাঁর লেখা Drive Your Plow Over The Bones পড়লাম আর পড়লাম বলেই আমার এ বছরের গোড়ায় এমন একটা বই পড়া হল বছরের শেষের সেরা বইয়ের তালিকায় যা অবশ্যই থাকবে।
যেহেতু এটা গল্পের বই, তাই গল্পটা আগে বলে নিই। উপন্যাসের নাম উইলিয়াম ব্লেকের কবিতার লাইন থেকে নেওয়া।
In seed time learn, in harvest teach, in winter enjoy.
Drive your cart and your plow over the bones of the dead.
নামকরণের সার্থকতা একেবারে একশোয় একশো। গল্পে উইন্টার আছে, ডেড আছে, লজঝড়ে চারচাকাকে গণ্য করলে কার্টও আছে। কার্টের মালিক আমাদের গল্পের হিরো, ইয়ানিনা (Janina Duszejko)। ইয়ানিনা প্রৌঢ়, ইয়ানিনা থাকে চেক প্রজাতন্ত্রের সীমান্ত সন্নিকটস্থ পোল্যান্ডের একটি জনবিরল গ্রামে। শীতকালে সেখানে কী রেটে বরফ পড়ে আন্দাজ করতে পারছেন। না পারলে এটুকু জানাই যথেষ্ট যে তা মানুষ বসবাসের অনুকূল নয় এবং যে গুটিকয়েক বাসিন্দা ওই গ্রামে সারাবছর থাকেন, অধিকাংশই শীত শুরু হলে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এবং বাসযোগ্য জায়গায় পালান। থেকে যায় যারা, বোঝাই যাচ্ছে স্বাভাবিক নয়, অদ্ভুত। এঁদের মধ্যে রয়েছেন আমাদের গল্পের হিরো ইয়ানিনা, আর বিগ ফুট আর অডবল।
বলা বাহুল্য, বিগ ফুট, অডবল ইত্যাদি লোকজনের মাতৃপিতৃদত্ত নাম নয়। ইয়ানিনা নিজের মাথার ভেতর এদের এই নামে ডাকে। যে প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে বসে ইয়ানিনা ইংরিজি কবিতার পোলিশ অনুবাদ করে তাকে ইয়ানিনা মনে মনে ডাকে Dizzy বলে। যে দোকান থেকে ইয়ানিনা সেকেন্ড হ্যান্ড জামাকাপড় কেনে সেখানকার গরিবগুর্বো কর্মচারী মেয়েটির নাম ইয়ানিনা রেখেছে “গুড নিউজ”।
ইয়ানিনার পেট চলে শীতকালে প্রতিবেশীদের ছেড়ে যাওয়া বাড়ি দেখভাল করে। একদিন রাতে, গল্পের প্রথম সিনে, অন্ধকার রাতে দুমদাম দরজা পিটিয়ে অড বল ইয়ানিনার ঘুম ভাঙায়। বিগ ফুট মারা গেছে। কী করে সেটা বোঝা যায় না, তবে মৃত্যু শান্তিপূর্ণ নয়। সন্দেহ করা হয় বেআইনি পোচিং করে যে সব জন্তুজানোয়ার মারত বিগ ফুট, তাদেরই কেটে খেতে গিয়ে মাংসের হাড় গলায় বিঁধে ব্যাটা মরেছে।
পুলিস আসে, তদন্ত হয়। বডি আবিষ্কার করা বাবদে অড বল আর ইয়ানিনাকে যথোপযুক্ত হেনস্থাও করা হয়। এই শীতে ঘাপটি মেরে বসে থাকাটাই সন্দেহজনক, তার ওপর এই খুন।
কিছুদিন পর আরেকটি রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে।
নোবেল পুরস্কারজয়ী লেখকের বিব্লিওগ্রাফিতে মার্ডার মিস্ট্রি, আশা করেননি তো? ওলগা তোকারজুক অবশ্য বলেছেন, স্রেফ খুনির নাম জানার জন্য একখানা পূর্ণাঙ্গ বই লেখা কালিকলমের অপচয় বই কিছু না। কাজেই একাধিক রহস্যজনক মৃত্যু, রহস্য সমাধানে পুলিসের ছোটাছুটি, ক্লু এবং রেড হেরিং ইত্যাদি সমস্ত রকম ট্রোপ থাকলেও, DUPOTB খুনখারাপি গোয়েন্দাগিরির গল্প নয়।
