একেন, মহাভারত, ফেলু



হইচইতে একটা গ্যাঁড়াকল হয়ে রয়েছে। অটো রিনিউয়্যালের গ্যাঁড়াকল। নভেম্বর পড়তে না পড়তে ঘচাং করে নেক্সট বছরের সাবস্ক্রিপশন কেটে নেয়। যা গায়ে লাগে। গায়ে লাগার প্রধান কারণ নিয়ন্ত্রণহীনতা। যে জীবন অভিভাবকহীন গাধার মতো দৌড়চ্ছে, তার অন্তত অবান্তর কয়েকটা বিষয় নিয়ন্ত্রণে থাকলে সান্ত্বনা মেলে। যেমন ফিক্সড ডিপোজিট। কক্ষনও প্রিন্সিপ্যাল/+ইন্টারেস্ট অটো রিনিউ অপশন বাছি না। সর্বদা রিডিম করি। ওই যে পরের বার আবার ফিক্সড খুলব, অ্যাট লিস্ট টাকাটা নিজের মনে হবে। কোনওদিন চোখে দেখি না দেখি।

নিয়ন্ত্রণহীনতার অসুবিধেটা প্রধান বলেই প্রচ্ছন্ন। প্রকট হয় অন্য একটা লজ্জা। লোকে আমাকে কী চেহারায় দেখছে (আমিও দেখছি, রোজ আয়নায় দেখাচ্ছি নিজেকে) সেটা সংক্রান্ত। হইচইয়ের মতো একটা নন-বুদ্ধিজীবী জিনিস গিলছি টাকা দিয়ে বছর বছর সেটার লজ্জা। প্রতি বছর নভেম্বরে সাবস্ক্রিপশনের সঙ্গে সঙ্গে সে লজ্জাও রিনিউ হচ্ছে।

অথচ এতদিনে সবার এবং নিজের কাছেও এটা প্রমাণ হয়েই গেছে যে আমার বুদ্ধির লেভেল হইচই-এরই সমান। না হলে এতদিন ধরে হইচই যা গেলাচ্ছে গিলতে পারতাম না। তবু ভ্রান্তিবিলাস।

গূঢ়তর কারণও একটা থাকতে পারে হইচইয়ের প্রতি নিষ্ঠার। খারাপ জিনিস দেখে, নিন্দে করে সস্তায় নিজের বুদ্ধির পিঠ চাপড়াতে পারার।

কারণ যা-ই হোক না কেন, গত কয়েকমাসে হইচই তিনটে জিনিস গেলালো। বলি আপনাদের।


দ্য একেন

একেনবাবুর ওয়েবসিরিজ নিয়ে কিছু লিখেছিলাম কি? নির্ঘাত ভালো কিছু লিখিনি। তাই বলে কি আর সবক’টা সিজন দেখিনি?

তা সত্ত্বেও যে ‘দ্য একেন’ সিনেমা দেখতে বসলাম তার কারণ হিসেবে ওটা সিরিজ এটা সিনেমা, পরিচালক আলাদা, নামভূমিকায় অনির্বাণ চক্রবর্তী ছাড়া বাঁধা চরিত্রের অভিনেতারাও আলাদা, এই সব অজুহাত দেখানো যেত। লাভ নেই। দেখেছি আর কোনও কাজ নেই বলে। হইচই যা দেখাবে তাই দেখব বলে।

গল্প ঘটছে, আজকাল পশ্চিমবঙ্গের সব গল্পই যেখানে ঘটে, উত্তরবঙ্গে। ডূয়ার্সের বনচেরা পিচরাস্তায় এস ইউ ভি-র একেবেঁকে চলা অনেএএএক ওপর থেকে দর্শককে দেখাতে হবে বলে বোধহয়।

মূর্তি চুরি, তিরিশ বছর আগের খুন, তিরিশ বছর পরের খুন, রুপোলি পর্দার নায়িকাটায়িকা মিলিয়ে 'দ্য একেন' জমজমাট। অনেক ঘটনা ঘটে, ঘটতেই থাকে। হাই তুলতে হয় না। গল্প সাদামাটা। মোটিভ অপরচুনিটির ঢ্যারা, গোয়েন্দার সক্রিয় খোঁজাখুঁজি, অ্যালিবাইয়ের ভাঙাগড়া, লাস্টে পাঠক/দর্শকের 'ওই ক্লুটা তো সামনেই ছিল ধরতে পারলাম না'' হাহাকার - এ সব আর হয় না। লোকে এখন ধাঁধার বদলে ড্রামা চায়। গোয়েন্দাগল্প চায় সাহিত্য হয়ে উঠতে। আর সে হতে গেলে ধাঁধার বদলে মানবমনের গভীরে ডুব দেওয়া আবশ্যিক।

এই ইস্যুতে হইচই-এরই আরেকটা সিরিজের চট করে নিন্দে করে নিই। অনির্বাণ ভট্টাচার্য অভিনীত ব্যোমকেশ সিরিজ। শুরু থেকেই খারাপ ছিল, শেষ সিজনটা আমার পক্ষেও দেখা অসম্ভব হচ্ছে। তবেই বুঝুন। বাংলার দুর্ভিক্ষ না মন্বন্তর কী একটা নিয়ে ব্যোমকেশের প্রতিক্রিয়া যদি দেখতেন। স্থির হয়ে বসতে পারছেন না, চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলছেন, মতের সঙ্গে মত না মিললেই যাকে যা খুশি মুখের ওপর বলে দিচ্ছেন। "ভালো লাগছে না ভালো লাগছে না সত্যওওও" বলে যা কাঁদুনি জুড়েছেন, আমি সত্যর জায়গায় হলে . . . থাক সে কথা।

