সময়ের তাড়া



সাপ্তাহিক বর্তমান নিয়ে একসময় হাসতাম। বছর পনেরো আগে। বাজি ধরতাম এ সপ্তাহে মলাটে কীসের ছবি থাকবে, টমেটোর না গাজরের না কাঁচা হলুদের। মলাটের ভেতর থাকবে সেই ছবির জিনিসটার মানুষের জীবনধারণ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় অবদানসংক্রান্ত প্রতিবেদন। রোজ যদি একটা করে টমেটো খান, স্কিন ভালো হবে। কাঁচা হলুদে খুলবে রং। রোজ একচামচ করে কালোজিরে চিবোলে রক্ত জোরে দৌড়বে। গাজর ছ'মাস খেলে আর চশমা পরতে হবে না। রসুন কাঁচা চিবিয়ে খেলে ক্যান্সার স্পর্শ করবে না, করলেও কাঁচা পেঁপে খেলে ল্যাজ তুলে পালাবে।

সব একসঙ্গে খেলে অমরত্ব বাঁধা। আর অমর হতে অনেকেই চায়।

আসলে চায় না, কিন্তু যেহেতু তলিয়ে ভাবার অভ্যেস নেই সেহেতু বর চাওয়ার সময় ফস করে অমরত্ব চেয়ে বসে। বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি অমরত্ব চান? নিচে আমি অমরত্বের কয়েকটা অপশন দিচ্ছি, দেখুন দেখি কোনওটা আপনার মনে ধরছে কি না।

অমর হলেন কিন্তু বয়স বাড়া থামল না। বা থামল, একশো ছোঁয়ার পর। অন্তত সত্তর। কিংবা অমর হলেন কিন্তু বয়স পাঁচের পর আর বাড়ল না।

আপনি এগুলো চাইছেন না, রাইট? রাইট।

আসলে আপনি অমরত্ব চাইছেন না। আপনি চাইছেন চিরযৌবন।

(সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম থাকে। আমি একজনকে চিনি যে লাইফ সাপোর্টে থাকলেও অমরত্বের বর লাফিয়ে নেবে বলে দাবি করেছে।)

ঠাকুমা যখন বিছানায় শুয়ে ছিলেন জীবনের শেষ দশটা বছর, সেই শেষেরও শেষ দুটো বছর যদি তাঁকে কেউ প্রস্তাব দিতে যেত যে ঠাকুমা এক কোয়া রসুন খাবেন নাকি, যাতে আয়ুটা আরেকটু বাড়ে -- ঠাকুমা জাঁতি ছুঁড়ে মারতেন শিওর। মৃত্যু ছাড়া আর কোনও কামনা তাঁর ছিল না।

সরি, এইরকম বিষণ্ণ দৃশ্যের অবতারণা করার জন্য, আমি যেটা বলতে চাইছি যে লোকে বলে বটে অমর হতে চাই কিন্তু আসলে লোকে চায় চিরযৌবন।

আমি অমরত্ব চাই না। আমি চিরযৌবনও চাই না। তবু চল্লিশে পড়ে বুক কেঁপেছিল। যৌবন চলে গেল বলে নয়, যৌবন থেকেও আমার এমন কিছু কাজে লাগছিল না। আমি রাস্তায় নেমে পৃথিবী বদলানোর চেষ্টা করিনি, প্রেমে পাগল হয়ে সমাজসংসার ত্যাগ দিইনি, দাগা খেয়ে পাথর হইনি কিংবা প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে সোনা হয়ে মহৎ সাহিত্য রচনা করে ফেলিনি। গোটা যৌবন জুড়ে আমি হিসেবি প্রৌঢ়র রোলে প্রাণ দিয়ে অভিনয় করে গেছি। খানিকটা রাগের চোটেই আমি কবির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছি। 


ভয় লেগেছিল সময়ের স্পিড দেখে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে চল্লিশটা বছর চলে গেল, হাই তুলতে তুলতে সামনের চল্লিশ উবে যাবে। আমি অমরত্ব চাই না, চিরযৌবন চাই না, আমি শুধু চাই এই পাগলা বাঘের পিঠ থেকে নামতে। নেমে, ধীরে সুস্থে, পারিপার্শ্বিকের শোভা অবলোকন করতে করতে ডেডলাইনের দিকে হেঁটে যেতে চাই। আমি চাই সময়ের মুখে রাশ পরাতে।

