করোনা জেনারেশন



কত কমে সংসার চালানো যায় টের পেয়ে আমি চমৎকৃত। কত কম খেয়ে পেট ভরানো যায় সেটা আবিষ্কার করেও। যে পাঁচ কেজি কমানোর জন্য উতলা ছিলাম গত এক বছর, করোনা দেড়মাসে তার তিন কেজি ঝরিয়ে দিয়েছে। এর পেছনে, বলা বাহুল্য, এক্সারসাইজের তিলমাত্র অবদান নেই। সেদিন হিসেব করলাম, দিনে আট থেকে ন’ঘণ্টা ঘুমোচ্ছি। যেটুকু যা নড়াচড়া - চান আর খাওয়া আর কাপড় মেলায় এসে ঠেকেছে। ওজন কমেছে স্রেফ খাওয়া কমে যাওয়ায়। আগে লাঞ্চ থেকে ডিনার পর্যন্ত অন্তত তিন বার কিছুমিছুর সন্ধানে বেরোতাম, এখন ডিনারও খেতে হয় বলে খাই। সম্পূর্ণ বাড়ির খাওয়ায় শিফট করে যাওয়াটাও সম্ভবত কাজে দিয়েছে। দু’দিন জোম্যাটো থেকে ব্রেকফাস্টে ইডলি বড়া আনিয়েছিলাম, তারপর খবর পেলাম ডেলিভারি পার্সনের পজিটিভ বার হওয়ায় বাহাত্তরটি পরিবারকে কোয়ারান্টাইন করা হয়েছে। নমস্কার করে ও রাস্তা ত্যাগ দিয়েছি। পয়সা বাঁচানোর জন্য চানাচুর কেনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। চার সপ্তাহ কাটার পর বুঝে পাচ্ছি না, চানাচুর থাকলে খেতাম কখন। খিদেই তো নেই। এদিকে ইউটিউবে কোয়ারেনটাইন স্ন্যাক্সের ভিডিওতে ছয়লাপ। যা বুঝলাম, সুজি আর দই যদি বাড়িতে থাকে, আপনি কম সে কম আড়াই লাখ স্ন্যাক্সের পেটেন্ট নিতে পারেন। জল কম, জল বেশি; নুন আছে চিনি নেই, চিনি আছে নুন নেই; পেঁয়াজরসুন রগরগে, জৈন স্টাইল; সেদ্ধ, ভাজা, এয়ার ফ্রায়েড; গোল, চ্যাপ্টা, ট্র্যাপিজয়েড আরও যত যা হওয়া সম্ভব।

প্রথমে ভাবছিলাম কারা বাড়িতে বসে রকম রকম খাওয়ার উৎসাহ পাচ্ছে। তারপর মনে পড়ল সবার অবস্থা আমার মতো নয়; যে যার প্রিয়জনদের নিয়ে চারদেওয়ালের মধ্যে সুরক্ষিত আছে। আমি বসে বসে টেনশনে নখ কামড়াচ্ছি। কবে দেশ খুলবে, কবে অর্চিষ্মান বাড়ি আসবে। চল্লিশ বছর যে নরম্যাল বলে জেনে এলাম, এখন নতুন নরম্যালে অভ্যস্ত হতে হলেই গেছি। বলছে নাকি মাস্ক পরে চলাটাই নরম্যাল হবে। তাহলে আমাকে সুতির গামছার খোঁজ দেখতে হবে। এই মাস্ক আধঘণ্টার বেশি পরে থাকলে করোনা থেকে বাঁচলেও ঘামতে ঘামতে মরে যেতে পারি যে কোনও মুহূর্তে।

তবে শুধু দুশ্চিন্তার দোষ নয়। পরিশ্রমও তো নেই যে খিদে পাবে। অফিস, হাঁটাচলা, খাওয়াদাওয়া, কথাবার্তা ইত্যাদি ক্রমাগত স্টিমুলেশন থাকলে খিদেতেষ্টা বেশি পায়। এই ঝিমন্ত সময়ে খিদে কম পাচ্ছে। এমনকি চায়ের সঙ্গে টা-টাও আর লাগছে না।

