লাভ ল্যাংগোয়েজ ও চেস্ট অফ ড্রয়ারস


ফেসবুকে যেমন লাইক, মধ্যবিত্ত বাঙালি আত্মীয়সম্মিলনে তেমন নতুন জামাকাপড়। অনেক বছর পর পর দেখা হওয়ার ক্যান্ডিডেটদের জমায়েতে প্রত্যাশিতভাবেই জামার পিসের প্রাধান্য। মাসছয়েক বা বছরখানেক বাদে বাদে দেখা হলে ঝুঁকি নিয়ে রেডিমেড। ফোনাফুনি যত কমছে, সামনাসামনি আড্ডা দেওয়া যত প্রাগৈতিহাসিক হচ্ছে, তত বাড়ছে ফেসবুকে একে অপরের ছবিতে লাইক আর দেখা হলে গিফট। আজকাল নেমন্তন্ন পর্যন্ত শান্তিতে খেতে যাওয়ার উপায় নেই, লোকে রিটার্ন গিফট না গছিয়ে ছাড়ছে না। কেন, ভেবে বার করেছি। বা চেষ্টা করেছি।

বিশেষজ্ঞদের মতে মানুষের লাভ ল্যাঙ্গোয়েজ অর্থাৎ ভালোবাসার পাঁচটা ভাষা।

১। প্রশংসাবাক্য।

২। কোয়ালিটি টাইম।

৩। সেবা

৪। গিফট।

৫। আদর। সমাদরটর নয়। বিশুদ্ধ গায়ে পড়া কাইন্ড। স্কিন টু স্কিন।

অফ কোর্স, পাঁচ নম্বরটা সবথেকে ট্রিকি এবং সতর্কতার দাবিদার। গ্রহীতার রিঅ্যাকশন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকলে কল্পনাতেও স্থান দেওয়া উচিত নয়।

প্রশংসাবাক্যের ঝামেলা হচ্ছে, ট্যাক্স লাগে না। কানাকে পদ্মলোচন বললাম, খোঁড়াকে উসেইন বোল্ট, অর্চিষ্মানকে লাইফ অফ পার্টি, কুন্তলাকে পরিশ্রমী। লাভের এ ল্যাংগোয়েজে ভরসা করে পাগলে।

দু'নম্বরটা আবার মারাত্মক কস্টলি। সময় দুর্মূল্য নয়, অমূল্য। খরচ করার আগে বিস্তর ভাবনাচিন্তা দরকার। দিল্লিতে বসে কাজের নামে ভ্যারেন্ডা ভাজব নাকি রিষড়া গিয়ে বাবাকে সঙ্গ দেব? বাড়িটা ঝেড়েমুছে নিয়মিত রং করাব? ছাদে লাউডগা আর জমিতে পালংশাক ফলাব? ট্রেসপাসার বেড়ালগুলোর দিকে কটমটিয়ে তাকাব? বাপরে বাপ, অনেক সময়ের ব্যাপার। তার থেকে চট করে পাঁচমিনিট ফোনে কথা বলে নেওয়া বেটার। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, ইভন বেটার।

সেবাটেবার প্রশ্নই নেই। আমার সেবা কে করে তার ঠিক নেই।

অর্থাৎ ভালোবাসা প্রকাশের জন্য চার নম্বরটাই সেফেস্ট। জিনিস কেনো আর গছাও। হ্যাঁ, টাকা লাগে। কিন্তু সবাই জানে, জীবনে টাকা জিনিসটাই আসলে সবথেকে সস্তা। বাবাকে সশরীরে দেখতে না গিয়ে অ্যামাজন থেকে করাচী বিস্কুট পাঠিয়ে দাও দেড় কিলো। বিনাপয়সার রেওয়াজে না বসে আরও স্পিডের ইন্টারনেট কিনে নাও। ইউটিউব ফ্রি থেকে প্রিমিয়ামে আপগ্রেড কর। নিজে গাওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে শুয়ে শুয়ে বাকিদের অ্যাড ফ্রি নাচাগানা স্ক্রোল করে আনন্দ ওঠাও। মাসের পর মাস যাদের ফোন করে 'কেমন আছ?' জিজ্ঞাসার কল্পনাও মনে স্থান দাওনি, দেখা হওয়ার দেড় মিনিটের মধ্যে নতুন জামার প্যাকেট হাতে ঠুসে দাও।