কী করে তা করা যায় কেউ না জানুক, গুগল নিশ্চয় জানে । জিজ্ঞাসা করব ভাবছি, এমন সময় ফোন থেকে চোখ তুলে ট্যাক্সির জানালার বাইরে তাকালাম, আর উড়ালপুলের রেলিঙের পিলারগুলো অসভ্যের মতো চোখের ওপর খটাখট চিরুনি বুলিয়ে উল্টো দিকে ছুটে গেল। রেনম্যান সিনেমাতে একটা দৃশ্য ছিল যেখানে ডাস্টিন হফম্যানের এই অপস্রিয়মাণ রেলিং গোনার ক্ষমতায় টম ক্রুজ হতচকিত হয়ে গেছিলেন। গোনার চেষ্টা করিনি, কিন্তু ওই রেলিংগুলোর রোয়াব খর্ব করার জন্য ওদের স্পিড ঢিলে করে দিতে চাইলাম।

পারলামও, কারণ এ কাজ আমি আগেও করেছি।

জানালার পাশে বসে রেললাইনের মাঝের আড়াআড়ি পাটাতনগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকেছেন কখনও? আলগোছে তাকিয়ে থাকলে সাঁই সাঁই ছোটে, কিন্তু সবগুলোর প্রতি একসঙ্গে তাকিয়ে না থেকে, একেকটা পাটাতনের ওপর দৃষ্টি যদি নিবদ্ধ করেন, দৃষ্টিসীমান্তে ঢোকার মুহূর্ত থেকে বেরোনর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যদি চোখ না সরান, দেখবেন ব্যাটাদের ছোটার স্পিড বলার মতো কমে এসেছে। পরের পাটাতনটার সঙ্গেও একই ট্রিটমেন্ট। তার পরেরটার সঙ্গেও। এই করতে করতে দেখবেন সবাই আগের থেকে আস্তে ছুটছে অনেক।

সবই মনে হওয়া, বলা বাহুল্য, সত্যি সত্যি কি আর আস্তে ছুটছে?

আমার তাতে আপত্তি নেই। শেষমেশ সবই মনে হওয়া। ভাবলাম, আমার ব্যক্তিগত সময়ের গতি কমানো যায় কি এই একই কৌশলে? অর্থাৎ সময়ের দিকে খুব মন দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে? একেকটা ঘণ্টা, একেকটা মিনিটের দিকে? একটি সেকেন্ড থেকেও দৃষ্টি সরিয়ে না নিয়ে?

সময় তো রেলকোম্পানির স্ল্যাব নয়, কিংবা ফ্লাইওভারের রেলিং-এর লোহার ডাণ্ডাও, কাজেই কাজে না দিতে পারে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে থাকা যায়, আমার ধারণা তাতে সময়ের স্পিড বলার মতো হ্রাস পাবে, কিন্তু আখেরে লাভ কিছু হবে না।

তার থেকে ঢের সুবিধে হবে সেই সময়টায় যে কাজটা করছি সেটার প্রতি মনোযোগ দিলে। যে কাজটা করছি শুধু সেটাই করা, অর্থাৎ ইউনিটাস্কিং।

বারংবার ভুল করে, ঠেকে, শিখে, আবার ভুল করে, আবার ঠেকে, জীবনে যতবার আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি তত আর কোনও সিদ্ধান্তে আসিনি। যে মাল্টিটাস্কিং-এর থেকে অনুৎপাদনশীল আর কিছু হয় না। একসঙ্গে পাঁচশোটা কাজ করলে বড়জোর পাঁচশোটাই খারাপ করে হবে, মোস্ট প্রব্যাবলি কোনওটাই হবে না। আপনি এক্ষুনি দেড়শোজন কর্মবীরের উদাহরণ দিয়ে দিতে পারবেন জানি যারা একজীবনে দেড়শো রকম কাজ করেছেন। করে থাকতে পারেন, কিন্তু আমি বাজি ধরতে রাজি দেড়শোটা কাজ তাঁরা একইসঙ্গে করার চেষ্টা করেননি। একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটাই কাজ করেছেন। সময়টুকু ছ'মাস হতে পারে, একমাস, একসপ্তাহ কিংবা এক ঘণ্টা, কিন্তু সেই ঘণ্টায় তাঁদের সমস্ত মনোযোগ ওই কাজটুকুতেই নিবদ্ধ ছিল, পনেরোখানা খোলা ট্যাবে লাফালাফি করে বেড়াচ্ছিল না।