কম খাওয়া। কম খরচ। কম জঞ্জাল। আলু, পেঁয়াজ, শিম, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়স, ঝিঙে, কুঁদরি - কোনওটাই, ভগবানের দয়ায়, এখনও পর্যন্ত প্লাস্টিকে মুড়ে আসে না। চাল ডাল অবশ্য প্লাস্টিক-মোড়া হয়ে আসে, কিন্তু সে প্লাস্টিকগুলোর যথাসম্ভব পুনর্ব্যবহার করার চেষ্টা করছি। বড় সাইজের পলিথিনে আগেও ময়লা ফেলতাম। ইদানীং পাউরুটির প্যাকেট, ডালের প্যাকেটকেও ছাড় দিচ্ছি না। ওই সব খুচরোখাচরা প্লাস্টিকে কম জঞ্জাল ধরায় তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বিদেয় করা যায়, কাজেই স্বাস্থ্যকর। পয়সা দিয়ে কেনা গারবেজ ব্যাগ বেঁচে যাওয়াটা উপরি অ্যাডভান্টেজ।

করোনা এসে আবশ্যিক আর অতিরিক্তর সংজ্ঞাটা আরেকবার ঝালিয়ে দিয়ে গেছে। মনে করিয়েছে - যা দিয়ে কাজ চলে যায় তা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের। এই চালিয়ে দেওয়ার যুক্তিটা জীবনের অন্যান্য জায়গাতেও খাটে। কয়েকটা সম্পর্কে আমি অলরেডি সচেতন। আমি জানি কত কম "খবরে" জীবন চলে যায়। কত কম "যোগাযোগে" জীবন চলে যায়। কত কম "নেটওয়ার্কিং"-এ জীবন চলে যায়।

এখন আমি দুটো জামা পরি। দিনে একটা, রাতে একটা। আমি দাবি করছি না যে আমি এই পরার প্যাটার্ন এমনি সময়েও অনুসরণ করতে পারব, কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে যে এমনি সময়েও আমার পরিধানে এমন কিছু বৈচিত্র্য থাকে না। সোম মঙ্গল একটা জামা পরি, বুধ বৃহস্পতি আরেকটা, শুক্রবারের জামাটা উইকেন্ডের বেড়ানোতে টেনে দিই। এদিকে গুনলে আলমারিতে আমার জামার সংখ্যা তিরিশের কাছাকাছি বেরোবে। সত্যিটা আমার আগেও নাপসন্দ ছিল, এখন আরও চোখে লাগছে। আলমারির প্রায় দ্রৌপদীর হাঁড়ির দশা। বিদায় করা মাত্র দেখি আরও দশটা জামা জোগাড় হয়েছে।

বুককেসটাও বিবেকে খোঁচা দিচ্ছে। ওর পাঁচ শতাংশ বই আমি এখনও পড়িনি, পড়ার আশি শতাংশ দ্বিতীয়বার পড়ব না। ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ক্রমাগত আত্মানুসন্ধান চালিয়েছি। বইয়ের মালিকানার পরিমাণ নিয়ে তিলমাত্র গর্ব বা সুখ বা তৃপ্তি কোথাও কোনও কোণাঘুঁজিতে এখনও রয়ে গেছে কি না। নেই। লকডাউন উঠলেই হয় লাইব্রেরি নয় পুরোনো বইয়ের দোকানে (যেটা কম পরিশ্রমে হবে) লট কে লট বিদেয় করব। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচতলা বুককেসটাও। মা একবার এসে একটা তিনতলা কাঠের বুককেস বানিয়ে দিয়ে গেছিলেন, শুধু সেটা থাকবে, আর সেটাতে যতগুলো বই ধরে ততগুলো থাকবে। ব্যস।