এ গল্প জনজাতির বদলানো মূল্যবোধের। শারীরিক যন্ত্রণা এবং মানসিক একাকীত্বের। নিজের থেকে দুর্বল মানুষ এবং অমানুষদের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার। গোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে আঙুলে-গোনা কয়েকজন মানুষের লড়াইয়ের।
গোয়েন্দাগল্প লেখা আর কালিকলমের অপচয়ের ব্যাপারে একমত না হলেও ওলগা তোকারজুকের অন্য একটা কথার সঙ্গে আমি একশো শতাংশ একমত। গণতন্ত্রের ধারণা ততক্ষণই বলবৎ যতক্ষণ তা দুর্বল, অসহায়, এবং সংখ্যালঘুর জন্য। The weakest, the vulnerable, the minorities. DUPOTB-তে সেই উইকেস্ট এবং মাইনরিটি হচ্ছে প্রাণীজগৎ। আমরা যাদের কখনও নিজেদের সমান বলে ভাবিনি। হয় মা হিসেবে পুজো করেছি, নয় অন্য কোনও মায়ের পুজোয় বলি দিয়েছি। ইয়ানিনা যে ধর্মের নাগালে বাতাবরণে বাস করে, সেখানে জীবজগতের অস্তিত্বের প্রধান কারণ মানুষের ভোগের সাধন। শিকার সেখানে খেলা। খেলা সেখানে শিকার।
মানুষের এই অমানুষিক খেলার বিরুদ্ধে ইয়ানিনার যুদ্ধ। যেখানে ক্ষমতায় থাকা একের পর এক ক্ষমতাবান লোকের রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে হইচই সেখানে ইয়ানিনা থানায় যায় মানুষের গুলিতে বুনো শুয়োরের খুন হওয়ার এফ আই আর লেখাতে।
DUPOTB তার সমাজচিন্তার জন্য আলোচিত। কিন্তু এ ছাড়াও লেখার খুঁটিনাটির, গল্পের কাঠামো, চরিত্রচিত্রণের দিক থেকেও উপন্যাসটি সম্পর্কে আমার কিছু কথা বলার আছে।
ভালো গল্পের একটা প্রধান শর্ত হল চরিত্রদের বহুমাত্রিকতা। রক্তমাংসের মানুষ যেমন হয় আরকি। প্রিজমের মতো তার যত দেওয়াল, যত কোণাঘুঁজি থাকবে, প্লটের আলো পড়ে তত সে পাঠকের চোখ ধাঁধাবে। ব্যাপারটা শুনতে যত সোজা কাজে তত নয়।
DUPOTB চরিত্রচিত্রণ শেখানোর টেক্সটবুক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমি যা যা মনে আছে, মেন চরিত্রের সেই ক’টা দিকের কথা মনে করে করে লেখার চেষ্টা করছি।
মহিলা জ্যোতির্বিদ্যায় বিশ্বাসী এবং রীতিমত প্র্যাকটিস করেন। তিনি স্থানীয় বাচ্চাদের স্কুলে ইংরিজি শেখাতেন। তিনি ইংরিজি কবিতার অনুবাদ করতে প্রাক্তন ছাত্রকে সাহায্য করেন। তিনি প্রতিবেশীদের ফাঁকা বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করেন। তিনি জন্তুজানোয়ারদের প্রতি অন্যায় দেখলে বিচলিত হন, প্রতিবাদ করেন, ঝামেলা পাকান, গ্রেপ্তার হন। তিনি সীমানার ওপারের চেক প্রজাতন্ত্রের দিকে তাকিয়ে, আহা গো স্বপ্নের দেশ, বলে হাহুতাশ করেন। গল্পের প্রায় মাঝখানে গিয়ে পাঠক জানতে পারে যে তিনি একসময় অ্যাফ্রিকার দুর্গম জায়গায় গিয়ে ব্রিজ বানাতেন, অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। (চরিত্রের এই দিকটি উন্মোচনের ক্রম বা দেরিটা উল্লেখ করলাম কারণ এটা গুরুত্বপূর্ণ। মহিলার