তাওয়াং ২ঃ দিরাং



একটা জায়গায় গিয়ে নামলাম, থাকলাম, ঘুমোলাম, সকালে বাজারের বেঞ্চিতে বসে চা খেলাম, বিকেলে কফির সঙ্গে ভুট্টাভাজা, খেতে খেতে লোক্যাল নেড়ির সঙ্গে বাক্যালাপের চেষ্টা চালালাম - এই বেড়ানোটা সে রকম নয়। নাকে দড়ি দিয়ে গন্তব্য থেকে গন্তব্যে ছুটে বেড়ানো। যা দেখার সব গাড়ির জানালা থেকে দেখে নাও। হোমস্টে-তে বডি ফেলো। পরদিন আবার দৌড়।

প্রথমদিনের গন্তব্য দিরাং। বহু বছর আগে বাবামায়ের সঙ্গে এই দিরাং পর্যন্তই গেছিলাম, তাওয়াংটুকু আর যাওয়া হয়নি। গুয়াহাটি টু দিরাং তিনশো কিলোমিটার। গুগলে লিখেছে সোয়া আট ঘণ্টায় সারা যাবে, কিন্তু আমরা কি না হেলেদুলে যাব, আমাদের লেগে যাবে প্রায় এগারো ঘণ্টা।

শুরুতে তো পাহাড় জঙ্গল থাকে না, থাকে জানালার বাইরে টপ সেম সিমেন্টের বিজ্ঞাপন, এস ইউ ভি-র ডিলারশিপ আর মেগামার্টের মিছিল। স-এর জায়গায় চ আর ছ-এ চোখকে অভ্যস্ত করে নেওয়া। ‘মা তসলিমা চাইকেল চপ’-এর কোন অংশটায় মাথা চুলকোব সেটা নিয়ে মাথা চুলকোনো। সরাইঘাট ব্রিজ। ট্রেনে চড়ে এই ব্রিজ ঝমঝম পেরিয়ে মায়ের কাছে যেতাম। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর দুম করে ফাঁকা ক্ষেত, কলাগাছের বিস্ফোরণ। আমার গত কুড়ি বছরের শান্ত, নরম প্রেমিক আসামের আত্মপ্রকাশ।

পঙ্কজকে বলি, থামো। নেমে চা খাই। পছন্দসই দৃশ্য পেলে অর্চিষ্মানকে শার্টের হাতা টেনে দেখাই। চায়ের কাপ দুমড়ে ডাস্টবিনে ফেলে কুরকুরে, যার প্যাকেটের ওপর বড় বড় ছাপা ‘স্পেশাল নর্থ ইস্ট ফ্লেভার’, আর অর্চিষ্মানের ফরমায়েশে মশলা মাখানো কড়াইশুঁটির প্যাকেট, যার ভেতর ঠিক পাঁচটা করে কড়াইশুঁটি থাকে, কিনে গাড়িতে উঠি। জুলি, গুরি, গাঁও-এর সাফিক্স সাঁটা নিরালা নেবারহুডেরা পিছলে পিছলে যায়। সামনে সামনে চলে কয়েকশো কলার কাঁদি ভর্তি টেম্পো। বাজার আসে। গেঞ্জির ঠেলা, আনাজের ঢিপি। হাতে হাতে দড়িবাঁধা ছাগল আর ভেড়া। চোখ সরিয়ে নিই।