মুশকিল হচ্ছে যে রেটে জামা আসে সে রেটে তো জামা বেরোয় না। আর লোকে ভালোবেসে দিচ্ছে বলেই যে আমি বেশি বেশি জামাকাপড় পরে ফেলব তাও নয়। কারণ যত জামা তত মাড়, তত ইস্ত্রি, তত রং মিলিয়ে শায়া ব্লাউজ ওড়না, সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে তত বেশি বেশি লোকসমাজে মেশামিশি। কাজেই আমি ঠিক তিনটে জামা পরে জীবন কাটাই। আত্মীয়সম্মিলনেও যাই। একটা পরে যাই, তিনটে নিয়ে ফিরি। এদিকে আমার জামা রাখার জায়গা তো হাউস অফ লিভস-এর সেই বাড়িটার মতো নয়, যে ধীরে ধীরে আয়তনে বাড়তে থাকে, কাজেই সেগুলো রাখার জায়গা একসময় ফুরোয়। একজন অভিজ্ঞ লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, এত জামা কোথায় রাখেন? বললেন, কেন আলমারিতে? বললাম, আলমারি ভরে গেলে? তিনি বললেন, কেন, আরেকটা আলমারি কিনে আনি?

আমাদের আলমারি নেই। এখানকার ভাড়াবাড়িগুলোর দেওয়ালে বিল্ট-ইন আলমারি থাকে। তাতেই কাজ চালাই। বা চালাতাম। ডি ব্লকের বাড়িতে সব ঘরে আলমারি ছিল। অর্থাৎ, দুটো। আই ব্লকের বাড়িটায় ঘর বেশি কিন্তু আলমারি মোটে একটা। ভেবেছিলাম আঁটিয়ে নেব। বেসিক্যালি তো তিনটে তিনটে ছ’টা জামা। সেগুলো রাখতে একটা আলমারির দুটো তাকের বেশি লাগার কথা নয়। যেগুলো পরি না, যেমন বিয়েতে পাওয়া জরি বসানো শাড়ি আর চুমকি বসানো সালওয়ার কামিজ, দশ বছর ছুঁইনি নেক্সট দশেও চান্স নেই, খাটের নিচের গুহায় থাকবে যেমন থাকার। আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড।

কিন্তু আর পারা গেল না। আত্মীয়স্বজনদের ভালোবাসা এবং ভদ্রতায় দেওয়াল আলমারি অবশেষে ফাটোফাটো হল। একটা আপাতসহজ ব্যবস্থা ছিল। যাঁদের প্রয়োজন আছে তাঁদের ডেকে দিয়ে দেওয়া। পুরোনো দিলে পুরোনো, নতুন দিলে নতুন। মুশকিল হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতায়, সমাজসেবা দানধ্যান শক্ত কাজ। পরিশ্রমেরও। প্রথম পরিশ্রম, লোক জোগাড়। ত্রাণ সেক্টরের এন জি ও-দের সাউথ দিল্লি শাখায় শাখায় অল ক্যাপসে নোটিস, জামাকাপড় দেওয়া বন্ধ করুন। চতুর্দিকে সিসিটিভি, মাঝরাত্তিরে চুপি চুপি গাঁঠরি বেঁধে বাড়ির যাবতীয় ধুদ্ধুড়ে জামা ফেলে দিতে গেলেই ক্যাঁক। মাংকি ক্যাপও বাঁচাতে পারবে না, অটোর নাম্বারপ্লেট ছবিতে উঠে যাবে। অটোভাইসাবকে জেরা করে আমি পর্যন্ত পৌঁছতে পাঁচমিনিট। ওর মধ্যে আমি নেই। আর তো মোটে ক'টা দিন, তাদের মধ্যে আবার কয়েকটা জেলে থেকে নষ্ট করতে চাই না। এক দম্পতি ঘোরাঘুরি করতেন পাড়ায়, দেখা হলেই বলতেন পুরোনো যা আছে দিয়ে দাও। অর্চিষ্মান আজ দেব কাল দেব করে ঘোরাল, এখন তাঁরা কোথায় চলে গেছেন।

