তাওয়াং ১: গুয়াহাটি



খোঁজ শুরু করেছিলাম, যেখান থেকে সমস্ত বেড়াতে যাওয়ার খোঁজই শুরু করি, সরকারি টুরিজমের সাইট। কৌটিল্য মার্গের অরুণাচল ভবনে ফোন করলাম। আপনাদের দেশে বেড়াতে গেলে শুনছি কী সব ইনার লাইন পারমিট লাগে? জোগাড় করতে ভোর ক’টা থেকে লাইন লাগাতে হবে যদি জানান।

সরকারি প্রতিনিধি উদাত্ত হাসলেন। লাইনটাইন কী বলছেন ম্যাডামজী? জমানা বদলে গেছে জানেন না? সব অনলাইন মিলতা হ্যায়।

সরকারি অসহযোগিতা এবং বদব্যবহারের কত গল্প শুনি, কেউ নাকি খেঁচিয়ে ছাড়া কথা বলে না, আমার উল্টো অভিজ্ঞতা। আগে ম্যাডাম, পিছে ম্যাডাম। ম্যামে আমার যত গা-জ্বালা, ম্যাডামে তিলমাত্র না। যত ক্রেডিটকার্ড গছানেওয়ালারা ম্যাম ম্যাম করেন, সরকারি লোকজন গছানোর বিজনেসে নেই, উল্টে তাঁদের কাছ থেকে কিছু আদায় করতেই ঘর্মাক্ত। সব পক্ষই। আমি ঘামতে ঘামতে বলি, থোড়া জলদি কর দিজিয়ে ভাইসাব, তাঁরাও, আরে ম্যাডামজি, সমঝনে কি কৌশিশ কিজিয়ে, বলতে বলতে টাক মোছেন (খোঁপাও প্রচুর হয়, টাকের উদাহরণটা দেওয়ার জন্য দেওয়া)। 

ইনি অবশ্য তেমন কিছু বলেননি। বেড়াতে যেতে চাই শুনে বরং খুশি হলেন। বহোৎ বঢ়িয়া ম্যাডামজি, আপ ইস নম্বর পে ফোন কর লো। বলে একটা মোবাইল নম্বর দিয়ে ফোন কেটে দিলেন।

সরকারি-স্কেপটিকরা লাফিয়ে পড়বেন। অ্যায় তো। তখন টেবিল থেকে টেবিলে ঘোরাত, এখন ফোন থেকে ফোনে ঘোরাচ্ছে। দ্বিতীয় নম্বরের ওপারে এক ভদ্রলোকের সজ্জন গলা, প্রচণ্ড চ্যাঁভ্যাঁর মধ্যে প্রায় চাপা পড়ার জোগাড়। নির্ঘাত রাজীব চৌকে মেট্রোর লাইনে ধাক্কাধাক্কি করছেন। বললাম, বেড়াতে যাব।  আমি হলে হাইলি বলতাম, যাবেন তো যান না, আমাকে জ্বালাচ্ছেন কেন। উনি আমার পঁচিশটা 'ইয়ে' আর সাতাশটা 'মানে' সংবলিত চরম অগোছালো বক্তব্য, তাও নির্মম হিন্দিতে, উইদাউট ইন্টারাপশন শুনলেন, তারপর চার রাত পাঁচ দিনে গুয়াহাটি-দিরাং-তাওয়াং-বমডিলা-গুয়াহাটি সারার উচ্চাশা শুনে পরামর্শ দিলেন টুর অপারেটরদের সাহায্য নেওয়ার। এ অসাধ্যসাধন সিভিলিয়ানদের পক্ষে অসম্ভব। ইন্টারনেটের সমুদ্রে অপারেটর খুঁজতে বেরোব কোথায়? বেরোলেই যে ভরসাযোগ্য অপারেটর পাব সে গ্যারান্টিই বা কোথায়? উত্তর দিতে ভদ্রলোকের গলা কেঁপে গেল, যেন পাঁজরে কেউ কনুই দিয়ে জোর গুঁতিয়েছে। সাইট পে অপারেটরস কা লিস্ট হ্যায় না। হ্যায় বৈকি। আমিও দেখেছি। কিন্তু সে সাত পাতা লম্বা। আমার ধান্দা ছিল ভদ্রলোককে আরেকটু খাটিয়ে শর্টলিস্ট বানিয়ে নেওয়ার। বললাম, আপনি কয়েকটা ভরসাযোগ্য নাম সাজেস্ট করুন না। ওপারের গোলযোগ চতুর্গুণ হল। হয় ট্রেন ঢুকেছে, নয়তো বোমটোম ফেটেছে। তার মধ্যেই গলা সপ্তমে তুলে ভদ্রলোক চারজন অপারেটরের নাম বলে দিলেন। নুয়ে পড়া কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, দরকার হলে আবার ফোন করার ইট পাতলাম আর ওদিকে জরুর, ম্যাডামজি, যব আপকি মর্জ্,… বলতে বলতে ফোন কেটে গেল। আশা করি ভদ্রলোক সুস্থ আছেন।

