বুলবুল
উৎস গুগল ইমেজেস
গল্পচুরির একটা রসালো স্ক্যান্ডালের খবর পেয়ে আমরা নেটফ্লিক্সে বুলবুল দেখতে উৎসাহিত হয়েছিলাম। যিনি গল্প চুরির রব তুলেছিলেন তাঁর গল্পটা আমি পড়িনি কাজেই দাবি ন্যায্য কি না বলতে পারব না, কিন্তু বুলবুলের বিরুদ্ধে প্লট চুরির অভিযোগ তোলার হক যদি কারও থেকে থাকে তবে সেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
গাছে চড়া, দস্যি, প্রায় মাটির সঙ্গে কথা বলা একটি বালিকার বিয়ে হয় বয়সে অন্তত পাঁচগুণ বড় রাহুল বোসের সঙ্গে। রাহুল বোস চাকরবাকর নিয়ে থামওয়ালা অট্টালিকায় থাকেন, সঙ্গে থাকেন অবিকল তাঁরই মতো দেখতে মানসিক অসুস্থ ভাই মহেন্দ্র আর মহেন্দ্ররূপী রাহুল বোসের স্ত্রী পাওলি দাম, তাঁর নাম আবার বিনোদিনী। আর থাকে এই দুই ভাইয়ের থেকে বয়সে অনেক ছোট ভাই সত্য। নষ্টনীড় পড়া থাকলে বা চারুলতা (২০১১-র গায়ে কাঁটা দেওয়া ভার্শান নয়, ১৯৬৪-র) দেখে থাকলে স্পয়লার দেওয়ার কিছু নেই, আপনি অলরেডি জানেন যে বুলবুল স্বামীকে যত না ভালোবাসে তার থেকে ঢের বেশি চায় দেওর সত্যকে, যে কি না বুলবুলের বয়সোচিত এবং বেড়ে ওঠার সঙ্গী। হিংসুটে জা পাওলি বুলবুল আর সত্যর সম্পর্ক নিয়ে ফুট কেটে গান করেন এবং ভাশুরের কান ভাঙান। বড়ঠাকুর রাহুল বোস রেগেমেগে ভাইকে লন্ডন পাঠিয়ে দেন। দেওর যাওয়ার আগে বৌদিকে বাঁধাই লালখাতা দিয়ে যান, ফ্রিলহাতা ব্লাউজ পরা বুলবুল পালংকে শুয়ে সে খাতায় মনের কথা লেখেন।
সিনেমা শুরু হয় লন্ডন থেকে সত্য, ছোটঠাকুর ফেরার সময়। ঠাকুরবাড়িতে এরমধ্যে অনেক পালাবদল হয়েছে। মহেন্দ্র মারা গেছে। বড়ঠাকুর, বুলবুলের বর, গৃহত্যাগ করেছেন। কিন্তু সবথেকে রোমহর্ষক আপডেট হচ্ছে, ঘন বনের মধ্য দিয়ে কোচোয়ান গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে ছোটঠাকুরকে সাবধান করে, সন্নিহিত জঙ্গলে এক পেত্নির আবির্ভাব হয়েছে, যে অলরেডি বহু লোককে খুন করেছে। মহেন্দ্রর অপঘাতে মৃত্যুর পেছনেও সম্ভবত তারই হাত। লন্ডন-ফেরত সত্য, বলা বাহুল্য, এ সব কুসংস্কারে আমল দেয় না। বরং সে ঢের বেশি বিচলিত বোধ করে বাড়িতে ডক্টর সুদীপের (আমাদের পরমব্রত) আনাগোনা এবং বুলবুলের সঙ্গে সখ্য দেখে।
পেত্নি আছে কি নেই সেই নিয়ে নানারকম বিশ্বাসঅবিশ্বাস, প্রমাণঅপ্রমাণ, আরও খানকয়েক খুন, ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে আসলে কী ঘটেছিল এবং শেষে রোমহর্ষক অ্যাকশন সিকোয়েন্সের মধ্য দিয়ে দেড়ঘণ্টার বুলবুল শেষ হয়।
