প্রজাপতি প্রিমিয়াম



একটা ঠিক মানুষকে যত শেখায়, একটা ভুল শেখায় তার থেকে অনেক বেশি। তাই বলে জীবনের মধ্য দিয়ে যেচে ভুল করতে করতে চলা যায় না। অন্তত কাম্য নয়। অথচ চললে শিখতাম হয়তো অনেক বেশি। বা শিখতাম না। ভুলের ওপর ভুলের পাহাড় জমিয়ে বসে থাকতাম, কিছুই না শিখে। আমার পক্ষে সবই সম্ভব।

ছাত্রের টাইপের ওপরও শেখা না-শেখা নির্ভর করে। বুদ্ধিমানরা দেখেশুনেই অনেকটা শেখে। আমার শিখতে হলে হাত পোড়াতে হয়। অনেকে বলে ওতে নাকি শেখা কায়েমি হয়। হাতও যে পোড়ে?

যে ভুলটা নিয়ে এত প্যাঁচাল, সেটার নাম 'প্রজাপতি প্রিমিয়াম'। গতবছরের অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকে গুরুচন্ডা৯-তে বেরোনো একটা নভেলা। যে নভেলাটার কথা আমি কাউকে বলতে পারিনি। 

কাউকে বলা মানে অবান্তরে বলা। আর কেই বা আমার কথা শুনবে বলে বসে আছে।

বলতে পারিনি, কারণ বলার অবস্থায় ছিলাম না। লেখাটা অ্যাটাচ করে ঈপ্সিতাকে সেন্ড করার মুহূর্ত থেকে ভয়ানক মন খারাপ হয়েছিল। ভয়ানক। ভয়ানক। কারণ, গল্পটা আমার মনের মতো হয়নি। 

অফ কোর্স, কোনও গল্পই মনের মতো হয় না। 'মনের মতো' অবস্থানটা শুধু মনের মধ্যেই সম্ভব। লেখা, চাকরি, প্রেম। বাস্তবের রোদহাওয়া গায়ে লাগা মাত্র সবাই, সবকিছু, হড়কাতে শুরু করে। শুয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে গল্প ভাঁজতে ভাঁজতে নিজেকে হেমিংওয়ে মনে হয়। গুগল ডক খুলে প্রথম বাক্যটা শেষ করারও আগে দাঁতনখ বার করে কুন্তলা আবির্ভূত হয়। হাঁউমাঁউখাঁউ চালিয়ে যায় শেষ দাঁড়িটি টাইপ করা পর্যন্ত।

তাছাড়া 'মনের মতো' আর 'ভালো' সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। আমার 'মনের মতো' নির্ধারিত হয় আমার বুদ্ধিবৃত্তি, ভালোমন্দের পরিচয়, জীবনবোধ, সংবেদনশীলতা, চর্চা - সোজা কথায় আমার মনের কোয়ালিটি দিয়ে। আমার যা মনের মতো, অনেকের কাছে তা পাতে দেওয়ার যোগ্যও নয়।

শান দিয়ে মনের কোয়ালিটি টপ নচ রাখার পরিশ্রমের থেকে সহজতর মগজের ভেতরের হেমিংওয়েটাকে যতখানি সম্ভব ধাওয়া করে যাওয়া। পঁচিশ পার সেন্ট রাস্তা গেলেও নিজেকে ক্যাডবেরি খাওয়ানো উচিত।

'প্রজাপতি প্রিমিয়াম'-এর ক্ষেত্রে সে ধাওয়ার প্রয়াসের সততা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। গল্পটা লিখতে চেয়েছিলাম মন থেকে। পিক আপ নিয়ে শুরু করেছিলাম। সময় দিয়েছিলাম। লাস্টে এসে গোলমাল হয়ে গেল। মাথার ভেতরের গল্পটার দশ পার সেন্টও কাছাকাছি গিয়ে উঠতে পারলাম না।

তাতেও আফসোস থাকত না। কারণ স্টিফেন কিং বলেছেন, এমন অনেক বিষয় থাকে যেটা ট্যাকল করার প্রস্তুতি লেখকের থাকে না। হয়তো এই গল্পটাও তেমনই। হয়তো আরও দশ বছর বাদে আরেকবার চেষ্টা করলে দশের বদলে পনেরো পার সেন্ট হত। কিন্তু আমার আফসোসটা গল্পের সেই খুঁতগুলোর জন্য নয় যেগুলো আমার অক্ষমতাজনিত। গল্পটার একটা বিরাট অসুবিধে স্ট্রাকচার; কাজেই পেসিং ঘণ্ট পাকিয়ে গেছে। এটা সময় দিলে বেটার করা যেত, দিইনি।

ক্ষমতায় কুলোল না বলে পারলাম না, আর যেটুকু ক্ষমতায় কুলোত সেটুকুও না করে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলে সময় নষ্ট করলাম-এর ফারাকটা আর জীবনে ভুলব না।