অরুণাচল প্রদেশ যাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। শুরুতে পাল্লা বেঁকে ছিল ওড়িশার দিকে। ঝেড়ে কাশলে, পুরী। বাবা পুরীর সিজন টিকিট কাটা ধরেছেন সত্তরে পৌঁছে, বেয়াল্লিশেই সে প্র্যাকটিসে নামতে আমার আপত্তি। ভিতরকণিকার রফা হল। সিমলিপালও হতে পারত, হল না কারণ ভিতরকণিকা থেকে লাস্ট দিন পুরীর বুড়ি ছুঁয়ে আসা যাবে, সিমলিপাল থেকে যাবে না। তারপর গোলেমালে নজর ঘুরল পশ্চিমবঙ্গের দিকে। বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ ঘুরে ইত্যাদি। মর্ষকাম মজ্জায় ঢুকেছে, দোলের বাজারে শান্তিনিকেতনের নাম মাথায় এল। সঙ্গে বিষ্ণুপুর জুড়ে নেব। দুর্গাপুর এয়ারপোর্টে নেমে শুক্রবার রাতেই গাড়ি ধরে চলে যাব, শনি রবি চাঁদিফাটা রোদ্দুরে রাসমঞ্চ ঘুরে, দলমাদল জাপটে ছবি তুলে সোমবার চলে আসব পুণ্যতীর্থ শান্তিনিকেতন, বেসুরো মাতালদের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে খুব বাঙালিয়ানা হবে।

বিধাতা বাঁচালেন। বা বিস্তারা। প্রচুর পয়েন্ট জমেছে। রাউন্ড ট্রিপ না হলেও একটা দিক দুজনের ফ্রি হয়ে যাবে। ক্যাচ একটাই, বিস্তারা-র দিল্লি-দুর্গাপুর ফ্লাইট নেই। দিল্লি-কলকাতা আছে আর কলকাতা হয়ে বিষ্ণুপুর শান্তিনিকেতন যাওয়া যায় কিন্তু কলকাতা গেলে বেসিক্যালি বাড়ি যাওয়া হবে। আর বাড়ি গেলে বেড়ানো হয় না এককোটি বার প্রমাণ হয়েছে। আমাদের দরকার বেড়ানো। তাওয়াং অর্চিষ্মানের অনেকদিনের ইচ্ছে।  অর্পণ ঠিকই আন্দাজ করেছে, ও সব দিক তেজপুর এয়ারপোর্ট হয়ে যাওয়াই সুবিধে। কিন্তু বিস্তারা তেজপুর যায় না কাজেই গুয়াহাটি হয়েই যেতে হল।