ঢেকিয়াজুলির শেষ মোড় পার করে হলুদ রঙের ছড়ানো স্কুল। পাঁচিলহীন, ফাঁকা মাঠে দুটো বড় বড় গাছ। একটা ঝাঁকড়া সবুজ পাতা, একটা ঝাঁকড়া লাল ফুলে ভরা। আমার ক্লাসে পড়ত চৈতালি, আর্টসি টাইপ। এই মারাত্মক ভালো ছবি এঁকে ফেলছে, এই মাটি দিয়ে মূর্তি বানিয়ে ফেলছে, এই ডিমের খোলা দিয়ে তবলাবাঁয়া। এদিকে আমি শিল্পসংস্কৃতিতে ঢ্যাঁড়স। জিভটিভ বার করে বিজ্ঞানবই খুলে কুকুরের অন্ত্র টুকে দিতে পারি, মন থেকে আঁকতে বললেই চিত্তির। কারণ সেটা করতে পর্যবেক্ষণ লাগে। যেমন লাগে মিমিক করতেও। অসংখ্য ভঙ্গি, অগুন্তি মুদ্রার এক্স্যাক্টলি কোনটায় লোকটা সবথেকে বেশি ধরা পড়বে সেই জায়গাটা চিনে, টুকতে হয়। একবার ড্রয়িং ক্লাসে স্কুলবাড়ি আঁকার দরকার হয়েছিল। সাহস দিয়ে চৈতালি বলেছিল, সোজা তো। একটা নর্ম্যাল বাড়ি আঁক, তাতে দুটোর বদলে কুড়িটা জানালা এঁকে দে। বাড়ি হয়ে যাবে স্কুলবাড়ি। সেই থেকে স্কুলবাড়ির দিকে তাকালেই সারি সারি জানালা দেখি আর চৈতালিকে দেখি। আসামে এক কিলোমিটার পরপর স্কুলবাড়ি। নিম্ন, মধ্য, উচ্চ। বালক, বালিকা। সাইকেল চড়ে স্কুলে যাচ্ছে, হেঁটে ফিরছে। একা, মায়ের সঙ্গে কিংবা ঝাঁক বেঁধে। সবাইকে দেখলেই মন ভালো হয়। একটু বেশি ভালো হয় সাদামেরুন ড্রেসের বালিকাদের দেখে। পার হয়ে আসার আগে মনে মনে হাই ফাইভ দিয়ে আসি।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গুয়াহাটির উচ্চতা পঞ্চান্ন মিটার, দিরাং-এর পনেরোশো ষাট। জানালার বাইরের শব্দ, বর্ণ, গন্ধ, উত্তাপ, মানুষের মুখ সব বদলে যায়। কলাবাগান পাইনবন হয়ে যায়, টানটান জমিতে জন্ম নেয় গভীর খাদ, নদীর গতি বাড়ে। নেড়িরা ক্রমে ষণ্ডা ও রোমশ হয়। মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করা গরুরা জমি থেকে পঞ্চাশ হাত ওপর একটা ক্ষুর পাথরে, বাকি তিনটে শূন্যে ভাসিয়েে উদাস মুখে ফার্ন চিবোয়। গাড়ি থামে। 

কিছু দেখার আছে বুঝি?

কেন এই যে ফাঁকা টানটান পিচরাস্তা, দু'পাশে ঝোপঝাড় এবং মহীরুহের বনানী, আকাশের গায়ে ধূসর পাহাড়ের আলতো গোঁফরেখা?

আই মিন, এ সবের বাইরেও কিছু? ওরে বাবা এটা কী?



একটা বোম্বাই গেট। বম্বের নয়, ভূটানের। পঙ্কজ বলে, ঘুমকে আইয়ে। বলে পাশে এসে দাঁড়ানো একটা গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে আসে দুই যাত্রী এবং ড্রাইভার। শেষের জনকে দেখে পঙ্কজ হাসে।

পটাপট ছবি তুলি। অর্চিষ্মান বলে, এটার ছবি তুলছ কেন? এটা তো ইন্ডিয়ার। ভূটানেরটা আরও এগিয়ে। থ্যাংক ইউ ফর ভিজিটিং ইন্ডিয়া লেখা আছে দেখছ না?

দেখিনি। আমি আজকাল একটা ইউজলেস চশমা পরে থাকি। কিছু কিছু জিনিস আন্দাজ করে নিতে হয়। তবু পরে থাকি কারণ এই চশমাটা সম্ভবতঃ, সম্ভবতঃ না, শিওর, আমার শেষ নর্ম্যাল চশমা। এরপর চালশে চশমা ধরাবে। ফন্ট তিনগুণ বাড়িয়ে টাইপ করছি, গেটের গায়ে থ্যাংক ইউ না ওয়েলকাম দেখতে পাচ্ছি না তবু চশমা ছাড়ছি না, যৌবনের ল্যাজটুকু আঁকড়ে থাকার তাড়নায়।