তিনটে গল্পের খসড়া একই সঙ্গে শুরু করেছি, তিনটে চ্যাটবাক্স একইসঙ্গে খুলে রেখেছি। একটা গল্পও এগোচ্ছে না, একটা কথোপকথনও কোথাও পৌঁছচ্ছে না। সময় কোথা দিয়ে কাটছে দেখতে পাচ্ছি না (কারণ সময়ের দিকে তাকাচ্ছি না আদৌ)। দিন ঢলতে না ঢলতে রাত হয়ে যাচ্ছে, রাত কাটতে না কাটতে দিন। যেটা হচ্ছে সেটা হচ্ছে খুব ব্যস্ত হয়ে আছি। মারাত্মক ব্যস্ত। ব্যতিব্যস্ত।

বোনাস কুইজ #১

"লোকটা ব্যস্ত--ইয়ে, ব্যতিব্যস্ত--ইয়ে, মানে, লোকটার তাড়া ছিল।"

লোকটার জামার রং আর মেটেরিয়াল আপনারা বলবেন।

সবসময় ছোটবেলার কান টানা নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ। ছোটবেলায় যা কাজ করেছিল, যে কারণে করেছিল, বুড়োবেলায় সেই জিনিস কাজ করবে কি না, সে সব নিয়ে বিস্তর সংশয়ের অবকাশ আছে। তবু এ কথাটা মনে পড়লে নিজের অবাক লাগে, একসময় পড়তে বসে গান পর্যন্ত শুনতাম না। পিনড্রপ সাইলেন্সে আমি, জীবনবিজ্ঞান বই আর এমারজেন্সি লাইট। এখন পিনড্রপ সাইলেন্সে আমি নিজের সঙ্গেও থাকতে পারব না, সুমনকে ডেকে এনে কানের ভেতর জলসা বসাতে হবে।

টিভি দেখলে চিপসের প্যাকেট নিয়ে বসতে হবে, চিপস খেতে গেলে টিভি, পড়তে গেলে চা, লিখতে গেলে গান।

সেদিন একজন বলছিল, অবিলম্বে আমাদের সবার মাথায় বন্দুক ধরিয়ে দেওয়ালের দিকে চুপ করে বসে থাকতে বাধ্য করা উচিত। সমস্ত রকম দেখা, শোনা, গেলা, বলা, বিশেষ করে বলা, বন্ধ করে। তবে যদি আমাদের ব্রেনগুলো ভাবতে বাধ্য হয় এবং জোম্বিদশা থেকে মুক্তি লাভ করে। ওই বন্দুকের জায়গাটা বাদে আমি মোটের ওপর একমত। তার নিদানটা ছিল ব্রেনকে সচল করানোর জন্য, আমার ধারণা এতে সময়কে দীর্ঘ করার কৌশলও মানুষের আয়ত্ত্ব হবে।

এইসব ভাবছি। এমন নয় যে মেনে চলছি। টিভি দেখতে দেখতে ক্যান্ডি ক্রাশ, ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে খেলতে টিভি এ সব যেমনকে তেমন চলছে। নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি যে এই লেভেলটা পার করেই ইউনিটাস্কিং-এ ঝাঁপাব।