ভদ্রলোকের সাজেস্ট করা চারটে এবং তাদের বাইরেও লিস্ট ধরে ধরে অপারেটরদের যোগাযোগ করলাম। আমাদের ঊর্ধ্বশ্বাস আইটিনেরারি শুনে অধিকাংশই উত্তর দিলেন না। অ্যাকচুয়ালি, আরও খারাপ করলেন। বললেন, হোয়াটসঅ্যাপে ভেজ দিজিয়ে, দেখছি। তারপর দেখলেন না। আরেকজন তো আরও সরেস। যাত্রাপথ পাঠিয়ে লিখলাম, যদি এমন একটা ভ্রমণের ব্যবস্থা আপনি করে দিতে পারেন তো বাধিত... পুরো মেসেজ হোয়াটসঅ্যাপে টাইপ করারও সময় পাইনি, সপাট উত্তর এল। উই ডু নট ডু সাচ ট্যুরস্‌। পরে অর্চিষ্মান খুঁজে দেখে বলল এঁরা নাকি হেবি হাইফাই, নেটে প্রচুর রিভিউ, প্রভূত স্টার। অধিকাংশই ককেশিয়ান ভ্রমণবিলাসীদের দেওয়া। এঁরা রেসপন্সিবল ট্র্যাভেল করেন এবং সুযোগ পেলেই আমাদের মতো ইরেস্পন্সিবল ট্র্যাভেলারদের কান মুলে দেন। ।

গ্র্যাজুয়েশনের স্ট্যাটিসটিক্স মাস্টারমশাই পাওয়া যাচ্ছিল না। মায়ের অফিসে কাজের চাপ চলছিল মনে হয়, খুঁজতে বেরোতে দেরি হয়ে গেছিল। এঁর ব্যাচ ভর্তি হয়ে গেছে। ওঁর বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে পরপর তিনদিন বলছে, উনি তো এখন বাড়ি নেই। চতুর্থ না পঞ্চম মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি থেকেও রিজেকশন নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। এ রিজেকশনটা মনে হয় বিশেষ রকমের তীক্ষ্ণ ছিল। আমি টের পাইনি, তখন পৃথিবী আর আমার মাঝে আমার সাতচল্লিশ কেজির মা ছিলেন, বদব্যবহারট্যবহার রেনকোটে বৃষ্টি। কিন্তু মা চুপ করে গিয়েছিলেন। রেললাইন পার হয়ে রিকশায় উঠলাম আর মা বলে উঠলেন, আমরা নিজেরাই পড়ে নিই চল সোনা, পারব না?।

মা যখন পারবেন বলছেন আমার কীসের আপত্তি। মা অফিস থেকে ফিরে চোখে সর্ষের তেল ডলে গুণ গুপ্ত দাশগুপ্তের প্রথম চ্যাপ্টার সবে শেষ করেছেন, ফোন এল। প্রথম পছন্দের মাস্টারমশাইয়ের ব্যাচে একটা সিট খালি হয়েছে। ।

সতেরো নম্বর হোয়াটসঅ্যাপ পাঠিয়ে ডিসিশন নিয়ে নিলাম নিজেরাই ঘুরব। লোকে চাঁদে চলে যাচ্ছে আমরা তাওয়াং যেতে পারব না? তাও আবার দোকা? শিরদাঁড়া টান করে বসলাম। দিরাং, তাওয়াং, বমডিলার সরকারি অ্যাকোমোডেশনের লিস্ট খুলে প্রথম নম্বর ডায়াল করে ফেলেছি, রিং হচ্ছে, এমন সময় পিং।

তাওয়াং টুরস বলে একটি অপারেটরের বিজনেস অ্যাকাউন্ট থেকে। পরে জেনেছিলাম সে অ্যাকাউন্টের পেছনের লোকটার - লোক বলা বাড়াবাড়ি, আমার তুলনায় বালক - নাম অগ্নিক গগৈ, তাওয়াং টুরস-এর কর্ণধার। ব্যবসার বয়স আড়াই বছর, আপাতত শুধু তাওয়াং টুরই হয়। উচ্চাশার ছিলা টানটান, তাওয়াং কেন, পাঁচদিনে মঙ্গলগ্রহ কভার করা যাবে কি না জিজ্ঞাসা করলে বলে দেবে, কিঁউ নেহি?

