অ্যানি আর্নো


অ্যানি আর্নো নোবেল পাওয়ায় সেই জরাজীর্ণ বিতর্কের ল্যাজে আবার ক্ষীণ সাড়া। আত্মজৈবনিকতা কি সহি সাহিত্য? একজন মহিলা স্রেফ নিজের কামনাবাসনা, নিজের বাবামা, নিজের শৈশব নিয়ে হেজিয়ে নোবেল বাগিয়ে ফেলাতে অনেকেই বিচলিত। চমকাইনি। বউঠানের স্মৃতিকথা গ্রামভারি পত্রিকায় ছাপা হয়ে গেলে প্রাবন্ধিক দেওররা চিরকালই টাল খেয়ে যায়।

বরাভয় দিতে এক লেখক নেমেছেন দেখলাম। চেখভ থেকে তলস্তয় থেকে সার্ত্রে থেকে শুরু করে রুশদি পর্যন্ত লেখকদের (মহাশ্বেতা, আশাপুর্ণার হয়ে তদবিরের ব্লাসফেমি বাদই দিলাম কিন্তু ভার্জিনিয়া উলফ, সিলভিয়া প্লাথ, আরসুলা কে এল গুইন-এর নামও - এমনকি নোবেলবঞ্চিত দের লিস্টেও - কখনও জায়গা পায় না) উদাহরণ দিয়ে দুধ কা দুধ, পানি কা পানি করেছেন। কই, এঁদের তো প্রাতঃস্মরণীয় হতে নোবেল লাগেনি? সার্ত্রে তো পেয়েও নোবেলের মুখে লাথি মেরে চলে এসেছিলেন। আর বছরবছর পাইকারি দরে যারা নোবেল পাচ্ছে (যেমন, এ বছরের প্রাপিকা) তাদের নামও আমরা জানি না। কেউ জানবে না কোনওদিন। নোবেল প্রুভস নাথিং। আর্নো নোবেল পেলেও চেখভ তো আর হচ্ছেন না, কাজেই চাপ নেবেন না।

কেউ বললেন, যাই পড়ে দেখি যোগ্য কি না। কেউ নোবেল সত্ত্বেও আর্নোকে না পড়ে দেখার অবিচলতায় শ্লাঘা প্রকাশ করলেন। কেউ পড়ে বললেন, ছি ছি, এর থেকে বাংলায় কত ভালো লেখা হয়েছে, কেবল বাঙালি বলে আমাদের কেউ নোবেল দিচ্ছে না।

বলা বাহুল্য, এ সব প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে অ্যানি আর্নোর নোবেলের কোনও সম্পর্ক নেই। ফ্ল্যাশ ফ্লাড আর বাঙালির ধনতেরাস পালনের গেল গেল রবের মাঝের ফাঁক ভরানোর আছে। যদি না এর মধ্যে কেউ বাঘের গলায় মালা, বেসুরো রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া, পরপুরুষের সঙ্গে বারান্দায় হাত ধরে নাচা লেভেলের কিছু করে বসে।

আত্মজৈবনিকতা-টিকতা নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। যার যা নিয়ে ইচ্ছে করবে লিখবে। ভালো হচ্ছে নাকি সেটাই আসল কথা। হ্যাঁ, হায়ারার্কি থাকবে। ওটা পার্ট অফ দ্য গেম বলে মেনে নিতে হবে। নিজের শৈশবের গল্প লিখলে হাততালি কম পড়বে। বালিগঞ্জের ক্যাফেতে বসে সাঁওতালদের নিয়ে লিখলে বেশি পড়বে। কিন্তু হাততালি নিয়ে মাথা ঘামালে লেখাটেখার আগে লেখকের অন্য কাউন্সেলিং দরকার।

অ্যানি আর্নোর নোবেল জয়ে আমি আপ্লুত। আগের বছরই নোবেলের দৌড়ে ওঁর পালে হাওয়া জোর ছিল, সবাই সিম্পল প্যাশন হাতে নিয়ে ছবিটবি দিচ্ছিল, সেই তালে বইটা পড়ে ফেলেছিলাম। এবং হড়কে গেছিলাম। চেনা কিছু লোককে ঝুলোঝুলি করে পড়িয়েওছিলাম। আমার সন্দেহ, তাঁদের আমার মতো কাছাখোলা ভালো লাগেনি। স্বাভাবিক। শিল্প তো রসগোল্লা নয় যে সকলেরই ভালো লাগবে। বেতের বাড়িও না যে সকলেরই খারাপ লাগবে।

বাক্যটা শেষ করারও আগে রসগোল্লাবিরোধী অন্তত পাঁচজনের নাম মনে পড়ল। বেতের বাড়ির দামও শুনেছি কোনও কোনও আনন্দের বাজারে চড়া।