ভাবতে ভাবতে কান সুড়সুড় করল।

সময়টা ছিল মাঝরাত। আমি আর অর্চিষ্মান যেমন বসে থাকি, খাটের মাঝখানে হাতখানেক তিমির পিঠের মতো উঁচু হয়ে ওঠা ম্যাট্রেসের দুদিকে বসে ছিলাম। খালিল জিব্রানের বই পড়িয়েছিল ফার্স্ট বয়ফ্রেন্ড, সেখানে লেখা ছিল আদর্শ সম্পর্কে থাকা দুটো মানুষ হবে দুটো স্তম্ভের মতো। পাশাপাশি থাকবে, মাঝে থাকবে সসম্ভ্রম দূরত্ব। তবেই অট্টালিকার ছাদ (অর্থাৎ সম্পর্ক) ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে পড়বে না। ওই জায়গাটা প্রেমিক বুকমার্ক করে দিয়েছিল। কেন, এখন বুঝি। আকবর বীরবলের গল্পে সেই ছিল না যে যার যা নেই, সেটার প্রতি তার ফ্যাসিনেশন/সম্ভ্রম/শ্রদ্ধা বেশি থাকে, সেই লজিক। আমাদের প্রেমটার চেহারায় দূরত্ববজায়ক স্তম্ভের তুলনায় একে অপরের বুকের ওপর বসে টুঁটি টিপে ধরার মিল ছিল। ইন ফ্যাক্ট ওই প্রেমটা করতে গিয়ে আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে টুঁটি টিপে ধরাটাই বোধহয় প্রেম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে বিশ্বাস ছাড়াতে হয়েছে।

যাই হোক, আমি আর অর্চিষ্মান বসে আছি, এমন সময় কান সুড়সুড় করল। চুলকোব বলে ইয়ারফোন খুললাম। ডানকানেরটা খুললেই হত, কারণ বাঁকানেরটা দিয়ে কিছু শোনা যাচ্ছিল না। নেহাত ডিসব্যালেন্সড লাগবে তাই দুটোই কানে গুঁজে বসেছিলাম। ঘোর সন্দেহ হচ্ছিল ওটা আমার ইয়ারফোন নয়। আমার ইয়ারফোনটা দিব্যি চলছিল আগেরদিন পর্যন্ত, বরং মাঝে একবার অর্চিষ্মানেরটা ভুল করে (আদিখ্যেতা করে দুজনের যমজ ইয়ারফোন কিনেছি আমিই, আলাদা করার জো নেই) কানে গুঁজে দেখেছিলাম বাঁ কানের সাউন্ড ঘ্যাঁসঘ্যাঁস। নির্ঘাত নিজেরটা পুরো খারাপ হওয়ার পর, আমি যখন অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম আমারটার সঙ্গে বদলাবদলি করে নিয়েছে। ওরটা এখন দু'কানে দিব্যি বাজছে। চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। তাতে আকাশ থেকে পড়ে বলল, আমার মতো সন্দেহবাতিক নাকি ও লাইফে দেখেনি। প্রমাণ করার উপায় নেই, গিলে নিলাম। এর পর থেকে দুজনের ইয়ারফোন ডিস্টিংক্টলি আলাদা দেখতে কিনব।

যাকগে। কান চুলকোব বলে সবেধন নীলমণি ডান কানের ইয়ারফোনটা টেনে নামিয়েছি, একটা সন্দেহজনক শব্দ কানে এল। ঝিরঝির। হাল্কা। একটানা। খাট থেকে নেমে পাশের অন্ধকার ঘর পার হতে হতে আওয়াজটা বাড়ল, বারান্দার দরজা খুলতেই হ্যালোজেন লাইটের ব্যাকড্রপে বৃষ্টির বেঁকা ছাঁট, সজনে পাতার দুলুনি, জামা শুকোনোর দড়ি বেয়ে দৌড়নো জলের বিন্দু জ্বলজ্বল করে উঠল। ফোন নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছিলাম, আঙুলে রেস্টলেস সিনড্রোম হচ্ছিল। আবার অতটা হেঁটে ফিরে যাব, তাই জোরসে বারান্দার গ্রিলটা আঙুল দিয়ে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। দৃষ্টিরাজ্য তো দখল অলরেডি হয়েছিলই, জলের মিহি শব্দ, ঠাণ্ডা হাওয়া, আর ভেজা কংক্রিটের গন্ধ কান, ত্বক আর নাকের দখল নিল। কিছুক্ষণ পরে ছায়া পড়াতে দেখি অর্চিষ্মানও এসে দাঁড়িয়েছে। ফোনটোন ছাড়াই। মারাত্মক আরাম লাগছিল। অবশেষে বৃষ্টি ধরল। অর্চিষ্মান বলল, যাই? আমি বললাম, চল।