আমাদের মাপে মাপ একটা প্যাকেজ আছে ওঁদের। চার রাত পাঁচ দিনে গুয়াহাটি টু গুয়াহাটি, মাঝে দিরাং, তাওয়াং, দিরাং (অথবা বমডিলা, বৈচিত্র্য চাইলে। আমরা চেয়েছিলাম।) রুট, প্যাকেজে কী কী ইনক্লুডেড কী কী নয়, গাড়ির মেক, প্রতিটি হোমস্টে-র ঘর এবং বাথরুমের ছবি সাঁই সাঁই করে অ্যাকাউন্টে উপস্থিত। অ্যাডভান্স পাঠিয়ে দিলাম। পারমিট ওঁরাই করিয়ে রাখবেন। পাঠাতে হবে আধারের দু'পিঠের স্ক্যান আর একপিস ফোটো, পাসপোর্ট কিংবা সেলফি। দুজনেরই একগোছা পাসপোর্ট সাইজ ফোটো তোলা ছিল স্পষ্ট মনে পড়ছে কিন্তু যে ড্রয়ারে ছিল বলে আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে আর অর্চিষ্মানের আবছা, সেখানে নেই। কাজেই কারি গাছের পাশে বারান্দার ফালিতে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে পাঠালাম। আমার হাস্যময় সেলফি দেখে অর্চিষ্মান হাসির স্মাইলি দিল। যে রকম স্মাইলিতে হাসির চোটে চোখ থেকে নীল রঙের অশ্রু ছিটকে বেরোয়। ওকে বললাম, গোড়াতে গোমড়া মুখের যে ভার্শানটা তুলেছিলাম সেটা দেখলে পারমিট দিতে অস্বীকার করত, হাসিমুখেরটা দেখলে চোখের জল মুছে অন্তত ইস্যু করে দেবে।।

প্রথম দিনের ব্রাহ্মমুহূর্ত থেকে পঞ্চম দিনের এগারোটা ঊনষাট পি এম পর্যন্ত নিংড়ে নেওয়া শেডিউল। গুয়াহাটি থেকে যাত্রা শুরু, অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল। অগ্নিক অপশন দিল সকাল সাড়ে ছ’টা বা সাতটা, যেটায় আপনারা কমফর্টেবল। আধঘণ্টায় আর কত সুখস্বপ্ন দেখব, সাড়ে ছ’টায় ঘাড় পাতলাম। প্লেন গুয়াহাটি ছোঁবে শুক্রবার রাত এগারোটা পেরিয়ে। একবার ভেবেছিলাম গোটা রাত এয়ারপোর্টের চেয়ারে ঘাড় হেলিয়ে কাটিয়ে দেব, তারপর মনে পড়ল আমার বয়স বাইশ নয় যে সারাদিন জেগে সারারাত জেগে পরদিন সারাদিন গাড়ি চড়ে পাহাড়ে চড়ার ক্ষমতা থাকবে। হোটেল বুক করলাম। এ টি ডি সি-র ‘প্রশান্তি’ লজে একরাতের ঘর খুঁজলাম, পেলাম না। আগাপাশতলা বেসরকারি বেড়ানো শুরু হল।

স্মরণীয় অতীতে এত ফাঁকা দিল্লি এয়ারপোর্ট দেখিনি। সিকিউরিটির পর কফি না খেলে পুলিশ ধরে তাই জঘন্য কফি গলাকাটা দাম দিয়ে খেতে হল। টফি হিসেবে অর্চিষ্মান নিল বার্গার, আমি মেদু বড়া। টেক অফ ঘটনাবিহীন, ল্যান্ডিং ঘটনাবিহীন, উবার ডেকে এগারো কিলোমিটার দূরের দ্য রাইনো-তে গিয়ে নামা অল্পবিস্তর রোমহর্ষক। গন্তব্যে পৌঁছে মিহিদুল বললেন, যদি খারাপ না পান, আমার একখান বুকিং আছে। বলে ঘুটঘুটে নিউ এয়ারপোর্ট রোডে ঘুটঘুটে দোতলা বাড়ির তালাবন্ধ দরজার সামনে নামিয়ে দিয়ে হাওয়া হলেন।

