দুটো বই ও অন্যান্য



র অসামান্য সব নিরামিষ পদ রেঁধেছিল। সর্ষে ঢ্যাঁড়শ, বেগুন কুমড়ো ডাঁটার পাঁচমেশালি তরকারি, আলু পটলের মাখামাখা ঝালঝাল ঝোল, টমেটো পেঁয়াজ রহিত। আমরা নাকি কোনও একসময় বাঙালি রান্না নিয়ে আলোচনা করেছিলাম যা আমি সম্পূর্ণ ভুলে গেছি কিন্তু র মনে রেখেছে, যেখানে আমি নাকউঁচুপনার হেস্তনেস্ত করে বলেছিলাম যে টমেটোর ঠ্যাকনা ছাড়া রাঁধতে পার তো বুঝি। পটলের তরকারির টমেটো পেঁয়াজ না দেওয়ার সিদ্ধান্তটা সেই আলোচনার প্রতিই হ্যাট টিপ, বলল র। নিজের রন্ধন প্রাওয়েস প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে আমার কনভিকশনের জোর আরও বাড়াল।

সে সব খেয়ে সবে উঠেছি। র-এর তিনজন বেড়ালের একজন অচেনা লোক দেখে শোওয়ার ঘর থেকেই বেরোয়নি, একজন একটা ডাইনিং চেয়ারের কুশনে, আরেকজন রান্নাঘরের কাবার্ড আর সিলিং-এর মাঝের দশ ইঞ্চি ফাঁকা জায়গায় নিজেকে গুঁজে ঘুম দিয়েছে। এই তিন নম্বর জনের সাদাকালো থাবাটুকু কাবার্ডের বাউন্ডারি থেকে শূন্যে অল্প ঝুলে রয়েছে। ওই ঝুলে থাকা থাবাটার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমারও চোখ লেগে আসে আসে, র বলল, এখন ঘুমিয়ো না। বেরোতে হবে।

সিনেমা তো শুরু হতে দেরি আছে, অটো নিলে মোটে পনেরো মিনিটের মামলা। র বলল, সময়টা ইস্যু নয়। সময়মতো বেরোতে গেলে ভিজে গায়ে বসে সিনেমা দেখতে হবে। হলের এসি চড়া, কোভিড হলেই চিত্তির। আবার ঘোরাঘুরি আছে সামনে।

কমিউনিটির সুইমিং পুলটা ওর বিল্ডিং-এ ঢোকার মুখেই। র বলল, বিকেলবেলায় ছোট পুলে প্রোটিন পাউডার খাওয়া বাচ্চারা দাপাদাপি করে, খুব দৌড়েও তার পাশ দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে যাওয়া যায় না, ভিজে একশা হতেই হয়। রাগ দেখিয়ে যে কান মলে অ্যাগ্রেশন প্রকাশ করবে লোকে তারও নাকি জো নেই, পুল ঘিরে গর্বিত অভিভাবকরা সন্তানদের জলকেলি দেখতে দাঁড়িয়ে থাকেন।

কাজেই দেরি থাকতেই বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দিষ্ট হল পি ভি আর লজিক্স, উদ্দিষ্ট সিনেমা ভুলভুলাইয়া টু। যেমন হবে আশা করা গিয়েছিল তেমনই - এর বেশি শব্দ খরচ করার দরকার নেই রিভিউতে। একটা বিষয় নিয়ে নেহাত না বলে পারা যাচ্ছে না তাই বলছি। এত খরচ করে এত বাজেটের সিনেমা বানিয়ে কার্তিক আরিয়ানের গোটা সিনেমার পাঁচ বাক্যের বাংলা বলার জন্য একজন কোচ, আচ্ছা কোচকে না হয় টাকা দিতে হবে, তার থেকে সে টাকা দিয়ে আইটেম সং-এর সেটে আরও দুটো টুনিবাল্ব লাগানো যায়, একজন বাঙালিকে ডেকে (অল্প বূড়ো, নতুন প্রজন্মের বাঙালিদের ডাকলে আবার উল্টো বিপদ) একটু প্র্যাকটিস করানো কি যেত না? উচ্চারণ, যতি সবের একেবারে পিণ্ডি চটকে ছেড়ে দিয়েছেন। জঘন্য।

