বাৎসরিক
শিল্পসাহিত্য ক্ষেত্রে পুরস্কার আদানপ্রদান প্রসঙ্গে মার্ক টোয়েন বলে গেছেন -- পুরস্কার গ্রহণ করলে যত না নাম করা যায়, তার থেকে ঢের বেশি হুলাবিলা সৃষ্টি করা যায় সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলে। সেই থেকে আমার মনে মনে ভয়ানক ইচ্ছে, যদি কোনওদিন সাহিত্যপ্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে কেউ কোনও একটা পুরস্কার ফস করে দিয়েই বসে, পত্রপাঠ তা প্রত্যাখ্যান করার। নিজেকে পুরস্কারের অযোগ্য মনে করে নয়, রাগ দেখিয়ে নয়, স্রেফ বেশি লোকের চোখে পড়ার জন্য।
প্রথমত, কেউ পুরস্কার দিচ্ছে না; দ্বিতীয়ত, দিলেও আমি সুড়সুড়িয়ে নিয়েই নেব। কারণ লোকের চোখে পড়ার থেকে পুরস্কার জেতা বেটার। বদখত শাড়ি দেখিয়ে মতামত চাইলে মা বলতেন, বাঃ, দারুণ আই ক্যাচিং তো শাড়িখানা। আই, ইয়ার, নোজ -- যে কোনওরকম ইন্দ্রিয় ক্যাচ করার বিভীষিকা মায়ের থেকে আমার মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে। জীবনে একবারই জুতো কিনে বাড়ি এনে বদলাতে গিয়েছিলাম। সম্ভবত দোকানির মনোযোগ ক্যাচ করা অ্যাভয়েড করতেই, দোকানে জুতো কেনার সময় যথেষ্ট হেঁটে দৌড়ে পরখ করিনি, এক দু'পা ফেলেই “থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ” বলে জুতো বগলে বাড়ি এসেছিলাম। পরদিন নতুন জুতো পরে অটোতে চড়ে অফিস গেছি; তারপর অফিসে হাঁটতে গিয়ে সে জুতোর দাপট দেখে কে। প্রিন্ট আউট নিতে যাচ্ছি, খটাস খটাস দামামা বাজিয়ে জুতো চলেছে। জল খেতে উঠেছি, আওয়াজের চোটে লোকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। ওই তাকানোর আতংকে সেদিন আমাকে ঘাড় গুঁজে ডেস্কে বসে থাকতে হয়েছিল; ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফাঁকি মারতে জল খেতে ওঠা মাটি।
অফিস থেকে সোজা দোকানে গিয়ে জুতো বদলে বাড়ি এসেছিলাম।
জামা জুতো সাজপোশাক -- সব বিষয়েই আমার আই ক্যাচিং ফোবিয়া সম্পর্কে আমি নিঃসংশয় হয়েছি। অনেক সময় প্রায় আমারই মতো প্রোগ্রেসিভ, বুদ্ধিমান, ফেমিনিস্ট, ওক লোক দেখেও কেমন কেমন ঠেকলে আবিষ্কার করেছি, সেসব লোকের পার্সোনালিটি আই ক্যাচিং। সব ভালো হওয়া সত্ত্বেও, গড় করে দূরে থেকেছি।
প্রশ্নটা যদিও খটখটে কটকটের নয়, প্রশ্নটা ভিড়ে মিশে থাকার। যেখানে সকলেই কটকটে, সেখানে বরং মিনমিন করলেই বেশি আই ক্যাচ করার সম্ভাবনা। যে ক্লাসে সকলেই প্রশ্ন করে, সে ক্লাসে মুখে বড়া দিয়ে বসে থাকার বিপদ ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন।
