কমফর্ট ইন দ্য টাইম অফ করোনা/ ১



চিরজীবন ভেবে এসেছি অফিস কেটে বাড়িতে থাকা আরামের। এখন বাড়িতে থেকে অশান্তি ছাড়া কিছু নেই। একগাদা চিন্তা মাথার ভেতর গাদাগাদি। কী হবে। কী হবে না। না হলে কী হবে। মাথার ভেতর জ্ঞানপাপী কুন্তলা বোঝাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকাটাই আসল হওয়া, বাকি সব তুশ্চু, কিন্তু মনে মনে জানি যে মরব না। কেন মরব না তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। কেউ বর দেয়নি, কুষ্ঠিতেও লেখেনি, এমন কি আয়ুরেখাদুটোও তালুর মাঝখান পর্যন্ত গিয়ে হাওয়া হয়েছে।

প্রথমে শুনেছিলাম মেয়েদের ভাগ্য বাঁ হাতে লেখা থাকে আর ছেলেদের ডান হাতে। যখন শুনেছিলাম তখন নারীবাদী ছিলাম না, "তাই বুঝি?" বলে নিষ্পাপ ঘাড় নেড়েছিলাম। যতদিনে নারীবাদী হলাম ততদিনে কেউ একজন আশ্বাস দিল, আহা ডানবাঁয়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ের কোনও সম্পর্ক নেই, ছেলেমেয়ে দুয়েরই বাঁ হাতটা হচ্ছে জন্মের হাত, আর ডান হাতখানা কর্মের। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আবার বাঁচলামও না, যখন পরীক্ষা করে দেখলাম জন্মের হাতে আমার আয়ুরেখা তালুর প্রায় মাঝখানে গিয়েই অদৃশ্য হয়েছে, কর্মের হাতে আরেকটু লম্বা - পাপতাপ করে খানিকটা লম্বা করেছি সব শোধ এ জন্মেই মিটিয়ে যেতে হবে বলে - তাও কবজির ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি।

তবু আমি আত্মবিশ্বাসী যে এ যাত্রা আমি টিঁকে যাব। আমি মরছি না। যে মরে মরুক। করোনা কেটে যেই না নতুন সূর্য উঠবে, ঝাড়াপাড়া দিয়ে উঠে হইহই করে জীবনের স্রোতে ভেসে যাব।

তবু চিন্তারা থামে না। খাটের ওপর চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকি। সকাল হলে দুপুর হয় না, দুপুরে বাইনোকুলার দিয়ে বিকেল দেখতে পাই না, বিকেল হলে পরের দিনের জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকি। দিনগুলো আটচল্লিশ ঘণ্টার হয়ে গেছে, আমি সেই আটচল্লিশ ঘণ্টা স্রেফ ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। কোথায় আধাখ্যাঁচড়া উপন্যাসখানা শেষ করে ফেলব, সে জায়গায় অবান্তরের পোস্ট লিখতেও গায়ে জ্বর।

আমার ধারণা অনেকেরই এই অবস্থা। ভুলে থাকার জন্য তাঁরা নানারকম কমফর্ট খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কমফর্ট ফুড, কমফর্ট রিড, কমফর্ট ওয়াচ, কমফর্ট যাবতীয় যা হওয়া সম্ভব। ইউটিউবে বুকব্লগাররা তেড়ে কমফর্ট রিডিং সংক্রান্ত ভিডিও আপলোড করছেন। যাতে যাঁরা আনকমফর্টেবল ফিল করছেন তাঁরা উক্ত বইগুলি নাড়েনচাড়েন এবং বেটার বোধ করেন। ফুডব্লগাররা যে যার কমফর্ট ফুডের রেসিপি ছাপছেন কিংবা 'আজ সারাদিন কী কী খেলাম'-এর খতিয়ান। এন্টারটেনমেন্ট ভাবলে এন্টারমেন্ট, ইন্সপিরেশন ভাবলে ইনস্পিরেশন। একঘেয়ে খাবার খেতে খেতে জিভে চড়া পড়ে গেলে নতুন খাবারের খোঁজ পান এবং বানিয়ে খাওয়ার অনুপ্রেরণাও। ফোরামে ফোরামে, থ্রেডে থ্রেডে, বন্ধুঅবন্ধুতে নতুন নেটফ্লিক্স শো-এর রেকোমেন্ডেশন চালাচালি চলছে। এটা দেখুন, চাকরি যাওয়ার দুঃখ অল্প হলেও কমবে; ওটা খবরদার দেখবেন না, সব থাকা সত্ত্বেও কেঁদে কূল পাবেন না।