একটা ভালো হল, র-এর বাড়ি যেতে আসতে মেট্রো চড়া হল। অনেকসময় উইল পাওয়ার ঢিলে হয়ে গিয়ে উবার নিই, খামোকা একগাদা টাকা খরচ হয়ে যায়। মেট্রোতে দাম উবারের নখাগ্রপরিমাণ, এসির আরাম, ফাঁকা কাম্ররা, আকাশ থেকে দিল্লির বার্ডস আই ভিউ। জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটি, নোংরা যমুনা পার করে নয়ডার উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির রাজ্য। ছবির মতো রাস্তাঘাট। বুলেভার্ডে গাছ। চেনা অনেকেই এখানে বাসা বেঁধেছে। খালি চপের দোকান নেই বলে আমাদের আর আসা হল না।

সেদিন আরও এক বন্ধুর কমিউনিটিতেও দেখলাম সুইমিং পুল। তার মানে সব কমিউনিটিতেই আজকাল পুল থাকে। রিষড়ার পাড়া, যেটাও একরকমের কমিউনিটিই বলা যায়, সেখানেও পুকুর ছিল। পাড়া প্রতিষ্ঠার সময়েই কাটানো হয়েছিল শুনেছি। পুকুরের লাগোয়া মাঠে দুর্গা মণ্ডপ আর মণ্ডপের লাগোয়া সাধারণ পাঠাগার বানানো হয়েছিল। সেকালের কমিউনিটিদের আবশ্যিক এলিমেন্টস।

সি আর পার্কেও আছে। চিত্তরঞ্জন ভবনের পেছন দিকটায়। লাইব্রেরিতে বাংলা বই প্রচুর। সেটা ভালো ব্যাপার। সময় যখন অল্প, আরও বাড়ন্ত মনঃসংযোগ, একটা টোটকা বারংবার কাজ দেয়, বাংলা বই। এক তো মাতৃভাষা। মাথার মধ্যে ট্রানস্লেশন, সে যত স্পিডেই হোক, করে সময় বা খাটনি নষ্ট করতে হয় না। তাছাড়া আরও ব্যাপার আছে।

যেমন ধরা যাক, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর একটা ছোটগল্প সংকলন এনেছি লাইব্রেরি থেকে, নাম 'আজ কোথায় যাবেন' আমার জন্মের বছর বেরিয়েছিল, মূল্য বারো টাকা। সে বইয়ের একটা গল্পে, সম্ভবত প্রথমটাতেই, একজন বুড়ো লোক ট্রামে চড়ে যাচ্ছেন। ট্রামটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কারণ গণ্ডা গণ্ডা দেখেছি। ভরদুপুরের গরমটরম সব যেন নিজেরই লাগল। রিটায়ার্ড, সংসারে অল্প অবহেলিত ভদ্রলোককেও কল্পনা করতে বেগ পেলাম না। বেকবাগানে নামলেন ভদ্রলোক। বেকবাগান যাইনি কখনও কিন্তু গ্যারান্টি রাস্তাটা খুব অন্যরকম দেখতে নয় আমার মাথার ভেতরের রাস্তাটার থেকে। রাস্তার শেষে একটা ছোটমতো শিবমন্দির, আমার দেখা পাঁচলক্ষ শিবমন্দিরের মতোই হবে নির্ঘাত, তার সামনে বসে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আবার বাড়ি ফিরে এলেন।

(গল্পে আরও রোমহর্ষক ব্যাপার হয়েছিল, স্পয়েল করব না বলে এরকম নীরসভাবে বললাম।)

এই যদি গল্পটা বেকবাগানের বদলে বারমন্ডসিতে ফাঁদা হত আর দোতলা বাসে চড়ে চার্চে যেতেন একজন ইংরিজি বলা পিসিমা, গোটা ব্যাপারটা কল্পনা করতে যে পরিমাণ পরিশ্রম হত, গল্প পড়ার অর্ধেক আরাম মাটি।