নাকি আবারও ভুলে যাব? আফটার অল, আমি তো আমিই থাকব।

গল্পটা পাঠিয়ে এমন আধমরা হয়ে পড়েছিলাম যে বেরোনোর পর গুরুর সাইটে দেখতে পর্যন্ত যাইনি। এরা কারা, কিস্যু হয়নি ইত্যাদি প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি পড়তে হওয়ার ভয়ে নয়, অন গড ফাদার মাদার। শুনতে যতই আর্ট অফ লাইফ মার্কা লাগুক না কেন, আসল লজ্জা করেছে লেখাটার মুখোমুখি দাঁড়াতে। তোমাকে সবটুকু দিলাম না, নিজে নিজেকে ডিফেন্ড করে নাও বলে বাড়ির বাইরে বার করে দিলাম, সেই সংকোচে লেখাটার দিকে তাকাতে পারিনি। সেই অক্টোবর মাস থেকে।

আজ সকালে অর্পণের মেলটা আসার আগে পর্যন্ত। অর্পণ লেখাটা নিজেই খুঁজে পেয়েছে। লিখেছে, আগে পড়িনি, অবান্তরে দাওনি বুঝি লিংক?

অর্পণের রুচিপছন্দ, ভালোমন্দ বোধের ওপর ভরসা আমার নিজের ভালোমন্দের বোধের ওপর ভরসার থেকে বেশিই। তাই অবশেষে 'প্রজাপতি প্রিমিয়াম'-এর লিংক অবান্তরে দিয়ে রাখলাম।


প্রজাপতি প্রিমিয়াম



Comments

  1. Arebbas. Amaar mail-e shudhu golpo na, ekta puro blogpost eshe gelo, eta dekhe nijei nijer pith chapre dilam.

    ReplyDelete
  2. খুব খুব ভালো লাগলো। এখনো ভাবছি। যেসব কথা মাথা থেকে সরিয়ে রাখি অনেক সে সব চিন্তা ফিরে এলো।

    ভালো থাকবেন।

    ইন্দ্রানী

    ReplyDelete
    Replies
    1. সত্যি ভালো লেগেছে, ইন্দ্রাণী? থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. One of your bests. Orwell এর 1984 পড়ার পর একটা ভয় মিশ্রিত অস্বস্তি হয়েছিল, এখানেও খানিকটা তেমনই মনে হলো, যদিও দাদাগিরির স্থান, কাল, context, আলাদা। মনে থাকবে লেখাটা অনেকদিন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঈপ্সিতা, থ্যাংক ইউ। এই লেখাটা নিয়ে এমন জর্জর হয়ে ছিলাম, কারও এটা ভালো লেগেছে জানাটা যে কী আশ্বাসের।

      Delete
  4. অনেকদিন কথা হয়নি কিন্তু আমি অবান্তর নিয়মিত পড়ি. হাজার টা কাজ আর ডেডলাইনের মধ্যেও গল্পটা না শেষ করে ছাড়তে পারলাম না। আর এতো ভালো লেখা কমেন্ট না করে পারলাম না। মন ভার হয়ে গেলো পড়তে পড়তে, কিছুটা গল্পের জন্যে আর বাকিটা এটা ভেবে যে এই দিন আর বেশি দূরে নেই। ইউটিউবে যা 'satvik' লাইফস্টাইল আর 'হিন্দু হিস্ট্রি' চ্যানেল এর রমরমা।

    গুরুচন্ডালি-র পেজে একটা আলোচনা দেখলাম ফর্মুলা সংক্রান্ত। "evil consumerism" ইত্যাদি ইত্যাদি মেনে নিয়েও যেটা বলার থাকে সেটা হলো দিনের শেষে ফর্মুলা কিন্তু লাইফসেভার। ফর্মুলা না থাকলে যে কত বাচ্চা-র বয়স দিন পেরিয়ে মাসেও পড়তোনা সেটার হিসেব রাখা হয়না বলে এটা আলোচনায় আসেনা। সত্যি বলতে কি আমি গেরোয় না পড়লে আমিও জানতে পারতাম না।
    - অপরাজিতা

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অপরাজিতা। কত ভালো লাগল মন্তব্য পেয়ে সেটা আর বোঝানোর চেষ্টা করছি না। ফর্মুলার ব্যাপারটায় আমারও কিছু সংশয় আছে। তোমার পয়েন্টটা তো সত্যিই, তাছাড়াও এত কনজিউমারিজমের দাপাদাপি থাকতে ফর্মুলার ওপরেই খাঁড়া সর্বদা উদ্যত কেন সেটাও আমার মতে দুটো বাক্যে সেরে দেওয়া যায় না।

      আবারও, থ্যাংক ইউ।

      Delete

Post a Comment