যাকগে মরুকগে।

এমনিও পুনর্পাঠের প্ল্যান ছিল, নোবেলজয়ের খবর পেয়ে আবার সিম্পল প্যাশন পড়লাম। আবার চিন্তা হল, আমার দ্বারা এমন কবে হবে। নির্ঘাত হবে না। চানাচুর খেলাম। 'A Man's Place' পড়া ছিল না, ধরলাম। আজকালের মধ্যে শেষ হবে, আর্নোর বাকি বইদের মতো এটিও তন্বী। পড়তে পড়তে কয়েকটা প্যারাগ্রাফ চোখে পড়ল।

"A while later I started writing a novel in which my father was the main character. Halfway through the book I began to experience feelings of disgust.

I realize now that a novel is out of the question. In order to tell the story of a life governed by necessity, I have no right to adopt an artistic approach, or attempt to produce something ‘moving’ or ‘gripping’. I shall collate my father’s words, tastes and mannerisms, the main events of his life, all the external evidence of his existence, an existence which I too shared.

No lyrical reminiscences, no triumphant displays of irony. This neutral way of writing comes to me naturally, it is the very same style I used when I wrote home telling my parents the latest news."

এই যে রেমিনিসেন্স ছাড়া, আয়রনি ছাড়া, লিরিক্যালিটি ছাড়া লেখা - এটা যে শুধু আমাদের শেখানো হয় না তাই না, উল্টে লংকাপোড়া দিয়ে সিস্টেম থেকে ঝেড়ে দেওয়া হয়। স্কুল কলেজে, আমার সন্দেহ ইউনিভার্সিটিতেও, "ভাষা" দিয়ে লেখার প্রতি পক্ষপাতিত্ব থেকেই যায়।

প্রত্যাশিত ডিসক্লেমার। ভাষা দিয়ে কারও ইচ্ছে হলে লিখতেই পারেন। লিরিক্যাল লেখার জয়পতাকা চিরদিন উড়েছে, যোগ্য কারণেই। ও লেখা সহজ কাজ নয়। কোনও ভালো জিনিসই সহজ না। ঠিক যেমন নিজের জীবনের ঘটনা ভ্যানতাড়াহীন লিখে গেলেই কেউ অ্যানি আর্নো হয়ে যায় না। প্রতিভা এবং সাধনা, দুই না থাকলে ওই উচ্চতা আরোহণ করা যায় না।

আমি বলছি আমাদের মাথার ভেতর একটা হায়ারার্কি আছে যে ভাষা দিয়ে লিখলে সেটা ভালো লেখা, না হলে নয়। ভাষার সঙ্গে এই জীবনভরের কুস্তির গোড়াপত্তন হয় স্কুল থেকে। রথের মেলা রচনায় যে ছাত্র কী খেলাম, কী দেখলাম, কী কিনলাম লিখে আসে, অর্থাৎ একটি মেলার যথাযথ বর্ণনা যে দেয়, তার থেকে বেশি নম্বর পায় সে যে মেলা দেখে মনে জাগা যাবতীয় মহৎ ভাবের ফিরিস্তি দেয়, রোজকার ভাষার একশো আশি ডিগ্রি দূরত্বের ভাষায়। এই করতে গিয়ে লেখার বেসিক নিয়মকানুন, বাঁধনছাঁদন শেখানোর সুযোগ সম্পূর্ণ বইয়ে দেওয়া হয়। 

অ্যানি আর্নোর নোবেল নিয়ে পোস্ট দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু ওই তিনটে প্যারাগ্রাফ আমাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিল আর্নোর লেখার কোনখানটা আমাকে টেনেছে। লেখাকে "লেখা" হয়ে ওঠার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন উনি।

পুরস্কারটুরস্কারের অনেক পলিটিক্স, সবাই জানে। পাড়ার স্পোর্টসে সান্ত্বনা পুরস্কার  থেকে নোবেল, কিছু দিয়েই কিছু প্রমাণ হয় না। দায়ই বা কী? তবু এও সত্যি, নোবেলের হাওয়া না উঠলে অ্যানি আর্নোর নাম আমার অজানা থাকত। পাঠকজীবনের এক অমূল্য অভিজ্ঞতাও।

জয় নোবেল। জয় অ্যানি আর্নো।

Comments

  1. Daarun laglo. Thank you. Aapnar sathe sompurno ekmot. Jar ja bhaalo lage, tai e lekha uchit. Aar bhashar byapartao puropuri sotti.

    Jaakge, ei weekend e definitely boita poRe phelchi. aami actually nobel, booker shunle normally bhoy pai poRte. Tobe eta poRbo nishchoi.