বোনাস কুইজ #২

"তারপর তিনজনে কেবল তিনটে কথা বলে গাড়িতে উঠলাম -- ____ 'চলুন,' ____ 'আসুন' আর ____ 'ছঃ'।"

তিনজনের নাম তো বলবেনই। ঘটনা ঘটার মিনিটখানেক (ওই তিনজনের একজনের মতে পনেরো মিনিট, এক্স্যাক্টলি সময় ঢিলে করার ব্যাপারটা ঘটেছিল তাঁর সঙ্গে) আগে ঘটনাস্থলে আরও একজন ছিল। তার নামও বলবেন।

ভাবলাম প্রহর গড়িয়ে গেছে, ঘরে ফিরে দেখি আধঘণ্টা মোটে।

দ্বিতীয়দিন বিকেলবেলা দাঁড়িয়েছিলাম গেটের সামনে। উঁচু গ্রিল গেটের মাথায় অর্চিষ্মান কম্ফরটেবল কনুই, আমি চিবুক রেখে। উল্টোদিকে মেলা গ্রাউন্ডে মেলা বসেছে। কুঁড়ে কুকুরকে পরিশ্রমী মানুষ হাঁটাচ্ছে, কুঁড়ে মানুষকে ছোটাচ্ছে বর্ধমান ভুঁড়ি। ডবল মাস্ক পরে উইকেটের মাঝে প্রাণপণ দৌড়চ্ছে ব্যাট কাঁধে ছেলে, কোলে চড়া ডগি নেড়ির স্বাধীনতায় লোভ দিচ্ছে টেরিয়ে টেরিয়ে, নেড়ি হাই তুলে তুড়ি বাজাচ্ছে।

দার্শনিকে হয়তো বলতেন প্যান্ডেমিকেও জীবনের স্রোত হ্যানাত্যানা, কিন্তু আমরা ফিলজফিক্যাল মুডে ছিলাম না। সর্বদা যেটায় থাকি সেই মুডেই ছিলাম, ফাজলামির। লোক দেখছিলাম, কাউকে কাউকে দেখে হাসছিলাম। কেউই হাস্যকর নন, বলা বাহুল্য, আমরা নরকের কীট। অর্চিষ্মান যথারীতি মুচকি, বড় জোর, নিঃশব্দে শরীর কাঁপিয়ে হাসছিল। আমি যথারীতি কালবৈশাখীর পথে কচুপাতার মতো দুলে দুলে পাড়া কাঁপাচ্ছিলাম।

পেছন থেকে একটি গলা বলে উঠল, জোম্যাটো দেরি করছে বুঝি?

নিচের তলার সাংবাদিক ভাড়াটে। ছেলেটা ভালো। আমরা পছন্দ করি। মানে ছেলেটা ভালো বলে পছন্দ করি তো বটেই, কিন্তু বাড়তি কারণও কিছু আছে। ছেলেটার জীবনে মারাত্মক ইন্টারেস্টিং সমস্যা ঘটে নিয়মিত ফ্রিকোয়েন্সিতে। একদিন অসময়ে, এই ধরুন রাত দশটা, বেল শুনে অর্চিষ্মান দরজা খুলে দেখে ভয়ানক পার্টিসুলভ মাঞ্জা দিয়ে ছেলেটি দাঁড়িয়ে। খালি পা। বলল, জুতো হবে? পার্টিতে যাওয়ার আগে জামাটামা পরার পর নাকি ও আবিষ্কার করেছে যে বাড়িতে জুতো নেই।

কী ভাগ্যিস বাড়িতে উপযুক্ত জুতো ছিল, প্রোভাইড করা গিয়েছিল। যাই হোক, আমার হাসির দামামায় বিরক্ত হয়েই নির্ঘাত জানালা খুলে মুখ বাড়িয়ে ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল, জোম্যাটো লেট করছে নাকি। প্রথমটা থতমত খেয়েছিলাম তারপর বুঝলাম আমরা যেহেতু সর্বদা খাবার ডেলিভারি নিতেই গেটের সামনে এসে অপেক্ষা করি, ছেলেটা ভেবেছে আমরা খাবার নিতেই দাঁড়িয়ে আছি। এমনি এমনি যে সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং মেনে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি, কল্পনাতেই আসেনি।