আমার নেটফ্লিক্স নেই, কিন্তু হইচই আছে। ওমুখো হইনি প্রায় একমাস হল। হইচই কর্তৃপক্ষের উপর্যুপরি ইমেল এবং "উই মিস ইউ" মেসেজ এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দিচ্ছি। আমি নিরুপায়। এই দুর্যোগে 'বন্য প্রেমের গল্প' দেখার বিন্দুমাত্র তাগিদ আমি জোগাড় করতে পারছি না। তার থেকে 'বোম্বাইয়ের বোম্বেটে'তে রজতাভর দাঁত কিড়মিড় একশো পাঁচতম বার দেখব, সেও ভি আচ্ছা। কমফর্ট বলতে যা বোঝায়, তা আমি নতুন জিনিসে পাই না। আমার আরামের জন্য চাই পুরোনো জামা, পুরোনো বই, পুরোনো খাবার, পুরোনো প্রেম। উত্তেজনা আর আরাম, আমার ক্ষেত্রে অন্তত, বেশিরভাগ সময়েই পরস্পরবিরোধী।

পরের কয়েকটা পোস্টে আমি আমার কমফর্ট আইটেমের একটা তালিকা দেব। পরোপকার নয়, আমার উদ্দেশ্য অবান্তরের পাতা ভরানো। তালিকা পড়ে যদি আপনাদের কারও আরাম হয় তা হবে ষোলোর ওপর আঠেরো আনা। আজকের পোস্টে জীবনধারণের সবথেকে জরুরি জিনিসটার কথাই রইল, অর্থাৎ কমফর্ট ফুড।

*****

ভাবতে বসে একাধিক খাবারের নাম মনে পড়ছে যা খেয়ে বারবার মনে হয়েছে এমন আরাম আর কিছুতেই নেই। যেমন রাজ্যের ঘাসপাতা। আজকাল খেতেও লাগে না, বাজারের ঝুড়িতে শুয়ে থাকতে দেখলেই আরাম হয়। বটলগ্রিন ব্রকোলি, বেগুনি বাঁধাকপি, টুকটুকে গাজর, রামধনু পেপারস, কচি কলাপাতা লেটুসেরা ডাকাতের দোকান আলো করে থাকে, নতুন যৌবনের দূতেরা মাথায় তুলে নিয়ে যায়। আমার চোখ টানে শরীরময় দাগড়া দাগড়া ব্রণ নিয়ে পড়ে থাকা করলার দল, গলায় দড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা বেতোঘেতো, শুষনিমুশনি, হিঞ্চেমিঞ্চে। জানি, ওই দিয়ে একথালা উঠে যাবে। আর যদি মনে করে কাসুন্দির শিশিখানা ফ্রিজ থেকে বার করার কথা মনে থাকে… নেক্সট ছ’মাসের জন্য পৃথিবীর আরামদায়কতম খাবারের সিংহাসনের ধারেকাছে কেউ এগোতে পারবে না। রুজুতা দিওয়ারকরের ভিডিও দেখে সাহস করে একদিন গরমভাতে এক চামচ ঘি - প্রায় গন্ধরাজ ফুলের মতো সুন্দর। যে শনিবার খিচুড়ির চালডাল না শক্ত না গলা, জল মাপমতো, অর্ধেক কাটা বড় আলুর টুকরো যথোপযুক্ত নরম, নাকতলার মায়ের শান্তিনিকেতন থেকে পাঠানো আচার থেকে সর্ষের তেল থালার টাল বেয়ে ধাবমান, বলাবলি করি, এই ফেলে আর কিছু কেন কেউ কেন খেতে যাবে গো? যারা যাবে তারা কারা?