রাস্তা একটাই। নতুন আলমারি কেনা।

আলমারি বলতে আমি এ যাবত একরকম জিনিসই বুঝে এসেছি। গোদরেজের স্টিলের আলমারি। ভুষো রঙের, ঘরের কোণে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। ছোটবড় শেলফ। সবথেকে নিচেরটায় জরুরি ফাইলপত্র, মাঝের আর ওপরটায় মায়ের শাড়িব্লাউজ, বাবার পাজামাপাঞ্জাবি শার্টপ্যান্ট, আমার ফ্রক স্কার্ট। রডে ঝোলানো হ্যাঙারে বাবার ভালো জামা, মায়ের ভালো শাড়ি। আমার ভালো বাজে সবই শেলফে গোঁজা।

আলমারিটা মা বাপের বাড়ি থেকে এনেছিলেন। ঠিক পণ নয় কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে চাওয়া হয়নি। পণ তো দূর, বিয়েটাই চাওয়া হয়নি। জাত মিলছিল না। অবশ্য জাত মিললেই যে পণ চাওয়া হত নাও হতে পারে। আমার জেঠুজেঠির বিয়ে জাতগোত্র লগ্নতিথি কুষ্ঠিঠিকুজি আরও যা যা মেলানো সম্ভব সমস্ত মিলিয়ে হয়েছিল। সে বিয়েতে পণের ব্যাপার ছিল কি না জেনে দাদুঠাকুমাকে শেড দেওয়া অনুচিত। যাই হোক, বাবামা বিয়ের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। তখন সবাই 'কী আর করা যাবে, আজকালকার ছেলেমেয়ে' বলে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। গুষ্টিশুদ্ধু আত্মীয় তিনদিন আগে থেকে এসে মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমোল, বাস ভর্তি করে বরযাত্রী গেল, বিয়েবৌভাতে কবজি ডুবিয়ে খেল। খুঁতখুঁতটাও রয়ে গেল। সম্ভবতঃ সেই কারণেই (আমি শিওর ওই কারণেই) বাবামা বিয়ের পরের আট মাস হিন্দমোটরের একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। ওই আটমাস কাকাপিসিরা দেখ না দেখ ব্যাগ গুছিয়ে, 'যাই বউদির বাড়ি দুদিন থেকে আসি' বলে রিষড়া থেকে হিন্দমোটরে চলে আসত। মা অফিস থেকে ফিরে দেখতেন ননদদেওরেরা, যে যখন থাকত, হয় মশারি কেচে রেখেছে, নয়তো উনুন ধরানোর জন্য সমস্ত কয়লা ভেঙে রেখেছে, নয়তো সারা বাড়ির ঝুল ঝেড়ে রেখেছে। বৌদির যাতে কাজ কমে। আমার ঠাকুমাদাদু অনেক কিছু ছিলেন, বোকা ছিলেন না। আটমাস পর দাদু একদিন হিন্দমোটরে গিয়ে বললেন, বাড়ি চল। মাবাবা 'বাঁচা গেছে' বলে দৌড়ে রিষড়া চলে এলেন।

পণ চাওয়া না হলেও, বিয়েতে মা খাটবিছানা জাজিমতোশক আলমারি নিয়েই এসেছিলেন। দিদিমা ততদিনে গত হয়েছিলেন, বোনের বিয়ের দায়িত্ব ছিল দাদাদের হাতে। মা মরা বোনকে যে তাঁরা একবস্ত্রে বার করে দেননি সেটা প্রমাণের দায় তাঁদের ছিল নিশ্চয়, কাজেই তাঁরা এ সব স্ট্যান্ডার্ড আইটেম সহযোগেই বোনকে বিদায় করেছিলেন। সেই গোদরেজ আলমারি, সেই সাতাত্তর সাল থেকে আমাদের বাড়িতে এখনও বিরাজ করছে। যাঁর আলমারি তিনি চলে গেছেন। বাবাকে তো বটেই, যা রকমসকম ও আলমারি আমাকেও,  'টাটা বাইবাই, আবার যেন দেখা না পাই' বলবে।