আজকাল সব গোয়েন্দাদের “রক্তমাংসের” করার যে বেগ এসেছে নির্ঘাত তার পরিণতি। যেন শান্ত, সংযত, বুদ্ধিমান, রসিক, ক্রাইসিসে না টসকানো লোক রক্তমাংসের হয় না। ব্যোমকেশ সম্পর্কে আমার মতামত অবান্তরে গোপন নেই, কিন্তু ইদানীং ভদ্রলোকের প্রতি মায়াই বোধ করছি। শরদিন্দু একটা বুদ্ধিমান লোক বানিয়ে গিয়েছিলেন, উপরোক্ত সমস্ত গুণাবলী যার ছিল। তাকে কী বানিয়ে ফেললাম আমরা।

‘দ্য একেন’ অতসব ক্যারেকটার বিল্ডিং-এ যায়নি। বাঁচিয়েছে। একটা জায়গাতেই সামলাতে পারেনি, সেটা অবশ্য সিনেমার দোষ না, সিরিজেও হয়েছিল, সেটা হচ্ছে একেনবাবুকে হ্যাংলাচূড়ামণি দেখানো। সিরিজে হুলিয়ে ভেজিটারিয়ান-ব্যাশিং ছিল, সিনেমা অন্তত সে বাবদে সংযমপালন করেছে। কিন্তু একেনবাবু এখানেও খেয়ে যাচ্ছেন। সিরিয়াস আলোচনায় সবাই খুনখারাপির কথা বলছে, একেনবাবু ননস্টপ খাওয়ার কথা বলে চলেছেন। এর ওর পাত থেকে খাবার তুলে খেয়ে ফেলছেন। হয়তো কারও কিউট লাগছে ব্যাপারটা, কে জানে।

মোটের ওপর আমার মতে 'দ্য একেন' দেখা যায়। ওয়েবসিরিজটা দেখার পর তো আরও বেশি করে দেখা যায়। ওয়েবসিরিজে আউটডোরের সমস্যা থাকাতেই সম্ভবত বেগুনিগোলাপি দেওয়াল আর বসার ঘরে সারি সারি রংচঙে বোতলের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের হদ্দমুদ্দর পর নর্থ বেংগলের খোলামেলা আউটডোর কলাকুশলী এবং দর্শক দুই পক্ষের স্বাস্থ্য ও চোখের পক্ষেও উপকারী।


মহাভারত মার্ডারস

বইটা পড়েছিলাম। তেমন ইমপ্রেসড হইনি।

সিরিজটা দেখলাম। ইমপ্রেসড হলাম না।

গল্পটার খাঁজখোঁজ ভুলে গেছি, খালি কে খুন করেছিল ছাড়া। অনেকে ছিক ছিক করে। বিশেষ করে যারা খুনীটুনি শুদ্ধু গোটা বই ভুলে যায়। আহা রে কী দুর্দশা, রি-রিডিং-এর মজা মাটি। করুণা পত্রপাঠ রিফিউজ করি। দুর্দশা কীসের? গোয়েন্দাগল্প তো শুধুমাত্র খুনীর পরিচয় ধরতে পড়ি না, পড়িনি জন্মেও। কাজেই খুনীর নাম কণ্ঠস্থ হওয়া সত্ত্বেও এক বই একশোবার পড়তে বাধা নেই।

মহাভারত মার্ডারস সম্ভবত আরেকবার পড়ব না। প্রতিক্রিয়া জানাব শুধু সিরিজের ওপর ভিত্তি করেই।

কলকাতায় সারি সারি খুন হতে লেগেছে। বউনি হয়েছে এক যৌনকর্মীর খুন দিয়ে, তারপর আইটি গাই, পর্ন পরিচালক এই সব রোমহর্ষক লোকজন খুন হতে লেগেছেন। রোমহর্ষণের ওপর রোমহর্ষণ, প্রতি খুনের স্পটে দুটো করে পোস্টার সাঁটা। একটা দ্রৌপদী এবং তার চার বরের কোনও একজনের। ঠিক ধরেছেন, মহাপ্রস্থানের রুটে পতনের অর্ডার অনুযায়ীই খুন হচ্ছে। অর্থাৎ দ্রৌপদী, সহদেব, নকুল, ভীম ইত্যাদি। দ্বিতীয় পোস্টারটা দ্রৌপদীর পাঁচ নম্বর (এক নম্বর বলাই উচিত) বরের এবং সমস্ত অকুস্থলে কমন। এই যুধিষ্ঠির হচ্ছেন রাজ্যের সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী, সততার প্রতীক, নাম পবিত্র সম্ভবত। পদবীও ভুলে গেছি, শাশ্বত অভিনয় করেছেন বলেই মনে হচ্ছে কি না কে জানে চ্যাটার্জি হলেও হতে পারে।

রহস্য সমাধানের গুরুদায়িত্ব লালবাজারের গোয়েন্দা রুখসানারূপী প্রিয়াঙ্কার ওপর। সঙ্গতে আছেন সিদ্ধার্থরূপী অর্জুন চক্রবর্তী, যিনি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তে এসেছি, এই মুহূর্তে টালিগঞ্জের সুপুরুষতম। বাবাকে ছুঁতে পারেননি, আক্ষরিক কয়েক ইঞ্চি কম পড়েছেন।

রুখসানা আর সিদ্ধার্থ-র সম্পর্ক যে একটু কেমন কেমন সে আর বানান করে বলার কিছু নেই, শোলা অউর শবনম ইত্যাদি প্রভৃতি।