তারপর ওর সঙ্গেও গল্প করলাম খানিক। ওপরে উঠতে উঠতে ভাবলাম না জানি কত ঘণ্টা ঘণ্টা কাবার করে এলাম। ও মা, মিনিটের কাঁটা গোটা একটা চক্কর কাবার করতে পারেনি।

দুটো ঢিলে সময়ের কমন ফ্যাক্টরটা আপনাদের চোখ এড়ায়নি নিশ্চয়। আমারও না।

বুড়ো হওয়া পিছোতে গেলে কাছাকাছি থাকা দরকার। বললাম আমি। কাল রাতে। ম্যাট্রেসের ঢিবির ওপারে বসে থাকা অর্চিষ্মানকে উদ্দেশ্য করে।

উত্তর নেই।

ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বললাম, শুনছ?

নিরুত্তর।

গলা চড়াতে হল। কী গো, কথা কানে যাচ্ছে? দৃষ্টিও ঘোরাতে হল।

কানে যাবে কী? আমার ভালো ইয়ারফোনখানা গাপ করে দুই কানে বেশ করে গুঁজে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে তিনি নিঃশব্দে শরীর কাঁপিয়ে হেসে চলেছেন।

Comments

  1. BQ1:
    -laal terylene

    BQ2:
    - haripada babu , ami , jatayu.

    4th jon Sultan.

    Quiz dekhei agey haat tuley diyechhi :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. একশোয় দেড়শো (খাতা সবার আগে এবং এমন দ্রুততায় জমা দেওয়ার জন্য এক্সট্রা পঞ্চাশ) পাওয়ার গৌরব তো তোমার একার, অর্পণ, কিন্তু কমেন্ট খুলে দেখার আগেই প্রথম কমেন্টকারীর পরিচয় এবং কমেন্টের কন্টেন্ট সম্পর্কে যে আমি নিশ্চিত ছিলাম সে বাবদে খানিক কলার আমিও তুললাম।

      Delete
  2. osadharon bhalo laaglo lekha ta.. thank you..

    headphone niye ei jhamela aamader o aache
    aami idaning start korechi audiobook shunte shunte candycrush khela.. khub baaje nesha hoyeche

    dekhi.. aamio aabaar theke unitasking er dike egoi

    aapnader barir gate theke mela ground dekha jaay shune khub hingshe dilam.. amader flat theke charti gaach aar hagarta aaro flat chara kichui dekha jay na..

    bhalo thakben

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, আমাদের এই বাড়িটার অবস্থানটা ভালো লাগে আমাদের বেশ, ইন্দ্রাণী। মাঠ দেখতে গেলে অবশ্য আমাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচে গিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়াতে হয়, কিন্তু সেটুকু করাই যায়। ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে খেলতে অডিও শোনার সুবিধে হচ্ছে, মনঃসংযোগটা অনেকটা বেড়ে যায় একলাফে। কিন্তু নেশা ধরে যায়, সেটা ভালো না।