ইন্ডিয়ার গেট পেরিয়ে ভূটানের গেট দেখা হল।


গাড়ি থেকে নামা দম্পতিও ভূটান গেটে এসে পৌঁছেছেন, দুজনের হাতেই ক্যামেরা। মানে একজনের হাতে ফোন, অন্যজনের ক্যামেরা। দুজনেই ভিডিও তুলছেন। আশ্চর্যের কিছু নেই কারণ স্থিরচিত্রের দিন গেছে। এই যে পাঁচদিন ঘুরলাম, কেবল আমিই প্রেয়ার হুইলের সারির পাশে কাঠ হয়ে দাঁড়ালাম আর অর্চিষ্মানও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে শাটার টিপে আমার ছবি তুলল। সহটুরিস্টরা হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে এগোলেন এবং তাঁদের ক্যামেরাধারীরা ক্যামেরা বাগিয়ে পিছু হাঁটলেন। নিচে বরফ, চারপাশে বরফ, আকাশ থেকে পড়ন্ত বরফের মধ্যে মুখে হাসি জমিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছাউনির নিচ থেকে এক ইঞ্চি পা না বার করা অর্চিষ্মানের "এগোও", "পেছোও", "অত দাঁত বার কোর না" কম্যান্ড অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম আর ভাবলাম এমন সুন্দর আবহাওয়ায় আর কেউ ছবি তুলছে না কেন। কেন তুলছে না টের পেলাম গাড়িতে উঠে। আমার পাশে বসা সহটুরিস্ট জানালা নামিয়ে প্রায় কোমর পর্যন্ত বার করে ফেলছেন দেখে চেঁচিয়ে জ্যাকেট টেনে ধরতে যাব, অর্চিষ্মান খোঁচা দিল। তখন দেখি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা লোকটিও জানালা দিয়ে অর্ধেক শরীর ঝুলিয়ে দিয়েছেন। হাসি হাসি মুখে, মাথা এদিকওদিক ঘোরাচ্ছেন, দুই হাত বাড়িয়ে বরফপাতকে আলিঙ্গন করার ভঙ্গি করছেন, সবের ভিডিও উঠছে পেছনের জানালা থেকে।

ভূটান গেটের দম্পতির ভিডিও তোলার রকমটা ইউনিক। এঁরা একে অপরের ভিডিও তুলছেন না। দ্রষ্টব্য বস্তুর, যথা ভূটান গেট, সামনে গিয়ে ক্যামেরা এবং ফোন নিচ থেকে ওপরে নিয়ে যাচ্ছেন, ওপর থেকে নিচে, এপাশ থেকে ওপাশে, ওপাশ থেকে এপাশে। একবার যেন মনে হল একজন অপরজনের ভিডিও তুললেন, কিন্তু যাঁর ভিডিও তোলা হল, হেসে হাঁটা, ফুল তোলা বা এদিক ওদিক তাকানোর বদলে তিনি ভূটান গেটের দিকে আঙুল তুলে কী সব বলে গেলেন গোটা সময়।

ইউটিউবার অ্যাট ওয়ার্ক।

সকলেই আজকাল ইউটিউব করে কোটিপতি হতে চায়। তালেগোলে কোটিপতি হলে মন্দ হবে না, কিন্তু যা বুঝলাম -আগেই খানিকটা সন্দেহ করেছিলাম এঁদের দেখে নিশ্চিত হলাম - সে জন্য ইউটিউবের পথে হাঁটা যাবে না। মারাত্মক খাটনির কাজ। বিশেষ করে ভ্রমণটিউব। ভ্রমণের আনন্দ পনেরো আনা মাটি। আমি পাইনগাছের আপটার্নড শাখায় জমা বরফ দেখে করপুটে প্রদীপের উপমা ভাবছি, ওঁরা পাশ থেকে বলছেন, শ্যাওলাটায় জুম করো, জুম করো। আমরা সেলা পাসে বরফের গোল্লা পাকিয়ে ছুঁড়ছি - একে অপরের দিকে নয়, অত প্রাণবন্ত নই আমরা - ওঁরা ট্রাইপডের ঠ্যাং নিয়ে টানাটানি করতে করতে ঘেমে যাচ্ছেন। যুদ্ধ মেমোরিয়ালে গলায় দলা নিয়ে মূর্তিগুলোর ফলকে লেখা মৃত্যুসাল থেকে জন্মসাল বিয়োগ করছি, বাইশ, উনিশ, একান্ন, বেয়াল্লিশ (মাগো), আর শুনছি, উইকির ওই পয়েন্টটা মিস করে গেলে তো। আবার গোড়া থেকে বল। গলায় প্যাথোজ ফোটাও। হাসছ কেন?