ভালোগুলোই প্রথমে বলি। রহস্যটা যথেষ্ট পরিমাণে ঘোরালো। গুচ্ছ সাবপ্লট। একটাই ঝামেলা থাকলে অনেকসময় রহস্য এবং সমাধান জোলো হওয়ার চান্স থাকে। সেটা হয়নি। তাছাড়াও খুনখারাপি, বৈধ এবং অবৈধ সম্পর্ক, রাজনীতি, হিন্দুমুসলমান, কলকাতার গলি, লোডশেডিং-এ মফস্বলে নাটকের মহড়া সব মিলিয়ে প্লট জমজমাট।

মহাভারত তো আছেই।

এবং সেই থাকাটা আমার খারাপের প্রথম পয়েন্ট।

লেখক রাগ করবেন, কিন্তু মহাভারত মার্ডারস-এর মহাভারতের অংশটা গজাল মেরে গোঁজা। স্পয়লার দেব না বলে দিচ্ছি না, কিন্তু মহাভারতের ব্যাপারটা এমন আলগা করে বসে আছে প্লটটার ওপর, ফুঁ দিলে উড়ে যাবে।

এটা আমার একটা গোপন (তত গোপনও নয়) খচখচানির জায়গা, তাই দু’লাইন বলি। এই ধরনের গল্প পড়লে বোঝা যায় মহাভারত থিমে একটা গল্প লেখার তাগিদ লেখকের আগে এসেছে, তারপর তিনি রহস্য ফেঁদেছেন। (দেবতোষ দাশের বিখ্যাত বিন্দুবিসর্গ-ও এই দলে পড়বে।) গোয়েন্দাগল্পকে “পাতি” গোয়েন্দাগল্পের থেকে উন্নীত করার অমোঘ বাসনা লেখকদের দিয়ে এ রকম গল্প লিখিয়ে নেয়। অর্থাৎ এঁরা ক্রিস্টি হবেন না, হবেন একো। হতেই পারেন। কিন্তু এই হতে চাওয়ার মধ্যে ক্রিস্টির প্রতি একধরণের তাচ্ছিল্যের ভাব কাজ করে, হতে পারে পুরোটাই ধরে নিচ্ছি (অর্ণব রায়ের সাক্ষাৎকার শুনে ওঁকে প্রায় আমার মতোই ক্রিস্টির ফ্যানবয় মনে হয়েছে, কাজেই এসব বলে ওঁর প্রতি অন্যায়ই হয়তো করছি), তবু এই ধরে নেওয়া আমার মধ্যে একটা অ্যাগ্রেশনের জন্ম দেয়।

এবং ছোটমুখে এই বড় কথা বলিয়ে নেয়। যদি কোনওদিন লিখে উঠতে পারি এমন গোয়েন্দাগল্প লিখব যেখানে লোকে স্রেফ সম্পত্তির জন্য বা জীবনবীমার টাকার জন্য বা প্রেমে দাগা খেয়ে খুন করবে। মহত্তর কোনও প্যাঁচপয়জার থাকবে না।

দেখুন আমার অনাগত গোয়েন্দাগল্প স্পয়েল করে দিলাম কেমন।

বাকি খারাপগুলোর অধিকাংশই টেকনিক্যাল। অফ কোর্স, সিনেমা বানানোর টেকনিক না, গোয়েন্দাগল্প বলার টেকনিক। যথাসম্ভব রেখেঢেকে বলছি।

ধরা যাক একটা ধুমধাড়াক্কা উন্মোচন হচ্ছে। ক (এবং পাঠক/দর্শকরাও) জানতে পারছে যে খ খুন করেছে। ভালো গোয়েন্দাগল্প হলে - ধরে নেওয়া যাক মহাভারত মার্ডারস ভালো গোয়েন্দাগল্প - ক এবং পাঠক/দর্শকের একটা "অ্যাঁ!!!!!!!!! শেষে কি না এ?????" ভঙ্গি হবে। এইবার এই "অ্যাঁ!!!!-এর" আঁচ পোহাতে তো খানিকটা সময় দেওয়া দরকার। ক যদি গোয়েন্দা হন তবে তাঁর মুখোমুখি খ-কে ফেলা দরকার। একটা মোলাকাত। হয় ভুল হয়ে গেছে, নয় বেশ করেছি আবার করব। টিভির এপারের লোকজনও রুটি তরকারি ফুরোনো থালা এবং শুকিয়ে ওঠা হাত নিয়ে বসে একে অপরের দিকে তাকাবে। তুমি ধরতে পেরেছিলে? আমিও পারিনি। কী কাণ্ড।

সত্য উন্মোচনের পর এই বিরতিটা (এটা সর্বদা যে লাস্টেই হতে হবে তেমন নয়, গল্পের মাঝামাঝি, শেষের দিকে, শুরুর দিকে - বেসিক্যালি যে কোনও বাড়াবাড়ির পর) 'মহাভারত মার্ডারস' সিরিজওয়ালারা দেননি এবং গোটা ব্যাপারটার উত্তেজনা অন্তত দ্বিগুণ করার সুবর্ণসুযোগ হেলায় হারিয়েছেন। যে তুবড়িটা পাড়ার সবার তুবড়ির থেকে উঁচু হওয়ার ক্ষমতা রাখত, সেটাতে আগুন দিয়ে পাশে রাখা বালতির জল ঢেলে এসেছেন, নিজের হাতে।