      Delete
  3. ইশ্!! কুইজে আবার লেট, আপনার কিন্তু এবার একটা পিওওওরলি ফেলুদা কুইজ করা উচিত, কমেন্টের জন্যে ২দিন সময় দিয়ে। সময় পেলে ভেবে দেখবেন প্লিজ।
    ইদানিং কিছু গোলমালের মধ্যে থাকার কারণে অবান্তরের কমেন্টবাক্সে আমার যাতায়াতে একটু ছেদ পড়েছে, তবে আমি দেরী করে হলেও প্রত্যেকটি পোস্ট পড়েছি(অন গড ফাদার মাদার)।
    আপনার ইয়ারফোনের গল্পটা ভারী মিষ্টি, আমিও একবার প্রায় এরকমই এক ঘটনার ভিক্টিম হয়েছিলাম।
    আমি আপনার লেখাটা পড়তে পড়তেই আবিষ্কার করলাম, আমিও একমাত্র একটা কাজ ছাড়া বাকি সবক্ষেত্রেই এই মাল্টিটাস্কিং-এর শিকার, আর এর সূচনা ঘটেছে মূলত গতবছর লকডাউনের পর থেকে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে গোড়াতেই সাবধান করে দেওয়ার জন্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সরি, আধিরা, বড় দেরি করলাম উত্তর দিতে। নানা ঝামেলায় জর্জরিত। তাড়াহুড়োয় অবান্তরে কথা বলতে ইচ্ছে করে না...
      কমেন্ট করা নিয়ে চিন্তা কোর না। ওটা ঝামেলার ব্যাপার, জানি। মাল্টিটাক্সিং ব্যাপারটা কীভাবে যে ঢুকে পড়ে, বোঝা যায় না। কাল একটা পয়েন্টে রিয়েলাইজ করলাম আমি জুমে মিটিং করছি, গান শুনছি, প্লাস একটা বই পড়ছি, একই সঙ্গে। কী করে জিজ্ঞাসা কোর না। আমিও জানি না।

      Delete
  4. ইয়ারফোন ঠিক নয় তবে হেডফোন নিয়ে একবার এরকম একটা গল্প হয়েছিল। চ্যাট হেডফোন কানে লাগিয়ে নিজের মনে কিসব দেখছিল, যাই বলি কানে ঢুকছিল না। আমি পাশের ল্যাপটপ খুলে আমার যা বক্তব্য সেটা রেকর্ড করে, এই ল্যাপটপের সাথে ওর হেডফোনটাকে blue tooth দিয়ে কানেক্ট করে আমার বক্তব্যটাকে জোরে, জোরে চালিয়ে দিয়েছিলাম। তারপরে চ্যাটের ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে মিনিট দশেক আগে হেসে নিয়ে তারপরে এক্সপ্লেইন করেছিলাম যে হেডফোনটা খারাপ হয়নি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এটা দারুণ মজার ঘটনা, চুপকথা। সত্যি, ঘরের লোকের সঙ্গে কমিউনিকেট করাই অনেকসময় সবথেকে দুষ্কর হয়ে ওঠে।

      Delete
  5. আমি অনেকদিন আগে একটা ব্লগ লিখেছিলাম খানিকটা এরকমই একটা আইডিয়া নিয়ে, যে আজকাল মানুষের "বোরডম" ভয়ানক কমে গেছে - কোনও সময়ে আমরা আজকাল আর "বোর" হইনা, কিছু না কিছু দেখতে/শুনতে/খেলতে/পড়তে থাকি - তাই আমাদের মাথায় নতুন ক্রিয়েটিভ আইডিয়া আসাও কমে গেছে। কিছুক্ষণ বোর হওয়াটা তাই খুব রিফ্রেশিং।

    ওই যে চোখের মুভমেন্ট দিয়ে রেলের স্লিপার বা পোস্ট আলাদা করে নেওয়ার খেলাটা বললেন, আমিও ওইটা খেলতাম। সিলিং ফ্যানের ব্লেড আলাদা আলাদা করেও দেখা যায় ওইভাবে। একেবারে পাঁচে চললে হয়তো যায়না, কিন্তু দুই কি তিনে থাকলে করা যায়। ফটোগ্রাফির একটা টেকনিক আছে যাতে ওই কায়দাটা ব্যবহার হয়, সেটার নাম ক্যামেরা প্যানিং।

    সর্বদা দুজনকার জিনিস আলাদা আলাদা রকম কিনবেন। আমার আর পৌলমীর ফোনদুটো আপাতত এক মডেল। সামান্য আলাদা রং হওয়া সত্ত্বেও আমরা খালি একে অপরের ফোন নিয়ে এদিক সেদিক চলে যাই। জঘন্য।

    কুইজদুটোর উত্তর তো পেয়েই গেছেন, তাই আর দিলামনা। নেটফ্লিক্সের "রে" দেখে যদি ধাক্কা সামলে উঠতে পারেন, তাহলে মতামত জানার আগ্রহ রইল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা, ধাক্কাই বটে। আমার কান্না পাচ্ছিল, সিরিয়াসলি বলছি। রাগটাগ না, স্রেফ হাল ছাড়া কান্না। আমার এত সাধের গল্পগুলো, মা গো, বাবা গো, শিবুকাকা গোওওও...