আচরণ দেখেশুনে, বিশেষ করে তাঁর জীবজগত সংরক্ষণের তাগিদ, যখন তিনি থানায় বন্য শুয়োর খুনের এফ আই আর লেখাতে গিয়ে এভিডেন্স হিসেবে তার রক্ত ও রোমে মাখামাখি চামড়ার টুকরো টেবিলে রাখেন, এবং যতক্ষণে পাঠক তাকে আধপাগলা গেঁয়ো বুড়ি বলে ধরে নেয় তখন গিয়ে লেখক খোলসা করেন যে ইনি এককালে অ্যাফ্রিকার দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে ব্রিজ বানাতেন। সমস্ত স্টিরিওটাইপিং-এর ওইখানেই ইতি।)
এবং ইয়ানিনার এতগুলো দিকের কথা জেনে যদি পাঠক ভয় পান যে ইস, এত লিখতে গিয়ে নির্ঘাত প্লটের ঘণ্ট পাকিয়েছে, তাহলে তার থেকে বেশি ভুল আর করবেন না। এই সমস্তই হয়েছে গল্পের গতি একটুও না টসকিয়ে।
টানটান ফিকশনের আরেকটা গোড়ার শর্ত কনফ্লিক্ট। কোনও একটা গোলমাল না বাধলে আর গল্প কীসের। DUPOTB এই কনফ্লিক্টের ধারণাটাকে একেবারে কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করে। সিস্টেমের ভেতরে থাকা মানুষের সঙ্গে সিস্টেমের বাইরে থাকা মানুষের কনফ্লিক্ট। বিগফুটের সঙ্গে ইয়ানিনার কনফ্লিক্ট। অডবলের সঙ্গে অডবলের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুলিসপুত্রের কনফ্লিক্ট। এবং সেই চিরন্তন প্রকৃতি এবং মানুষের কনফ্লিক্ট। একই সঙ্গে সে চরম প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড় করায় মানুষকে, ভিটেমাটি চাটি করে প্রতি বছর, আবার সেই প্রকৃতিই মানুষের নিষ্ঠুরতার সামনে অসহায়। মানুষের গুলির মুখে নিজের সন্তানদের বলি দিতে বাধ্য।
DUPOTB-র তিন নম্বর চমকে দেওয়ার মতো ব্যাপার হচ্ছে রসবোধ। সেই বিরল, বিরলতম রসবোধ যা কোনও রকম ‘সিচুয়েশন’ উদ্ভূত নয়। টর্চ খুঁজে না পাওয়া নিয়ে দুটো লাইন পড়ে জোরে না হেসে উঠে থাকা যায় না। আমি হাসির জায়গাগুলো কিন্ডলে বুকমার্ক করে রেখেছিলাম কিন্তু তুলে দিচ্ছি না। কারণ আমার বিশ্বাস ওগুলো ঠিক হাসি পাওয়ার মতো লাইন নয়। আমার সেই মুহূর্তে হাসি পেয়েছিল। আপনাদেরও হয়তো হাসি পাবে, কিন্তু হয়তো আমার যেখানে হাসি পেয়েছিল সেখানে পাবে না, অন্য কোনও জায়গায় হাসি পাবে।
এমন রোমহর্ষক কাম ভাবনা-উসকানি গল্পের বই বেশি পড়িনি। Drive You Plow Over The Bones আমার অ-সা-মা-ন্য লেগেছে।
Roadside Picnic/ Arkady and Boris Strugatsky
গ্রহান্তরের প্রাণীদের নিয়ে মানুষের কৌতূহল চিরকালই ঊর্বর। আকাশের দিকে যতবার তাকিয়েছে, মানুষের মনে হয়েছে, ওই বিরাট অন্ধকারে কেউ কোত্থাও নেই এ কি হতে পারে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোসো, খুঁজে দেখি। শিল্পীসাহিত্যিকদের ধৈর্য চিরকালই কম, তাঁরা ধরে নিয়েছেন কেউ না কেউ আছেই, ধরে নিয়ে কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়েছেন। তাঁদের কল্পনায় মহাকাশচারীদের মাথায় কখনও অ্যান্টেনা, কখনও তারা