শুনেছি, বড় কোনও একটা বিপদ/ঘটনার মধ্যে দিয়ে মানুষের লোকের জীবনদর্শন, জীবনযাপন চিরদিনের মতো বদলে যায়। বলা যায় না আমিও হয়তো একদিন করোনা-ঠাকুমায় পরিণত হব, যে আমৃত্যু ঘণ্টায় ঘণ্টায় হাত ধোবে, সামাজিক ভদ্রতাপূর্ণ করমর্দন বা আলিঙ্গনের উপক্রম দেখলে লাফ দিয়ে দু’মিটার দূরে পালাবে, আর নতুন যুগের লোকজনকে খাবার ফেলেছড়িয়ে নষ্ট করতে দেখলেই ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলবে, কষ্ট করেছিলাম বটে আমরা ওই ক’টা মাস। জানতাম, অনেক লোক খেতে পাচ্ছে না। আমরা কতদিন পাব তারও ঠিকঠিকানা ছিল না।

করোনাকে গল্পকথা বানিয়ে দাও ঠাকুর, আর কিছু চাইব না কোনওদিন।



Comments

  1. করোনা এসে আবশ্যিক আর অতিরিক্তর সংজ্ঞাটা আরেকবার ঝালিয়ে দিয়ে গেছে। <3

    ReplyDelete
    Replies
    1. কতদিন মনে থাকে সেটাই এখন দেখার, অন্বেষা।

      Delete
  2. জীবন আগের ছন্দে ফিরবে না। কিন্তু নতুন ছন্দে নিশ্চই ফিরবে। বড্ড বেশী চেয়ে, এই ছোট্ট সবজেটে নীল গ্রহটার ওপরে বড় বেশী অত্যাচার করে ফেলেছি। কিছুদিন নাহয় দেখলামই কত কমে কত স্বচ্ছন্দে থাকা যায়। তবে হ্যাঁ, বাড়িতে বসে কাজ করতে হচ্ছে বলে কাজের সময় বেড়ে ১৩-১৪ ঘন্টা হয়ে গেছে।।সকালের দৌড় ঝাঁপ শারীরিক কসরত বাদ, কেননা লাল তারকা খচিত অঞ্চলে বসবাস আমার। তবুও অল্প স্বল্প সময় যে টুকু পেলাম, তাতে প্রচুর বই পড়লাম, টিনটিন থেকে শরদিন্দু। হ্যাঁ এই বই গুলো আমার অত্যাবশ্যকিয় বটেই। পাহাড়ে ওঠার সময়েও মার্টা হার্নেকারের দাঁতভাঙ্গা চটি বই নিয়ে গেছিলাম যাতে আস্তে আস্তে অনেক দিন ধরে পড়া যায়। ও ভালো কথা, রবিবার করে অল্প স্বল্প টাইপ করার সময় পাওয়া গেল, তাই সতোপন্তের ভ্রমনবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করে ফেলেছি। ইচ্ছে হলে চোখ রাখতে পারেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেকেই বাড়িতে বসে কাজের জয়গান গাইছেন, আমি তাঁদের দলে একদমই নই। সতোপন্তের বৃত্তান্ত পড়লাম, খুবই ভালো লাগল, সোমনাথ।

      Delete
  3. Replies
    1. অন্টারিওতে, চুপকথা।

      Delete
    2. Tahole to ekhono onek din. Sabdhane theko ar beshi kore jol, ar vitamin C ar vitamin D kheyo

      Delete
    3. ওহ, এগুলো কাজ দেয় বুঝি? থ্যাংক ইউ, চুপকথা।

      Delete
  4. Corona jaak, Archishman firuk taratari ei asha korchi - satyi eka ei somoyta paar kora khub kothin.
    কম খাওয়া। কম খরচ। কম জঞ্জাল। - ei paragraph ta khub bhalo laglo - Coronar silver lining - sustainability. Tips gulo mone rakhbo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে মনে রাখার মতো কিছু নয়, কাকলি। এ কথাগুলো আমরা সকলেই জানি। তবে জঞ্জাল উৎপাদনটা সিরিয়াসলি কম করা দরকার বলে আমার ইদানীং মনে হচ্ছে।

      বাড়ির সবাই সুস্থ আছেন আশা করি।

      Delete

Post a Comment