তবু কেনার সময় ও রকম আলমারি কেনার কথা মাথায় এল না। এক, জায়গার অভাব। জামা রাখার জায়গা নেই, আলমারি রাখার জায়গা কোত্থেকে পাব? তাও অত লম্বা? প্রতি দেওয়ালে হয় সুইচবোর্ড, নয় টিভি, নয় ছবি। ব্রেনকে খুব খাটিয়ে অবশেষে টিভির নিচে একটা ফাঁক বেরোল। মানে বার করতে হল। একটা টেবিলমতো পাতা ছিল সেটাকে কোণায় গুঁজতে হল। সোজা গোঁজা গেল না, কাত করে গুঁজতে হল। এই সব করে যে জায়গাটা বেরোল তাতে লম্বা আলমারি আঁটবে না। বেঁটে আলমারি কিনতে হবে। যেগুলোকে চেস্ট অফ ড্রয়ারস বলে।

দ্বিতীয় কারণ, কেন যেন মনে হল ওই ধরণের গাবদা স্টিলের আলমারির পক্ষে আমরা 'টু কুল'। আমাদের বাড়িতে ধাতব ফার্নিচার নেই। গোটা দুই কাঠের (যেগুলো মা বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন) বাকি সব এঞ্জিনিয়ারড উড। চারপাঁচ বছর কাটতে না কাটতেই প্রত্যাশিতভাবেই শরীরে জরা প্রকট হতে শুরু করেছে। তবু আমাদের বুদ্ধি পাকেনি। কার্যকারিতা চুলোয় দিয়ে কোহেসিভ লুকের পেছনে পড়ে আছি।

চেস্ট অফ ড্রয়ারস নিয়ে রিসার্চ করে কয়েক সপ্তাহ নষ্ট করলাম। শর্টলিস্ট করে অর্চিষ্মানকে পাঠালাম। একটা পছন্দ হল। অর্ডার করলাম। অনলাইন। পাঁউরুটি পর্যন্ত অনলাইন কিনি, আলমারি কিনতেই বা কী। ইউটিউবে একটা রিলে কমেডিয়ান বলছিলেন, এক গ্লাস পানি ভি জোম্যাটো সে মাংগাতা হুঁ। আমাদের অবস্থাও প্রায় সে রকমই। জল পর্যন্ত নামিনি, কফি রেগুলারলি আনিয়ে খাই। সপ্তাহে অন্ততঃ দুবার। চায় পয়েন্ট বলে একটা দোকান আছে কালকাজীতে, কখনওই বন্ধ থাকে না। অথচ দোকানের বর্ণনায় কোথাও ২৪*৭ লেখা নেই। সে রকম ২৪*৭ একটা মোমোর দোকান আছে। রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে অথচ একটাও চোঁয়াঢেঁকুর ওঠেনি এমন হলে সেই দোকান থেকে আমরা কুড়কুড়ে ফ্রায়েড মোমো আনাই। চায় পয়েন্ট-এ সে রকম কোথাও লেখা নেই, অথচ রাত সাড়ে এগারোটাতে অর্ডার করে কফি পেয়েছি, ভোর পাঁচটা দশেও। একদিন অ্যালার্ম দিয়ে আড়াইটের সময় উঠে অর্ডার করে দেখতে হবে।