লোলচর্ম, কখনও তাদের কাঠি কাঠি আঙুল কিংবা ঘংঘঙে গলা, কেউ কেউ আবার এক্স্যাক্টলি মানুষের মতো। মানুষের প্রতি মনোভাবের ক্ষেত্রে অবশ্য এত সম্ভাবনা তাঁরা খতিয়ে দেখেননি। হয় তারা আমাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন, বছর বছর এসে মানুষকে অগ্রগতিতে সাহায্য করে; নয় তারা আমাদের শত্রু, গোটা মানবসভ্যতাকে দাস বানিয়ে পৃথিবী দখল করার মতলব।
যে সম্ভাবনাটা মেগালোম্যানিয়াক মানুষের কল্পনা করতে কষ্ট হয়েছে, সেটা হল আমাদের প্রতি মহাকাশের প্রাণীদের সম্পূর্ণ উদাসীনতা। আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা না থাকা। আমাদের ক্ষতি কিংবা লাভসাধন, একটাতেও তাদের উৎসাহী না হওয়া। আমরা যেমন পিঁপড়ের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে তাকে পায়ে টিপে মারি না, মারি কারণ আমি তাকে দেখতেই পাইনি, কিংবা…(মানুষ অজান্তে প্রকৃতির কী উপকার করে ভাবতে আমার মাথার বাকি চুল পেকে যাচ্ছে, আদৌ করে কি? কারও জানা থাকলে বলবেন) ……সে রকম ব্যাপার।
বড়জোর নিজেদের উদ্ভট গাড়ি চড়ে যেতে যেতে পথে একটা গ্রহ দেখতে পেয়ে থেমে দু’দণ্ড থেকে শতরঞ্চি পেতে খাওয়াদাওয়া করে, চারদিকে জঞ্জাল ছড়িয়ে রেখে (অবিকল আমাদেরই মতো), আবার উদ্ভট গাড়ি চড়ে হাওয়া হয়ে যাওয়া ছাড়া পৃথিবীর প্রতি তাদের আর কোনও হেলদোল নেই।
Arkady and Boris Strugatsky, দুই ভাইয়ের উনিশশো একাত্তরে রাশিয়ানে প্রকাশিত হওয়া এবং উনিশশো বাহাত্তরে ইংরিজিতে অনুবাদ হওয়া ছোট্ট উপন্যাস ‘রোডসাইড পিকনিক’-এর ঘটনা ঘটছে এইরকম পিকনিক-পরবর্তী পৃথিবীতে। পৃথিবীর ছ’টি জায়গায় একই সঙ্গে গ্রহান্তরের প্রাণীরা এসে নেমে দু’দিন ধরে তাদের “পিকনিক” চালিয়ে আবার উধাও হয়ে গেছে। সেই অঞ্চলগুলি সুরক্ষিত করে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। যদি কোনওভাবে সেই বর্জ্য পদার্থ মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে কাজে লাগানো যায়। কিন্তু মহাকাশবাসীদের জঞ্জালের তেজস্ক্রিয়তার কুপ্রভাব পড়েছে অঞ্চলের অর্থনীতি ও সমাজে। বাসিন্দারা বেশিরভাগই সরে পড়েছে। ক্রাইম বেড়েছে।
একটা প্রধান ক্রাইম হচ্ছে বেআইনি ভাবে “জোন”-এ ঢুকে মহাকাশচারীদের বর্জ্য জিনিসপত্র চুরি করে এনে কালোবাজারে বিক্রি করা। বলা বাহুল্য, কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকির। ধরা পড়লে কড়া শাস্তির জন্য তো বটেই, এ ছাড়া চোরদের, যারা “স্টকার” নামে কুখ্যাত, তাদের জীবনের পক্ষেও বটে। তেজস্ক্রিয়তায় তাদের প্রাণ পর্যন্ত যেতে পারে, অঙ্গক্ষয় কমন ব্যাপার।
রোডসাইড পিকনিক পড়তে আমার সুবিধে হয়েছে কারণ কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস হলেও ‘সাই ফাই’ অংশটি অর্থাৎ গ্রহান্তরের প্রাণীদের পৃথিবী ভিজিট, রয়েছে সম্পূর্ণ নেপথ্যে। এ উপন্যাস সেই উপস্থিতিজনিত পরিবর্তিত পৃথিবীতে প্রান্তিক মানুষদের জীবনসংগ্রাম, অপরাধ এবং থ্রিল এবং সুখের খোঁজে ঘুরে মরার গল্প।