লোকে বলতে পারে, আপনিও তো দেখতে দেখতে পাইন গাছের করপুটটরপুট মার্কা যমের অরুচি উপমা ভাঁজেন, সে বেলা দেখার আনন্দ কিছু মাটি হয় না বুঝি? হয়, কিন্তু আমার সঙ্গে এঁদের তফাৎ হচ্ছে, আমার সঙ্গে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষেরই যা তফাৎ, এঁরা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন। প্রথমটা এঁদের ভিডিও তোলাটাকে পজিটিভ হিসেবেই দেখছিলাম। সম্পর্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য  ডাক্তারদের একটা কমন সাজেশন হল দুজনে মিলে একটা কোনও কাজে নিযুক্ত হওয়া। একই প্যাশন পারসু করা। এই যে একসঙ্গে ভিডিও তোলা, এডিট করা, ছাপা, কমেন্টের প্রশংসা এবং গালি ভাগ করে নেওয়া, এতে বন্ডিং বাড়ার কথা। থিওরিতে। প্র্যাকটিকাল অত সোজা না। কারণ প্যাশনের প্রতি দুজনের মরণবাঁচন ভাব অসমান হতে পারে। পারে না, হবেই। অধিকাংশ সময়েই অরিজিন্যাল আইডিয়া যার, মরণবাঁচন তার থেকে বেশি হয় অন্যজনের। সবথেকে বড় কথা, এঁরা সন্দেহ কনফার্ম করলেন,  একসঙ্গে কাজ করতে নেমে হাসাহাসির থেকে বকাবকি বেশি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দেখেশুনে ঠিক করেছি, স্বাস্থ্য খানিক দুর্বল থাকলে  থাক, অর্চিষ্মান যেমন খাটের ওপাশে শুয়ে টুইটার চষে, চষুক,  আমি যেমন খাটের এপাশে শুয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলি, খেলি। নো জয়েন্ট ভেনচার।

এঁরা সামনের চারদিন আমাদের আগেপিছেই ঘুরবেন। কারণ এঁরাও এসেছেন তাওয়াং টুরস-এর সঙ্গে।  আমাদের তো কেবল দেখে শেখা। ইউটিউবারদের নিয়ে সবথেকে বেশি ঝামেলা ভ্রমণ কর্তৃপক্ষের। কারণ "অফবিট" ওঁদের ইউ এস পি। সবাই যা দেখে শুধু সেটুকু দেখলে চলবে না, সবাই যতটুকু যায় ততটুকু গেলে চলবে না। এমন এমন সব জায়গার নাম বলছিলেন অরুণাচলের ম্যাপে পর্যন্ত তার উল্লেখ নেই। এদিকে কোন অফবিট ইউটিউবার নাকি সে জায়গার পাঁচমাইল আগে পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে, বাকি পাঁচমাইলের বাজি না মারলে এঁদের ভাত হজম হচ্ছে না। সবাই বুমলা পাস দেখেই খুশি, ওঁরা ফিসফিসিয়ে বলছেন টুক করে চায়না-য় একবার পা রেখে আসা যায় না? বাকিরা যখন নিয়ম মেনে নীল রেলিং-এর এপারে থেমে যাবেন, ওঁরা রেলিং পার করে দাঁড়াবেন। 'অফবিট'-এর ভুত অনেক নন-ইউটিউবার টুরিস্টদের তাড়িয়ে বেড়াতেও দেখেছি। দার্জিলিং-এর নামে শিউরে উঠে কানে হাত দিয়ে দার্জিলিং-এর পনেরো মিনিট দূরে জঙ্গলে মশা মারতে মারতে বনফায়ারে মাতেন, ম্যালে বসে মোমো মেরে ফেললেও খাবেন না, বদলে তাঁবু খাটিয়ে রিপাবলিক অফ চিকেন-এর ভ্যাকুয়াম প্যাক খুলে স্পাইসি চিকেন সসেজের বার বি কিউ-তে আত্মহারা।

ভূটান গেটের লাগোয়া ভৈরব কুণ্ড নামের পিকনিক স্পট। পিকনিক তো করব না, ঝুপড়িতে চা খেতে ঢুকলাম। এই চা খাওয়াটা সিগনিফিক্যান্ট কারন নীল ফ্রক পরা কিশোরী ওপেন কিচেনে আমাদের চোখের সামনে চা বানিয়ে দিল আর উপলব্ধি করলাম সকাল থেকে চারবার চা খেয়ে প্রত্যেকবার অস্বস্তি কেন হচ্ছিল।