এই যুক্তি দেখিয়েই মা বিয়ের সময় চুলে কলপ করাতে কনভিন্স করেছিলেন। বলেছিলেন পুরুতমশাইয়ের ভাত মেরেই নিজেকে যথেষ্ট প্রগতিশীল নববধূ প্রমাণ করেছ, পাকাচুলো কনের শিরোপা না কুড়োলেও চলবে।
সইসাবুদ হয়ে যাওয়ার পর কারা যেন ঝোলা থেকে গেরিলা আক্রমণের মতো একজোড়া রজনীগন্ধার মালা আর সিঁদুরের বাক্স বার করেছিল। ভাবখানা এমন, পালাবে কোথায় বাছাধন। আঁতকে “না না” বলে উঠেছিলাম । তারপর মায়ের চোখে চোখ পড়েছিল। মা চোখ অল্প বড় করে, স্লাইট মাথা নাড়ছিলেন। যে মাথা নাড়া যে আমাকে ওই মুহূর্তের আগেও কোটিবার ফাঁদে পড়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বুঝেছিলাম, আমার ওইমুহূর্তের ওইরকম হাল্লারাজার মতো বেনারসি-পরা, কষে পাউডার-মাখা মূর্তি, সিঁদুরসংস্কৃতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার অনুকূল নয়। গ্রেসফুলি হার মেনে নেওয়াটাই রাস্তা। অর্চিষ্মানও সে কথা বুঝেছিল; আমার ব্যথায় সমব্যথী হয়ে এক চিমটে সিঁদুর কেমন যেন একটা কায়দা করে মাথার এক মিলিমিটার ওপর থেকে ছিটিয়ে দিয়েছিল। কয়েকগুঁড়ো নাম কা ওয়াস্তে মাথায় পড়েছিল; অধিকাংশটাই বোসবাড়ির মেঝেতে গড়াগড়ি।
অর্চিষ্মানও ঠেকে শিখেছে। মামাতো দিদির বিয়েতে মামামামী কাঁথা স্টিচের সিল্কের চুড়িদারপাজামা এনে ভাগ্নের পায়ে ধরতে বাকি রেখেছিলেন। বাড়ির সবাই বলেছিল ওরে একদিনের জন্য সাজলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। অর্চিষ্মান শোনেনি। পাগল? তারপর লোকে তাকাক আর কী। শুধু তো এক সন্ধের ব্যাপার নয়, ওই পাঞ্জাবীর প্রমাণ তারপর অ্যালবামে, ভিডিওয় বছরের পর বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জ্বলজ্বল করবে। পরিণতি? বিয়েবাড়িশুদ্ধু সিল্কের পাঞ্জাবী আর কাঞ্জিভরমের ভিড়, ফ্যাবইন্ডিয়ার পাঁচবার কাচা হওয়া রং চটা ফতুয়া আর সোল প্রায় খুলে আসা বাটার চপ্পল পরা ছেলেটার দিকে ঘন ঘন ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল।<
যেখানে ভিড়, আই ক্যাচ না করতে চাইলে, সেখানে ভিড়ের মতো থাকাই ভালো।
এই যুক্তি মেনেই আসন্ন বাৎসরিক নিয়ে আমি কিছু বলছি না। এই মুহূর্তে শব্দটা আমার কাছে বাংলা অভিধানের দুর্বোধ্যতম শব্দ হওয়া সত্ত্বেও। কার বাৎসরিক? কী জন্য বাৎসরিক? কেনই বা বাৎসরিক -- ইত্যাদি উত্তরহীন প্রশ্ন ব্রেনে গাদাগাদি করা সত্ত্বেও।
একমাত্র সন্তানের উচ্চপদাধিকারের মুখ চেয়ে লোকে বারংবার আমার মত জানতে চেয়েছে। গোড়াতেই একটা ব্যাপার বুঝে গিয়েছিলাম, বাৎসরিক যে হবে সেটা নিয়ে কারও মনে কোনও প্রশ্ন নেই; কেমন করে হবে, কোন স্কেলে হবে, সেই নিয়েই যেটুকু যা আলোচনা। আমি আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি। আমি মতামত দিয়েছি। তাছাড়া আমি সত্যিসত্যিই মনে করি, এই বিষয়ে বাবার অধিকার আমার থেকে অনেক বেশি আর বাবা শ্রাদ্ধশান্তি বাৎসরিকের পক্ষে। আমার এখানে কিছু বলার থাকতে পারে না।