চেস্টের ডেলিভারির মুহূর্ত থেকে গোলমাল শুরু হল। খবর না দিয়ে ভাইসাবেরা হাজির হলেন, আমি আর অর্চিষ্মান তখন থার্ড ওয়েভ-এ বসে কাজের নামে ইউটিউব দেখছি। ভাগ্যিস পাশের পাড়াতেই। আলতো অফার করেছিলাম, আমি যাব? তুমি না হয় আরাম কর। চোখ ঘুরিয়ে অর্চিষ্মান বাড়ি গেল ডেলিভারি নিতে। ভাইসাব নাকি টেম্পোর মাথা থেকে দমাস করে প্যাকেট রাস্তায় ফেলেছিলেন। অ্যাসেম্বল করতে মনোজজী এলেন। প্যাকেট খুলে কপাল চাপড়ালেন। একটা শেলফের কোণার চলটা উঠে গেছে। অর্চিষ্মান দাবি করল দমাস শুনেই নাকি ও বুঝেছিল এ রকম কিছু একটা ঘটবে। চলটার ছবি তুলে আফটারগ্লো ফিল্টার অ্যাপ্লাই করে ভেন্ডারের সাইটে আপলোড করলাম। বিনা বাক্যব্যয়ে নতুন শেলফ চলে এল। মনোজজী আবার এলেন। কাজে লাগলেন। আড়াই মিনিটের মধ্যে সি আর পার্ক কাঁপানো হাহাকার। 'কেয়া হুয়া কেয়া হুয়া' বলতে বলতে দৌড়ে গিয়ে দেখি মুখমণ্ডলে আতংক বিষাদ মাখামাখি। কথা বলার অবস্থা নেই, অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন। আরও একটা শেলফ, অরিজিন্যাল প্যাকেজের, ভেঙে প্রায় দু'খানা। আগের শেলফের চলটা আবিষ্কার করে আমরা এত মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম যে বাকিগুলো চেক করিনি। আবার ছবি, আবার আফটারগ্লো, আবার আপলোড। ভারতবর্ষের কাস্টমার সার্ভিস একটা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, নতুন তাক চলে এল, নো কোয়েশ্চনস আস্কড।

এই যে মনোজজী আসছিলেন যাচ্ছিলেন, একেবারে ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছিল না। জুতোর বাক্সের চারটের মধ্যে দুটো তাক ভেঙে পড়েছিল, সারিয়ে দিলেন। বুককেসের একটা তাকে বোকার মতো একইসঙ্গে পরশুরাম, ত্রৈলোক্যনাথ, সন্দীপন উপন্যাস ১ ও ২, লীলা মজুমদার ১ ২ ও ৩ সমগ্র রেখেছিলাম, সে তাক ধনুকের মতো বেঁকে নিচের তাকের বইয়ের মাথা ছুঁয়ে ফেলেছিল। ঠিক করে দিলেন।

মা যে কাঠের বুককেসটা বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন সেটাতে বিশ্বের সমস্ত সমগ্র চাপালেও টসকাবে না। তবু কাঠের জিনিসের দাম দেখে এমন ছ্যাঁত করে ওঠে যে ফার্নিচারের নামে এই সব এঞ্জিনিয়ারড উডের ধ্যাষটামো কিনে আনি। মাশুলও গুনি।

শিক্ষা জিনিসটা আর যারই হোক, আমার হওয়ার নয়। এই যে চেস্টটা কিনলাম, মারাত্মক স্লিক। এক চামচ চর্বিও নেই। অর্থাৎ হ্যান্ডেলও না। প্রত্যেকবার টানার সময় দুই হাত সাতচল্লিশ ইঞ্চি ছড়িয়ে ড্রয়ারের দুই প্রান্ত ধরে টানতে হবে। শক্তপোক্তের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তিনটে শেলফে তিনশো তিনশো করে করে ন'শো গ্রাম জামা রাখলাম, ওইরকম দুই হাত ছড়িয়ে টানতে গিয়ে ড্রয়ার একদিকে কাত হয়ে পড়ল।

প্রথমবার ফেল করাতেই আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম এ জিনিস টিকবে না, বিদায় কর। ভুল হয়ে গেছে কান মুলে হার স্বীকার কর। পয়সা নষ্ট হয়েছে বলে আরও পয়সা ঢেলো না। অর্চিষ্মান বলল, সারানো যায় কি না দেখি একবার।

মনোজজী এলেন। বললেন, আমি বেটার স্ক্রু এঁটে দিয়ে যাচ্ছি। দেখবেন সারা পাড়ার জামা রাখলেও টসকাবে না।

মনোজজী গেলেন, সাবিত্রী পর্যন্তও পৌঁছননি, আমি ড্রয়ারে সব জামাকাপড় তুলে পরীক্ষা পার্পাসে টানতেই বেটার স্ক্রু মটকে গেল। জামাকাপড়শুদ্ধু গোটা ড্রয়ার আমার সাতচল্লিশ ইঞ্চি ছড়ানো দুই হাতের মধ্যে। ধীরে হলেও মাধ্যাকর্ষণ ডেফিনিটলি জিতছে। যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে প্রতিক্রিয়াটা আমার প্রথম জাগে, পরিস্থিতিটার কারণটাকে আছড়ে ভাঙার, সেটা চরিতার্থ করতে গেলে আমার দু'পায়ের পাতাই চূর্ণ হবে। ডিপ ব্রিদিং করতে করতে কোনওমতে উল্টোদিকে ঘুরে গোটা জিনিসটা খাটে নামিয়ে রাখলাম।