খারাপ না পাওয়া-র লব্জটা মা শিখেছিলেন ধুবড়ি গিয়ে এবং প্রম্পটলি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। কিছু কিছু প্রবাদের ক্ষেত্রে বাংলা অন্য ভাষার তুলনায় পিছিয়ে। যেমন কাঠখড় পোড়ানো, পাঁপড় বেলার ধারেকাছে আসে না। আক্ষরিক বা আলংকারিক কোনও অর্থেই কাঠখড় কোনওদিন পোড়াইনি তাই ব্যাপারটার স্ট্রাগলের মাত্রা সম্পর্কে আইডিয়া নেই। খালি মনে হয় একটা লোক নিভু নিভু কাঠ আর খড়ের গাদার সামনে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে। পরিশ্রমের থেকে বিরক্তিটাই বেশি। এদিকে পাঁপড় বেলা বললেই মোটাসোটা, নিপাট ভদ্র এক মহিলা কোমরে আঁচল গুঁজে দুপুররোদে ছাদে বসে পাঁপড় বেলতে শুরু করেন, গোটা দৃশ্য থেকে হাঁসফাঁস, গলগল, আইঢাই উপচে পড়ে। তেমনই, কিছু মনে করবেন না-র তুলনায় খারাপ পাবেন না একশোগুণ এফেক্টিভ। ও লব্জ শেখার পর আমরা 'কিছু মনে করিসনি তো সোনা', কিছু মনে করলে নাকি মা' জাতীয় বাক্যগঠনে বিশ্বাস করতাম না। বলতাম, খারাপ পাস/পেয়ো না যেন আবার।

ও রকম খাঁ খাঁ চত্বরে হোটেল হলে আমরাও দরজায় তালা দিয়ে রাখতাম। যতক্ষণ না ভেতরের লোক এসে তালা খুললেন, আরেকটা গাড়ি, যে মনে হয় রাতে হোটেলেই থাকবে, মিহিদুলভাইয়ের মতো সটকাবে না, আমার আর অর্চিষ্মানের হাঁটুর আধ ইঞ্চি দূরে এসে দাঁড়িয়ে গ্যাঁ গ্যাঁ করে হর্ন বাজাতে লাগল। সহবত জিনিসটা সুলভ নয়।

অসমে যদিও দুর্লভ নয়। যদিও অসমের কয়েকজন ভদ্রলোক আমাকে জানিয়েছেন, অনেক বছর আগে এই অবান্তরের পোস্টের কমেন্টেই, যে অসমিয়ারাও নাকি তেরিয়ে কথা বলেন, স্পিড পছন্দ না হলে ধাঁই ধাঁই বাস পেটান। ভদ্রতাবশে "তাই বুঝি?" বলেছি বটে কিন্তু খুব যে বিশ্বাস করেছি তা না। রাইনো-তে ঢুকে সে বিশ্বাস গাঢ় হল। অতি মৃদু ব্যবহার। অত রাতেও গরম জল থেকে টিভির রিমোটের প্রতিটি বাটনের ব্যাখ্যা, সবটাই কেকওয়াক।

কেবল চেক ইন-এর সময় ভদ্রলোক, আমরা দুটো আলাদা আলাদা বিছানাওয়ালা রুম প্রেফার করব কি না সবিনয়ে জানতে চাওয়াতে অর্চিষ্মান থতমত খেয়ে গিয়েছিল, আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে “হোয়াটেভার” বলে ম্যানেজ দিলাম।