এঁরা চা বানান কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে। এবং সে মিল্ক ঢালতেই থাকেন, ঢালতেই থাকেন যতক্ষণ না চায়ের রং হিথ লেজারের মেকাপের কাছাকাছি যাচ্ছে। চিনি ছাড়া চা-ও বেসিক্যালি পায়েস। পরের তিনদিন হোটেলে বা রাস্তায়, সর্বদা দুধ ছাড়া চা চেয়েছি এবং অতি সাধারণ দোকানের চায়ের ফ্লেভারে চমৎকৃত হয়েছি।

রূপা নামে একটি অতি রূপবান জায়গায় থামা হল। মিলিটারি অধ্যুষিত অঞ্চল। গাড়ি থেকে নেমে ব্রিজের ধার পর্যন্ত যেতে যেতে দৌড়ে ফিরে গাড়ি থেকে সোয়েটার নিয়ে এলাম। ঠাণ্ডাটা বেশ বেড়েছে।


এতবার থামলে যা হয়, আটঘণ্টার রাস্তা এগারো ঘণ্টা লাগল। বাবামায়ের সঙ্গে ছিলাম দিরাং টুরিস্ট লজে। পাহাড়ের মাথায় লজ, সমস্ত উপত্যকা পায়ের নিচে ছড়িয়ে। আমি আর মা জানালা দিয়ে ভিউ দেখছিলাম। সিলিং-এর ঝাড়লণ্ঠন, মেঝের কাঠ, দেওয়ালে রংচঙে সুতোর ঝালরসজ্জা। সবই সুন্দর কিন্তু মায়ের চোখ টেনেছিল ডিমের মতো আয়না। ফ্রেমে লতা, লতার গায়ে ফুল। আমাদের জুতোর বাক্সের ওপর ডিম্বাকৃতি আয়নাটার দায় এই দিরাং-এর। ওদিকের খাটটার উল্টোদিকের দেওয়ালে পুঁচকে ঘণ্টা বাঁধা উলের ঝালর, সেটার ইন্সপিরেশনও যুগযুগান্ত আগের সেই দিরাংবাসের স্মৃতি।

স্মৃতি গিলে নির্ধারিত হোমস্টে ফোর সিজন-এ ঢুকে গেলাম। রীতিমতো ঠাণ্ডা তখন। খাটের ওপর ভাঁজ করা লেপকম্বল মনে হচ্ছে সপসপে ভেজা। হোমস্টে-তে এর আগে আমি এত থাকিনি। হোটেলের তুলনায় হোমস্টে-র একটা প্রধান তফাৎ আমার লেগেছে যে ব্যাপারটা অনেক বেশি পার্সোন্যাল। গেলাম, দরজা বন্ধ করে এই লাও সেই লাও হুকুম চালালাম, সে রকম চলবে না। জামাকাপড় বদলে গেলাম রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরের বাতাস আশ্চর্যজনকরকম আরামদায়ক। এই জিনিসটির কল্যাণে। 


এখানে একটু বসা যায়? ওঁরা বললেন, নিশ্চয়। চা জল এল। ওখানে সবাই গরম জল খায়। প্রথমটা অস্বস্তি লাগে, তারপর আরাম হয়।  ডিনারে আমার ভেজ, অর্চিষ্মানের ননভেজ থালির অর্ডার দিয়ে যে যার ল্যাপটপ নিয়ে এসে গদিতে পা মুড়ে বসলাম। অর্চিষ্মান কী করল জানি না, আমি তাওয়াং ভ্রমণের প্রথম কিস্তি টাইপ করতে শুরু করলাম।

Comments

  1. খুব ভালো লাগছে, যেমন ছবি তেমন বর্ণনা| আসামের প্রতি তোমার ভালোবাসার কারণ খানিকটা কি নস্টালজিয়া থেকে? আমি অরুণাচলের এই দিকটা যায়নি এখন মনে হচ্ছে যেতেই হবে আর তাওয়াঙ টুরের সাথেই যাবো|
    "হাতে হাতে দড়িবাঁধা ছাগল আর ভেড়া। চোখ সরিয়ে নিই" - সেই সাথে মুরগি পা বেঁধে উল্টো করে সাইকেলে করে নিয়ে যাওয়া! আমি খালি ভাবি আমার মেয়ের চোখে না পড়ে!