(আমরাই যাব, খিচুড়ি ফেলে এককাঁড়ি টাকা জাম্বালায়া আর রিসোতোর পেছনে গচ্চা দেব, কিন্তু নিজেদের বোকা ভেবে মজা নেই।)

তবু এগুলো সাময়িক মনে হওয়া। খিচুড়ির কম ভালো, ভালো বা অতি ভালো যেদিন যেমনই হোক না কেন, খাওয়া শেষ হলে প্রেশার কুকার মাজা প্রতিদিন সমান কান্না-পাওয়ানো। হাড়ে হাড়ে মনে করানো, এই যন্ত্রণার কি আদৌ কোনও দরকার ছিল?

ছিল না। এর থেকে ঢের বুদ্ধিমানের হত সসপ্যানে জল ফুটিয়ে, হলুদ প্যাকেট ছিঁড়ে ফেলে, রহস্যময় টেস্টমেকার ঘটাঘট ঘুলিয়ে, দু’খানা বাটিতে ঢেলে, চামচ দিয়ে গিলে খেল খতম করা। স্বাদ চমৎকার, তৃপ্তি টইটম্বুর, কার্ব কোমা এক ও অবিকল। অমিল শুধু রাঁধাবাড়া ও সাফসাফাই সব মিলিয়ে দশ মিনিটে রান্নাঘর থেকে প্রাণ নিয়ে পালানোর সুযোগ।

ম্যাগি যদি মিরাকিউলাস বড়ি হত, আমি তিনবেলা, সাত দিন, বারো মাস, গোটা জীবন ম্যাগি খেয়ে কাটাতাম। করোনা অর নো করোনা।



Comments

  1. ...ডাকাতের দোকান আলো করে থাকে... পড়লাম। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেল। গিন্নি কে শোনালাম। তারও পেট ব্যথা হয়ে গেল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর বলবেন না। ডাকাত ছাড়া এদের আর কিছু বলা মানে বাংলাভাষার অপমান। সবাই সুস্থ আছেন আশা করি?

      Delete
  2. সত্যি তো খিচুড়ি কেন, শুধু ডাল ভাতও পরম উপাদেয় | একটা বাটিতে বেশি করে পাতলা মুসুর ডাল নেবে আর অল্প কটা ভাত আর চামচ দিয়ে খাও| শেষ হয়ে গেলে আরো ডাল আর অল্প ভাত অ্যাড করো |
    আমার ছেলে মেয়ে সব কলেজ থেকে বাড়ি চলে এসেছে আর অনলাইন ক্লাস করছে, সেই সাথে আমার মেয়ের দিকে দুই বেড়াল নাতিও এসেছে আর আমরা তাদের নিয়ে খুব আল্হাদিত আছি | করোনার স্ট্রেস থেকে বাড়িভর্তি সদস্যদের জন্য অনেক রিলিফ পাচ্ছি |

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা একেবারে টেলিপ্যাথির ঠাকুরদাদা হয়েছে, অমিতা। কাল রাতে আমি এই বাটিতে করে ভাত ডালই খেলাম। খালি ডালটা সেদ্ধ ছিল, জল বেশি দিয়েছিলাম, কাজেই জল জল সেদ্ধ। পাঁচ ফোঁটা সর্ষের তেল বাটির ওপর ঢেলে নিলাম, কাঁচা লংকা কুচি করে ছড়িয়ে নিলাম। চামচ দিয়ে খেলাম। স্বর্গসুখ।

      থালায় খাওয়ার জিনিস বাটি চামচ দিয়ে খেলেও একটা বেশ অন্যরকম আরাম হয় কিন্তু, তাই না? মনে হয় নতুন কিছু খাচ্ছি।

      বাড়ির লোকের সঙ্গে থাকার সুযোগ পাওয়াটা করোনার একটা প্লাস পয়েন্ট (যদি সুসম্পর্ক থাকে)। বিল্লি ফাউ পাওয়াটা চমৎকার। খুব হিংসে করলাম।

      Delete
  3. Jaah tomar bhalo lagchena office baad diye bari thakte :-( Khub dukku pelam shune, ki je holo, shob thik ache to?

    ReplyDelete
    Replies
    1. একটুও ভালো লাগছে না। ঠুঁটো জগন্নাথ ফিলিং হচ্ছে। শরীর এখনও বেগড়বাঁই করেনি, এইটাই একমাত্র রুপোলি রেখা।

      Delete
  4. "ডাকাতের দোকান আলো করে থাকে".. epic!

    ReplyDelete
  5. "ডাকাতের দোকান আলো করে থাকে".. epic!

    ReplyDelete

Post a Comment