রোডসাইড পিকনিক পড়তে আমার অসুবিধেও হয়েছে। আমার অসুবিধের বিশেষ বৈচিত্র্য নেই, অবান্তর যারা পড়েন তাঁরা এতদিনে আমার অসুবিধের দৌড় ধরে ফেলেছেন।
রোডসাইড পিকনিক হচ্ছে সেই সময়ের (সময়ের দোহাই দিতে আমার ভালো লাগে না কারণ আমার মতে সমস্যাটা সময়ভিত্তিকের থেকে ঢের বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক) আর সেই গোত্রের সৃষ্টি যেখানে মেয়েদের দুটো রোল। হয় বউ, নয় বেশ্যা। প্রথমে বেশ্যার বর্ণনাঃ (ইনি আক্ষরিক বেশ্যা নন, তবে পুরুষসংসর্গ করেন, টাকার লোভে বড়লোক বিয়ে করেছেন, কাজেই।)
She was silky, luscious, sensuously curvy, without a single flaw, a single extra ounce—a hundred and twenty pounds of twenty-year-old delectable flesh—and then there were the emerald eyes, which shone from within, and the full moist lips and the even white teeth and the jet-black hair that gleamed in the sun, carelessly thrown over one shoulder; the sunlight flowed over her body, drifting from her shoulders to her stomach and hips, throwing shadows between her almost-bare breasts.
মিথ্যে বলব না, ডিলেক্টেব্ল ফ্লেশের গভীরে মহিলার মনোজগৎও লেখক এক্সপ্লোর করেছেন। মহিলা হিস্টেরিক্যাল। বাধ্য হয়েই হিরোকে ঠাস করে চড় কষাতে হয়। এক চড়েই সব সিধে।
ওপরের নারীচরিত্র যেমন নায়কের কামরিপু জয়ের ক্ষমতা এবং বীরত্ব প্রমাণ করার পক্ষে আদর্শ, তেমনি নায়কের দায়িত্বশীলতা ও অন্যান্য গার্হস্থ্যগুণ বোঝানোর জন্য বাড়িতে বউয়ের আমদানি করতে হয়েছে। হিরোর বউ হওয়ার সুবাদে ইনি প্রায় দেবীসুলভ কাজেই স্তন ও ঊরুর বদলে এঁর চোখ ও চুলের বর্ণনায় পাঠককে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। হিস্টেরিক্সের জায়গা নেয় মাতৃত্ব।
তো? সমাধানটা কী? এ সব ক্ল্যাসিক বই। মেয়েদের মানুষ মনে করেনি বলে কি বিশ্বসাহিত্যে এঁদের অবদান স্বীকার করব না?
নিশ্চয় করব। এবং স্বীকার করার সময় অসুবিধের জায়গাগুলো উল্লেখই করব না। কারণ সেটা করার জন্য আগে অসুবিধেগুলো টের পাওয়া দরকার। যেটা বেশি লোকে পায় না। আমিও পাই না। সকলেই শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম, সকলেই উচ্চবর্ণ, সকলেই বিপরীতলিঙ্গে উৎসাহী চরিত্রে ভরপুর গল্প পড়ে দিব্যি স্বাভাবিক বলে ধরে নিই।
কিন্তু আমি সে জন্য লজ্জা পাচ্ছি না বা কাউকে পেতেও বলছি না। টের না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
অস্বাভাবিক হবে অন্য কেউ টের পেলে তেরিয়া হয়ে উঠলে। ভাবলে, কই আমি তো টের পাইনি? তার মানে কি আমি বুঝিনি?