শরীরমগজের মধ্য দিয়ে রাগের সুনামি বইতে লাগল। রাগটা অর্চিষ্মানের কিংবা মনোজজীর ওপর নয়, অন গড ফাদার মাদার। নিজের ওপর। যোগ না শিখে দুয়ে দুয়ে পাঁচ আশা করলে একরকম সান্ত্বনা থাকে। ক্যালকুলাস পেরিয়ে এসে দুয়ে দুয়ে যোগ করে বাইশের জন্য বসে থাকলে?

নিজের ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা যায় না। আত্মসংরক্ষণের খাতিরে অন্য কারও ওপর ট্রান্সফার করতে হয়। জামাকাপড়গুলো বিছানার ওপর লাইন দিয়ে সাজালাম যাতে অর্চিষ্মান টের পায় চেস্টটা ফেলে দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমি ঠিক ছিলাম, ও ভুল। ঘরে ঢুকে অর্চিষ্মান বলল, ওরে বাবা, এ সব কী হয়েছে? উদাস গলায় বললাম, যা হওয়ার ছিল।

মনোজজী এলেন। আমি বললাম, আরেকবার চেষ্টা করে দেখুন। একেবারে নতুন কেনা, ফেলে দিতে গায়ে লাগছে। অর্চিষ্মান বলল, এটাই লাস্ট অ্যাটেম্পট, এবার না সারলে টান মেরে ফেলে দেব।

মনোজজী বললেন, তওবা তওবা, ফেলবেন কেন? ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্রেংথের চ্যানেল বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি, ফেলতে হবে না। আমরা বললাম, এত নির্মেদ বডিও চাই না, হ্যান্ডেল বসিয়ে দিন। মনোজজী বললেন, এটা ভালো আইডিয়া। তিনটে ড্রয়ারের মাঝখানে একটা করে হ্যান্ডেল বসিয়ে দিচ্ছি। লুকস্‌ ভি জ্যাদা খারাব নেহি হোগা।

সমস্বরে আর্তনাদ করলাম। লুকস্‌ যিতনা খারাব হো সকে উতনা হি খারাব চাহিয়ে। তিনটে ড্রয়ারের মাঝখানে একটার বদলে দুই হাত ভদ্রভাবে ছড়ানোর দূরত্বে দুটো করে ছ'ছটা হ্যান্ডেল পোঁতা হল।

দুটো শিক্ষা হয়েছে। অ্যাট লিস্ট, হওয়া উচিত। এর পর থেকে ফার্নিচার কিনলে স্ট্রিকটলি বিশুদ্ধ কাঠের কিনব (কিংবা স্টিলের) অ্যাফর্ড করতে না পারলে কিনব না। জামাকাপড় জুতো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। নো মোর এঞ্জিনিয়ারড উড ননসেন্স।

দ্বিতীয় শিক্ষা ফার্নিচারের রকমসংক্রান্ত। সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে সব ফার্নিচার ব্যবহার হয় সে ছাড়া আর কোনও রকম কিনব না। জামাকাপড় রাখতে হলে কাবার্ড, ওয়ার্ডরোব, চেস্ট অফ ড্রয়ারসের ধ্যাষ্টামোর বদলে পরিষ্কার গোদরেজের আলমারিতে রাখব। রোজের ব্যবহারের জামাকাপড়ের জন্য আলনা থাকবে। খোলা। উন্মুক্ত, ফুরফুরে আলনা। সামনের রডগুলোতে শার্ট প্যান্ট কামিজ সালওয়ার বুক ফুলিয়ে হাওয়া খাবে। পেছনের রডগুলোতে অল্প লজ্জা পেয়ে মোজা রুমাল অন্তর্বাস।