সকাল সাড়ে ছ’টায় পঙ্কজের নিতে আসার কথা। এ যাবত হোয়াটসঅ্যাপে অগ্নিকের সঙ্গে মিস্টার পঙ্কজ উল্লেখেই কথাবার্তা চলেছে। অস্বস্তি চেপেই। ভাস্বতীদি’ভাই শিখিয়েছিলেন মিস্টারের পর হয় নামপদবী, নয় শুধু পদবী বসে। শুধু নাম কদাপি নয়। তাই বলে তো আর “পদবী বলুন” বলে ঝুলোঝুলি করা যায় না। তার থেকে জী সেফ। পঙ্কজজী। ফোনে গলা শুনে সন্দেহ হয়েছে এ আমার হাঁটুর বয়সী, কিন্তু সেটা জী কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। গলা শুনে শিওর হওয়া যায় না। পারমিটের স্ক্যান কপির ছবি দেখে তো আরওই না।

কসবার গোটা গলিতে তখন স্রেফ মামাবাড়িতেই ফোন এসেছিল। একদিন রাত এগারোটার সময় কে যেন ফোন করে বলেছে, পাঁচমিনিট পর ফোন করে যেন টিংকুর সঙ্গে কথা বলতে পাই, না হলে তোরই একদিন কি আমারই একদিন। বলে ফোন কেটে দিয়েছে। ভাগ্নেভাগ্নীদের মনোরঞ্জনের জন্য গল্পে মামার রং চড়ানোর বদভ্যেসটা চেনা, কিন্তু মামা কিরে কেটেছিলেন ফোনের হুমকি শুনে ডিসেম্বরের রাতেও মামার ঘাম ছুটে গিয়েছিল। টিংকু কে, কেন, কোথায় কিছুই মামা জানতেন না। ভোর ছ'টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত রোগী ঠেলেন, প্রতিবেশীদের খবর রাখেন না। মামী নির্ঘাত রাখতেন কিন্তু মামী আর সুমন মেদিনীপুর গেছে সেদিনই সকালে। কাজেই মামা "টিংকুবাবু! টিংকুবাবু!" চেঁচাতে চেঁচাতে গলির এমাথা থেকে ওমাথা হেঁটেছিলেন। টিংকুর সম্পর্কে কিছুই না জানায় বাবু-র সেফসাইডে থাকাটাই মামার সমীচীন লেগেছিল। অ্যাকচুয়ালি, তাতেও সব কূল রক্ষা হয়নি।  ডাক পাড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই মামা উপলব্ধি করেছিলেন টিংকু সেই বিরল বাঙালি নাম যা জেন্ডার নিউট্রাল। অর্থাৎ টিংকুবাবু বাবুও হতে পারেন, দেবীও। কিন্তু তখন আর শোধরানোর সময় নেই। পাঁচনম্বর ফেরতার মাথায় এক বাড়ির ভেতর থেকে আড়াই ফুটের একটি মানুষ বেরিয়ে রিনরিনে গলায় মামাকে চার্জ করেছিল, কী হল, এত রাতে আমার নাম ধরে চেঁচাচ্ছ কেন?

চৌঠা মার্চ ভোরবেলা দ্য রাইনো-র চাতালে সাদা গাড়ি থেকে যে ছেলেটি হাসিমুখে নেমে এল তার বয়স আমার হাঁটুর থেকে অন্তত কুড়ি বছর কম। চোখের মাথা খাওয়া বিনয়ী না হলে তাকে জী ডাকা যায় না।

কিন্তু সময় কি বছর দিয়ে আদৌ মাপা যায়? কুড়ি বছরে শুধু কুড়িটা বছর কাটে না, গোটা দুনিয়া বদলে যায়। ফেরার দিন নুরানাং জলপ্রপাতের পয়েন্টে, খানপঞ্চাশ সিঁড়ি বেয়ে নেমে, অর্চিষ্মানের ঠেলাঠেলিতে এবড়োখেবড়ো পাথর ডিঙিয়ে জলপ্রপাতের একেবারে সামনে পৌঁছে, প্রপাতের নিচের ছোট্ট পুকুরে রামধনু দেখতে গিয়ে আমি যখন এই পাথরে কোমরে হাত দিয়ে জিভ বার করে হাঁপাচ্ছিলাম আর ওই পাথরে দুই কিশোরী এ ডান আর ও বাঁ হাত মাথার ওপর তুলে "হার্ট" সাইন বানিয়ে ছবি তুলছিল, ওদের সঙ্গে আমার দূরত্ব কি শুধু কয়েকটা দশকের? আমার পায়ের নিচের আর ওদের পায়ের নিচের পাথরদুটোর তফাৎ কি মোটে দশ হাতের? আমার দিক থেকে দেখি বা ওদের দিক থেকে, আমরা আসলে অবস্থান করছি দুটো আলাদা গ্রহে।