    Ekdin ekta post likhun na? bangali lekhokder, lekhikader hole aaro bhalo, atmojibonimulok lekha ja apnar bhalo legeche? besh darun hobe, na?

    khub bhalo thakben..

    Indrani

    PS pujo bhalo kateni shune ektu kharap laglo. aami record bhenge ei pujoy 3te thakur dekhechi, anandamelay shirshendur uponyas poRechi.. bhalo kore kaaje phnaki diyechi... daarun upbeat feel korchi ei niye.. :) :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার দ্বিতীয় প্যারার প্রসঙ্গে বলি ইন্দ্রাণী, নোবেল বুকার অ্যাকচুয়ালি তুলনামূলকভাবে কম দাঁতভাঙা সাহিত্যরাই পায় বলে আমার বিশ্বাস। কড়া লেখক/পাঠকরা ওসবকে নিচু চোখে দেখেন। আমি তো পুরস্কার পাওয়া বই লুকিয়ে পড়ি। ভয় পাওয়ার কোনও কারণই নেই।

      তৃতীয় প্যারাঃ মারাত্মক খাটনির কাজ। শারীরিক এবং মানসিক খাটনি। রিটায়ারমেন্টের আগে টাইম পাব বলে মনে হচ্ছে না।

      তি-ন-টে-এ-এ-এ???? আমি নেক্সট বছর চারটে ঠাকুর চর্মচক্ষে দেখবই দেখব। চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্টেড। শীর্ষেন্দু, কাজে ফাঁকি - সমস্ত নিয়মকানুন নিষ্ঠাভরে পালন করে এ বছরের পুজো কাটিয়েছেন দেখছি। মাদুর্গা তো আশীর্বাদ দেবেন গ্যারান্টি, আমিও কোলাকুলি পাঠালাম।

      Delete
  2. Amar jana chilo na eta.. dekhbo ebar kichu puroshkar pawa boi try kore.. thank you

    Simple passion kal poRe phelechi.. khub e bhalo laglo.. khali kemon jyano mone holo, sob bodh hoy bujhlam na.. lekha toh khub bhalo lagloi.. identify o korte parlam kichuta.. aaro boi poRe dekhbo

    Durgapujo related comment ta poRe khub haschilam.. aami asole durgapujor bhiR etc khub ekta bhalobasi na.. tai tinte pujo dekhe phele gorbo korchilam.. :) boyes hoye jacche bolei bodh hoy, ebaar bhalo laglo beriye.. Onekdin por Shirshendu poReo aram pelam..

    khub bhalo thakben

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইন্দ্রাণী, আমার অনেকসময় ওই সব বুঝতে না পারা ব্যাপারটাও বেশ ভালো লাগে। কবিতা পড়তে গেলে যেটা হরদম হয়। তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে দিলে হাত তুলে দেব কিন্তু একটা ভালোলাগার ফিলিং থেকে যাবে।

      অবান্তর কথা থাক। আপনি যে উদ্যোগ নিয়ে সিম্পল প্যাশন পড়ে ফেললেন সে জন্য হাই ফাইভ। আপনিও ভালো থাকবেন।

      Delete
  3. দারুণ লিখেছেন🙏

    ReplyDelete
  4. আমার বিশ্বাস লেখা লিরিকাল নন-লিরিক্যাল যাই হোক না কেন আঠালো হতেই হবে, ইটা যার আসে গ তার সব কিসুই আসে | আমি কলেজকালে Coetzee র disgrace পড়েছিলাম, কি জানি কেন এতো দুঃখ সহ্য করতে পারিনি, কিন্তু বইটা ফেলতেও পারিনি - হুড়মুড় করে পড়ে ফেলেছিলাম| আমার ঘি তেল ছাড়া রান্না হয়না , ওনারা দিব্বি উচ্ছে দিয়ে শুক্তো রেঁধে দেন, আর লোকজন হাপুত হুপুত করে খেয়ে নেয়|

    ReplyDelete
    Replies
    1. এইটা একঘর বলেছেন, হীরক। ডিসগ্রেস-এর উদাহরণটাও মোক্ষম দিয়েছেন। এত খারাপলাগার জন্ম দেওয়া লেখা একটানে পড়িয়ে নিতে পারাটাই আসল কেরামতি। বেল জার পড়তে পড়তে কেউ উঠে গেছে বলে শুনিনি। অথচ ওই বইটায় আবার হাত দেওয়ার কথা মনে পড়লে ভয় লাগে। সেই একই অনুভূতি আমার পথের পাঁচালী-র কথা মনে পড়লেও হয় অ্যাকচুয়ালি। বলতে গিয়ে সিনেমার নামও মনে পড়ছে কিছু। যতবার দেখছি কেঁদে ভাসাচ্ছি, তবু দেখতে ছাড়ছি না। অদ্ভুত।

      Delete

Post a Comment