আসল শিক্ষাটা অবশ্য অন্য। স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার সুপারফিশিয়াল প্রগতি বাদ দিলে ঠাকুমাদাদুদের সঙ্গে আমাদের জীবনের কিস্যু তফাৎ নেই। বাবামাদের সঙ্গে তো নেইই। বাড়ির স্টোরেজ সমস্যার যে সমাধান তাঁদের কাজে দিয়েছিল সেটা আমাদেরও দেবে। নতুন করে চাকা আবিষ্কারে নামার কোনও দরকার নেই।

মনোজজীকে আর স্মরণ করতে হয়নি। হ্যান্ডল ধরে কমফর্টেবলি টানাটানি ঠেলাঠেলি করা যাচ্ছে। তিনটে তাকই ভরে উঠেছে। আমাদের জামাগুলো একটু হাতপা ছড়িয়ে আরাম করে শুতে পেরেছে। অর্চিষ্মান এবেলা ওবেলা মনে করাচ্ছে ওর অপার ধৈর্য আর হাল না ছাড়া ইত্যাদি ভালো ভালো গুণের জন্যই এ মির‍্যাকল সম্ভব হচ্ছে। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দিচ্ছি।

পুজোও এসে গেছে। খবর পাচ্ছি সবাই শপিং করতে বেরোচ্ছে্। বুক ধুকপুক করছে। লাভ ল্যাংগোয়েজে ছিপি তো দিতে পারব না। দেওয়ার দরকারও নেই। লাভ জিনিসটা এখনও দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। তাছাড়া কীই বা হবে? ক'মাস বাদে আরেকটা আলমারি কিনতে হবে। কিনব। এবার স্ট্রিক্টলি গোদরেজ। স্থানসংকুলান নিয়ে একটা গোলমাল বাধতে পারে, তারও সমাধান আছে। একটা বড় বাড়িতে শিফট করে গেলেই হবে।

Comments

  1. চেস্ট অফ ড্রয়ার্স বস্তুটা আমার আলমারির থেকে বেশি পছন্দ হয়েছে, জিনিসপত্র খুঁজে পেতে সুবিধা হয়। শুধু জায়গা একটু কম।

    লাভ ল্যাঙ্গুয়েজ গিফট হলে তো লাভই।
    তবে জামা কাপড়টা রিসিভারের জন্য একটু মুশকিল হলেও গিভারের জন্য খাটনি কম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. লাভ তো বটেই, বৈজয়ন্তী। ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী?

      চেস্ট আমার একেবারে ভালো লাগেনি। হয়তো এই খারাপ অভিজ্ঞতার জন্যই। এই প্রথম, এই শেষ।

      Delete
  2. আমাদের বাড়িতে রাজ এন্ড রাজের আলমারি ছিল, বাবা মায়ের বিয়ের সময় দাদুর দেওয়া। সেটার রঙ যে কি বাজে ছিল.. না সিলভার, না গোল্ডেন, না গ্রে, না বেইজ। কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, আর বিরক্তিকর লাগতো। পছন্দ করে কেউ এরম বিচ্ছিরি জিনিস কেনে? মাকে অসম্ভব ভয় পেতাম বলে কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি। দাদুর পছন্দকে খারাপ বলছি, এরম কিছু মনে হলে তারপর কপালে দুঃখ হতে পারতো।

    নিজের বিয়ের সময় ইঞ্জিনিয়ার্ড উড শুরুতেই টেঁকসই হবেনা বলে বাদ গেলো, মলের ফার্নিচার ব্রান্ডের দোকানের সেলসম্যান, স্পষ্ট না বললেও আকার ইঙ্গিতে বলে দিলেন।
    সলিড উড ক্ষমতার বাইরে।
    সেই রাজ এন্ড রাজের শোরুমে ট্রাই করলাম, ঢাকুরিয়া ব্রিজের কাছে ।
    প্রথমেই দোকানের সাজ সজ্জা আর হাবভাব দেখে ভক্তি হয়ে গেলো। যাঁরা কথা বললেন, আলমারি দেখালেন, তাঁদেরকেও পছন্দ হলো.. মানুষগুলো, এবং দোকানটা সবটাই ভদ্র, পরিচ্ছন্ন কিন্তু কোনো চটক নেই, একটা সরকারি অফিস সুলভ ব্যাপার আছে। কাকু কাকু দেখতে একজন ভদ্রলোক অর্ডার নিলেন, শক্ত কাগজের চারদিক মোড়া ফাইলে অর্ডার রেকর্ড ঢুকিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধলেন।
    আমি পছন্দ করেছিলাম ক্যাটালগ দেখে গোলাপি আর ল্যাভেন্ডারের মাঝামাঝি একটা রং, যেটা সামনের দরজা গুলোতে ওঁরা করে দেবেন, আর বাকি পাঁচ দিকে অফ হোয়াইট। আলমারি ডিরেক্ট আমার শ্বশুরবাড়িতে ডেলিভারি হয়েছিল। বিয়ের পর দেখলাম বেশ ভালো রং, দিব্যি মানিয়ে গেছে।