পঙ্কজ যে গ্রহের মানুষ সে গ্রহের বাইশ বছরের ছেলেরা স্বপ্ন দেখে "ইউটিউবার" হওয়ার, যারা টিভি দেখে সময় নষ্ট না করে টিকটকে নাচে, যারা আমাদের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে জীবনে প্রথমবার 'রোজা' নামের কোনও সিনেমার গান শুনল।

Comments

  1. শেষের লাইনটা পড়ে রীতিমত চমকে গেলাম। এটাও যে সম্ভব, কখনো মাথায় আসেনি।
    খারাপ পাওয়া, আর হাসি ওড়ানো আমার প্রিয়।
    খুব হেসেছি টিংকু বাবুর গল্প শুনে। আমি ছানা হবার আগে এরকম একটা নাম খুঁজে রেখেছিলাম, যাতে ছানা হোক বা ছানি, দুটো নাম বাছার খাটুনি এড়ানো যায়।

    এখনও চোখ বুজলে নুরানাং এর ছবিটা ব্রেনের মধ্যে ভালো ভালো কেমিকাল ক্ষরণ হয়।
    পরের গল্পগুলোর অপেক্ষায় থাকছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও চমকে গেছি, রাদার ঘাবড়ে গেছি, বৈজয়ন্তী। রোজা, সাথিয়া - এ সবের গান নাকি আগে শোনেনি। এবং এ এমন কিছু ল্যাপাপোঁছা ছেলে না যে নিজের দোষে শোনেনি। নর্ম্যালিই শোনেনি। শোনার সুযোগ বা প্রয়োজন পড়েনি কখনও।

      নুরানাং সত্যি মন ভালো করা। আর তাওয়াং নদীও।

      Delete
  2. দারুন লাগলো।
    অনেক জিনিস ছুঁয়ে গেছেন লেখাটায়। কিছু খুব রিলেটেবেল - যেমন সম্বোধনের সমস্যাটা।
    আর রোজার গান না শুনে থাকলে তো 'ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া', 'সাজন', 'জো জীতা ভোহি সিকান্দার' ('ভোহি' বানানটা bn.wikipedia.org থেকে কপি করলাম, ভুল হলে ওদের দোষ) এসবের গানও শুনে থাকবে না। আমাদের জন্যে একদম অচেনা পৃথিবী।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অন্য গ্রহ, কী বলছি আপনাকে। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. আমার favourite topic এর লেখা এসে গেছে বাঃ, ভালো লাগছে । খারাপ পাওয়া টা ওদিকের কথা এবার বুঝলাম , আমার এক শিলিগুড়ির রুমমেট বলতো। আর রোজা সিনেমার গান শোনেনি! সত্যি এইভাবে বয়স নিয়ে ভাবিনি আগে 😊 প্রথম পর্বে চা পাকোড়ার ছবি নেই যে ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওটা সম্ভবত থার্ড কিংবা ফোর্থ এপিসোডে আসবে, ঊর্মি। খারাপ পেয়ো না জিন্দাবাদ।