তাছাড়া এই বাৎসরিকের বিরুদ্ধে গলা ফাটাতে গেলে ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যাবে। প্রিয়জনেরা আঘাত পাবেন; আমারও কিছু আরাম হবে না। তার থেকে ঢের সোজা হবে দিনটাকে অগ্রাহ্য করে দিনটার মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যাওয়া। যেমন গত বারোমাস গেছি। যেমন সামনের গোটা জীবন যাব।
কাজেই আমি বাৎসরিকে বাড়ি যাব। মিষ্টির বাক্স, শাড়ি, মালা, তিল, তুলসী, চালকলা, মধু, অং বং চং, ধুনোর ধোঁয়ার ওপারে মায়ের মুখের দিকে তাকাতে যদি চোখ জ্বালা করে, নিজেকে মনে করাব, ওটা আমার মায়ের ছবি। ও ছবিতে মা নেই। মায়ের সঙ্গে আমার কালও দেখা হয়েছে। যেমন গত কুড়ি বছর ধরে পিসির সঙ্গে হচ্ছে, তিন বছর ধরে ঠাকুমার সঙ্গে হচ্ছে। এই দেখা হওয়াগুলোর সবথেকে ভালো ব্যাপার হচ্ছে, সব কিছু অবিকল আগের মতো। স্বাভাবিক। যেমন হওয়া উচিত তেমন। পিসির ডায়ালিসিস-লাঞ্ছিত হাড়জিরজিরে শরীর চিতায় পুড়েঝুড়ে শেষ, দিব্যি মোটাসোটা হাসিখুশি, টিউশানি করে ফিরে আমার সঙ্গে রসিকতা করছে। মাথায় ফুটো করে নল ঢুকিয়ে, নার্সিংহোমের বেডে শুইয়ে রাখা ঠাকুমা কোথায়? তিনি কুয়োর কিনারায় উঠে লগা দিয়ে কাঁঠাল খোঁচাচ্ছেন দেখ গিয়ে।
আমিও সেম টু সেম। লকডাউন খুললেই পরীক্ষা, কিচ্ছু পড়িনি। বাকি সবাই সব পড়ে ফেলেছে। ঘামছি। কাঁপা কাঁপা আঙুলের কর গুনছি। একবার, দুবার, বারবার। বলা যায় না, গোনার গুণে দিন বাড়তেও পারে। ব্রেকডাউন হয় হয়, এমন সময় সেই গলার আওয়াজ। মায়ের গলা। দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু মা আছেন। ছাদে, কিংবা বারান্দায়। এই দেখলাম বাগানে আবার এই রান্নাঘরে। খুন্তি নাড়তে নাড়তে গান গাইছেন। দাদু বলতেন, “আমাগো বাড়িতে একখান রেডিও আসে। অধিবেশন সমাপ্ত হয় না, চব্বিশঘণ্টা চলে।” আঙুলের কাঁপুনি থেমে যাচ্ছে। ঘাম শুকিয়ে যাচ্ছে। ক্লাস থ্রিতে পড়তে পড়তেই সেই যে আবিষ্কার করেছিলাম — নোটখাতা ভুলে স্কুলে চলে গেলে, খুব জোর করে, সবকিছু ভুলে মায়ের মুখ মনে করলে সেদিন দিদিভাই নোটখাতা চেক করেন না — এ জীবনে সে নিয়মের ব্যত্যয় দেখলাম না।
বাৎসরিক আসছে, আসবে, চলে যাবে। আমার দিনে রাতে, জাগরণে ঘুমে, মা আসবেন। আমার জীবনের হাল শক্ত করে ধরে থাকবেন। দুঃস্বপ্নগুলোতে আঙুল বুলিয়ে আমার জীবন পরিপাটি করে রাখবেন। যেমন চিরদিন রেখেছিলেন।