গল্প দেখতে বসার আগে আমার ধারণা ছিল বুলবুল ভূতের সিনেমা। আর পাঁচটা ভূতের সিনেমার মতো ধড়াম করে বিটকেল আওয়াজে চমকে ওঠা, পরিণামে নিজের গলা থেকে বেরোনো অশরীরী চিৎকারে নিজেই ভয় পেয়ে যাওয়া, পেছন থেকে কাঁধে হাত এসে পড়া ইত্যাদি জাম্প স্কেয়ার বুলবুলে নেই। এই না থাকাটা ভালো ব্যাপার হতে পারত, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এইসব চেনা ট্রোপ বাদ দিয়ে ভয় দেখানোর মতো প্রতিভা বুলবুলের নেই। বুলবুল ভূতের সিনেমা কি না সেটা আমি স্পয়েল করছি না, কিন্তু বুলবুল ভয়ের সিনেমা নয়। গা ছমছম পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ঘোর রক্তবর্ণ এক বিৎকুটে আলোর আমদানি করা হয়েছে, আর জঙ্গলময় গলগলে ধোঁয়া। আমার মতো কাপুরুষকেও এক সেকেন্ডের জন্যও চোখে হাত চাপা দিতে হয়নি, তবেই বুঝুন।
ভূতের বা ভয়ের হোক না হোক, বুলবুল নিঃসন্দেহে নারীবাদী সিনেমা। স্বামী ছাড়া এক নারীর নিজের আর কী থাকতে পারে, পুরুষকে বশে রাখাই নারীর মোক্ষ ইত্যাদি সংলাপে সংলাপে, প্লটের মোচড়ে মোচড়ে একটি ঘোর পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দিকে আঙুল তুলেছেন কর্তৃপক্ষ। অর্চিষ্মান যদিও বলছে, নারীবাদী মেসেজটা আরেকটু সাটলি দিলে ভালো করত, আমিও হুঁ হাঁ করলাম, তারপর মনে পড়ল গত পরশু নেটফ্লিক্সেই ২০২০তে মুক্তি পাওয়া আরেকটা ওয়েবসিনেমা দেখলাম, চমন বাহার না কী যেন নাম, যেখানে গোটা গল্পটার বেসিস হচ্ছে একপাল ছেলের একটি মেয়ের হাফপ্যান্টের দিকে তাকিয়ে থাকা। এটা কী বাদ আমি জানি না, যে বাদই হোক না কেন, এই বাদের যদি সাটল হওয়ার দায় না থাকে তাহলে নারীবাদেরই বা থাকবে কেন।
বুলবুল একটা চেনা হররের গল্প বলে, যা দেখে যে কোনও স্বাভাবিক মানুষের হাতপা পেটের ভেতর সেঁধোনো উচিত। সেদিক থেকে বুলবুল আমার মতে সফল। লাস্টে একটু গাঁজাখুরি হয়ে গেছে, তবে গাঁজাখুরি সাবজেক্টিভ একটি শব্দ; যা আমার গাঁজাখুরি লেগেছে তা আপনাদের না-ই লাগতে পারে।
ক্যামেরা, এডিটিং, আলোকসম্পাত ইত্যাদি নিয়ে তো আমার কিছু বলার থাকতে পারে না, আমি বরং হিরোহিরোইনদের নিয়ে দু'কথা লিখে শেষ করি। সিনেমার অথর-ব্যাকড রোল পেয়েছেন পরমব্রত। পরমব্রতর চেহারার একটা দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, তিনি যে চরিত্রেই অভিনয় করুন না কেন - তোপসে, খুনি সিনেমা পরিচালক, পুলিশ অফিসার, ড্রেডলকসম্বলিত মাফিয়া কিংবা এই সিনেমায় পরাধীন ভারতবর্ষের গ্রামের ডাক্তারবাবু - সর্বত্রই ওঁকে আলটিমেটলি যাদবপুর ইংলিশের মতো দেখতে লাগে। চেহারার ডিসঅ্যাডভান্টেজটা চাপা দিতে ভ্রূভঙ্গি, চোয়াল চোমরানো, কথা বলার ভঙ্গি, উচ্চারণ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো বদলে দেখা যেতে পারে। এ সব যদি না হয় তাহলে একমাত্র রাস্তা ভিঞ্চিদার লেভেলের মেকআপ আর্টিস্টের হাতে পড়া। যতদিন সেটা না হচ্ছে...