    ReplyDelete
    Replies
    1. খানিকটা না, অমিতা। পুরোটাই। আসামে প্রথমে মা এবং পরে বাবা না ট্রান্সফার হলে আমার আসামে গিয়ে থাকা হত না। আর চট করে দুদিনের বেড়াতে গিয়ে তো একটা জায়গাটা বা লোকজনের প্রতি সেই টান জন্মায় না। তবে উত্তর লিখতে গিয়ে ভেবে দেখছি, আসাম আমার ভালো লেগেছিল তো বটেই, আরও বেশি ভালো লেগেছিল মায়ের ভালো লেগেছিল বলে। ওই কয়েকটা বছর একলা থাকা, সংসার থেকে দূরে, মাকে অন্যরকম একটা জীবনের স্বাদ দিয়েছিল, যেটা মা ফলাও করে কখনও না বললেও, মাকে দেখলে বোঝা যেত, অন্তত আমি পারতাম। ওই যে একলা ভাড়াবাড়িতে মায়ের একলার রান্নাঘর, একলার বাজার, অফিস থেকে ফেরার পথে একা একা গৌরীপুরের মাঠ পেরোনোর অভিজ্ঞতা, শুনে শুনে জায়গাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর মায়ের কাছে বেড়াতে গিয়ে সব মিলিয়ে নিয়ে আরও কিছু বেশি প্রাপ্তি হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্রের ধারে বসে আমি আর মা বাদামভাজা খাচ্ছি, শনিবার রাতে ব্যাম্বু গার্ডেনে চাইনিজ - অত আনন্দ চট করে পাব না আর কখনও। এই সব মিলিয়ে আসাম আমার কাছে স্পেশাল।

      মুরগি আর সাইকেলের ওই দৃশ্যটা আমার সিদ্ধান্তের পেছনে অন্যতম অনুঘটক ছিল।

      Delete
    2. তাওয়াং সত্যি যান। খুব সোজা যাওয়া। গোটাটাই গাড়িতে। খালি উচ্চতায় কারও কারও কষ্ট হয় শুনেছি, সেটা যদি না থাকে তাহলে একেবারে কেকওয়াক। আপনাদের যদি সময় বেশি থাকে, আমি শিওর থাকবে, দূর থেকে এসে তো পাঁচ দিনে ঠেসাঠেসি করবেন না, তাহলে অন্য টুর কোম্পানিদের সঙ্গেও যেতে পারেন, আরও অভিজ্ঞ এবং এস্ট্যাবলিশড। তাওয়াং টুরস-ও খুবই ভালো, অফ কোর্স, তবু বলছি, অভিজ্ঞতা হয়তো ম্যাটারস। যার সঙ্গেই যান, সুযোগ করতে পারলে অবশ্যই যান। আমরা ফ্লোরড।

      Delete
    3. দূর থেকে এসেই তো ঠেসাঠেসি করতে হয়, পুরো ছুটি তো আর তাওয়াং যেতে খরচ করা যায়না, কাছের লোকজনকে সময় দিতে হয়, ব্যাংকের কাজ সারতে হয়| আর অক্সিজেন ছাড়াও আমার পাহাড়ি ঘোরানো পথে মাথা ঘরে বমি হয়| দুবার ইটানগর গিয়েছি মাথা গুঁজে আর বমি করে | শিলঙের রাস্তায় একই ব্যাপার | তিন বছর আগে কেরালায় মুন্নার যাবার সময় একই অবস্থা, মানে বয়েস হয়ে গেছে কিন্তু রোগটা সারেনি |

      Delete
    4. মা ছিলেন মনে আছে, বাবাও যে ছিলেন সেটা মনে নেই| প্রিয়জনদের ভাললাগার জায়গা বা বিষয় সব কিছু নিজেদের ভালো লাগে বা লাগানোর চেষ্টা করি আমরা|
      মুরগির কথাটা আলোচনা করে বড্ডো মন খারাপ হয়ে গেল, সারাদিন এভাবেই কাটলো, রাত্তিরে সেই ঝুলন্ত অসহায় মুরগির স্বপ্ন দেখলাম| থাক আর না |

      Delete
    5. ঠেসাঠেসির পয়েন্টটা ঠিকই বলেছেন, অমিতা। ঠিকই। দূর থেকে এলেই টাইম কম পড়ে। বমির ব্যাপারটা, আপনি নিশ্চয় জানেন, তবু আমার অত্যাশ্চর্য কাজ দিয়েছে বলে বলছি। কমনস্য কমন রেমেডি। অ্যাভোমিন। আমাকে একজন বলেছিলেন, অ্যাভোমিন সবাই খায় এবং ভুল ভাবে খায়। তাঁর পরামর্শ মেনে আমরা যাত্রা শুরু হওয়ার বেশ খানিকটা আগে অ্যাভোমিন খেয়ে নিই, মিনিমাম আধঘন্টা তো বটেই, এক দেড় দুই হলেও অসুবিধে নেই। এমনকি সকালে উঠে অ্যাভোমিন খেয়ে, পুরিসবজি ব্রেকফাস্ট করে মারাত্মক ট্যাঁরাবেঁকা রাস্তায় সারাদিন চলেছি, কিচ্ছু হয়নি।