আমাকেও সামনের বছর গরম কালে এই কর্মটি করতে হবে, এই বছর জীবনে প্রথম মুণ্ডিত মস্তক হলুম।
ReplyDeleteওহ :(
Deleteথ্যাংক ইউ, অনিন্দ্য। পরিবার নিয়ে সুস্থ আছেন আশা করি।
ReplyDeleteঅনবদ্য। মন ছুঁয়ে গেল। বড় মন কেমন করা শ্যাওলা ধরে ইঁটের দেওয়ালের মফঃস্বলি গলির মত লেখা। বড্ড আপন।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, সোমনাথ। আপনার কমেন্টটিও ভালো লাগল খুব।
Deleteএক বছর হয়ে গেল কুন্তলা? মনে হয় এই সেদিন পড়লাম তোমার মায়ের চলে যাবার কথা| বাৎসরিক শব্দটাই কেমন কুৎসিত মনে হয় না? মা আছেন আর থাকবেন তোমার সাথে - এই অং বং ফুল মিষ্টি করতে হবে করে যাও অন্যদের কথা চিন্তা করে |
ReplyDeleteহ্যাঁ, যেন দারুণ একটা কিছু ব্যাপার ঘটেছিল, বছর বছর তার উদযাপন করতে হবে। যত্তসব।
Deletesomoi jeno doure jai... priyojoner songe bichhed hoina asole tara amader sarbokhoner songi hoe thekei jan... sudhu chokher dekha tuku na pabar otripti thake... bhalo theko.. - Ichhadana
ReplyDeleteসেই, ইচ্ছাডানা।
Deleteএক বছর হয়ে গেল এর মধ্যেই?
ReplyDeleteসাড়ে দশ মাসের একটু বেশি হয়েছে, অন্বেষা।
Deleteউঃ ।
DeleteBhalo theko. Jeita bhalo laage koro
ReplyDeleteসেই, বং মম। তবে আমাদের যাওয়া ক্যানসেল হয়েছে। এখন গেলে ওখানে পৌঁছে ১৪ দিন কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে, এসে আবার চোদ্দ দিন এখানে। তার থেকেও ভয়ানক একটা সম্ভাবনা আছে; যে রেটে পজিটিভ বাড়ছে, যে কোনওদিন আবার লকডাউন ৫.০ শুরু হবে। তখন বাড়ির বাইরে কোথাও আটকে পড়লে আর দেখতে হবে না। কাজেই আপাতত আমার যাওয়া স্থগিত।
Deleteetukui asol. amio ebhabei mone rakhi.
ReplyDelete"ও ছবিতে মা নেই। মায়ের সঙ্গে আমার কালও দেখা হয়েছে। যেমন গত কুড়ি বছর ধরে পিসির সঙ্গে হচ্ছে, তিন বছর ধরে ঠাকুমার সঙ্গে হচ্ছে। এই দেখা হওয়াগুলোর সবথেকে ভালো ব্যাপার হচ্ছে, সব কিছু অবিকল আগের মতো। যেমন হওয়া উচিত তেমন। পিসির ডায়ালিসিস-লাঞ্ছিত হাড়জিরজিরে শরীর চিতায় পুড়েঝুড়ে শেষ, রয়ে গেছে দিব্যি মোটাসোটা হাসিখুশি, টিউশানি করে ফিরে আমার সঙ্গে রসিকতা করছে। মাথায় ফুটো করে নল ঢুকিয়ে দেওয়া নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে থাকা ঠাকুমা কোথায়? তিনি কুয়োর কিনারায় উঠে লগা দিয়ে কাঁঠাল খোঁচাচ্ছেন দেখ গিয়ে।"
এ ছাড়া উপায় নেই, চুপকথা।
Deleteএকদমই তাই হবে কুন্তলাদি , তোমার জীবন পরিপাটি করে রাখবেন , তোমার সাথে থেকে। বাৎরিক আবার কি!
ReplyDeleteআরে নিয়মকানুনের আর শেষ নেই, প্রদীপ্ত।
Delete❤
ReplyDelete