      Delete
  4. এমনিতেই বেড়ানোর গল্প ভালো লাগে তায় আবার আমার দেশের গল্প| আমার দেশ আসাম আর আমার বরের দেশ অরুণাচল| অসমীয়া শিখেছি বাংলা শেখার আগে| অসমীয়ারা বলে "বেয়া না পাবা" আর ওখানকার বাঙালিরা তার আক্ষরিক অনুবাদ "খারাপ পেয়োনা" বলে| আমরাও তাই বলতাম| পরে জানতে পারলাম যে বাংলায় "কিছু মনে করোনা" বলতে হয় আর আমরাও যে বাংলা জানি বোঝাতে সেটাই বলতে শুরু করলাম যদিও ঠিক স্বাভাবিক মনে হতোনা|
    গোগোই বানানটা ওরা গগৈ লেখে, এত লিস্ট তাই জানতাম|

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি বলার পর মনে পড়ল, ওই বানানটাই দেখেছি বটে। দাঁড়ান ঠিক করে দিই। থ্যাংক ইউ, অমিতা।

      ওরে বাবা। আপনার বাপেরবাড়ি শ্বশুরবাড়ি দুইই তো মারকাটারি জায়গায়। আপনার স্বাভাবিক বাংলা শুনে হাসছি। সত্যিই, কোনটা যে স্বাভাবিক আর কেন, ভারি শক্ত বোঝা। খারাপ পেয়ো না-র উৎসটা জেনে ভারি ভালো লাগল। আরেকটা থ্যাংক ইউ।

      Delete
  5. Khub enjoy korlam tomar beranor goppo Kuntala. Aro asche jani .... post er opekkhaye achi.
    Tomar curry patar gaach ta ekhono ache jene khub bhalo laglo. Sheyi kobekar purono bondhu :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে তোমার কারি গাছের কথা মনে আছে, শর্মিলা? এতে প্রমাণ হয় যে তুমিও কবেকার পুরোনো বন্ধু। কারিদা-কে নিয়ে একটা পোস্ট লেখার দরকার আছে, তোমার কমেন্ট পড়ে উজ্জীবিত হলাম। খুব ভালো বেড়িয়েছি জানো। ওই দিকটা না যাওয়া থাকলে ঘুরে আসতে পারো।

      Delete
  6. khub... khub bhalo laglo pore. Abar beranor post porlam.

    Satti eisab shunle nijeder boddo prachin mone hoi. Jara Youtube prithibite aasar por school gechhe tader sathe amader jiboner bistor farak...Gen Z der byapar sapar alaada...

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুস্মিতা। হ্যাঁ এরা অন্য জগতের ছেলেমেয়ে। ইউটিউবটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর, ঠিকই বলেছেন।

      Delete
  7. ভাল লাগল, কিন্তু এখনও ছবি দেখতে পেলামনা। খারাপ পাওয়া কথাটা বেশ ভাল। আর রোজার গান শোনেনি শুনে ভয়ানক অবাক হলাম। যাই পরের গুলো পড়ি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ছবি দেখার মতো নয়, কাজেই কিছু মিস করেননি।

      Delete
  8. Darun lekha Kuntala. Mon bhalo kora roddurer moto. Tawang beranor ichchhe amadero aachhe. Puttush boro hole jaoaya hobe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সায়ন। শুনুন, যাওয়া কিন্তু খুব সোজা। পুরোটা গাড়িতে যাওয়া যায়। থাকার জায়গাটায়গাগুলোও দিব্যি স্ট্যান্ডার্ড। ঘুরেই আসুন। পুট্টুস বড় হলে আরেকবার যাবেন।

      Delete
  9. ওহঃ। দেড় বছর কর্মসূত্রে গুয়াহাটিতে থেকেছি আর অসম-অরুণাচল-নাগাল্যান্ডের কাঁহা কাঁহা মুল্লুক ঘুরেছি। স্মৃতি জ্যান্ত হয়ে ওঠা শুরু হল। আপনি যা লিখেছেন না, চরম ডিপ্রেশনের রোগীও চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সৌম্যদীপ, থ্যাংক ইউ। আপনি ওইদিককার সঙ্গে পরিচিত তার মানে। আমার যে কী প্রিয় দিক ওটা।

      Delete

Post a Comment