    কাট টু বর্তমান, দশ বছর কেটে গেছে। ওই রঙ, কিভাবে জানিনা, উবে গিয়ে টিয়ে আলমারিটার এখনকার রঙ... না সিলভার, না গোল্ডেন, না গ্রে, না বেইজ। মনে পড়লো, রাজ এন্ড রাজের ভদ্রলোক বলেছিলেন, আলমারি আবার ওঁরা রি-পেইন্ট করিয়ে দেন.. ভাবছি আরেকবার ঢাকুরিয়া হানা দিতে হবে..
    --অনামিকা

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাদের আলমারির মতো আলমারিই কেনা উচিত ছিল আমাদের, অনামিকা। সরকারি-কাটিং। সরকারি-লুকিং দোকান থেকে। এই সব কায়দাবাজি আমার সয় না জেনেও কেন যে বার বার অ্যাটেম্পট নিই।

      আলমারিটা রং করিয়ে নিন। আরও দশ বছর হেসে খেলে টেনে দেবে।

      আপনার মন্তব্যটা ছোটগল্পের মুন্সিয়ানায় লেখা। খুব ভালো লাগল।

      Delete
  3. দারুন লিখেছেন এক্সপেরিয়েন্সটা।

    আমার ঘরে একটা ঢাউশ "বম্বে সেফ"-এর স্টিলের আলমারি আছে, যেটার দিকে তাকালে আমার মাঝে মাঝে টেনশন হয় এই ভেবে, যে যদি কোনোদিন ওটা বাতিল করতে হয়, কিভাবে করা হবে, কটা লোক ডাকতে হবে, ওটাকে বের করার জন্যে ওটার পথ খালি করতে কোন অন্য ফার্নিচার আগে সরাতে হবে, ইত্যাদি। ওটা আবার সাধারণ গোদরেজের স্টিলের আলমারির থেকেও বেশি ভারী আর শক্তপোক্ত (গোদরেজের আরেকটা আলমারি আছে আরেকটা ঘরে)। এর থেকে আরেকটা বাড়িতে নিজেকে শিফট করা সহজ। রাজবাড়ীতে থাকার আলমারি ফ্লাট বাড়িতে ঢুকলে এই হয়। আর কোন লজিকেই বা ডিসপোস করা যাবে - কারণ আমার জীবদ্বশায় তো এই আলমারির কিস্সু হবে না - যেমন ছিল তেমন অটুট থাকবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বম্বে সেফ-এর নাম শুনিনি আমি আগে, তবে সেটা বম্বে সেফ-এর দোষ নয়। আমি এই সেদিন পর্যন্তও জানতাম ওম পুরী, অমরীশ পুরীর ভাই।

      আলমারির দিকে তাকিয়ে আপনার মনে জাগা ভাবনাগুলো পড়ে হাসিও পেল আর এ সন্দেহও হল যে আপনি খুবই গোছানো এবং প্ল্যানপ্রোগ্রাম করা মানুষ। ভেরি গুড। আমি যদি আপনার মতো হতাম।

      Delete
    2. প্ল্যানপ্রোগ্রাম করতে তো খারাপ লাগে না, তা সে প্ল্যান এক্সিকিউট হোক বা না হোক। তবে গোছানো কিনা সে বেপারটা কংফিউসিং। আমার ঘরের মতো অগোছালো ঘর কমে দেখা যায়, এটা সবাই মানে। আবার ধরুন হোটেলে আছি কিছুদিন, তখন সেখানে ভালো করে গুছিয়ে রাখি।

      Delete

Post a Comment