শেষ নিন্দে হচ্ছে যে গোয়েন্দাগল্প জটিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরল হওয়াও আবশ্যিক। প্যাঁচ ছাড়ানোর সময় বারবার পজ টিপে বা পাতা উল্টে এ কার পিসে, ও কার মামা, এ ক'ঘণ্টা কত মিনিটে হোটেলে ঢুকেছিল, সে ক'টা বেজে কত মিনিটে বেরিয়েছিল, এর জুতোর ছাপ ক'সেন্টিমিটার, ওর বন্দুকের নল কত মিলিমিটার দেখে নিতে হলে একটা সময়ের পর ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত দিতে হয় এবং গোয়েন্দাগল্পের মূল প্রতিপাদ্যটা ফেল পড়ে। তা হল আরামের। সমস্যা জটিল হবে, কিন্তু জট ছাড়ালে মনে হবে ফুরফুরে। মহাভারত মার্ডারস এইখানে স্ট্রাগল করেছে। আমার অন্তত তাল রাখতে ঘাম ছুটে যাচ্ছিল।

বলব না বলব না করেও একটা তৃতীয় খারাপ বলে যাই। সেটা হচ্ছে সিরিজটার বটম হেভিনেস। অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা সাবপ্লট সামনে এসেছে পেনালটিমেট এপিসোডে। নিষ্ট গুট।


ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি দার্জিলিং জমজমাট

এত বাজনা কেন? এক মুহূর্ত থামছে না। সাসপেন্সের সময় সাসপেন্সফুল, চনমনের সময় চার্পি, কমেডির সময় প্যাঁও প্যাঁও, শিল্পে কিছু ব্যান করা যাবে না মর্মে চন্দ্রিল যতই শিরা ফোলান, ওই লাস্টের আইটেমটা ইমিডিয়েটলি ব্যান করা উচিত। অনেক আগেই করা উচিত ছিল। মৌন চলচ্চিত্র হলে তবু বুঝতাম, সংলাপ দিয়ে মনের ভাব বোঝানোর সুবিধে নেই। এখানে তো সে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ক্যামেরারাও এই পরিমাণ উন্নতি করেছে, ক্লোজস্য ক্লোজ শটে ভ্রূকম্পন তো দূর মনের কথাও বেঁধে এনে দেবে। তবে?

পিরিয়ড পিস বলে বোধহয় ধুলো পড়া কনে দেখা আলোয় গোটা সিনেমাটা দেখতে হল।

অনির্বাণ চক্রবর্তীর জটায়ুকে আশি শতাংশ টেনে দিয়েছে ওঁর চেহারা। তোপসের কিছু করার নেই কাজেই ওঁকে নিয়ে আমার কিছু বলারও নেই। পুলক চক্রবর্তীর রোলে রাহুল অরুণোদয় খুব হাততালি কুড়োচ্ছেন দেখলাম।

মুশকিলটা হচ্ছে এঁরা যত ভালো কিংবা যত খারাপই করুন না কেন, সিনেমাটা ফেলুদার। বাকিরা নিমিত্তমাত্র। শুধু সিনেমা না, গল্পের ক্ষেত্রেও এ সত্য ঝমঝমে ছিল। শার্লক হোমস-এর গল্প যেমন লেখা হয়েছিল শার্লক হোমসকে চেনানোর জন্যই। রহস্যটহস্য ওয়াটসনটোয়াটসন সব কন্টেক্সট। ফেলুদারও তাই।

কাজেই টোটার দায়িত্ব ছিল হিমালয়প্রমাণ। অনেকেই দেখলাম ওঁর দুর্ভাগ্যজনক চুল, নিষ্প্রভ দৃষ্টি এবং অ-ফেলুদাচিত শরীরের ব্যাপারে বলেছেন। চুল যদি বা কিছু করার থাকে, চোখ নেই, শরীরেও নেই। হাতা গোটানো পাঞ্জাবী থেকে বেরিয়ে আসা ফর্সা মণিবন্ধে ঘড়ি, দীর্ঘ আঙুল, পাঞ্জাবীর আড়ালে দীর্ঘ নমনীয় বেতের আভাস . . .

কী কথা যেন হচ্ছিল?

ফেলুদাকে জ্যান্ত করার ক্যারিশমা নেই মেনে নিয়েও বলছি, গোটা দোষ টোটার নয়। বলতে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে, ব্যোমকেশের থেকে কম স্পিডে হলেও "রক্তমাংসের" খেলাটা ফেলুদার ক্ষেত্রেও ঢুকছে। বেশ কয়েকবছর হল ঢুকছে। সাক্ষাৎকারে নিজকর্ণে শুনেছি, খুদে দর্শকদের ফেলুদাকে দেখে ভয় লাগার ফিডব্যাক শুনে সব্যসাচী বেশি হাসতে এবং কণ্ঠস্বরে মজার অনুপাত বাড়াতে শুরু করেছিলেন। ফেলুদাকে গণর কাছে প্রিয়তর করে তোলার আশায়।

দেখুন, ছোটবেলায় বুঝিনি, মানে আঁচ পেয়েছিলাম, কিন্তু বানান করে বুঝিনি। এখন বুঝি। ফেলুদা কোনওদিন গণের ছিলেন না। ফেলুদা নেভার সাফারড ফুল্‌স্‌। আর আমি আপনি অধিকাংশ লোকই কমবেশি ফুল। আচ্ছা আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। আমি, লালমোহনবাবু এবং আরও বিবিধ পার্শ্বচরিত্ররা যারা ফেলুদার গল্পে আসেন যান - আমরা নিরানব্বই শতাংশ যে বাঙালির প্রতিনিধি, সেই বাঙালির সাধারণত্বকে ফেলুদা ডেসপাইজ করেন। আমরা কারও বাড়ি গিয়ে মালিকের পুরো নাম জেনে আসি না, ক্রমাগত বুজরুক গুরুর পাল্লায় পড়ি, ইংরিজি (এবং বাংলাও) ভুল বলি ভাষাটা জানা নেই বলে নয়, স্রেফ মনোযোগ দিই না বলে। নিজেদের খাওয়াবপরা ওঠাবসার বাইরে যাদের জিগীষা বলে কোনও বস্তু নেই। যারা চান্স পেলে বা না পেলেও ক্রমাগত নিজের কথাই বলে যাই, সামনের মানুষটির প্রতি বিন্দুমাত্র কৌতূহল দেখাই না। আমরা যারা বৈকুন্ঠ মল্লিক মার্কা শিল্পকর্ম হইহই করে চর্চা করে যাই।