'আজ কোথায় যাবেন' এখনও পড়া চলছে। শেষ হলে মন্তব্য করা যাবে সব মিলিয়ে, অবশ্য কীই বা মন্তব্য করব, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী দারুণ লিখতে পারতেন? জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখকপ্রতিভা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই, সে ধৃষ্টতাও আমি করব না, খালি বলছি নন্দীর বাকি সব লেখার মতো এই গল্পগুলোও প্রত্যেকটা গায়ে কাঁটা দেওয়া। ‘দুই শিশু’ গল্পে চরিত্র চারটে। দুটি শিশু, দুটি বাবা। সে অর্থে কোনও প্লট নেই। শুধু চারটি চরিত্র বুনে বুনে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী দাঁড় করান একটা রচনা যার বিষয়বস্তু, আঙ্গিকের আধুনিকতা মাপার কোনও মাপকাঠিও আমরা তৈরি করে উঠতে পারিনি।

এই বইটা আনার আগে যে বইটা পড়ছিলাম সেটা হচ্ছে মহাশ্বেতা দেবীর ‘অনবরত-র অবিশ্বাস্য’। মহাশ্বেতা দেবীর সৃষ্ট অনবরত বাগচী হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের গুলবাজ গপ্পুড়ে দাদাদের একজন। মহাশ্বেতা দেবী যদিও মুখবন্ধে অনবরতর অনুপ্রেরণা হিসেবে  বাঙালি লেখকদের মধ্যে একমাত্র ত্রৈলোক্যনাথের কথাই উল্লেখ করেছেন, অনবরত বাগচীর আজগুবি গল্প বলা এবং গল্পের শেষে অন্যের দ্রব্য গাপ করে অম্লানবদনে প্রস্থান ইত্যাদি দেখলে ঘনাদার কথাই সবথেকে আগে মনে পড়ে।

তবে ঘনাদার সঙ্গে অমিলও আছে অনেক। প্রথম অমিল, অনবরত বাগচী ঠিক শিশু বা কিশোর সাহিত্যও নয়। কিশোর সাহিত্য বলতে আমি বাঙালি কিশোর সাহিত্যের কথা বলছি। আজকাল ইংরিজি ভাষায় ইয়ং অ্যাডাল্ট বলে যে শ্রেণীর সাহিত্য চলছে তার বিষয়বস্তুতে যে মাত্রার রোমহর্ষক জিনিসপত্র থাকে তার তুলনায় বাঙালি কিশোর সাহিত্য গোবরজলে ধোয়া শালগ্রাম শিলা।

এই যে মেল গেজ ফিমেল গেজ নিয়ে এত কথা, আমি একবার একজনকে আস্তে করে যেই না বলেছি, ছেলেরা মেয়েদের পার্সপেক্টিভ থেকে লিখলেই ওইরকমই লিখবে। তাতে তিনি পত্রপাঠ বলেছিলেন, ছেলেদের পার্সপেক্টিভ মেয়েরা সার্থকভাবে লিখে দেখাক তো বুঝি। আমার দ্বারা হবে না, কিন্তু মহাশ্বেতা দেবীর দ্বারা খুবই হয়েছিল। 

অনবরত বাগচী খুবই রোম্যান্টিক প্রকৃতির মানুষ, তাঁর অ্যাকিলিস হিল বা পচা শামুক, যেভাবেই বলুন না কেন, হচ্ছেন মেয়েরা। নিজের নামকরণ সার্থক করে ক্রমাগত মহিলাদের ফাঁদে পড়েন এবং ল্যাজেগোবরে হন। আমি বলছি না পুরুষজাতির গোটা দৃষ্টিভঙ্গি এই লঘুচালের গল্পগুলোতে উঠে এসেছে। কিন্তু সেই সব মহিলাদের প্রতি প্রেম থাকলেও তাঁদের নিষ্ঠুরতার বর্ণনার আড়ালে নারীদের প্রতি সমব্যথী লেখকের উপস্থিতির ছায়াও পাওয়া যায় না। অন্তত আমি পাইনি।