বিশ্ববরেণ্য সাহিত্য নিয়ে হইচই হোক। বেড়ে ওঠার বইদের সমস্ত খামতি অগ্রাহ্য করে আমরা নস্ট্যালজিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকি। কিন্তু তা বলে বাকি কেউ টের পাবে না এমনটা ধরে না নেওয়াই ভালো। টেরও পাবে এবং পয়েন্ট আউটও করবে। যারা টের পাচ্ছি না তারা নামসংকীর্তনের ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে সেই স্বরগুলোকে চাপা দিয়ে দিতে পারি, বা “ধুর, কিস্যু বোz-এনি” বলে উড়িয়ে দিতে পারি। যার যেমন (অভি)রুচি।
The Testaments/ Margaret Atwood
অবশেষে আমি মার্গারেট অ্যাটউডের দ্য হ্যান্ডমেডস টেল-এর বহুআলোচিত, বহুচর্চিত, বহুনিন্দিত সিকোয়েল উপন্যাস দ্য টেস্টামেন্টস পড়ে উঠতে পারলাম।
এটাও গল্পের বই, কাজেই গল্পটা আগে বলতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে আগের গল্পটার সঙ্গে এই গল্পটা এত ওতপ্রোত যে সেটা না বললে এটার আগামাথা কিছুই বোঝা যাবে না। যাঁদের স্পয়লারে ভয় এখানেই টা টা বাই বাই করুন।
আগের গল্পে অর্থাৎ হ্যান্ডমেড’স টেল-এ আমরা একটি ডিসটোপিয়ার মুখোমুখি হই। স্থান, গিলিয়াড (অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্র); কাল কাল্পনিক। গিলিয়াডে একটি সামাজিক বিপ্লব সাধিত হয়েছে, যেখানে পুরুষরা সমস্ত ক্ষমতা দখল করেছে। মেয়েরা যে যা সব কাজ করত - শিক্ষক, অধ্যাপিক, লেখক, বিচারক - সব বন্ধ। মেয়েদের কাজ এখন শুধু একটাই। বাচ্চার জন্ম দেওয়া।
হ্যান্ডমেড’স টেল-এর শেষে গিয়ে আমরা জানতে পারি যে অফফ্রেড (ফ্রেড নামক পুরুষের ব্যক্তিগত ব্যবহারের হ্যান্ডমেড অর্থাৎ “অফ ফ্রেড” থেকে অফফ্রেড) নিক বলে এক ড্রাইভার প্রেমে পড়ে এবং নিকোল বলে একটি সন্তানের জন্ম দেয়। গিলিয়াডে এ কাণ্ডের একমাত্র পরিণতি মৃত্যুদণ্ডের পর দুজনের মৃতদেহ রাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে দেওয়া। কিন্তু অফফ্রেড ও নিক একটি অসাধ্য সাধন করে। গিলিয়াডের “আই” এড়িয়ে তারা বেবি নিকোলকে কানাডায় পাচার করে এবং নিজেরাও পালায়। এবং এটা কিন্তু খুব বিরল ঘটনা নয়, পরে আমরা জানতে পারি যে অনেকেই সীমান্ত দিয়ে কানাডায় পালিয়ে যায়। তবে সামান্য পরিমাণে, বলাই বাহুল্য, কারণ ধরা পড়লে সোজা মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু বেবি নিকোলের পাচারটা গিলিয়াডের কর্তৃপক্ষের গালে একটি মোক্ষম চড় হিসেবে প্রতিভাত হয় এবং তারা দীর্ঘসময় ধরে কানাডায় মিশনারি চর পাঠিয়ে বেবি নিকোলকে গিলিয়াডে ফেরত আনার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