আমাদের কাছে মিষ্টি হেসে নিজেকে প্যালেটেবল করে তোলা তো দূর অস্ত ফেলুদা যেচে নিজের পরিচয়ও দেবেন না।

ফেলুদা হাসি না পেলে হাসেন না। হাসিও তাঁর বাকিদের থেকে কম ঘনঘন পায়।

অন্তত এতদিন পেত। এখন ঘনঘন পাচ্ছে। অচিরেই আরও ঘনঘন পাবে। কারণ, রক্তমাংস। তদন্ত শুরু হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত টোটাকে দেখে অরুণ গোভিলের দেজা ভু হচ্ছিল। আরও একটা "সংশোধন"-এর দিকে ফেলুদা হাঁটতে শুরু করেছেন, বছরকয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবেন। অলরেডি ভিতের কাজ শুরু হয়েছে। একটা লোক গোয়েন্দা বলে কি সারাজীবন একা থাকবে মর্মে পুলক চক্রবর্তী, লালমোহনবাবু জাতীয় রক্তমাংসের লোকেরা জোর সওয়াল শুরু করলেন। ফেলুদাও ব্লাশমিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে "সেইইই" না কী একটা বলে উঠলেন। হাঁড়ির ভেতর গুমে গুমে সুসিদ্ধ হয়ে ওঠা চিরকুমার সভার সভ্যগুলির কথা মনে পড়িয়ে দিয়ে।

সবই রক্তমাংস প্রোজেক্টের পরিণতি।

মুশকিলটা হচ্ছে রক্তমাংস অনেক রকম হয়। একেনবাবুর হ্যাংলামি যেমন রক্তমাংসের তেমনি ফেলুদার সাধারণত্বের প্রতি তাচ্ছিল্যও রক্তমাংসের। কাজের প্রতি নিষ্ঠাও রক্তমাংসের। রক্তমাংসের করে তোলা মানে নিজেদের মাপে ছেঁটেকেটে নেওয়া নয়। ফেলুদার সৃষ্টিকর্তাও রক্তমাংসের ছিলেন, এই ধরাধামে হেঁটেচলে বেড়াতেন। শুনেছি সবার সঙ্গে পুরী গেছিলেন বেড়াতে। সবাই যা করার করছিল, অর্থাৎ সানরাইজ সানসেট, গর্ভগৃহে প্রদক্ষিণ, কাকাতুয়ার খাজা এবং পাণ্ডার ডাণ্ডা ভক্ষণ। সত্যজিৎ রায় একঘণ্টা সবার সঙ্গে ঘুরে হোটেলে ফিরে কাজে বসতেন।

বাকিদের কথা জানি না, আমার রক্তমাংসের সংজ্ঞায় এবং আমার দেখা নিরানব্বই শতাংশ লোকের রক্তমাংসের সংজ্ঞায় এ জিনিস পাগলের কাণ্ড মনে হবে। তাহলে উপায়? লোকটাকে রক্তমাংসের করে তুলতে ভলভোয় চড়িয়ে পাঠিয়ে দিই উদয়গিরি খণ্ডগিরি। অস্কার ফস্কে যাক।

সবথেকে জরুরি কথা, ফেলুদা যে রক্তমাংসের নন (সেদিক থেকে দেখলে ব্যোমকেশও) তাতে অসুবিধে কিছু হয়নি। ফেলুদার ফ্যানবেসে কিছু টান পড়েনি। বরং উল্টোটা। আমি যে জীবনটা ক্যান্ডি ক্রাশ খেলে কাটিয়ে দিলাম আর এই সাড়ে একচল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছে হইচই যে আমার বিনোদনের কর্নার স্টোন হয়ে উঠল এবং আট বছরে পড়া কিশোর সাহিত্যের গোয়েন্দা যে আমার চেতনা এইভাবে জুড়ে রইল যে তাকে নিয়ে সাপ ব্যাং বিচ্ছু যেখানে যা হচ্ছে হামলে পড়ে দেখছি এবং শয়ে শয়ে শব্দ টাইপ করে উত্তেজনার আঁচ পোহাচ্ছি, এতেও যদি ফেলুদা সৌমিত্রর মতো ভুরু কুঁচকে আমার দিকে না তাকান এবং আমাকে পোকার মতো ট্রিট না করেন, তাহলেই আমি হতাশ হব।

যাই হোক, ফেলুদাতে ক্ষান্ত দিয়ে অন্য কথায় আসি। যেগুলো ফেলুদাসংক্রান্ত তো নয়ই, এমনকি দার্জিলিং জমজমাট সংক্রান্তও নয়।

কথাগুলো সংলাপলেখক, যিনি পরিচালকও বটে, তিনি সংক্রান্ত।

এঁর অনেক ম্যানারিজমের একটা হচ্ছে অনাবশ্যক দীর্ঘ, ফলত অকওয়ার্ড সংলাপ। সেগুলো আবার অভিঘাতময় বিশ্বাসে ট্রেলারেই থাকে, গোটা সিনেমা খুঁড়ে আনতে হয় না। কানে লেগে আছে সে রকম একটা উদাহরণ দিচ্ছি।

"আচ্ছা আপনি কি মহিলাদের দেখে জেনারেলি এত টেনশন করেন না আমি হস্টেস বলে আপনার মধ্যবিত্ত রুচিশীল বড় হয়ে ওঠা আপনাকে তোতলাতে বাধ্য করছে?"