অনবরত বাগচীর মূল অসুবিধের জায়গাটা আমার লেগেছে গল্প বলার ধরণে। অনবরত-র গল্প বলার ধরণ তো বটেই, মহাশ্বেতা দেবীর অনবরত-র গল্প বলার ধরণও। রুদ্ধশ্বাস, চরিত্রের পর চরিত্র, ঘটনার পর ঘটনা এবং সবই সংলাপে। শব্দবহুল গল্পগুলো শেষ করে আমি খেই হারিয়েছি। কী যে পড়লাম, সব মাথার ভেতর গুলিয়ে গেছে।

Comments

  1. CR Park e je shudhu chop jhalmuri pawa jaay na, aabaar bangla golper boier library o aache, ete aami je ki hingshe pacchi ki bolbo.. kolkata geleo toh bodh hoy chalu bhodrostho library pawa mushkil.. Bombay te toh chalu bhodrostho ingriji boi er library o nei.. maane aache kichu, kintu amar bhalo lageni..

    Kolkata, Chennai, Bangalore e Eloor bole ekta lending library r chain chilo.. ekhon uthe geche.. aar chotobelay jamshedpurer paRar libraryr ek almari chotoder boi.. aamaar jiboner sobcheye lucky somoy.. Behalateo bodh hoy ekta library te member hoyechilam.. seta maa beshi use korechilo, aami kom..

    ontoto jodi keu ekta bangla boi er virtual library e korto - scribd ba kindle unlimited er moto..

    anyways.. khub khub bhalo laglo..

    bhalo thakben

    Indrani

    PS aami hall e giye belashuru dekhe elam.. aapni dekhechen naki?

    ReplyDelete
    Replies
    1. 😀😀😀 আমার লেখা পড়ে সি আর পার্ক বিচার করতে বসলে খুবই অন্যায় হবে, ইন্দ্রাণী। চপ আর ফুচকা ছাড়াও অনেক কিছু আছে। গাদা গাদা মাঠ, পার্ক, সুলভ চিকিৎসালয়, পাঠাগার, যোগব্যায়ামের ক্লাস (বড়দের ও ছোটদের), কুংফু ক্যারাটের ক্লাস, নাচগানের ক্লাস, মাঝে মাঝেই ছোটবড় মেলা। পুজোটুজোর হুল্লোড় তো ছেড়েই দিলাম। আসলে সবই দৃষ্টির ব্যাপার কি না, আমার দৃষ্টি কেবল চপ ফুচকার ওপরই পড়ে।

      হলে যাওয়ার খরচটা শবরের তীরন্দাজ-এর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছি। বেলাশুরু দেখার মারাত্মক কৌতূহল, কিন্তু ফ্রি-তে। অন্তত সেইরকমই ইচ্ছে।

      আপনার কেমন লাগল?

      Delete
  2. Onekdin por apnar boi niye lekha porlam. Ki je agroho niye porechhi... Jotirindra Nandir chhoto golpo amar khubi priyo!
    Apanake janano hoy ni, ei fnake notun boiyer noyo shubhechha janiye rakhi.
    Amar Delhibaas kale Logix e soptahintik cinema dekhte jetam, apnar lekhay sei smriti fire elo. Shobor dekhe janaben kemon laglo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. শবরের জন্য যাকে বলে শবরীর প্রতীক্ষায়, সায়ন। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী হাই ফাইভ। অভিনন্দনের জন্য অগুন্তি শুভেচ্ছা।

      Delete
  3. জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী তেমন পড়া হয়নি। পড়তে হবে তো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. পড়ে দেখো, ভালো লাগবে মনে হয়।

      Delete
  4. Jyotirindra Nandy amar khub prit=yo ekjon lekhok. Chhotogolper jadukor bola jay

    ReplyDelete

Post a Comment