      আমিও আজকাল আর বোর হই না। কিছু কাজ করতে পারি না সে জন্য। দ্রুত বোরডমের দেবতাকে তুষ্ট করে জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে।

      Delete
  6. ¨দৃষ্টিরাজ্য তো দখল অলরেডি হয়েছিলই, জলের মিহি শব্দ, ঠাণ্ডা হাওয়া, আর ভেজা কংক্রিটের গন্ধ কান, ত্বক আর নাকের দখল নিল। ¨ - অপূর্ব !
    unitasking নিয়ে যা বললে ভাববার বিষয় - হাঁটতে হাঁটতে audible , রান্না করতে করতে netflix , মিটিং চলতে চলতে whatsapp - চারিদিকে multitasking এর ফাঁদ পাতা :(
    মনঃসংযোগ ব্যাপারটাই উঠে গেলো, ভাগ্যিস আমাদের ছাত্রজীবনে ফোন ছিল না !

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, যা বলেছ, কাকলি। সব পরীক্ষায় ফেল করতাম আমি। মনঃসংযোগ এখন স্রেফ ডিকশনারিতে, আর কোথাও না।

      Delete
  7. Brishti kothay? akdin hoyto ektu hoyechhilo; onek somoy obosso Delhi te hoy kintu Gurgaon te hoyna.
    Khub e baje weather toh aajkal..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর বোলো না, রণদীপ। স্রেফ মরে যাচ্ছি। এ কী গরম, বাপ রে বাপ রে বাপ! এদিকে যাকেই ফোন করি বলে হয় বৃষ্টি নামবে, চলছে, থামল। নেক্সট তিন মাসে বোধহয় পূর্বাভাস নেই এক ফোঁটা পড়ার আমাদের এদিকে।

      Delete
  8. Totally useless fact: আমার ঠাকুমা বরিশালের ভাষায় জাঁতি কে সর্তা বলতেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে তীর্থ, আমার ঠাকুমাও বরিশালের, কিন্তু আপনার শব্দটা শুনিনি। হয়তো বরিশালের মধ্যেও আঞ্চলিক ভাগাভাগি থেকে থাকবে ভাষার।

      আর মোটেই ইউজলেস নয়, আমার অনেক স্বপ্নের একটা হচ্ছে ঢাকা আর বরিশাল, দুটো জায়গার বাঙাল ভাষায় ফ্লুয়েন্ট হওয়া। কাজেই অত্যন্ত ধন্যবাদ শব্দটি জানানোর জন্য।

      Delete
  9. এই মাল্টিটাস্কিং এর জ্বালাতেই মনোঃসংযোগ গোল্লায় গেছে আর কিছুতে মন বসে না বলেই হয়তো ভালো না লাগাও বেড়ে গেছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালোলাগাটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, প্রদীপ্ত।

      Delete
  10. ei somosyati amio abishkar korechi besh kichu bochor dhore..chirokal sob kaj eksathe ebong taratari kore felr ekta atmoshlagha bodh kortam..eksathe duto ranna..pashpashi duto reaction etc..kintu ekhon dekhchi chotata boddo jore hoye jachche thamte chaileo pachchina..ekla hoar bhalolaga gulo dupure korikath gonar abhyesh gulo besh bhalo chilo...somehow, eta theke ber hote parata khub dorkar..high five for the same feelings...kmn jeno bekheyale chollish pray kete gelo!! jai hok, delhi te achi kokhon kibhabe dekah hobe thik koro shiggiri..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি এখন রিষড়ায় রে, পারমিতা। মারাত্মক বৃষ্টি হচ্ছে।

      Delete
  11. শুভ চল্লিশ। চোরের মন বোঁচকার দিকে। এইবার অবান্তর এর দ্বিতীয় বইটা আসুক অন্তত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুদীপ। আর এ প্রলাপ স্থায়ী করে কী লাভ।

      Delete

Post a Comment