ভয়ে ভয়ে কয়েকটা কথা বলতে চাই। এক, তোতলানো একটা অ্যাকশন, যেটা অলরেডি দেখানো হয়েছে। মানে উক্ত ব্যক্তি অলরেডি তুতলিয়েছেন। তিনি যে মধ্যবিত্ত সেটাও তাঁর চাকরিটা এবং এযাবতের ঘটনাপরম্পরা থেকে বোঝা গেছে। হ্যাঁ, রুচিশীল কি না সেটা চট করে ওপর থেকে দেখে বোঝা যায় না, মানছি।

সংলাপের মাধ্যমে তাঁর রুচিশীলতার প্রমাণ দেওয়ার দায় না থাকলে গোটা সংলাপটাই উড়িয়ে দেওয়া যেত। যদি না বক্তার ক্যারেকটার বিল্ডিং করার দরকার থেকে থাকে যেখানে স্বস্তিকা ওই টাইপের যিনি ব্যাকফুটে থাকা লোক দেখলেই লাফিয়ে পড়ে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শোনান এবং সে কথার মধ্যে বিন্দুমাত্র চিমটি বা সাবটেক্সট অনুপস্থিত, গোদা ভাষায় মনের মোটা ভাব প্রকাশই উদ্দেশ্য।

দার্জিলিং জমজমাটের উদাহরণটা আরও টাটকা। অলরেডি একটা হাফদীর্ঘ সংলাপ বলা হয়ে যাওয়ার পর দম না নিয়ে ফেলুদা বলে চলেঃ 

"কাজেই কেন আমি আমার নৌকো দিয়ে আপনার বোড়েকে না মেরে বৃথা সময়নষ্ট করে আপনার ঘোড়াকে আক্রমণ করছি সেটা তো খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি বুঝবেন না।"

এইরকম করে কোনও সুস্থ লোকে কথা বলে না সে যুক্তি যদি তুলেও নিই (একটু আগেই রক্তমাংসের নিয়ে এত সংলাপ দিলাম যখন। আমার ‘সুস্থতা’র সংজ্ঞার মোল্ডে ফেলুদা ফিট করবেন না। একে প্রতিভাবান তায় শীর্ষাসন করেন), অন্য একটা অসুবিধে ঘটে বলে আমার বিশ্বাস। আনাড়িদের কথা ছেড়েই দিন, ঘাগু অভিনেতাদেরও এত লম্বা সংলাপ টানা বলতে গেলে হয় মোনোটোনে (স্বস্তিকার ক্ষেত্রে) নয়তো সুর করে (টোটার ক্ষেত্রে) বলা হয়ে যায়।

আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক চুল চিরে ফেললাম। কী করব, বড় নরম জায়গা।

লাস্টে একটা কথা শুধু বলে যাই। প্রতিক্রিয়া নয়, গভীরগোপন ব্যক্তিগত অনুভূতি। একটি চেনা লোক। দেখতে শুনতে ঠিকঠাক, মনটাও ভালো। খাওয়াশোওয়া বাদ দিয়ে এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাকটিভিটিতেও উৎসাহী। পাহাড়পর্বতে বেড়াতে যেতে ভালোবাসে। ছবি তুলতেও।

তার অ্যালবামে, যা ভাগ্যিস পাবলিক করা থাকে বলে ফেক থেকেও দেখা যায়, একটা ছবি প্রতিটি ট্রিপে কমন থাকে। একটি সেলফি। কোমরে হাত দিয়ে‌ বুক চিতিয়ে তোলা। সেই সেলফিতে সে থাকে আর পেছনে, জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা বোর্ড, 'এনট্রি রেস্ট্রিকটেড'।

চিড়িয়াখানার জালে নাক ঠেকিয়ে বাঘের চোখে চোখ মিলিয়ে কম্পিটিশনরত ফেলুদার দৃশ্যটা বারংবার সেই লোকটার কথা মনে পড়াচ্ছে।

এত মনোবেদনা জীবনে কম পেয়েছি।

Comments

  1. 3 te series er modhye kontar opor lekha shob theke beshi hobey, sheta bojhar jonno Goyenda hobaar dorkar nei :)

    Eken dekhini...baki duto niye shompurno ekmot.
    Mahabharat ta ekdomi "ekta mahabharat er style serial killer golpo lekha jaak" mone hoyechhilo pore. Dekheo shetai mone holo...

    Aar tarpor Feluda. ..ki aar bolbo..Srijit er cinema ami chesta kori bhalo lagate...cheshta kori bhabte achha dekhina ki baniyechhe....kintu aajkaal praye shib director der modhyei dekhi " Ami XYZ, eta amaar signature style" ei bhaab ta probol... Ebong ei bhaab ta elei cinema ta aar golpo, shonglap, obhinoyer opor thaake na...hoye jaye directorer style...ekhaneo tai hoychhe...aar etai amaar shob theke probelm laage...