এই গল্প ভবিষ্যতে বসে শুনছি আমরা। গিলিয়াড ধ্বংস হয়ে গেছে বহু শতাব্দী আগে। গিলিয়াড-গবেষকরা তিনটি তথ্যপ্রমাণ আবিষ্কার করেছেন, আন্ট লিডিয়ার ডাইরি আর দু’জন সাক্ষীর বয়ান। টেস্টামেন্ট অফ উইটনেস ৩৬৯এ এবং টেস্টামেন্ট অফ উইটনেস ৩৬৯বি। আন্ট লিডিয়া গিলিয়াডের কর্তৃপক্ষের দিকের লোক এবং পাওয়ারফুল (গিলিয়াডে একজন মহিলার গিলিয়াডে যতখানি পাওয়ারফুল হওয়া সম্ভব)। ৩৬৯এ গিলিয়াডের আরেকজন মহিলা বাসিন্দা যিনি আন্ট হওয়ার ট্রেনিং নিচ্ছেন। আর উইটনেস ৩৬৯বি হচ্ছে - বেবি নিকোল। কীভাবে গিলিয়াডের ধ্বংসের শুরু হল এবং সেই শুরুতে এই তিনজনের ভূমিকার কথা আমরা জানতে পারি টেস্টামেন্টস-এ।
আমার নিজের ধারণা টেস্টামেন্টস-এর কপালে এত নিন্দে জুটত না যদি না উপন্যাসটিকে বার্নার্ডিন এভারিস্টোর ‘গার্ল, ওম্যান, আদার’-এর সঙ্গে যুগ্মভাবে বুকার প্রাইজটা না দেওয়া হত। কয়েকজন বলেছেন দেখলাম, টেস্টামেন্টস যত না হ্যান্ডমেড’স টেল-এর সিকোয়েল তার থেকে বেশি নেটফ্লিক্স সিরিজের সিকোয়েল। আমি সিরিজ দেখিনি কাজেই বলতে পারব না। এটা বলার একটা কারণ হতে পারে যে উপন্যাসটি ফিল্মি, প্লটপ্রধান। তবে অ্যাটউডের লেখার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে তাঁদের এই প্লটপ্রাধান্য নতুন ঠেকবে না। আমার একজন পছন্দের সমালোচককে অনুযোগ করতে শুনেছি, তাঁর মার্গারেট অ্যাটউডের লেখা অনেক চেষ্টা করেও ভালো লাগাতে না পারার একটা অন্যতম প্রধান কারণঃ “ইটস জাস্ট প্লট, প্লট, প্লট।”
আমার ব্যক্তিগতভাবে প্লটে অসুবিধে নেই (না হলে আর গোয়েন্দাগল্প সহ্য করি কী করে), কিন্তু টেস্টামেন্টস পড়তে আমার অন্য কয়েকটা কারণে অসুবিধে হয়েছে।
যেহেতু গল্পটা বলা হয়েছে বয়ানে, টেলিং বেশি হয়ে গেছে শোয়িং-এর থেকে। চোখে লেগেছে গিলিয়াডের পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য সেট পিসের অবতারণা। চরিত্রচিত্রণেও ভালোমন্দর রেখাটা বড় বেশি স্পষ্ট। আন্ট ভিডালা ক্ষমতালোভী, শমামাইট বিয়ে-স্ট্যাটাসলোভী অগভীর মেয়ে, বেবি নিকোল রেবেলিয়াস তারুণ্যের ক্যারিকেচার। তাছাড়া বেবি নিকোলের চরিত্র “চোজেন ওয়ান” সিনড্রোমে টইটম্বুর - চরিত্রটির গুরুত্বটা পুরোটাই জন্মের লটারির ফল। উল্টোদিকে আন্ট লিডিয়াকে, যিনি পূর্বাশ্রমে জজসাহেব ছিলেন, সব হারিয়ে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। বুদ্ধি, শঠতা, সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট - চরিত্রের সমস্ত অস্ত্রের যথাযথ প্রয়োগ করে প্রতিকূলতম পরিস্থিতিতে নিজের জায়গাটুকু ছিনিয়ে নিতে হয়েছে।
বলা বাহুল্য, আন্ট লিডিয়ার গল্প অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং।
টেস্টামেন্টস পড়াকালীন খুঁটিনাটি অনেক খামতি চোখে পড়ছিল। কিন্তু পড়ার পর থেকে বলতে বাধা নেই, টেস্টামেন্ট আমাকে ভাবাচ্ছে। ভাবাচ্ছে গিলিয়াডও। যদিও গল্পে গিলিয়াডকে কাল্পনিক দাবি করা হয়েছে, কিন্তু নিচে গিলিয়াডের কয়েকটা বৈশিষ্ট্যের কথা লিখছি। দেখুন তো কাল্পনিক লাগে কি না।