অর্চিষ্মানের ভালো লেগেছে পাওলি দামকে। আমি একমত। স্ট্রাইকিং যাকে বলে, গোটা ছবিতে পাওলিকে তেমনই লেগেছে। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল বুলবুলের চরিত্রে পাওলি দামকে নিলে কেমন হত। তারপর মনে হল, বুলবুলের আর্ক বোঝাতে হয়তো তৃপ্তি ডিমরি-র মতো নিষ্পাপ এবং কম-ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারারই দরকার ছিল।
সত্যর চরিত্রে অভিনয় করা অবিনাশ তিওয়ারিকে ২০১৮তে রিলিজ করা লায়লা মজনুতে দেখে আমি মারাত্মক, মারাত্মক ইমপ্রেসড হয়েছিলাম, এখানেও ভালো লেগেছে খুবই। হিমশীতল বড়ভাই এবং অসুস্থ মেজভাইয়ের চরিত্রে রাহুল বোসও দিব্যি। পরমব্রতর সমস্যাটা ওঁরও আছে, দেখলেই সন্দেহ হয় যায় নির্ঘাত রাগবি খেলেন, কিন্তু বেটার অভিনেতা বলেই হয়তো সেটা বেটার চাপা দিতে পারেন।
bhalo summary. ebar dekhte hobe movie ta.
ReplyDeleteদেখতে পার, চুপকথা।
DeleteBhalo legechhe. Amar obosso horror/suspense genre er beshir bhag movie i bhalo lage. Tobe cinemar shurur dike Bulbul er mannerism, kotha bolar style eke barei 1930s/40s er moto noi - ei anachronism ta amar bhishon baje legechhilo...
ReplyDeleteহ্যাঁ, খুঁত প্রচুর আছে, রণদীপ। তবে সব মিলিয়ে আমারও মন্দ লাগেনি।
Deleteprothom ek ghonta besh bhalo.. tobe sesh tay sob ghente gho hoye gelo.. hathat kore bulbul / bulbbul pray Tarzan style e lafiye lafiye e gach o gach korata adbhut laglo.. plus sei roktoborno alo..
ReplyDeleteহ্যাঁ, শেষের ওই গ্র্যাভিটি-ডিফাইং লাফালাফিটা আমারও চোখে লেগেছে। তবে সব মিলিয়ে দিব্যি।
DeleteRahul Bose ar Parambrata niye ekdom ekmot.
ReplyDeleteAnirban Bhattacharya namok cheletir obhinoy dekhben..recent time e eto versatile bangali obhineta dekhini.
অনির্বাণের নাটক আর সিনেমা দুইই দেখেছি, ঋতম। আমারও ভালো লাগে ওঁকে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, জি বাংলার দুপুরবেলার সিনেমায় উৎপল দত্তকে বা জটায়ুর ভূমিকায় রবি ঘোষকে দেখলে উপলব্ধি হয় যে অভিনেতা শেষপর্যন্ত পরিচালকের হাতের পুতুল। অনির্বাণের শেষ কয়েকটা সিনেমা এবং হইচইয়ের ব্যোমকেশ জাতীয় ওয়েবসিরিজ দেখলেও সেটা স্পষ্ট।
Delete"পরমব্রতর চেহারার একটা দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, তিনি যে চরিত্রেই অভিনয় করুন না কেন - তোপসে, খুনি সিনেমা পরিচালক, পুলিশ অফিসার, ড্রেডলকসম্বলিত মাফিয়া কিংবা এই সিনেমায় পরাধীন ভারতবর্ষের গ্রামের ডাক্তারবাবু - সর্বত্রই ওঁকে আলটিমেটলি যাদবপুর ইংলিশের মতো দেখতে লাগে।" :P
ReplyDelete:(
Deleteহ্যাঁ, খুবই স্পষ্টাস্পষ্টি অনুপ্রাণিত।
ReplyDeleteভাল বলেছেন
ReplyDelete👍🏽
Delete