    Jodio ei 3 ter part na...kintu Aparajito dekhechho?ota dekhe borong amaar bhalo legechhe...okhanei 2/1 jaigae anik Dutta nijeke Anik Dutta dekhate charen ni..kintu tao..cinema ta dekhe ek line o notun tothyo amra janbo na...kintu ontoto ekta fan tribute bole mene neya jaye

    ReplyDelete
    Replies
    1. সিগনেচারের ব্যাপারটা ঠিকই বলেছ। ওই সিগনেচারের জন্যই অনীক দত্ত-এ আমার একটু কেমন কেমন আছে। তবে নাগালে পেলে দেখব। রুচির ওপর বিশ্বাস আছে এমন একজন আবার আমাকে বললেন অপরাজিত-র থেকে অভিযান (নতুন) তাঁর ভালো লেগেছে। ওটাও দেখব চান্স পেলে তাহলে।

      Delete
  2. Ar bolo na. Homework korar moto kuthe kuthe feluda dekhar cheshta korlam. Bibidho background music, birupakkho babur ashchorjo pujo pandal sulobh bari, rajen rayna ebong tar heroine er rogroge prem jatiyo nanan khutkhutani periye jokhon dekhlam long shot e feluda, jatayu ar topsher height ek, TV ta bondho kore ditei holo.

    Mahabharat Murders er lekhok er chorom daanponthi rajneetir jonyo ota dekhbo naa-i thik korechilam. Bhaggish tumi details e review ta diye dile. Bishesh kichu miss korini mone hochche.

    ReplyDelete
    Replies
    1. 😄😄😄 আমি খুব মাইন্ড ওভার ম্যাটার করে গ্রেট বং-এর থেকে অর্ণব রায়কে আলাদা রাখার চেষ্টা করি, বিম্ববতী। না হলে আমারও একই সমস্যা হত। চেষ্টা করি, কারণ ভদ্রলোকের প্রতি কেন যেন আমার এখনও অল্প অল্প আশা আছে। ওই রাজনীতির ব্যাপারটা সত্ত্বেও।

      তোমার কথা শুনে যে ব্যাপারটা আমি লিখতে গিয়েও লিখিনি, সেটা লিখি। আমার ধারণা টোটাকে সামহাউ বেশি করে অ-ফেলুদাচিত/ অনাকর্ষণীয় দেখানো হয়েছে সিনেমাটাতে। ওই যে খুঁড়িয়ে হাঁটার সময় অল্প পেছন থেকে ফেলুদাকে দেখানো, জাস্ট নো।

      Delete
  3. সত্যি বলতে পুরোটাতেই সৃজিতের পাকামোটা বড্ড অসুবিধে ঘটিয়েছে। চিড়িয়াখানার দৃশ্যটা অন্যতম বলাই বাহুল্য। আর একটা কথা, জটায়ুর আহ্লাদী গলায় কথা বলাটা ভারী অসুবিধে লাগে না?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এহে নাম লিখতে ভুলে গেছি। ভুলেই যখন গেছি গোয়েন্দাগিরির সুযোগটা ছাড়বে কেন?

      Delete
    2. হাহা, সুযোগটা ছেড়েই দিলাম তবে জটায়ুর আহ্লাদীপনায় একইরকম বিরক্ত হয়েছি। ওটা একেনবাবুর রেমন্যান্টস। একেনবাবুতে বসে শোনা যাচ্ছিল না।

      Delete
  4. অনেকদিন বাদে অবান্তর খুললাম। ফেলুদা সিরিজ শেষ করতে পারলাম না। এই পরিচালক ভদ্রলোকের সিনেমা আজকাল আর বসে দেখা যায় না, যত্নের অভাব বড় প্রকট।
    হৈচৈ নাকি টিকটিকিরও রিমেক করে ফেলেছে।ভাবা যায়!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আসলে কাজের চাপ বেড়েছে সম্ভবত। হইচই-এর টিকটিকি আমি দেখেছি যথারীতি। শুধু রিমেকই করেনি, লাস্টে মৌলিকত্ব দেখিয়েছে। এর এক পার সেন্ট কনফিডেন্স যদি আমার থাকত।

      Delete
  5. এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আপনার সঙ্গে মতামত মোটামুটি মিলেছে। তবে মহাভারত মার্ডার্স এর ক্ষেত্রে যে দুটো বড় সমস্যা, খুনির পরিচয় বলার পর যথেষ্ট সময় না দেওয়া, আর শেষের দিকে গুরুত্বপূর্ণ সাবপ্লট ঢোকা, এই দুটোই আমার মতে সিরিজের ক্ষেত্রে বইয়ের থেকে বেশি প্রকট। মানে বই পড়ার সময় আপনি চাইলে যে কোনও জায়গায় বইটা বন্ধ করে চোখ বুজে ভাবতে পারেন, কিন্তু সিরিজ পজ করে ভাবার ব্যাপারটা ঠিক হয়না।

    একেনের বিষয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। আপনি যদি গোয়েন্দা হন, আর আপনাকে যদি একটা মানুষের খুনের তদন্ত করতে বলা হয়, তাহলে কি আপনি একবারও তার ছবি দেখতে চাইবেননা? তাকে আপনার সহকারীর মতন দেখতে শোনার পরেও? আমি ঐখানেই আটকে গেছি। তাছাড়া দার্জিলিং এ বসে একটা ইমেল পড়ে দুঘন্টার মধ্যে বাঁকুড়ায় ইমেল-এর সেন্ডারকে খুন করানো হয়তো ভিটো কোর্লিওনের পক্ষেও অসম্ভব হত।