১। গিলিয়াড মনে করে যে মহিলাদের প্রতি কোনও বৈষম্য আসলে হয়নি, কারণ প্রকৃতিতে নারীপুরুষের সৃষ্টি হয়েছে দু’রকম কাজ করার জন্য। সে প্রাকৃতিক নিয়মের অন্যথার শাস্তি হওয়াই উচিত। গিলিয়াডের সমর্থকরা এও মনে করেন যে মহিলাদের সঙ্গে কোনও অনাচার হয়নি কারণ বাড়ির ভেতর মহিলাদের প্রাধান্য আগের মতোই রয়েছে; ইন ফ্যাক্ট, আগের থেকেও শক্তপোক্ত হয়েছে, কারণ বাইরের কাজে শক্তিক্ষয় করার বদলে রান্নাবান্না সন্তানপালন ইত্যাদি কাজ মহিলারা আরও মনোযোগ দিতে পারছেন, কাজেই এ সব কাজে মহিলাদের পারফরম্যান্স আরও ভালো হয়েছে।
(অফিসের একজন আমাকে বলেছিলেন, কী আজকাল সব নারীবাদ নারীবাদ করে, আমাদের বাড়িতে তো কবে থেকে নারীবাদ চলছে। সংসার তো পুরো মায়ের দখলে ছিল। কী রান্না হবে, বাড়িতে কী খাওয়া হবে, কী মেনু, ছেলেমেয়েরা কী খাবে, কোন কোন ব্রত পালন হবে - এই নিয়ে তো মায়ের ওপর বাবাকে কোনওদিন একটা কথাও বলতে শুনিনি? ‘বাইরে বাঘ বাড়িতে বউয়ের ভেড়া’ বাবদে যত চুটকি, সব ওই গিলিয়াড-লজিকের এদিকওদিক। রিসেন্টলি ওই লজিকেই বানানো, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি অভিনীত একটা অ্যাড মতো দেখলাম - একজন প্রগতিশীল শেয়ার করেছেন।)
২। গিলিয়াডে মেয়েদের সাবধানে চলাফেরা করতে হয়, পাছে তারা পুরুষদের কোনওভাবে উত্তেজিত করে ফেলে। মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে চমৎকার চমৎকার সব ইমেজারি জড়িয়ে আছে। কোন পুরুষের যে মেয়েলি ঘাড় দেখে মন ভুলবে, কোন পুরুষের সুডৌল পায়ের পাতা, কার যে আবার ভ্রূভঙ্গিতে দুর্বলতা বোঝা মুশকিল, কাজেই গোটাটাই ঢেকে ফেলা দরকার। না হলে বিপদ কারণ পুরুষের উত্তেজনার পরিণতি মহিলার ধর্ষণ থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। পুরুষের আত্মসংযমের প্রতি ভরসা? পাগলেও করে না, কারণ বয়েজ উইল বি বয়েজ।
৩। তা বলে কি গিলিয়াডে ধর্ষণ অপরাধ বলে গণ্য নয়? অবশ্যই গণ্য। যদি প্রমাণ হয় যে ধর্ষণের পেছনে মহিলার কোনওরকম উসকানি ছিল না, তিনি ধর্ষককে কোনও ভাবে উত্তেজিত করেননি, তা হলে ধর্ষণ ঘোরতম অপরাধ। এবং সে অপরাধের এনকাউন্টার দৃষ্টান্তমূলক। স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকের উল্লাসের মধ্যে দোষীকে পাল পাল “ফেরাল” হ্যান্ডমেডদের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারা দোষীকে আক্ষরিক ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে।
ওই যে বিশ্বসাহিত্যে অবদানটবদানের কথা হচ্ছিল, অ্যাটউডের গিলিয়াড, প্রাইজ পাক বা না পাক, যোগ্য হোক বা না হোক, নিঃসন্দেহে সে অবদান রেখেছে। আমরা আমাদের সমাজের খোপে খোপে, বুকের কোটরে কোটরে যে আস্ত গিলিয়াড পুরে নিয়ে চলেছি সেটা সামনে এনে দেখানোর জন্য। খাদের কতখানি কাছে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যও।
"মানুষ অজান্তে প্রকৃতির কী উপকার করে ভাবতে আমার মাথার বাকি চুল পেকে যাচ্ছে, আদৌ করে কি? কারও জানা থাকলে বলবেন" , মানুষ এতো জেনেই বা পৃথিবীর কি উপকার করেছে তাওতো এতদিনে বুঝতে পারলাম না।
ReplyDeleteহাহা, যা বলছেন, নালক।
Delete