      Delete
    6. মনে রাখবো এভোমিনের কথাটা, থ্যাংক ইউ|

      Delete
  2. কি মজা, আমরাও দিরাং ট্যুরিস্ট লজে ছিলাম। যেমন সুন্দর বিল্ডিং, ঘর, ডেকোরেশন, তেমন মায়াময় লোকেশন।
    হাই ফাইভ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে হাই ফাইভ, বৈজয়ন্তী।

      Delete
  3. সত্যি, আজকাল দেখে মনে হয় যেন বেড়ানো বা অনুষ্ঠান ফিক্সড ডিপোজিট করে নেওয়া হচ্ছে ছবি আর ভিডিওতে, এখন না উপভোগ করে পরে কখনো উপভোগ করা হবে বলে। কোনো বেড়ানো বা অনুষ্ঠানে ছবি বা ভিডিও তোলার প্রতি আজকাল আমি খুবই উদাসীন। তাছাড়া সাথে অন্য মানুষজন থাকলে আমার তোলার কোনো দরকারও পরে না, কারণ অন্যরা ছবি বা ভিডিও তোলার দায়িত্বটা এতটাই নিয়ে নেয়, যে আমার শুধু শুধু এক্সট্রা খাটার কোনো মানেই হয় না। সব শেষ হয়ে বাড়ি ফেরার পর শুধু "ছবি ভিডিও গুলো শেয়ার করে দিস" বললেই কাজ চলে যায়।

    শেষ ছবিতে, যেটার জন্যে লিখেছেন ঘর আরামদায়ক, ওটা আসলে কি? স্টোভ / উনুন জাতীয় কিছু, নাকি শুধু ঘর গরম করার জন্যেই ওটা ওরম ঘরের মাঝখানে রাখা?

    ReplyDelete
    Replies
    1. সব থেকে বড় কথা এই ছবিগুলো তো আমি নিজেও পরে বার করে দেখব না। তবু কাঁড়ি কাঁড়ি ছবি তুলছি। ওই শেয়ারের ঝামেলা এড়াতে অনুষ্ঠানবাড়িতে ফোন বার করি না। অন্যের ফোনে দাঁত বার করে পোজ দিই। সে শেয়ার করলে ভালো, না করলে আরও ভালো।

      ছবি তোলা নিয়ে আরেকটা ভয়ের ব্যাপার হয় আজকাল। ধরুন, কোনও পুরোনো চেনার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হচ্ছে। যাওয়ার আগে সে ফটাশ করে ফোন বার করে আমার মাথায় মাথা ঠেকিয়ে চারপাঁচখানা ফোটো তুলে ফেলে। আমি ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই। প্রথমবার যখন ঘটেছিল, নিষ্পাপ ছিলাম, বিপদ যে এখানেই শেষ নয় বুঝিনি। কয়েকদিন পর জানলাম ফেসবুকের গ্রুপে আমার সেই হতচকিত মুখের ছবি ঘুরছে। আমাকে যারা খুঁজে পাচ্ছিল না (কেন খুঁজছিল ভগবান জানে, কোনও কাজের কথা নেই) তারা সবাই ছবির নিচে এসে ও মা, ও বাবা জাতীয় মন্তব্য করতে লেগেছে। সেই থেকে শিখে গেছি। ছবি তুলতে বারণ করি না, বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, কিন্তু কিরে কাটিয়ে নিই যে কোথাও পোস্ট করা যাবে না। সকলেই মুখ এমন করে যে বুঝি বারণ না করলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছবি আপলোড হয়ে যেত। করুণ মুখ করে বলে, প্রাইভেট গ্রুপেও না? রেসলিউট মাথা নেড়ে বলি, নোপ। তোর ইচ্ছে করলে মাঝে মাঝে ছবিখানা খুলে দেখতে পারিস, ব্যস।

      ওটা উনুন। খুব খারাপ করে তুলেছি ছবিটা তাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। সিলিন্ডার টাইপের একটা জিনিস যার গায়ে আরেকটা ছোট সিলিন্ডার অ্যাংগল করে ঢোকানো। সেখানে কাঠকুটো দেয়। মেন সিলিন্ডারে আগুন জ্বলে। খুবই সরল ইঞ্জিনিয়ারিং, কিন্তু এফেকটিভ।