    সৃজিতের এই "সিগনেচার আঁতলামো" আর নেওয়া যাচ্ছেনা। আর বিশ্বাস করুন, আমি এই ফেলুদাকে পছন্দ করতেই চেয়েছিলাম (সব্যসাচীকে ভালবাসি, কিন্তু বয়সটা আর ভুঁড়িটা মেনে নেওয়া যাচ্ছিলনা), কিন্তু ওই হলদে রঙের আলো, আর সবাইকার একবার করে বরুন চন্দকে ছুরি মেরে যাওয়া - ব্যাপারটা আর সিরিয়াস থাকেনা। শুধু কাস্টিং দিয়ে কি হয়? এই সেদিন কাকাবাবু দেখতে গিয়ে দেখি, জঙ্গলের মধ্যে হোটেলে কাকাবাবু চটি পরে ঘুরছেন। সুনীলবাবু গল্পে পইপই করে বলে গেছেন কাকাবাবু বুটজুতো ছাড়া কিছু পরেননা, পাব্লিকলি তো নয়ই। সেটা কি পরিচালক পড়ে দেখেছিলেন? আর তাছাড়া একেনবাবু আর ফেলুদার একই লোকেশন, একই ঝাউবন, সেই বাড়ি, হাবিব মল্লিক, এমনকি আমার তো একবার মনে হল মহাভারত মার্ডার্স-এর ক্লাইম্যাক্সটাও ওই বাড়িতেই। ফিরে গিয়ে যাচাই করার সাহস হয়নি। এসব করে পয়সা রোজগার হয়তো হয়, মহৎ কোনও শিল্প হয়না।

    শেষে দুটো কথা। প্রথমত আপনার লেখা খুনের গল্প তো পড়লাম। দারুন লাগল। টেলিছবি বানানোর পক্ষে আদর্শ মেটিরিয়াল। দ্বিতীয়ত, ওই যে পাহাড়ে বেড়ানো ভদ্রলোকের কথা বলছিলেন, আমি তাঁর বর্ণনার শুরু দিকটা পড়ে নিজেকে ভেবে নিয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিলাম। শেষের দিকটা পড়ে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছি (তাও পুরোটা নয়)।

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিশ্চিন্ত থাকুন। ভয়ের কিচ্ছু নেই। আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে, ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে দূর থেকে ক্ষুরে ক্ষুরে।

      একেনের ব্যাপারটা মোক্ষম ধরেছেন। আমি ব্রেন অফ করে দেখতে বসি এসব তাই এত খুঁটিনাটি খেয়াল করি না।

      মহাভারত মার্ডারস-এর প্রসঙ্গেও একমত। আমি বইটার ঘোরপ্যাঁচ ভুলে গেছি, কিন্তু সিরিজটা যে কয়েকটা গোলমাল পাকিয়েছে যা বইতে ছিল না, সেটার একটা ফিলিং হচ্ছিল। সে জন্যই প্রতিক্রিয়াটা স্ট্রিক্টলি সিরিজের। (ওই মহাকাব্য আরোপ করার ইস্যুটা ছাড়া, ও সমস্যা গল্পেরও)।

      এবার ওই মহৎ শিল্পের ব্যাপারে আসি। ওসব তো ছেড়েই দিন। সে না হয় আমরাও মহৎ দর্শক কিছু না, আমাদের জন্য এই সব জুভেনাইল গোয়েন্দাগপ্প ঠিক আছে। কিন্তু আপনি আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করেছেন, "সিরিয়াস"। অমহৎ শিল্পও সিরিয়াসলি করা যায়, যেটা হচ্ছে না। ফেলুদা, বিশেষ করে এই ব্র্যান্ডের ফেলুদার সিনেমার সঙ্গে সিরিয়াসনেসের কোনও সম্পর্ক নেই। গোটাটাই হোমাজ। গোটাটাই পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব একটা জেনারেশনের নস্ট্যালজিয়ায় সুড়সুড়ি। দার্জিলিং-এই ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়েছিল এটা বলার পর তোপসে গড়গড় করে রাধা ডানদিকের বেঞ্চে বাঁদিকের গালে রোদ্দুর ইত্যাদি বলে গেল। সেটা কি বর্তমান সিনেমাটার প্রতি কোনও দায় থেকে? উঁহু। গোটা দায়টা ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গল্পটা যারা মুখস্থ করে রেখেছে, এই আমি আপনি, তাদের ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং দেওয়ার। দার্জিলিং জমজমাট-এর প্রতি সিরিয়াস কমিটমেন্ট থাকলে এ রকম কেউ করে না। ওখানেই অর্ধেক গোলমাল বেধে আছে।

      Delete
  6. Feludar Goendagiri dekhlam. Apnar sathe ekmot. Srijit er ei roktomangsher goenda bananor project ta motei bhalo laagena. Kakababur khetreo halka rasikota Santur sathe jeta kokhonoi character er sathe jai na. AAr ei Feluda ke shudhu sajiyechhe Feludar moto. Kintu ekdam manaini. Amar chheleo bollo je kothai sei depth Feludar chokhe ba personality te. Seta missing. Amar o mone hoyechhilo. AAr Lalmohan babu erokom khaja bhanr thik non. Lalmohan babuke boroi boka legechhe. Onar je sohojato rosbodh seta ekdam anuposthit.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরে বাবা সুস্মিতা, কাকাবাবু নিয়ে আমার পেটে গজগজ করছে নালিশ। চেপেচুপে রেখেছি। কোনদিন বেরিয়ে পড়বে। নতুন সিনেমার কাকাবাবুর, প্রতিটি, প্র-তি-টি চরিত্রকে খারাপ লাগে। বাস্তবে এঁদের সামনে পড়লে কেঁদে ফেলতাম নির্ঘাত। লালমোহন শুধু চেহারায় মিলেছেন, বাকিটা ফেক।

      Delete

Post a Comment