      Delete
    2. একটা জিনিস খেয়াল করেছি যে এলবামে রাখা ফিজিক্যাল ছবি আমার বেশি দেখা হয়, ডিজিটাল ছবির থেকে। ভাবছি কোথায় কি ডিজিটাল ছবি হারিয়ে রয়েছে সেগুলো কোনো একদিন এক এক করে খুঁজে দেখে নিয়ে, বেছে বেছে কিছুর প্রিন্ট নিয়ে এলবামে রেখে নেবো।

      আর ফেসবুক একাউন্ট আমি একবার বানিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু কদিনের মধ্যেই ডিলিট করে দিয়েছিলাম রেগেমেগে, এই দেখে যে আমার একাউন্ট ঠিক আমার থাকছে না। তাছাড়া বড্ডো বেশি noise। তারপর নতুন করে আর বানাইনি। ফলত এখন আমার ফেসবুক একাউন্ট নেই (আর লোকজন শুনলে অবাক হয়ে তাকায়)। অনেক আগে orkut.com বলে একটা নেটওয়ার্কিং সাইট ছিল, গুগল এর, ব্যবহার করেছেন কিনা জানি না। ওটা ফেসবুকের থেকে আমার অনেক বেশি ভালো লাগতো। পরে তো সাইটটাই উঠিয়ে দিলো।

      Delete
    3. হ্যাঁ, ভীষণ ভিড় ফেসবুকে। আর সবাই এত সুখী এবং ফেমাস যে পাঁচমিনিটের মধ্যে ডিপ্রেশন সেট ইন করতে বাধ্য। যেচে ওই যন্ত্রণা কে নেয়।

      অরকুটে ছিলাম না। আমার রিয়েল লাইফ বন্ধুত্বেই অসুবিধে হয়, ভার্চুয়াল যে হ্যান্ডল করতে পারব না সে সম্পর্কে গোড়া থেকেই ক্লিয়ার ছিলাম।

      Delete
  4. তোমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত তুমি তো উপভোগ করেইছ, লেখন প্রসাদে, আমরা , মনে হয়, আরো বেশি উপভোগ করেছি। আর কিছু তো বেশি লাভ আমাদেরই হয়েছে। তোমার লেখা থেকে উত্সারিত নির্মল হাস্যরস। নিজের লেখা পড়ে নিজে নিজে এত হাসা যায় কি? মাম্মা, তোমার পায়ের তলে বিছিয়ে দেবার জন্য আমি আরো অনেক ব্যাগ সর্ষে পাঠিয়ে দেব।


    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে এমন সুন্দর উপহারের কথা কেউ কোনওদিন বলেনি আমাকে। থ্যাংক ইউ, মালবিকা। আমাদের বেড়ানোর গল্প পড়ে ভালো লেগেছে জেনে পুলকিত হলাম।

      Delete
  5. এ হে, ওই বুড়োদের থুড়ি মাঝবয়েসীদের চশমাটা আমারও হয়েছে এই জানুয়ারি মাস থেকে। সুমন চাটুজ্জের জবাব নেই। ঐরকম দম না ফেলতে পারার মতন করেই আমরা বেড়াই, আর অন্যরকমটার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ইউটিউবারদের বর্ণনাটা মোক্ষম দিয়েছেন। তবে আপনার লেখায় সবচেয়ে লোভনীয় লাগল হোমস্টের লেপ কম্বল দেওয়া বিছানাটা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন না, অত রয়েসয়ে বেড়াতে গেলে আবার দেখবেন বোর লাগছে। চালশে চশমা হাই ফাইভ।

      Delete
  6. behind the scene youtuber couple দের গল্প পড়ে বেশ জ্ঞানচক্ষু খুলল !
    কে জানতো এই pathos, retake ইত্যাদি নিয়ে ঝগড়া চলে আসলে!

    দারুন উপভোগ করলাম লেপ কম্বল, লিকার চা, offbeat এর তাড়না - সমস্ত গল্প। বাকি পর্ব গুলো পড়তে যাই :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. একসঙ্গে কোনও কাজ করা মানেই ঝগড়া, কাকলি। স্বামীস্ত্রীর টিম হলে তো আরওই, কারণ তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সৌজন্যরক্ষার দায়টুকুও থাকে না।

      Delete

Post a Comment